Skip to content

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

ধান ক্ষেতে নির্দিষ্ট সময় ধরে বর্ষার পানি জমে থাকে যা মাছ চাষের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ।

ধান ক্ষেতে ব্যবহৃত সার, গোবর ইত্যাদি পানি ও মাটির সাথে মিশে প্রাকৃতিকভাবে খাবার তৈরি করে যা মাছ চাষ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধান ক্ষেতে মাছ চাষের প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন চাষি ধান উৎপাদনের সাথে সাথে বাড়তি আয়ও করতে পারে।

আমন ও বোরো দুই মৌসুমেই ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা সম্ভব। তবে আমন মৌসুমে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ বেশি লাভজনক।

সেচ সুবিধার আওতাধীন যে সমস্ত ধানি জমি রয়েছে সে সকল জমিতে স্বল্প ব্যয়ে এবং অল্প পরিশ্রমে ধানের পাশাপাশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। ধান ক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শুধু বাড়তি অর্থই জোগান দেয় না সেই সাথে তাদের পুষ্টিও নিশ্চিত করে।

(১) ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সুবিধা

চিত্র- ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

ধান ক্ষেতে মাছ চাষের বেশি কিছু সুবিধা রয়েছে, যেমন-

  • একই জমি থেকে ধানের সাথে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে মাছ পাওয়া যায়। সুতরাং জমির সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব।
  • ধান ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে এবং অনিষ্টকারী পোকা-মাকড় মাছ খেয়ে ফেলে। ফলে ধান ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
  • মাছের চলাফেরার মাধ্যমে ক্ষেতের কাদামাটি উলটপালট হয়। ফলে জমি হতে ধানের পক্ষে অধিকতর পুষ্টি গ্রহণযোগ্য হয়।
  • মাছের বিষ্টা সার হিসাবে ধান ক্ষেতের উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে।

(২) ধান ক্ষেতে চাষ পদ্ধতি

সাধারণ দুই পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা যায়-

ক) ধানের সাথে মাছের চাষ

  • একই জমিতে ধান ও মাছ একত্রে চাষ করা হয়।
  • আমন মৌসুমে মাঝারি উঁচু জমিতে যেখানে ৪-৬ মাস বৃষ্টির পানি জমে থাকে সেখানে ধানের সাথে মাছ চাষ করা যায়।
  • বোরো মৌসুমে সেচ সুবিধার আওতাধীন জমিতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।

খ) ধানের পরে মাছের চাষ

বাংলাদেশের যে সমস্ত জমি বর্ষাকালে প্লাবিত হয় এবং রোপা আমন চাষ করা হয় না সেখানে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়।

(৩) মাছ চাষের জন্য জমি নির্বাচন

সব ধান ক্ষেত মাছ চাষের জন্য উপযোগী নয়। ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সফলতা নির্ভর করে জমি নির্বাচনের উপর। জমি নির্বাচনের সময় নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। 

জমি নির্বাচনের সময় বিবেচনাধীন বিষয়সমূহ-

  • সাধারণত দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ এবং এঁটেল মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা এবং উর্বরাশক্তি বেশি বিধায় এসব মাটির জমি ধান ক্ষেতে মাছ চাষের জন্য উপযোগী।
  • অতি উঁচু অর্থাৎ পানি ধরে রাখতে পারে না এবং অধিক নিচু জমি অর্থাৎ সহজেই প্লাবিত হয় সে সব জমি মাছ চাষের অনুপযোগী।
  • বন্যার পানি প্রবেশ করে না এরূপ উঁচু জমিই মাছ চাষের উপযোগী।
  • বোরো মৌসুমে চাষের ক্ষেত্রে সেচের সুবন্দোবস্ত থাকতে হবে।

(৪) ধান ক্ষেত প্রস্তুতকরণ

ধান ক্ষেতকে মাছ চাষের উপযোগী করতে হলে-

  • যথাযথভাবে চাষ ও মই দিয়ে ধান চাষের প্রচলিত নিয়মে জমি প্রস্তুত করতে হবে।
  • ক্ষেতের চারপাশের আইল কমপক্ষে ১ ফুট উঁচু ও ১ ফুট চওড়া করে তৈরি করতে হবে। তবে আইলের উচ্চতা নির্ভর করবে জমির অবস্থানের উপর।
  • জমির যে অংশ অপেক্ষাকৃত ঢালু সে অংশে জমির শতকরা ২-৫ ভাগ এলাকা জুড়ে কমপক্ষে ২-৩ ফুট গভীর একটি ডোবা বা মিনি পুকুর খনন করতে হবে, যা ক্ষেতের কোনায়, পাশে বা মধ্যে হতে পারে।
  • শুষ্ক বা খরা মৌসুমে অথবা অন্য কোনো কারণে জমির পানি শুকিয়ে গেলে উক্ত গর্ত মাছের জন্য সাময়িক আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
  • জমি তৈরির জন্য প্রচলিত নিয়মেই জমিতে সার, গোবর ইত্যাদি প্রয়োগ করে ধান রোপণ করতে হবে।

