নিম্নে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি গবাদিপশুর রোগ ও চিকিৎসা, রোগের লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায় সমূহ বর্ণনা করা হলো-
ক) ক্ষুরারোগ
ক্ষুরারোগ বিভক্ত ক্ষুরবিশিষ্ট পশুর তীব্র ছোঁয়াচে ভাইরাস রোগ। জ্বর, মুখ ও পায়ে ফোসকা এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে প্রতিবছর ক্ষুরারোগের কারণে বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতি হয়।
লক্ষণ:
- প্রথমে জ্বর হয় এবং মুখ, পা ও বাঁটে রসভরা ফোসকার সৃষ্টি করে।
- খাদ্য গ্রহণের ফলে মুখের ভিতরে ও জিহ্বার ফোসকা ছিঁড়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়।
- প্রদাহের ফলে মুখ থেকে প্রচুর লালা ঝরে, দুই পায়ের ক্ষুরের মাঝে ক্ষত সৃষ্টি হয়।
চিকিৎসা: মৃদু জীবাণুনাশক পদার্থ দ্বারা মুখ ও পায়ের ক্ষত পরিষ্কার করতে হবে। ক্ষুরারোগের জীবাণুর জটিলতা রোধে অ্যান্টিবায়োটিক অথবা সালফোনামাইড ইনজেকশন দিলে সুফল পাওয়া যায়। আক্রান্ত পশুকে শুকনো ও পরিষ্কার স্থানে রাখতে হবে এবং নরম খাবার দিতে হবে।
প্রতিরোধ:
- খামারের মানসম্মত জীবনিরাপত্তা ও প্রতি ৬ মাস পর পর এ রোগের টিকা প্রদান করতে হবে।
- রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করতে হবে।
- মৃত পশুকে গভীর গর্ত করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
খ) পিপিআর রোগ
রোগটি আমাদের দেশে ছাগলে মাঝে মাঝে মহামারী আকারে দেখা দেয়। পিপিআর ভাইরাস দ্বারা এ রোগটি হয়।
লক্ষণ:
- ঝিম ধরে পিঠ বাঁকা করে দাঁড়িয়ে থাকে পরবর্তী পর্যায়ে নাক, মুখ ও চোখ নিয়ে তরুণ নিঃসৃত হয়।
- শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় (১০৬-১০৭ ফাঃ), পাতলা পারখানা শুরু হয়।
- মলের রং গাঢ় বাদামি, মাঝে মধ্যে রক্তমিশ্রিত আম থাকতে পারে।
- আক্রান্ত ছাগলের ব্যাপকভাবে নিউমোনিয়া দেখা দেয়, নাকের হয়ে যেতে পারে ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে ৭১ দিনের মাথায় আক্রান্ত মারা যেতে পারে।
চিকিৎসা: এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই, তবে লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসা করালে মৃত্যুর হার কমানো যায়। পানিশূন্যতা রোগের জন্য ছাগলকে মুখে বা শিয়ায় পর্যাপ্ত স্যালাইন দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রতিরোধ:
- রোগ দেখা দেওয়ার আগেই সুস্থ ছাগলকে পিপিআর টিকা নিতে হবে। একবার টিকা প্রয়োগ করলে সাধারণত এক বছরের অধিক সময় প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে। টিকাকৃত স্থানীয় বাচ্চার তিন মাস পর্যন্ত পিপিআর রোগের অ্যান্টিবডি থাকে।
- এ রোগে আক্রান্ত মৃত ছাগলকে পুড়িয়ে অথবা নিরাপদ দূরত্বে পুঁতে ফেলতে হবে।
গ) তড়কা রোগ বা অ্যানথ্রাক্স
তড়কা ব্যাকটেরিয়া সৃষ্ট পশুর একটি মারাত্মক রোগ। রোগটি পশু থেকে মানুষে ছড়াতে পারে।
লক্ষণ: অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশের আগে যারা যায়, কখনো কখনো ১-২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়, জ্বর (১০৪-১০৭ ফা), ক্ষুধামান্দ্য নিক্ষেলতা, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, পেট ফাঁপা, গর্ভপাত, দেহের কাঁপুনি, রুমেনের গতি কমে যায়, নাক, মুখ, প্রগ্রাম ও মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে দেখা যায় ও শরীরের ভিতরে বিভিন্ন অঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়।
চিকিৎসা:
- তড়কা রোগের চিকিৎনার অ্যান্টিসিরাম ও অ্যান্টিবায়োটিক ভালো কাজ করে। অ্যান্টিসিরাম পাওয়া গেলে ১০০-২৫০ মিলি হিসেবে প্রতিটি আক্রান্ত গরুতে প্রত্যহ শিরায় ইনজেকশন দিতে হবে। তবে একই সময়ে অ্যান্টিসিরাম ও অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন অধিক কার্যকর।
- পেনিসিলিনজাতীয় ওষুধ প্রতি কেজি দৈহিক প্রজানের জন্য ১০,০০০ ইউনিট করে মাংসপেশিতে দিনে দুইবার করে ৫ দিন ইনজেকশন দিতে হয়।
প্রতিরোধ:
- মড়কের সময় পশুর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- শুষ্ক ও পরিছন্ন অবস্থায় পালন করতে হবে।
- রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে পৃথক রেখে চিকিৎসা ও সুস্থ পশুকে টিকা প্রদান করতে হবে।
- এ রোগ প্রতিরোধে ১ মিলি চামড়ার নিচে ইনজেকশন দিতে হবে এবং প্রতি একবার করে প্রয়োগ করতে হবে।
ঘ) বাদলা রোগ
এ রোগে পা আক্রান্ত হয় তাই একে ব্ল্যাক লেগ বলে। এ রোগ প্রধানত বাড়ন্ত বয়সের পশুর একটি তীব্র সংক্রামক রোগ।
লক্ষণ:
- অতি তীব্র প্রকৃতির রোগে আক্রান্ত পথ হঠাৎ মারা যায়। মৃত্যু আকস্মিক না হলে ক্ষুধামান্দ্য, জ্বর (১০৪-১০৭ ফাঃ), পেটে গ্যাস, নাকে শ্লেষ্মা, অবসানতাৰ প্রকাশ পায়। উপসর্গ প্রকাশের ১২-৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পঞ্চ মাত্রা যায়।
- পায়ের মাংসপেশি আক্রান্ত হয়, ফলে পশু হাঁটতে পারে না এবং স্টুড়িয়ে হাটে। আক্রান্ত মাংসপেশি কিছু ফোলা থাকে এবং টিপলে পচপচ শব্দ হয়।
চিকিৎসা: অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়।
প্রতিরোধ: বাদলা রোগের টিকা দিয়ে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
ঙ) ওলান পাকা রোগ
গাভীর ওলানের কোষ-কলার রোগজীবাণু বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক দ্বারা প্রদাহের সৃষ্টি হলে তাকে ওলান পাকা রোগ বলে। এ রোগ বিশেষ করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অস্বাস্থ্যকর উপায়ে ও অপরিষ্কার হাতে দুধ দোহন, ওলানের বাঁটে ক্ষত বা ঘা এ সমস্ত অব্যবস্থাপনার কারণে দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ: মুখ পানির মতো সাদা বা হলদে অথবা জমা মুখ, ওলান গরম থাকে, জ্বর হতে পারে।
চিকিৎসা: অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিহিস্টামিন মাংসে ইনজেকশন এবং সাধারণ স্যালাইন শিরার ইনজেকশন নিয়ে চিকিৎসা করলে সুফল পাওয়া যায়।
প্রতিরোধ: খামারে নতুন গাভির আগমন হলে সাথে সাথে তার ওলান পরীক্ষাসহ দুখ পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। মাসে অন্তত দুইবার খালি চোখে দুধ পরীক্ষা করতে হবে।
চ) ইউরিয়া ও এর বিষক্রিয়া
খড়কে শতকরা ৪ ভাগ ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ানো হয়। তবে ইউরিয়া মিশ্রিত খাদ্যে শর্করাযুক্ত হলে পশু অধিক মাত্রায় ইউরিয়া সহ্য করতে পারে। এছাড়া ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক করে পশুকে মোটাতাজাকরণে খাওয়ানো হয়।
