জমিতে পানি সেচের প্রয়োজনীয়তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অতিরিক্ত পানি নিকাশ ও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর। সুতরাং অপ্রয়োজনীয় পানি জমি হতে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা রাখার একান্ত প্রয়োজন।
জমি থেকে অতিরিক্ত পানি অপসারণ করাকে পানি নিকাশ বলা হয়। পানি নিকাশের ফলে জমিতে ফসল উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেচ ও নিকাশ মূলত একে অপরের পরিপূরক।
এ পাঠ শেষ অবধি পড়লে আপনি- ফসলি জমির পানি নিস্কাশন সম্পরেক স্পষ্ট ধারনা পারবেন; পানি নিস্কাশনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি পারবেন; পানি নিস্কাশনের উপযুক্ত সময় জানতে পারবেন; পানি নিস্কাশনের পদ্ধতি ও তাদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
(১) ফসলি জমির পানি নিস্কাশন কাকে বলে?
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা সেচ, বন্যা বা জলোচ্ছাস প্রভৃতির মাধ্যমে ফসলের জমিতে অতিরিক্ত পানি জমা হতে পারে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
ফসলি জমির পানি নিস্কাশন কাকে বলে: ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি উন্নয়ন ও ভালো ফসলের জন্য জমি থেকে গাছের জন্য অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় পানি অপসারন করাকে পানি নিস্কাশন বলে।
(২) ফসলি জমির পানি নিস্কাশনের প্রয়োজনীয়তা
জমি হতে সময়মত অতিরিক্ত পানি নিস্কাশনের ফলে ফসলের যে উপকার হয় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
- অতিরিক্ত পানি অপসারণ করলে মাটিতে বায়ু চলাচল সুগম হয় ফলে গাছের মূলের বৃদ্ধি ভালো হয়। অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে গাছের মূল মারা যায়। পানি নিস্কাশন করলে গাছ সতেজ হয়, পোকামাকড় ও রোগ জীবাণু সহজে আক্রমন করতে পারে না।
- পানি নিস্কাশনের ফলে পুষ্টি উপাদানের সহজলভ্যতা বাড়ে।
- অতিরিক্ত পানি সরে গেলে অক্সিজেনের পরিমান বাড়ে এবং সাথে সাথে বিভিন্ন গৌন পুষ্টি উপাদান যেমন ম্যাংগানিজ, জিংক, কপারের বিষাক্ততা কমে যায়।
- পানি নিস্কাশনের ফলে মাটিতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া যেমন নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী ব্যাকটেরিয়া, জৈব পদার্থ বিয়োজনকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় বলে মাটিতে পুষ্টি উপাদান সহজলভ্য হয়।
- পানি অপসারণ করলে মাটির তাপমাত্রা বাড়ে যা বীজ অংঙ্কুরোদগম ত্বরান্বিত হয়।
- অতিরিক্ত পানির সাথে ক্ষতিকর লবন অপসারণ হয়।
- শস্য উৎপাদন মৌসুমের ব্যপ্তিকাল হ্রাস করা সম্ভব হয়। কারণ জমি হতে অতিরিক্ত পানি সরালে আগাম অথবা সময়মত ফসল লাগানো সম্ভব হয় এজন্য পরবতীর্ ফসল ও সময়মতো লাগানো যায়।
- অধিকাংশ ফসলই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না যেমন তোষা পাট, মরিচ, তুলা, বেগুন ইত্যাদির জন্য পানি নিস্কাশন অত্যাবশ্যক।
- জমিতে অতিরিক্ত পানির জন্য গাছের মূল ঠিকমত বিস্তার লাভ করতে পারে না। পরবতীর্ তে মাটির উপরিস্তর শুকিয়ে গেলে অগভীর মূলের জন্য নিচের স্তরের পানি নিতে পারে না। যেমন আমন ধানের ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেয়া যায়।
- মাটিতে উদ্ভিদের জন্য বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের উৎপাদন কম হয়।
- বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের হাত থেকে ফসল রক্ষা করা যায়।
(৩) ফসলি জমির পানি নিস্কাশনের উপযুক্ত সময়
ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য ফসলের জমিতে সেচ দেয়া যেমন জরুরী তেমনি জমি থেকে অতিরিক্ত পানি অপসারণ করাও জরুরী।
মাটির বুনট, ফসলের প্রকৃতি, ফসলের জীবনকাল, বৃষ্টিপাতের ধরণ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে পানি নিস্কাশনের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা হয়।
ধানের পানি নিস্কাশনের সময়:
- চারা রোপনের পর ৫ম থেকে ৮ম দিন পর্যন্ত অবিরতভাবে ৩-৫ সে.মি. পানি রাখা।
- কুশি হওয়া ত্বরান্বিত করার জন্য রোপনের ৪০ থেকে ৫০ দিন পর্যন্ত পানি নিস্কাশন করা।
- রোপনের ৫৫ হতে ৭০ দিন পর্যন্ত জমিতে ৭-১০ সে.মি. পানি আটকে রাখতে হবে যাতে কুশি হওয়া কমে যায়।
- এরপর ৭০-৮০ দিন পর্যন্ত জমির পানি কমিয়ে ফেলতে হবে প্রায় ৩ সে.মি. এ নামিয়ে আনা।
