গাভী গরম হলে বা ডাকে আসলে ষাঁড় ছাড়া কৃত্রিম ভাবে গাভীর জরায়ুতে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ দেওয়াই কৃত্রিম প্রজনন।
গাভী গরম হলে বা ডাকে আসার বারো থেকে আঠারো ঘণ্টার মধ্য গরুর কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হয়।
গরুর কৃত্রিম প্রজনন প্রশিক্ষণ বিষয়ক এই পোষ্টটি শেষে অবধি পড়লে আপনি- কৃত্রিম প্রজনন কি, কৃত্রিম প্রজনন কাকে বলে তা বলতে পারবেন। গাভীকে বীজ দেওয়ার সঠিক সময় ও গাভীকে বীজ দেওয়া নিয়ম সম্পর্কে জানতে পারবেন। গরুর কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির সকল ধাপসমূহ বর্ণনা করতে পারবেন। কৃত্রিম প্রজননের সফলতা ও ব্যার্থতার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন। কৃত্রিম প্রজননের সুবিধা ও অসুবিধা বুঝতে পারবেন; কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গবাদি পশুর জাত উন্নয়নের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারবেন। কৃত্রিম প্রজননের উদ্দেশ্য গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন।
(১) কৃত্রিম প্রজনন কি?
কৃত্রিম প্রজনন ব্যাখ্যা করার পূর্বে প্রজনন কী তা জানতে হবে।
প্রজনন কাকে বলে: যে শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতির মাধ্যমে জীব তার বংশ রক্ষা করে এবং একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নতুন জীবের আবির্ভাব ঘটায় তাকে প্রজনন বলে।
এই প্রজনন দু’ভাবে হতে পারে। যথা-
- প্রাকৃতিক উপায়ে
- কৃত্রিম উপায়ে
প্রাকৃতিক প্রজনন কাকে বলে: ডাকে আসা বা গরম হওয়া বকনা বা গাভীকে ষাঁড় দ্বারা সরাসরি পাল দেয়াকে প্রাকৃতিক প্রজনন বলে।
- এই প্রাকৃতিক প্রজনন মাঠে-ঘাটে সকলের অগোচরে ঘটতে পারে। আবার গরম হওয়া বকনা বা গাভীর মালিক নিজে ষাঁড়ের নিকট নিয়েও এ কাজ করাতে পারেন।
- তবে প্রাকৃতিক প্রজনন প্রক্রিয়ায় গরুর জাতকে কখনও উন্নত করা যায় না। দেশী বা অনুন্নত গরুর জাতকে উন্নত করতে চাইলে অবশ্যই উন্নত ষাঁড়ের বীর্য নিয়ে কৃত্রিম প্রজনন ঘটাতে হবে।
কৃত্রিম প্রজনন কাকে বলে: কৃত্রিম উপায়ে ষাঁড় থেকে সিমেন বা বীর্য সংগ্রহ করার পর বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই বীর্য দিয়ে ডাকে আসা বকনা বা গাভীকে প্রজনন করিয়ে গর্ভবতী করার প্রক্রিয়াকেই কৃত্রিম প্রজনন বলা হয়।
- উন্নতজাতের ষাঁড়ের বীর্য সংগ্রহ করে দেশীয় অনুন্নত গাভী বা বকনাকে প্রজনন করানো হলে উন্নত ষাঁড়ের গুণাবলী বাচ্চার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এজন্যই কৃত্রিম প্রজনন খুবই প্রয়োজন।
- বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়ন্ত্রণাধীন নিজস্ব অথবা বেশ কিছু বেসরকারী বা সমবায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। এসব কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে দেশীয় গাভী বা বকনাকে কৃত্রিম প্রজনন করানো যায়। এজন্য কাঙ্খিত উন্নতজাতের ও ভালো মানের ষাঁড় নির্বাচন করতে হয়।