বিষক্রিয়ার লক্ষণ: গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর ২০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে উপসর্গ প্রকাশ পায়। পেটে ব্যথা, ফেনাযুক্ত লালা করা, মাংসপেশির কম্পন, শ্বাসকষ্ট, পেট ফাঁপা উপসর্গ দেখা দেয়।
চিকিৎসা: অ্যাসিটিক এসিড ৫% অথবা ভিনেগার ০.৫ থেকে ১ লিটার ভেড়া ও ছাগলকে খাওয়াতে হবে। গরুর জন্য ২-৫ লিটার। চিকিৎসার পর পুনরায় উপসর্গ দেখা দিলে ২০ মিনিট পর পুনরায় ওষুধ খাওয়ানো যায়।
ছ) পেট ফাঁপা বা ব্লোট
গবাদিপশুর (রোমন্থনকারী পশু) পেটে (রুমেনে) অতিরিক্ত গ্যাস জমা হয়ে এ রোগের সৃষ্টি হয়। যদি কেবল অতিরিক্ত গ্যাস জমা হয় হবে তাকে টিপ্যানি বলে এবং গ্যাসের সাথে ফেনা থাকলে তাকে পেট ফাঁপা বা ব্রোট বলা হয়।
গবাদিপশুর পেটে প্রায় ৫০০-৬০০ মিটার গ্যাস উৎপাদিত হয়। এ গ্যাস বের হতে না পারলে বা বের হওয়ার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে এ রোগ হতে পারে।
নরম ডালজাতীয় (লিগিউম) ঘাস খাওয়ার ফলে ফেনাযুক্ত গ্যাস তৈরি হয়। এর কারণ রুমেনের অণুজীব দ্রুত এ ঘাস পরিপাকে সাহায্য করে কিন্তু এত অল্প সময়ে পশু গ্যাস বের করতে পারে না। আবার ফেনাযুক্ত হওয়ায় এ গ্যাস বের হতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। নরম সবুজ ঘাস, পশুর চারণভূমিতে অতিরিক্ত ইউরিয়া প্রয়োগ করা হলে পশুর এ রোগ হতে পারে।
লক্ষণ:
- পশুর পেট (রুমেন) অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়।
- পশু অস্বস্তিতে থাকে বারবার মাটিতে বসে।
- পশুর শ্বাসকষ্ট হয়।
- জিভ বের হয়ে যায় এবং লালা পড়ে।
- আক্রান্ত পশু আস্তে আস্তে দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে যায়।
- খাওয়া ও পায়খানা প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়।
চিকিৎসা: পশুর রোগ যদি গুরুতর হয় তবে দ্রুত পেটের বাম পাশের মাঝখানে ট্রকার ও ক্যানুলা প্রবেশ করিয়ে গ্যাস বের করে দিতে হবে।
প্রতিরোধ: নরম সবুজ ঘাস বা ডালজাতীয় ঘাস শুকনা খড়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
জ) কৃমি
কৃমি আক্রান্ত পশু মাঠে বা চারণভূমিতে পায়খানা করার ফলে মাঠের ঘাস দূষিত হয়। এসব দূষিত ঘাস সুস্থ গরু খেলে তারাও কৃমিতে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া অনেক কৃমি আছে যা শরীরের চর্ম ভেদ করে দেহে প্রবেশ করে।
লক্ষণ:
- কৃমিতে আক্রান্ত গবাদিপশু সহজে যারা না গেলেও স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে এবং দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
- ঠিকমতো খাবার দিলেও তার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয় না। বরং দিন দিন রোগা হতে থাকে। পশু ক্রমান্বয়ে হাড্ডিসার হয়ে পড়ে।
চিকিৎসা/প্রতিরোধ:
- কৃমির জন্য কৃমিনাশক ওষুধ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- আমাদের দেশে গবাদিপশুর লালন-পালন ব্যবস্থায় বছরে ৩ বার কৃমির ওষুধ খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- কোনো গবাদিপশু অসুস্থ হলে তৎক্ষণাৎ সুস্থ প্রাণী থেকে আলাদা রাখতে হবে। এজন্য দ্রুত নিকটস্থ পশু হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।