পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থ করী ফসল। পাট ও পাটজাত পন্য বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপাজর্ন করা হয়। বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ দেশে উৎপাদিত পাট আঁশের মান খুবই ভালো। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে এদেশে পাটের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই পাট চাষ করা হয়। তবে জামালপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, রংপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, রাজশাহী, ঢাকা প্রভৃতি জেলাতে পাটের চাষ বেশি হয়।
পাটের আঁশের গুণাগুণ নির্ভর করে পাট পচানোর পদ্ধতির ওপর, আবার পাটের মূল্য নির্ভর করে আঁশের গুণাগুণের ওপর। কাজেই পাট পচানোর পদ্ধতি, আঁশের গুণাগুণ ও পাটের মূল্য একটির সাথে অন্যটি সম্পর্কিত।
এ পাঠ শেষে আপনি- রিবন কি, পাটের রিবন রেটিং কি ও পাটের রিবন রেটিং পদ্ধতির উদ্ভাবক কে তা বলতে পারবেন। পাটের ছাল ছড়ানোর ধাপগুলো সম্পর্কে জানতে পারবেন; পাটের রিবন রেটিং পদ্ধতির ধাপসমূহ ও পাটের ছাল পচানোর পদ্ধতি শিখতে পারবেন। কম সময়ে পাটের ছাল পচানোর উপায় সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন। রিবন রেটিংয়ের গুরুত্ব ও রিবন রেটিংয়ে কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তা বুঝতে পারবেন।
(১) রিবন কি? রিবন রেটিং কি, কেন করা হয়? পাটের রিবন রেটিং পদ্ধতির উদ্ভাবক কে?
রিবন কি: এখানে ribbon শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ফিতা এবং retting অর্থ হলো পচানো।
রিবন রেটিং কি: কাঁচা পাট গাছ থেকে ছাল বা বাকল আলাদা করার পর ঐ ছাল বা বাকলকে যে পদ্ধতিতে অল্প পানিতে পচানো হয়, তাকে রিবন রেটিং (ribbon retting) বলা হয়।
রিবন রেটিং পদ্ধতির উদ্ভাবক কে: রিবন রেটিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।
পাটের রিবন রেটিং কেন করা হয়: যে সব অঞ্চলে পাট কাটার পর পচানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না ঐসব অঞ্চলে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানো হয়। এই পদ্ধতিতে পাটের ছাল বা বাকল কাঁচা পাট গাছ থেকে আলাদা করার পর অল্প পানিতে পচানো হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ পদ্ধতি খুবই উপযোগী। এই পদ্ধতির মাধ্যমে পাটের ছাল ছাড়ানো যেমন সহজ তেমনি খরচও কম। এছাড়া এটা অত্যন্ত পরিবেশ সম্মত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে পাটের ছাল পচালে আঁশের মানও ভাল হয়।
(২) পাটের রিবন রেটিং পদ্ধতির ধাপসমূহের বর্ণনা
ক) ছাল বা বাকল ছাড়ানোর পদ্ধতি
যার মাধ্যমে পাট গাছের কাঁচা ছাল ছাড়ানো যায় তাকে রিবনার (Ribboner) বলে এবং রিবনারের মাধ্যমে ছাল ছাড়ানোর কৌশলকে রিবনিং (Ribboning) বলে।
খন্ডিত বাঁশের দুই মাথায় ইংরেজি U আকৃতির রিবনার শক্তভাবে বেঁধেও পাটের ছাল ছাড়ানো যায়। এছাড়াও লোহার তৈরি দীর্ঘস্থায়ী সিঙ্গল ও ডাবল রোলার উদ্ভাবন করা হয়েছে যার মাধ্যমে কম পরিশ্রমে সহজে ও দ্রুত রিবনিং করা সম্ভব।
- ৬ ফুট লম্বা এক খন্ড বোরাক বাঁশ নিয়ে এর উপরের দিকের প্রান্ত আঁড়াআঁড়িভাবে এমন করে কাটতে হবে যেন বাঁশটি চালা ঘরের জন্য ব্যবহৃত খুঁটির মত হয়। আড়াআড়িভাবে কাটা বাঁশের প্রান্তটির দু’দিক ফলকের মত দেখাবে যাকে বাঁশের হুক বলে। এরূপ বেশ কয়েকটি বাঁশ নিয়ে প্রত্যেকটির উপরের দিকের প্রান্তে হুক তৈরি করতে হবে। হুকের আকৃতি ইংরেজি ঠ বা ট অক্ষরের মত হবে।