(২) গাভীকে বীজ দেওয়ার সঠিক সময়
গাভী গরম বা ডাকে আসার ১২ থেকে ১৮ ঘন্টার মধ্যে বীজ দিতে হবে।
বকনা বা গাভীর গরম হওয়া বা ডাকে আসার বাহ্যিক লক্ষণসমূহ হলো-
- অস্থিরতা বেড়ে যায় ও ঘন ঘন ডাকাডাকি করে।
- এক স্থানে দাঁড়িয়ে না থেকে ছটফট করতে থাকে।
- লেজ উঁচু করে রাখে ও বার বার নাড়ে।
- ঘন ঘন অল্প পরিমাণ প্রস্রাব করে।
- খেতে চায় না বা খাওয়া কমিয়ে দেয়।
- যোনিদ্বার ফুলে যায় ও লাল দেখায়।
- যোনিদ্বার দিয়ে স্বচ্ছ জেলির মতো শ্লেষ্মা বের হয় যা লেজের গোড়া ও যোনির চারিদিকে লেগে থাকে।
- অন্য গরুর উপর লাফিয়ে উঠতে যায় এবং নিজের উপর অন্য গরুকে উঠতে দেয়। নিজের পিছনে অন্য গরুকে চাটতে দেয়।
- বকনা বা গাভীর শরীরের তাপমাত্রা আগের চেয়ে বেড়ে যায়।
- দুধালো গাভীর বেলায় দুধ দেওয়া কমে যায়।
(৩) কৃত্রিম প্রজননের ধাপসমূহ
ক) ষাঁড় নির্বাচন
ষাঁড়ের যে সমস্ত গুণাবলি থাকা দরকার তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
- ষাঁড়কে অবশ্যই সুস্থ-সবল ও সতেজ হতে হবে।
- ষাঁড়কে সর্ব প্রকার রোগমুক্ত হতে হবে। এমনকি বংশগত কোন রোগ থাকলেও চলবে না।
- ষাঁড়ের মাতাকে অবশ্যই অধিক দুধ বা মাংস উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং উন্নত জাতের হতে হবে।
- ষাঁড়ের শুক্রাণু অবশ্যই উর্বর হতে হবে।
- ষাঁড়ের বয়স কমপক্ষে ২-৩ বছর হবে। তবে জাতভেদে এ বয়স কম বা বেশি হতে পারে।
- ষাঁড়ের দেহ বা গায়ের রঙ খুবই আকর্ষণীয় হতে হবে। কারণ কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বাচ্চার গায়ের রঙ ষাঁড়ের মত হয়।
- ষাঁড়ের স্বাস্থ্য মধ্যম মানের হওয়া উত্তম।
- ষাঁড়ের গায়ে বা দেহে কোনো পরজীবী থাকা চলবে না।
- ষাঁড়ের মেজাজ শান্ত প্রকৃতির হতে হবে।
- কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহারের আগে ষাঁড়কে সুষম খাদ্য ও প্রচুর পানি খাওয়াতে হয়।
- ষাঁড়কে কোনো প্রকার ভয়-ভীতি দেখানো যাবে না বা কোনো ভারবাহী কাজে ব্যবহার করা যাবে না। নিয়মিত গোসলসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় ষাঁড়কে রাখতে হবে।
- এছাড়াও ষাঁড়টি কৃত্রিম প্রজননের জন্য উপযুক্ত কিনা সেজন্য নিয়মিত পশু ডাক্তার দ্বারা পর্যবেক্ষণ করানো উচিত।
খ) বীর্য সংগ্রহ
গরুর কৃত্রিম প্রজননের জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হয়।
নিচের ৪টি পদ্ধতির মাধ্যমে বীর্য সংগ্রহ করা যায়। যথা-
- প্রাকৃতিক প্রজননের পর বকনা বা গাভীর যোনিপথ থেকে বীর্য সংগ্রহ করা যায়।
- ষাঁড়ের মলদ্বার নাড়াচাড়া করলে যৌনভাবে উত্তেজিত হয়ে বীর্যপাত ঘটায়। এ সময় বীর্য সংগ্রহ করা যায়।
- বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মাধ্যমে ষাঁড়কে যৌনভাবে উত্তেজিত করলে বীর্যপাত ঘটায়। এসময়ও বীর্য সংগ্রহ করা যায়।
- কৃত্রিম যোনি পদ্ধতি যাকে ইংরেজিতে Artificial Vagina Method বা AV পদ্ধতি বলা হয়।
AV পদ্ধতির মাধ্যমে গরুর বীর্য সংগ্রহের নিয়ম:
আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বে Artificial Vagina Method বা AV পদ্ধতি একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। কারণ এটি অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে সহজ ও কম ব্যয়সাপেক্ষ।
- এই পদ্ধতিতে কৃত্রিম যোনি তৈরি করতে নির্দিষ্ট মাপের একটি শক্ত রাবারের নলের মধ্যে একটি পাতলা রাবারের নল ঢুকাতে হয়। নল দুটোকে এমনভাবে সেট করতে হয় যাতে দুনলের মধ্যবর্তী জায়গায় পানি দিলে তা বের হতে না পারে।
- এরপর নলের একপ্রান্তে রাবারের পাতলা টিউব লাগিয়ে অপরপ্রান্তে কাঁচের টিউব লাগাতে হয়।
- এবার নল দুটোর মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থানে গরম পানি দিয়ে কৃত্রিম বা নকল যোনির তাপমাত্রা বকনা বা গাভীর যোনির তাপমাত্রার সমপর্যায়ে রাখতে হয়।
- এখন বিশেষভাবে তৈরি একটি খোয়াড় বা ট্রাভিসে একটি খোঁজাকৃত ষাঁড় গরু (যাকে ডামি নামে অভিহিত করা হয়) দাঁড় করিয়ে কাঙ্খিত ষাঁড়কে কাছে আনলে উত্তেজিত হয়ে বকনা বা গাভীর উপর উঠে ষাঁড়টি লিঙ্গ বের করবে।
- লিঙ্গ বের হবার সঙ্গে সঙ্গে কৃত্রিম যোনির ভিতর তা ঢুকিয়ে দিতে হবে। উত্তেজিত ষাঁড় এই কৃত্রিম যোনিকে গাভীর যোনি মনে করে বীর্যপাত ঘটাবে। সেই বীর্য রাবারের পাতলা নল দিয়ে কাঁচের টিউবে জমা হবে।
- বীর্যভর্তি কাঁচের টিউব কৃত্রিম যোনি থেকে খুলে রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা হয়।
গ) বীর্য পরীক্ষা
৫টি উপায়ে বীর্যের গুণাগুণ বা মান পরীক্ষা করা যায়। যথা-
i) বীর্যের আয়তন মেপে
সংগৃহীত বীর্য আয়তন মাপক নলের সাহায্যে মেপে যদি দেখা যায় যে, একটি ষাঁড় থেকে প্রতিবার গড়ে ৫-৮ সিসি বীর্য পাওয়া গিয়েছে, তবে তা উপযুক্ত পরিমাণ বলে ধরে নেয়া যাবে।
ii) বীর্যের রঙ দেখে
ভালো বীর্যের রঙ সাধারণত ক্রীমের মতো ধূসর বা হালকা ধরনের হয়। এর বাইরে হলুদ, লালচে, রক্ত মেশানো, পুঁজ বা প্রস্রাব মেশানো থাকলে সেই বীর্য ব্যবহারের অনুপযুক্ত হবে।
iii) বীর্যের ঘনত্ব দেখে
সুস্থ ও সবল ষাঁড়ের বীর্যের ঘনত্ব ক্রীমের ঘনত্বের মতো হয়ে থাকে। অপরদিকে অসুস্থ বা দূর্বল ষাঁড়ের বীর্য পানির মতো হয় যা ব্যবহারের অনুপযোগী।
iv) অনুবীক্ষণ যন্ত্রে বীর্য পরীক্ষা
বীর্য সংগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে এক ফোঁটা বীর্য স্লাইডে নিয়ে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা শুক্রাণুর নড়াচড়ার গতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। বীর্যের এই গতিকে ০-৫ গ্রেডে ভাগ করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ শুক্রাণু নড়াচড়া না করলে তার গ্রেড হবে ০ (শুন্য) যা ব্যবহারের অনুপযোগী। এই গ্রেড যত বাড়বে সেই বীর্য তত ভাল মানের হবে।
v) বীর্যের রাসায়নিক পরীক্ষা
সংগৃহীত বীর্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের সাথে কয়েক ফোঁটা মিথাইল ব্লূ মিশিয়ে ১১০- ১১৫০ সে. তাপমাত্রায় একটি টেস্ট টিউবের পানির সাথে মিশ্রিত করলে নীল রঙ ধারণ করে। যদি এই নীল রঙ ৩-৬ মিনিটের মধ্যে চলে যায় তবে তা ভালো মানের বীর্য হবে। আর তা না হলে সেই বীর্য ব্যবহারের অনুপযুক্ত বলে ধরতে হবে।
গ) বীর্য তরলীকরণ
বকনা বা গাভীর গর্ভধারণের জন্য একটি মাত্র উর্বর শুক্রাণুর প্রয়োজন হয়। কিন্তু বীর্যে অসংখ্য শুক্রাণু থাকে এবং অত্যন্ত ঘন থাকে। ঘন বীর্য কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহার করলে অপচয় হয়। কারণ কৃত্রিম প্রজননে এই ঘন বীর্যকে পাতলা বা তরল করে অনেক বেশি বকনা বা গাভীকে প্রজনন করানো সম্ভব হয়।
কুসুম-সাইট্রেট দ্রবণের মাধ্যম বীর্যকে তরল করা হয়।
- প্রথমে ২-৯ গ্রাম সোডিয়াম সাইট্রেট ও ১০০ মিলিলিটার পাতিত (distilled) পানি একসাথে মিশিয়ে সাইট্রেট সলিউশন তৈরি করা হয়। পরে ২ ভাগ সাইট্রেট সলিউশনের সাথে ১ ভাগ ডিমের কুসুম মিশিয়ে কুসুমসাইট্রেট দ্রবণ তৈরি করা হয়।
- পরে এই কুসুম সাইট্রেট দ্রবণের সাথে বীর্য মিশিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী তরল করে নিতে হয়।
উল্লেখ্য এসব ডাইলুয়েন্ট বা তরীলকারক শুক্রাণুর জন্য পুষ্টি জোগান দিয়ে থাকে।
ঙ) বীর্য সংরক্ষণ
সংগৃহীত বীর্যকে তরল করার পর সংরক্ষণ করে প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা হয়।
তরল বীর্যকে সধারণত ২ ভাবে সংরক্ষণ করা হয়। যথা-
i) স্বল্প সময়ের জন্য রেফ্রিজারেটর বা বরফযুক্ত থার্মোফ্লাক্সে বীর্য সংরক্ষণ
তরলীকৃত বীর্যকে টেস্ট টিউবে রেখে রেফ্রিজারেটরে ৩-৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ২-৩ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায়। কিন্তু যখন দূর দূরান্তে বীর্য নেয়ার প্রয়োজন হয়, সে সময় রেফ্রিজারেট থেকে বীর্য বের করে দূরে কোথাও নেয়ার পথে বাইরের তাপমাত্রায় উক্ত বীর্য নষ্ট হয়ে যায়। কারণ ঐ তাপমাত্রা বীর্য সহ্য করতে পারে না। এজন্য থার্মোফ্লাক্সের ভেতর বরফ দিয়ে তার মধ্যে বীর্য ভর্তি ঐসব টেস্টটিউব রেখে পরিবহণ করলে কোনো সমস্যা হয় না। এভাবে বীর্য ৩ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে। এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত বীর্যকে তরল বীর্য বলা হয়।
ii) দীর্ঘ সময়ের জন্য তরল নাইট্রোজেন ভর্তি সিমেন ক্যানে বীর্য সংরক্ষণ
- এটি হলো বীর্য সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে তরলীকৃত বীর্য ছোট ছোট নল বা স্ট্রতে ভরে তরল নাইট্রোজেন ভর্তি সিমেন ক্যানের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে সংরক্ষণ করা হয়। এরূপ প্রতিটি নলে প্রতি মাত্রা বীর্যে ২০-৩০ মিলিয়ন শুক্রাণু থাকে।
- তরল নাইট্রোজেনে -১৯৬ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় বীর্যকে ২৫ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব। বীর্যের কার্যক্ষমতা ভালো রাখার স্বার্থে বীর্য ভর্তি নল বা স্ট্র সার্বক্ষণিক তরল নাইট্রোজেনের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে হয়। এজন্য সিমেন ক্যানে তরল নাইট্রোজেনের পরিমাণ অবশ্যই ১০ সে.মি. বা তার চেয়ে বেশি রাখা উত্তম।
- সাধারণত ২ লিটার মাপের একটি সিমেন ক্যান প্রতি ৪-৫ দিন পর পর তরল নাইট্রোজেন দ্বারা ভরতে হয়। এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত বীর্যকে হিমায়িত বীর্য বলা হয়।
চ) বকনা বা গাভীতে বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি
i) তরল বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি
- রেফ্রিজারেট বা থার্মোফ্লাক্সে রাখা টিউব হতে ১ মি.লি. বীর্য নিডলের সাহায্যে সিরিঞ্জের মধ্যে ভরতে হবে।
- এই সিরিঞ্জের সঙ্গে এ.আই. টিউব লাগানোর পর টিউবটিতে গ্লিসারিন মাখিয়ে পিচ্ছিল করে নিতে হবে।
- এরপর বাম হাতে গ্লোবস পরে সেই হাত গরম হওয়া বকনা বা গাভীর মলদ্বার দিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে জরায়ু ধরতে হবে।
- ডান হাত দিয়ে সিরিঞ্জ ধরে টিউবটি বকনা বা গাভীর যোনিতে প্রবেশ করাতে হবে যাতে টিউবের প্রান্তটি বাম হাত দ্বারা ধরা যায়। তবে টিউবটি যেন জরায়ুতে প্রবেশ না করে।
- এখন সিরিঞ্জের পিস্টন ডান হাত দ্বারা ঠেলা দিলেই বকনা বা গাভীর জরায়ুতে বীর্য প্রবেশ করবে এবং কৃত্রিম প্রজনন কার্যটি সম্পন্ন হবে।
ii) হিমায়িত বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি
সিমেন ক্যান থেকে চিমটার সাহায্যে একটি করে বীর্য ভর্তি নল বা স্ট্র উঠিয়ে তা দ্রুত ৩৪-৩৮ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত থার্মোফ্লাক্সের পানিতে রাখতে হয়। একে স্ট্র-থয়িং (Thawing) বলে। এবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই বীর্য ব্যবহার করতে হবে।
- বীর্য ভর্তি নলের কটন প্লাগ প্রান্ত নিচের দিকে রেখে খাড়া অবস্থায় উপরের বায়ুশুন্য অংশের সীল কাঁচি দ্বারা সমান করে কেটে নিতে হবে।
- এরপর এ.আই. গানের পিস্টন বের করে বীর্য ভর্তি নলে এমনভাবে ঢুকাতে হবে যাতে কটন প্লাগ প্রান্ত নিচের দিকেই থাকে।
- জীবাণুমুক্ত একটি এ.আই. সিথের ভিতর এ.আই. গান ঢুকিয়ে প্লাস্টিক রিং বা অন্য কোনো লকিং ডিভাইস দ্বারা শক্ত করে আটকাতে হবে।
- এ.আই. সিথ লাগানোর সময় বীর্য ভর্তি নলের কাটা প্রান্ত ও কটন প্লাগ প্রান্তের মধ্যে কোনো ফাঁক রাখা যাবে না।
- এরপর গরম হওয়া বকনা বা গাভীকে একটি খোয়াড়ে আটকাতে হবে।
- আটকানোর পর বকনা বা গাভীর যোনিদ্বারের চারপাশ পরিষ্কার করতে হবে।
- এরপর বাম হাতে গ্লোবস পরে তাতে তরল প্যারাফিন লাগিয়ে পিচ্ছিল করে নিতে হবে। এই গ্লোবস পরা বাম হাত বকনা বা গাভীর মলদ্বারে ঢুকিয়ে জরায়ু ধরতে হবে।
