বীজ কৃষি উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপকরণ। অন্যান্য উপকরণ সঠিক মাত্রায় এবং সঠিক সময়ে ব্যবহার করা সত্ত্বেও বীজ যদি মানসম্পন্ন না হয় তবে ফসলের ফলন ভাল আশা করা যায় না। এজন্য কীভাবে বীজ উৎপাদন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হয় সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
ভালবীজ উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য মাঠ পর্যায়ে আমাদের করণীয় হলো ভালো জমি নির্বাচন, সুস্থ বীজ নির্বাচন, সঠিক সময়ে বীজ বপন/চারা রোপণ, আগাছা নিয়ন্ত্রণ, বিজাত বাছাই এবং সময়মত ফসল কর্তন। এছাড়া, ফসল কাটার পর সঠিকভাবে ফসল মাড়াই, ঝাড়াই, নির্ধারিত মাত্রায় বীজ শুকানো, বীজ শোধন এবং বীজ সংরক্ষণ বা গুদামজাতকরণ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে।
এই পোষ্টটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- বীজ সংরক্ষণ কী বা বীজ সংরক্ষণ কাকে বলে, তা জানতে পারবেন। বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি কত প্রকার হতে থাকে তার ধারণা পাবেন। মাটির পাত্রে/কলসে বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি শিখতে পারবেন।
(১) বীজ সংরক্ষণ কী/কাকে বলে?
বীজ সংরক্ষণ কী/কাকে বলে: বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ শেষে প্রাপ্ত মানসম্পন্ন বীজ পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের পাত্র বা স্থানে রেখে দেয়াকে বীজ সংরক্ষণ বুঝায়।
বীজ সংরক্ষণের মূল লক্ষ্য হল বীজের সজীবতা ও সতেজতা অক্ষুন্ন রাখা যার মাধ্যমে কাংঙ্খিত অঙ্কুরোদগম হার নিশ্চিত হবে।
আমাদের বাংলাদেশে কৃষকরা সাধারণত বীজ সংরক্ষণ করে থাকে চটের বস্তা, প্লাষ্টিক বস্তা, মাটির মটকা, ড্রাম, কলসী, টিনের পাত্র, কাচের বৈয়ম, বাশের তৈরি বেড়, ডোল, পলিব্যাগ ইত্যাদি।
প্রচলিত পদ্ধতিসমূহ বীজ সংরক্ষণের জন্য খুব একটা ভালো নয়। বিশেষ করে চটের বস্তা, বেড়, ডোল, মটকা, কলসী ইত্যাদিতে বীজ সংরক্ষণ করলে বীজের আর্দ্রতা বাহিরের পরিবেশের আর্দ্রতা দ্বারা প্রভাবিত হয়। কারণ এ সকল পাত্র বায়ুরোধী নয়।
তবে বায়ুরোধী প্লাষ্টিক কনটেইনার, ব্যাগ, ড্রাম, কাচের বৈয়ম প্রভৃতিতে উপযুক্ত আর্দ্রতার বীজ পাত্র ভর্তি করে সংরক্ষণ করলে ৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত ভালো রাখা সম্ভব। সেক্ষেত্রে বীজ মাঝে মধ্যে পরীক্ষা করতে হবে এবং প্রয়োজনে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
আধুনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন হিমাগারে বা ফ্রিজে বীজকে উপযুক্ত আর্দ্রতা ও তাপমাত্রায় দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জার্মপ্লাজম এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করা হয়।
সংরক্ষিত বীজের বস্তা বা পাত্র সরাসরি মাটির উপর রাখা যাবে না। পরিস্কার বা শুষ্ক স্থানে রাখতে হবে। স্তুপ করে রাখলেও খেয়াল রাখতে হবে যেন তা ২-৩ মিটারের বেশি উঁচু না হয়।
(২) বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি কত প্রকার?
বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতিসমূহকে আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ভিত্তিক ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
১। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণবিহীন সংরক্ষণ পদ্ধতি: এক্ষেত্রে সংরক্ষিত বীজের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত হয় না। বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা দ্বারা বীজের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা প্রভাবিত হয়। অর্থাৎ পাত্রের মধ্যে অবাধে বায়ু চলাচল করতে পারে। যেমন: চটের বস্তা, ডোল, বেড়, মটকা, কলসী ইত্যাদি।
২। স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও নিয়ন্ত্রিত আর্দ্রতায় বীজ সংরক্ষণ: বায়ুরোধী পাত্র যেমন: টিনের কনটেইনার, ড্রাম, কাচের বৈয়ম, মোটা প্লাষ্টিক ব্যাগ অর্থাৎ যে সকল পাত্রে সরাসরি বায়ু চলাচলের সুযোগ নাই সে সকল পাত্রে নির্দিষ্ট আর্দ্রতায় বীজ সংরক্ষণ করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিলে বীজ ভালে থাকে। কম খরচে বীজ সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতিই অধিক গ্রহণযোগ্য।
৩। উচ্চ আর্দ্রতা ও নিম্ন তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ: সাধারণত হিমাগারে অঙ্গজ বীজ যেমন: আলু, পিয়াজ, গাজর এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত থাকে। হিমাগারে উচ্চ আর্দ্রতা (৮০% বা বেশী) ও নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা (৩-১০০ ডিগ্রি) থাকে। নিয়মিতভাবে হিমাগারে বায়ু প্রবেশ করাতে হয় যাতে অক্সিজেনের অভাবে বীজ নষ্ট না হয়। তবে এ ধরনের হিমাগারে অন্যান্য বীজ বায়ুরোধী পাত্রে রেখে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
৪। নিম্ন আর্দ্রতা ও তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ: এ ধরনের সংরক্ষণ পদ্ধতিতে হিমাগারের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা কাঙ্খিত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সাধারণত নিম্নতাপমাত্রায় (১০০ সে.) ও আর্দ্রতায় (<৫০%) বীজ সংরক্ষণ করা হয়। উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ এ পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদী (৩-৮ বছর) সংরক্ষণ সম্ভব।
(২) মাটির পাত্রে/কলসে বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি
মূলতত্ব: মাটির বীজ কলস বা মটকায় বীজ সংরক্ষণ গ্রামে সবচেয়ে পরিচিত একটি পদ্ধতি। এভাবে সংরক্ষণ করলে পোকা মাকড় রোগ জীবাণু, বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর প্রাণীর হাত থেকে বীজকে রক্ষা করা যায় এবং সাথে সাথে বীজও অনেক দিন ভালো থাকে।
উপকরণ:
১। মাটির কলস
২। ধান/গম বা অন্য শস্য দানা
৩। কাদামাটি/রং/আলকাতরা
৪। ঢাকনা
কাজে ধারা:
১। বাছাইকৃত বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে মাটির কলসে পুরোপুরি ভর্তি করুন।
২। ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করার পর মাটির প্রলেপ দিয়ে ঢাকনার চারপাশে আটকিয়ে দিন এবং বায়ুরোধী করুন।
৩। কলসের গায়ে মাটির প্রলেপ/রং/আলকাতরা দিয়ে প্রলেপ দিন।
ফলাফল: এভাবে মাটির পাত্রে/কলসে দীর্ঘ দিন বীজ সংরক্ষণ করা যায়।
সাবধানতা:
১। কলসটি ছিদ্র অন্য কোন সমস্যা আছে কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে।
২। কলসের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে বায়ুরোধী করতে হবে।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা বীজ সংরক্ষণ কী, বীজ সংরক্ষণ কাকে বলে, বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি কত প্রকার, মাটির পাত্রে বা কলসে বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি, প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম।
মানসম্পন্ন বীজ প্রাপ্তির জন্য ফসল বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। বীজ উৎপাদনের জন্য বীজের প্রাথমিক উৎস এলাকার জলবায়ু, মাটি, সার প্রয়োগ, বপন সময়, বীজ হার, নিরাপদ দুরত্ব, রোগিং, কর্তন সময় সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মাঠ পর্যায়ে যথাযথ পরিচর্যা সম্পন্ন করে ভাল বীজ উৎপাদন করা হলেও প্রক্রিয়াজাতকরণের যে কোন ধাপে মান হ্রাস পেতে পারে। তাই উপযুক্ত সময় ও পদ্ধতিতে মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও উপযুক্ত পাত্রে সংরক্ষন নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।