- বাঁশের খন্ডগুলোর গোড়ার অংশ মাটির মধ্যে শক্ত করে এমনভাবে পুততে হবে যাতে একটি বাঁশ থেকে পরবর্তী বাঁশের দূরত্ব ৩ ৩.৫ ফুট হয়।
- এরপর মাটিতে পুতা ঐ বাঁশগুলোর হুকের সাথে অপর একটি মুরুলী বাঁশ বেঁধে আড়া তৈরি করতে হবে যাতে জমি থেকে পাট গাছ কেটে পাতা ঝরানোর পর ঐ আড়ার সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়।
- আড়ার সাথে দাঁড় করানোর পূর্বে পাট গাছগুলোর গোড়ার ৩-৪ ইঞ্চি একটি শক্ত কাঠের হাতুড়ির সাহায্যে থেতলে দিতে হবে।
- প্রতিটি পাট গাছের গোড়ার দিকের থেতলানো ছাল হাত দিয়ে দুই ভাগ করে গোড়ার পাট কাঠি বাঁশের হুকের মধ্যে রাখতে হবে। এরপর গোড়ার ছালের দুই ভাগ দুই হাত দিয়ে ধরে জোরে টান দিলে ছালগুলো সহজেই আলাদা হয়ে যাবে এবং পাট কাঠি সামনের দিকে চলে যাবে।
- এই পদ্ধতিতে ৩-৪ টি পাট গাছের ছাল একসাথে ছাড়ানো যায়। পরে ছাড়ানো ছালগুলো পরিমাণ মতো একসঙ্গে করে গোলাকার মোড়া বাঁধতে হয়।
খ) ছাল পচানোর পদ্ধতি
তিন পদ্ধতিতে পাট গাছের কাঁচা ছাল পচানো যায়, যথা-
- গোলাকার মোড়া বাঁধা প্রায় ৩০ কেজি কাঁচা ছাল ড্রাম বা মাটির চাড়িতে সাজিয়ে নিয়ে ঐ ড্রাম বা চাড়ি পরিষ্কার পানি দিয়ে ভরে দিতে হবে। এতে কাঁচা ছালের পচন ক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
- গোলাকার মোড়া বাঁধা কাঁচা ছালগুলোকে একটা লম্বা বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে বাড়ির আশেপাশের ছোট ডোবা, পুকুর বা খালের পানিতে ডুবিয়ে রেখেও পচানো যায়।
- ছোট ডোবা, পুকুর বা খাল না থাকলে সেক্ষেত্রে বাড়ির আশেপাশে অথবা পাট ক্ষেতের পাশে ১৫-১৬ ফুট লম্বা, ৬-৭ ফুট প্রস্থ ও ১.৫-২ ফুট গভীর গতর্ করে গর্তের তলা ও কিনারা পলিথিন দিয়ে ঢাকতে হবে। এরপর গোলাকার মোড়া বাঁধা কাঁচা ছালগুলোকে গর্তের মধ্যে সাজিয়ে নিয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে গতর্ টি ভর্তি করে ছালগুলোকে পচানো যায়। পচানোর সবগুলো পদ্ধতির ক্ষেত্রেই কাঁচা ছালগুলো কচুরিপানা, খড় বা চট দ্বারা ঢেকে দিতে হয়। সাধারণত ১২-১৫ দিনের মধ্যেই কাঁচা ছালগুলোর পচন কাজ শেষ হয়।
গ) কম সময়ে ছাল পচানোর পদ্ধতি
দুই উপায়ে কাঁচা ছাল পচানোর সময় কমানো যায়, যথা-
- এক হাজার (১০০০) কেজি কাঁচা ছালের জন্য ২৫০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে পচন কার্যক্রম ত্বরান্বিত হয়।
- একটি ছোট হাঁড়ির মধ্যে পানি নিয়ে ২-৩ টা পাট গাছ পূর্বে ই কেটে ছোট ছোট টুকরো করে ঐ হাঁড়ির পানিতে পচিয়ে নিতে হবে। পরে এই হাঁড়ির পাট পচানো পানি কাঁচা ছাল পচানোর সময় ব্যবহার করলেও পচনক্রিয়া দ্রুত হয়।
ঘ) ছাল পচনের সমাপ্তি নির্ণয়
- পচানোর মাত্রার ওপর আঁশের গুণাগুণ নির্ভরশীল। পচন কম হলে আঁশের সাথে শক্ত শক্ত দাগ থেকে যায়, ফলে আঁশের গুণগত মান হ্রাস পায়। পচনের মাত্রা এমন হওয়া উচিত যাতে আঁশগুলো একটির সাথে অন্যটি লেগে না থাকে।
- পানিতে ডুবানোর ৮-৯ দিন পর থেকে ছালের পচন সঠিকভাবে হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
- মোড়া বাঁধা ছালের মধ্য অংশ থেকে কোন একটি ছালের গোড়ার দিকের ২.৫ সে.মি. কেটে তা একটি বোতলের পানির ভিতর ঝাকানোর পর পানি ফেলে দিয়ে পুনরায় বোতলে পরিষ্কার পানি নিয়ে ঝাকালে যদি দেখা যায় যে, আঁশগুলো বেশ পৃথক হয়ে গেছে তাহলে বুঝতে হবে ছালের পচন কার্যক্রম শেষ হয়েছে।