(৫) ধানের জাত নির্বাচন

ধানের জাত নির্বাচনে যেসব বিষয় লক্ষ রাখতে হবে-

  • সমন্বিত ধান-মাছ চাষের ক্ষেত্রে যে জাতের ধান বেশি পানি সহ্য করার ক্ষমতা রাখে এবং ফলনও বেশি সেই জাত নির্বাচন করতে হবে।
  • আমন মৌসুমের জন্য বিআর-৩ (বিপ্লব), বিআর-১১ (মুক্তা), বিআর-১৪ (গাজী) এবং বোরো মৌসুমের জন্য বিআর-১৪, বিআর-১৬, বিআর ২৮ ও ২৯ ইত্যাদি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উপযোগী।
  • ধানের সাথে মাছ চাষের জন্য ধানের চারা অবশ্যই সারিবদ্ধভাবে রোপণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সে.মি. এবং গোছা থেকে গোছার দূরত্ব ১৫-২০ সে.মি. রাখাতে হবে।
  • যদি কোনো সময় বাইরে থেকে পানি সরবরাহের প্রয়োজন হয়, তখন পুকুর বা ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করতে হবে।
  • ইঁদুর, কাঁকড়া ও অন্যান্য প্রাণী যাতে আইলে গর্ত না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি জমে ক্ষেত প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে অপেক্ষাকৃত ঢালু অংশে আইলের কিছু জায়গা ভেঙে বাঁশের বানা বা ছাঁকনিযুক্ত পাইপ দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে।
  • ধান ক্ষেতে প্রাকৃতিভাবে উৎপাদিত খাবারই মাছের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। তবে প্রাকৃতিক খাবারের অপর্যাপ্ততা পরিলক্ষিত হলে প্রয়োজনবোধে মাছের খাবার হিসেবে ক্ষুদিপানা বা চালের কুঁড়া সরবরাহ করা যেতে পারে।
  • প্রচলিত নিয়মে জৈব বা অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) পদ্ধতিতে পোকা-মাকড় দমন করা যেতে পারে।
  • ধান ক্ষেতের মাছকে ডোবা বা নালায় স্থানান্তরের পর প্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  • কীটনাশক ব্যবহারের পর বৃষ্টি হলে ৫-৭ দিন পর মাছগুলোকে ক্ষেতে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। আর যদি বৃষ্টি না হয় সে ক্ষেত্রে ৫-৭ দিন পর সেচের মাধ্যমে পুনরায় মাছকে সমস্ত জমিতে চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে।
  • কীটনাশক ব্যবহারের উপযুক্ত সময় হলো বিকেল বেলা, কারণ এ সময় ধানের পাতা শুদ্ধ থাকে।
  • পাশের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানো হলে লক্ষ রাখতে হবে যেন কীটনাশক মিশ্রিত পানি কোনোক্রমেই মাছের ক্ষেতে প্রবেশ না করে।
  • ধান রক্ষার জন্য জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হলে মাছকে আইলের সাহায্যে গর্তে আটকে রাখতে হবে।
  • অতিরিক্ত গরম বা খরার সময় ক্ষেতে গর্ভের পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য গর্তের কিছু অংশে কচুরিপানা রাখতে হবে।
  • ক্ষেতের পানির প্রয়োজনের তুলনায় কমে গেলে দ্রুত সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

(৬) ধান ক্ষেতে মাছ আহরণ

ধান পাকার পর ক্ষেতের পানি কমিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা নিতে হবে, এ সময় মাছ আস্তে আস্তে ডোবায় চলে যাবে এবং মাছ ধরতে হবে।

ধান ক্ষেতে সমন্বিত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে ৩-৪ মাসে হেক্টরপ্রতি ৩২৫-৩৫০ কেজি মাছ এবং ৩০-৩.৫ টন ধানের ফলন পাওয়া যায়।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, ধানের সাথে মাছ চাষ করলে ধানের ফলন গড়ে প্রায় শতকরা ১২-১৫ ভাগ বেশি হয়। এতে চাষিরা অধিক মুনাফা অর্জন করে থাকে।

(৬) পরামর্শ

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করতে হলে কিছু বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন-

  • ধান ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে।
  • অতিবৃষ্টিতে যেন ধান ক্ষেত প্লাবিত না হয় অথবা খরায় ধান ক্ষেত শুকিয়ে না যায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • চাষিকে দৈনিক সকাল ও বিকাল ধান ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts