নিম্নে সহজ ও সংক্ষিপ্তাকারে সরিষা কোন মাটিতে ভালো হয়? সরিষা চাষ পদ্ধতি ও বিঘা প্রতি সরিষার ফলন সম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরা হলো-
ভূমিকা
বাংলাদেশে তৈল ফসল হিসেবে সরিষা, সয়াবিন, তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী প্রভৃতির চাষ হয়ে থাকে। তবে এদেশের মানুষ সরিষাকেই তৈল ফসল হিসেবে বেশি চাষ করে থাকে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ বাংলাদেশের মানুষ সরিষার তৈল মাথায় ও গায়ে মাখাতে অভ্যস্ত। এছাড়া রান্নার কাজে ও সর্দি-কাশি হলে নাকে-মুখে ব্যবহার করে।
কিন্তু এ সরিষার তেলের অন্য একটি দিক হলো- এতে ৪০-৪৫% ক্ষতিকর ইরোসিক এসিড থাকে যা হৃদপিন্ডে রোগ সৃষ্টি করে থাকে। তবে আশার কথা আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ সরিষার তৈল খেয়ে থাকি তাতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
সরিষার বীজ থেকে তৈল নিষ্কাশনের পর যে খৈল থাকে তাতে প্রায় ৩৫% প্রোটিন এবং ৬.৪% নাইট্রোজেন থাকে। এ জন্য খৈল গৃহপালিত পশুর ভালো খাবারও বটে।
খৈলে নাইট্রোজেন থাকায় ভালো জৈব সার হিসেবে জমিতে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
এছাড়া সরিষার জমিতে কৃত্রিম উপায়ে অত্যন্ত অল্প খরচে মৌমাছি পালন করে বেশ মধু সংগ্রহ করা যায়। এ জন্য সরিষাকে মধু উদ্ভিদ বলা হয়। উপরন্তু মৌমাছি থাকাতে সরিষার পরাগায়ন ভালোভাবে হয় বিধায় সরিষার ফলনও বেশি হয়।
সরিষা কোন মাটিতে ভালো হয়?
সরিষা কোন মাটিতে ভালো হয়: পানি নিকাশের সুব্যবস্থা আছে এমন বেলে দো-আঁশ মাটি সম্পন্ন জমি সরিষা চাষের জন্য উপযোগী।
জাত, বপন সময় ও বীজ হার সরিষার স্থানীয় ও উফশী দু’ধরনের জাত রয়েছে।
নিম্নে এদের কয়েকটির নাম, বপন সময়, বীজ হার ও জীবনকাল একটি তালিকার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলো-
জাত | জাতের নাম | বপন সময় | বীজ হার (কেজি/হেক্টর) | জীবনকাল (দিন) |
উফশী | কল্যাণী | মধ্য অক্টোবর-মধ্য নভেম্বর | ৮ | ৭৫-৮৫ |
উফশী | সোনালী | মধ্য অক্টোবর-মধ্য নভেম্বর | ৮.৫ | ৯০-১০৫ |
উফশী | সম্পদ | মধ্য অক্টোবর-মধ্য নভেম্বর | ৯ | ৯০-১২০ |
উফশী | সম্বল | মধ্য অক্টোবর-মধ্য নভেম্বর | ৭.৫ | ৯৫-১১০ |
স্থানীয় | রাই-৫ | মধ্য অক্টোবর-নভেম্বরের শেষ | ৮ | ৯০-১০৫ |
স্থানীয় | মাঘী | মধ্য অক্টোবর-নভেম্বরের শেষ | ৫ | ৭০-৮০ |
বীজ শোধন
প্রতি কেজি বীজ ২.৫ গ্রাম ভিটাভ্যা• ২০০ বা ক্যাপটান দিয়ে শোধন করে নিয়ে বুনতে হয়।
জমি তৈরি
- মাটির জো অবস্থায় আড়াআড়ি ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হবে।
- উল্লেখ্য যে সরিষার বীজ ছোট বিধায় মাটি অবশ্যই মিহি করতে হবে যাতে বীজ সহজেই মাটির সংস্পর্শে আসতে পারে।
- জমির উপরিভাগ মই এর সাহায্যে সমতল করে নিতে হবে যেন কোথাও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে না পারে।
সার প্রয়োগ
সরিষার জাত ও মাটি ভেদে সারের পরিমাণের পার্থক্য হয়ে থাকে।
নিম্নে সাধারণ একটি হিসেব উপস্থাপন করা হলো-
সারের নাম | সারের পরিমাণ/হেক্টর |
কম্পোস্ট/খামারজাত সার | ৭-৮ টন |
ইউরিয়া | ২০০-২৫০ কেজি |
টি এস পি | ১৫০-১৮০ কেজি |
এম পি | ৭৫-৮৫ কেজি |
- উল্লেখ্য ইউরিয়া সারের অর্ধেকসহ বাকি সব সার জমি প্রস্তুত করার সময় মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ফুল আসার সময় জমিতে ছিটিয়ে দিতে হয়।
- কোন জমিতে সালফার, দস্তা ও বোরনের অভাব পরিলক্ষিত হলে স্থানীয় কৃষি কর্মীর পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জিপসাম, জিংক সালফেট ও সোহাগা (বরিক এসিড) উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
- এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সার প্রয়োগ করার পর জমিতে সেচ দিলে সরিষার ফলন আরও বৃদ্ধি পাবে।