- এছাড়াও দু’একটি ছাল বের করে নিয়ে পানিতে ধুলে যদি আঁশগুলো বেশ আলাদা আলাদা মনে হয় তাহলে পচন কাজ সম্পন্ন হয়েছে ধরে নিতে হবে।
ঙ) পাটের ছাল বা আঁশ ধৌতকরণ
পরিষ্কার পানিতে আঁশগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে আটি বাঁধতে হয়।
চ) পাটের আঁশ শুকানো
রৌদ্রময় স্থানে বাঁশের আড় তৈরি করে আঁশগুলো শুকাতে হয়। শুকানোর পর তা একত্রে বেঁধে রাখা হয়। অতিরিক্ত শুকানো বা কম শুকানো উভয়েই আঁশের গুণগত মান নষ্ট করে। কারণ বেশি শুকালে আঁশ ভঙ্গুর হয়ে যায়। আবার কম শুকালে পানি থাকায় আঁশ পচে যায়।
(৩) পাটের রিবন রেটিং পদ্ধতির গুরুত্ব
- কোনো এলাকায় পাট পচানোর জন্য পানির অভাব হলে এ পদ্ধতি অত্যন্ত উপযোগী।
- এ পদ্ধতির মাধ্যমে ছাল পচাতে জায়গা ও পানি কম লাগে।
- এ পদ্ধতিতে ছাল পচাতে প্রচলিত জাক পদ্ধতির অর্ধেক সময় লাগে।
- পচা ও দুর্গন্ধ পানিতে দাঁড়িয়ে আঁশ ছাড়াতে হয় না বিধায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। ফলে এ পদ্ধতি স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব।
- আঁশে কাটিংস না থাকায় এবং গুণগতমানের আঁশ পাওয়ায় বাজার মূল্য বেশি পাওয়া যায়।
- এ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত পাট খড়ি শক্ত, মজবুত ও টেকসই হয় এবং জ্বালানী সাশ্রয় হয়।
- প্রতি বিঘা জমির পাটের ছাল ছাড়াতে মাত্র ৪-৫ জন শ্রমিক প্রয়োজন হয়।
- চাষীকে প্রচলিত পদ্ধতিতে জাক দেয়ার চিন্তা করতে হয় না।
- প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে খরচ কম হয়।
- এ পদ্ধতিতে ছাল পচানো পানি জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
- সর্বোপরি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
(৪) রিবন রেটিং পদ্ধতির সতর্কতা
- দেশি ও কেনাফ পাটের ছাল ছাড়ানো সহজ বিধায় এগুলো পানি স্বল্প এলাকায় চাষ করতে হয়। পাট চাষে অনুমোদিত মাত্রায় সার ব্যবহার করলে পাটের রিবনিং ভালো হয়।
- পাট গাছে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকলে রিবনিং করতে সমস্যা হয়। তাই ক্ষেতে আর্দ্রতা বা রস না থাকলে পাট কাটার ২-৩ দিন আগে হালকা সেচ দিতে হয়।
- পাতা ঝরানোর সাথে সাথে রিবনিং করতে হয়। কারণ রৌদ্রে পাট গাছ শুকিয়ে গেলে ছাল ছাড়াতে সমস্যা হয়।
- পাট পচন গর্তের চারদিকে উঁচু করে বেঁধে দিতে হবে যাতে বাইরের পানি গর্তের মধ্যে ঢুুকতে না পারে।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনাটির মাধ্যমে আমরা রিবন কি, রিবন রেটিং কি, কেন করা হয়, পাটের রিবন রেটিং পদ্ধতির উদ্ভাবক কে, পাটের রিবন রেটিং পদ্ধতির ধাপসমূহের বর্ণনা, পাটের রিবন রেটিং পদ্ধতির গুরুত্ব প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম।
পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। এদেশে উৎপাদিত পাটের আঁশের মান খুবই ভালো। পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না এমন এলাকায় রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানো হয়। রিবন রেটিং পদ্ধতির ধাপসমূহ হলো পাটের ছাল ছাড়ানো, ছাল পচানো, কম সময়ে ছাল পচানো, ছাল পচনের সমাপ্তি নির্ণয়, ছাল বা আঁশ ধৌতকরণ ও আঁশ শুকানো। রিবন রেটিং পদ্ধতির ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।