বাংলাদেশে গমের পরই আলুর স্থান। ১৯৬০ সাল থেকে বিদেশের বহু আলুর জাত বাংলাদেশে চাষ করা হচ্ছে। পৃথিবীর ৪০ টির ও বেশি দেশে আলু প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এ পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- আলুর বীজ উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন। আলুর বীজ শোধন পদ্ধতি শিখতে পারবেন।
নিম্নে উন্নত মানের আলুর বীজ উৎপাদন পদ্ধতি ও আলুর বীজ শোধন পদ্ধতির বর্ণনা করা হলো-
১। জমি নির্বাচন ও তৈরি: বীজ আলু চাষের জন্য বেলে দোঁআশ মাটি উত্তম। জমিতে একই গোত্রভুক্ত (সোলানেসী) ফসল যেমন-আলু, টমেটো, মরিচ, তামাক ইত্যাদি ক্ষেত থেকে অন্তত ৩০ মিটার দূরে রাখতে হবে। মাটি ৫-৬ টি চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। জমি অবশ্যই আগাছামুক্ত করতে হবে। মাটি বেশি শুকনো হলে সেচ দিয়ে মাটিতে “জো” আসার পর আলু লাগাতে হবে।
২। আলুর বীজ শোধন পদ্ধতি: আলু হিমাগারে রাখার আগে শোধন করা হয়ে না থাকলে অঙ্কুর গজানোর পূর্বে বীজ আলু বরিক এসিড দ্রবণে (২০ গ্রাম/লিটার) ১৫-২০ মিনিট চুবিয়ে ছায়ায় শুকাতে হবে।
৩। বীজ প্রস্তুতি: আলুর বীজ উৎপাদন পদ্ধতির জন্য জন্য আস্ত আলু ব্যবহার করা ভাল, এতে বপনের পর রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। আলু কেটে লাগালে প্রতি কাটা অংশে কমপক্ষে ২টি চোখ থাকতে হবে। আলু কাটার সময় সাবান পানি দ্বারা বারবার ছুরি বা বটি পরিষ্কার করা উচিত যাতে রোগজীবাণু এক বীজ হতে অন্য বীজে ছড়াতে না পারে। বীজ আলু না কেটে লম্বালম্বিতভাবে কাটতে হয়। টিস্যু কালচার পদ্ধতি এবং প্রকৃত বীজের মাধ্যমেও আলুর চারা উৎপাদন করা হয়।
৪। মাটি শোধন: ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধের জন্য শেষ চাষের পূর্বে প্রতি শতাংশ জমিতে ৮০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে মাটি শোধন করা উচিত। এতে মাটিতে বসবাসকারী জীবাণু মারা যাবে।
৫। সার প্রয়োগ: আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত বীজ আলুর গুণগত মান ভালো হওয়ার জন্য সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।
শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া এবং সবটুকু গোবর, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক সালফেট সার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর গাছের গোড়ায় মাটি তুলে প্রয়োগ করতে হবে এবং সেচ দিতে হবে।
আলু বীজ উৎপাদনে সারের মাত্রা নিম্নরূপ-
সারের নাম | প্রতি শতাংশ |
গোবর | ৪০ কেজি |
ইউরিয়া | ১.৪ কেজি |
টিএসপি | ০.৯ কেজি |
এমওপি | ১.০৬ কেজি |
জিংক সালফেট | ৫০ গ্রাম |
জিপসাম | ১/২ কেজি |
৬। বীজ হার: বীজের আকার ও বপন দূরত্বের উপর আলুর বীজ হার নির্ভর করে। সাধারণত প্রতি হেক্টরে ১.৫ টন থেকে ২ টন বীজ আলুর প্রয়োজন।
৭। বীজ বপন দূরত্ব:
আলু বীজের বপন দূরত্ব নিচে উল্লেখ করা হলো-
দূরত্ব | লাইন থেকে লাইন | বীজ থেকে বীজ |
আস্ত আলুর ক্ষেত্র | ৬০ সে. মি. | ২৫ সে. মি. |
কাটা আলুর ক্ষেত্র | ৬০ সে. মি | ১০-১৫ সে. মি. |
৮। সেচ ব্যবস্থাপনা: মাটির আর্দ্রতার উপর ভিত্তি করে ২-৪ টি সেচ প্রদান করা উচিত। জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে বীজ আলুর অঙ্কুরোদগমের জন্য হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে। তবে সেচ বেশি হলে বীজ পচে যাবে। বপনের ৩০- ৩৫ দিন পর ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে।
৯। আগাছা দমন: বীজ বপনের পর থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত মাঠে আগাছা পরিস্কার রাখতে হবে। গাছ ছোট অবস্থায় থাকাকালীন আগাছা যথাসম্ভব দমন করে রাখতে হবে।
১০। রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন:
আলুর রোগ ও পোকা মাকড় সম্বন্ধে নিচে আলোচনা করা হলো-
- আলুর রোগসমূহের মধ্যে মড়ক রোগ, ঢলে পড়া রোগ, দাদ রোগ, কান্ড পচা রোগ ও ভাইরাসজনিত রোগ অন্যতম। নিম্নতাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও মেঘলা আকাশ আলুর চাষের জন্য ক্ষতিকর। এতে আলুর মড়ক রোগের (লেট ব্লাইট) আক্রমণ বেশি দেখা যায়। এ অবস্থা থেকে ফসলকে রক্ষা করার জন্য ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হবে।
- আলুতে আক্রমণকারী পোকার মধ্যে কাটুই পোকা, আলু গাছ কেটে দেয় এবং আলু আক্রমণ করে। কাটুই পোকার উপদ্রব বেশি না হলে গাছের আশে পাশের মাটি খুঁড়ে কীড়া খুঁজে মেরে ফেলতে হবে। জাব পোকা আলু গাছের রস খায় এবং ভাইরাস রোগ ছড়ায়। গাছের পাতা গজানোর ৭-১০ দিন পর কীটনাশক প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করা যায়। সুতলী পোকা আলুর মধ্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করে আলুর ক্ষতি সাধন করে। এজন্য বীজ আলুতে সুতলী পোকা আক্রান্ত আলু বেছে আলু বপন করতে হবে।
১১। ফসল সংগ্রহ এবং পরিচর্যা: আলুর পরিপক্কতা আসতে ৮৫-৯০ দিন সময় লাগে। বীজ আলু সংগ্রহের অন্তত ১০ দিন আগে সেচ বন্ধ করতে হবে।
১২। হামপুলিং: মাটির উপরের আলু গাছের সম্পূর্ণ অংশকে উপড়ে ফেলাকে হামপুলিং বলে। আলু সংগ্রহের ৭-১০ দিন পূর্বে হাম পুলিং করতে হবে। এতে সম্পূর্ণ শিকড়সহ গাছ উপড়ে আসবে কিন্তু আলু মাটির নিচে থেকে যাবে।
১৩। আলু সংগ্রহে ও সংরক্ষণ: আলু তোলার পর কোনো অবস্থাতেই ক্ষেতে স্তুপাকারে রাখা যাবে না কারণ বিভিন্ন প্রকার রোগ ও পোকা দ্বারা আলু আক্রান্ত হতে পারে। আলু উত্তোলনের পর সাথে সাথে কাটা, দাগি ও পচা আলু আলাদা করে বেছে ফেলতে হবে। তারপর ৭-১০ দিন ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে রাখতে হবে। অত:পর আবারও দাগি ও পচা আলু বেছে বাদ দিতে হবে, পরে আলু বস্তায় ভরে হিমাগারে রাখতে হবে।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা আলুর বীজ উৎপাদন পদ্ধতি ও আলুর বীজ শোধন পদ্ধতি সমএর্ক জানতে পারলাম।
বাংলাদেশে গমের পরেই আলুর স্থান। বীজ আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পরিমিত ও সময়মতো সার প্রয়োগ, আন্তঃপরিচর্যা রোগ বালাই দমন ইত্যাদি সঠিকভাবে করলে ভাল আলু বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।