- গাছে শিশির শুকিয়ে গেলে অর্থাৎ পড়ন্ত বিকেলে উপরি প্রয়োগ করা উচিত।
বপন পদ্ধতি
- সরিষার বীজ সাধারণত ছিটিয়ে বোনা হয়।
- বীজ ছোট বিধায় বোনার সময় জমিতে সমানভাবে ছিটানো কষ্টকর হয়। এজন্য বালি বা ছাই এর যে কোন একটি বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ ছিটালে জমিতে সমভাবে পড়ে। এতে জমির কোন জায়গায় গাছ ঘন আবার কোন জায়গায় পাতলা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
- লাইন করেও সরিষার বীজ বোনা যায়। এতে সার, সেচ, নিড়ানি প্রভৃতি পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়। এক্ষেত্রে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব সাধারণত ২৫-৩০ সে.মি. রাখা হয় এবং প্রতি লাইনে প্রয়োজনীয় পরিমাণ বীজ ছিটিয়ে বুনতে হয়।
পোকা দমন
সরিষা গাছের প্রধান ক্ষতিকারক পোকা হলো জাব পোকা। এ পোকা সরিষা গাছের কান্ড, পাতা, পুষ্প মঞ্জুরী, ফুল ও ফল থেকে রস চুষে যায় বলে গাছ দুর্বল হয়ে যায়। ফুল ও ফল ধারণ বাধাগ্রস্থ হয়। ফল কুচকে যায় এবং শতকরা ৩০-৭০ ভাগ ফলন কম হতে পারে। জানুয়ারি এ আক্রমণ বেশি হয়। এ পোকার আক্রমণ দূর কতে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি প্রয়োগ করতে হবে।
রোগ ও পরগাছা দমন
সরিষা গাছে পাতায় দাগ পড়া বা অলটারনেরিয়া ব্লাইট রোগ হয়। এ রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে পাতায় বাদামী বা গাঢ় বাদামী দাগ পড়ে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পাতা, কান্ড, শুঁটি ও বীজেও এই দাগ পড়ে। এ রোগ দমনের জন্য ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ বা রোভরাল ডব্লিউপি ১ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১২ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
এছাড়া সরিষা ক্ষেতে অরোবাংকি নামক এক প্রকার পরগাছা জন্মে যা সরিষার মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। অরোবাংকি দেখা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিড়ানি দিয়ে জমি থেকে উঠিয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
ফসল কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই
কোন জাতের সরিষা কতদিন পর সংগ্রহ করতে হবে তার একটি হিসেব পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
- এ ছাড়া সরিষা গাছে শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ গাছ হলদে হলে পরিষ্কার দিনে সকাল বেলা গাছ কেটে নিয়ে মাড়াই করার স্থানে নিয়ে যেতে হয়।
- এখানে প্রখর সূর্যালোকে ২-৩ দিন শুকানোর পর বিকেলের দিকে গরু দ্বারা মাড়াই করতে হয়।
- এরপর সরিষার বীজ আলাদা করে কুলা ও চালুনি ব্যবহার করে পরিষ্কার করতে হয়।
বীজ শুকানো ও সংরক্ষণ
পরিষ্কার বীজ রোদে ৩-৪ দিন ভালোভাবে শুকিয়ে (আর্দ্রতা ৫-৬%) নিতে হয়। এই বীজ শীতল পরিবেশ ও আর্দ্রতা কম এমন স্থানে শুকনো পরিষ্কার যে কোন পাত্রে ১-২ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
বিঘা প্রতি সরিষার ফলন
বিঘা প্রতি সরিষার ফলন হলো-
- বিঘা প্রতি উফশী জাতের সরিষার ফলন ২০০-২৭০ কেজি।
- বিঘা প্রতি স্থানীয় জাতের সরিষার ফলন ১৩০-১৫০ কেজি।
সারসংক্ষেপ
সরিষা এ বাংলাদেশের বিভিন্ন তৈল জাতীয় ফসলের মধ্যে অন্যতম। সরিষার বীজ থেকে তৈল ও খৈল পাওয়া যায়। তৈলে ক্ষতিকর ইরোসিক এসিড বিদ্যমান। আর খৈল ভালো জৈব সার ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুনিষ্কাশিত বেলে দো-আঁশ মাটি সরিষা চাষের জন্য উপযুক্ত। সরিষা বীজ প্রধানত মধ্য অক্টোবর থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত বোনা যায়। সরিষা ফসলের ক্ষতিকর পোকা, পরগাছা ও রোগ হলো- যথাক্রমে জাব পোকা, অরোবাংকি এবং পাতায় দাগ পড়া রোগ।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।