- রোপনের ৮০ দিন থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত আবার পানির গভীরতা ৭-১০ সে.মি. এ বাড়িয়ে দেয়া।
- ফসল কাটার সুবিধার্থে ফসল কাটার এক সপ্তাহ আগে জমি থেকে পানি বের করে দেয়া।
- চারা রোপনের সময় জমির পানি খুব কম গভীরতায় রাখা।
ভূট্টার পানি নিস্কাশনের সময়: ভূট্টা অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না। চারা ও পুস্পায়ন অবস্থায় পানি জমলে ফলন কম হয়। ভূট্টার দানা পর্যায়ের পর জমিতে পানি জমলে পানি নিস্কাশন করতে হবে।
ডাল জাতীয় শস্যে পানি নিস্কাশনের সময়: ডাল জাতীয় শস্য কোন অবস্থাতেই অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারেনা। বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে জমিতে পানি থাকলে তা মূলের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয় ও মূলে গুটি গঠনে বাঁধা দেয়। মাটিতে বায়ু চলাচলের সুবিধার জন্য পানি নিস্কাশন করতে হবে।
পাটের জমির পানি নিস্কাশনের সময়: তোষা পাট জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। দেশী পাট জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে কিন্তু পরিপক্ক পর্যায়ে পানি জমে থাকলে গোড়ার দিকে শিকড় হয়ে পাটের গুনগতমান কমিয়ে দেয়। এজন্য পরিপক্ক পর্যায়ে পানি নিস্কাশন করতে হবে।
তুলার জমির পানি নিস্কাশনের সময়: তুলার বল গঠনের সময় জমিতে অতিরিক্ত পানি থাকলে তা বল বিলম্বিত করে। তাই পুস্পায়নের পর জমিতে পানি জমা থাকলে তা নিস্কাশন করতে হবে।
(৪) পানি নিস্কাশন ব্যবস্থাপনা
প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ফসলের জমি হতে সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে অপসারণ করে কাঙ্খিত ফলন পাওয়াই পানি নিস্কাশনের মূল উদ্দেশ্য। কোন জমিতে পানি নিস্কাশন পদ্ধতি নির্ভর করে ভূ-গর্ভস্থ পানির তল, পানির উৎস, জমির প্রকার ইত্যাদির উপর।
প্রধানত দুইটি পদ্ধতিতে পানি নিস্কাশন করা হয়। যথা-
- খোলা নালা পদ্ধতি
- বদ্ধ নালা পদ্ধতি
ক) খোলা নালা পদ্ধতি
আমাদের দেশে এ পদ্ধতি বেশি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে জমির উপর কয়েকটি প্রধান নালা কাটা হয়। এরপর আরও কিছু শাখা নালা কাটা হয় এবং প্রধান নালার সাথে যুক্ত করা হয়। এ নালার গভীরতা ও প্রশস্থতা মাটির প্রকারের উপর নির্ভর করে। পানি দ্রুত অপসারনের জন্য নালা একদিকে ঢালু হওয়া প্রয়োজন।
সুবিধা:
- পানি নিস্কাশন দক্ষতা বেশি।
- কাঁদা বুনটের মাটির জন্য উপযুক্ত।
- ভূ-গর্ভস্থ পানির তল উচুঁ হলে ও পানি নিস্কাশন সম্ভব।
অসুবিধা:
- নালা তৈরিতে জমি নষ্ট হয়।
- ভূমি ক্ষয় হয়।
- বেলে মাটির জন্য উপযুক্ত নয়।
- কৃষি যন্ত্রপাতি চলাচলে সমস্যা হয়।
খ) বদ্ধ নালা পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে ১-১.৫ মিটার গভীরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নালা তৈরি করা হয় এবং নালা-গুলিকে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। অতিরিক্ত পানি মাটির রন্ধ্রের মাধ্যমে নিচে গিয়ে নালাার মাধ্যমে নিকাশ হয়।
সুবিধা:
- জমির অপচয় হয় না।
- ভূমি ক্ষয় হয় না।
- ভূ-গর্ভস্থ পানি অপসারনের জন্য উপযোগী।
- হালকা বুনটের মাটিতেও এ পদ্ধতিতে নিস্কাশন করা যায়।
অসুবিধা:
- নালা তৈরির জন্য প্রাথমিক খরচ খুব বেশি।
- নিকাশ দক্ষতা কম।
- ভারী বুনটের মাটিতে এ পদ্ধতি তেমন কার্যকর নয়।
- এ পদ্ধতির জন্য কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনাটির মাধ্যমে আমরা ফসলি জমির পানি নিস্কাশন কাকে বলে, ফসলি জমির পানি নিস্কাশনের প্রয়োজনীয়তা, ফসলি জমির পানি নিস্কাশনের উপযুক্ত সময়, পানি নিস্কাশন ব্যবস্থাপনা, প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম।
ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও ভালো ফলনের জন্য জমি থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি অপসারণই পানি নিস্কাশন। পানি নিস্কাশণের ফলে বায়ু চলাচল পথ সুগম হয়, পুষ্টি উপাদানের সহজলভ্যতা বাড়ে। ক্ষতিকর লবণ অপসারিত হয়। এছাড়াও আরও অনেক উপকারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পানি নিস্কাশন পদ্ধতি দুই প্রকার; বন্ধ নালা পদ্ধতি, খোলা পদ্ধতি।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।