- ডান হাত দ্বারা এ.আই. গানটি বকনা বা গাভীর যোনিতে এমনভাবে ঢুকাতে হবে যেন বাম হাত দ্বারা তা বুঝা যায়।
- এরপর আস্তে আস্তে ডান হাত দ্বারা পিস্টনে চাপ দিয়ে বকনা বা গাভীর জরায়ুতে বীর্য প্রবেশ করানো হয়।
এভাবেই হিমায়িত বীর্য দ্বারা কৃত্রিম প্রজননের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
উল্লেখ্য বীর্য প্রয়োগের সময় ব্যবহৃত সকল উপকরণ জীবাণুনাশক দ্বারা জীবানুমুক্ত করে নিতে হয়।
(৪) কৃত্রিম প্রজননের সফলতার কারণ
- কাঙ্খিত বা উর্বর ষাঁড় থেকে সঠিক পদ্ধতিতে বীর্য সংগ্রহ করা।
- পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বীর্যের গুণগতমান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।
- সঠিক উপায়ে বীর্য সংরক্ষণ করা।
- সাবধানতার সাথে ও সঠিক উপায়ে বীর্য পরিবহন করা।
- প্রজনন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও তার চারিদিকের পরিবেশ দূষণমুক্ত হওয়া।
- কৃত্রিম প্রজননকারীর অভিজ্ঞ ও দক্ষ হওয়া।
- বকনা বা গাভীর প্রজননের আগে গরম হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া।
- বকনা বা গাভীর গরম হওয়ার ১২-১৮ ঘন্টার মধ্যে প্রজনন করানো।
- অনিয়মিত গরম হওয়া বকনা বা গাভীকে চিকিৎসা করে প্রজনন করানো।
- কৃত্রিম প্রজননের পূর্বে বা পরে বকনা বা গাভীকে বিশ্রামে রাখা।
- বকনা বা গাভীর যৌনাঙ্গে কোনো সংক্রামক বা যৌন রোগ না থাকা।
(৫) কৃত্রিম প্রজননে ব্যার্থতার কারণ
- রোগাক্রান্ত, অসুস্থ বা দূর্বল ও অনুর্বর ষাঁড় থেকে বীর্য সংগ্রহ করা।
- বীর্যের গুণগতমান সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া।
- সঠিক উপায়ে বীর্য সংরক্ষণ না করা।
- সাবধানতার সাথে ও সঠিক উপায়ে বীর্য পরিবহণ না করা।
- সিমেন ক্যানে নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া।
- ত্রুটিপূর্ণভাবে সিমেন স্ট্র থয়িং করা।
- প্রজনন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও তার চারিদিকে পরিবেশ দূষিত হওয়া।
- কৃত্রিম প্রজননকারীর অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ হওয়া।
- বকনা বা গাভীর প্রজননের আগে গরম হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া।
- বকনা বা গাভীর গরম হওয়ার ১২-১৮ ঘন্টার মধ্যে অর্থাৎ সঠিক সময়ে প্রজনন না করানো।
- প্রজনন অঙ্গের ভেতর ভুল স্থানে শুক্রাণু স্থাপন।
- অনিয়মিত গরম হওয়া বকনা বা গাভীকে চিকিৎসা না করে প্রজনন করানো।
- কৃত্রিম প্রজননের পূর্বে বা পরে বকনা বা গাভীকে বিশ্রাম না দেয়া।
- বকনা বা গাভীর যৌনাঙ্গে কোনো সংক্রামক বা যৌন রোগ থাকা।
(৬) কৃত্রিম প্রজননের সুবিধা
- অনুন্নত দেশীয় জাতের প্রাণির/গরুর উন্নয়ন ঘটানো যায়।
- কোনো ষাঁড় থেকে একবার সংগ্রহ করা বীর্য দ্বারা ১০০-৪০০ বকনা বা গাভীকে প্রজনন করানো যায়।
- উন্নত জাতের বা কাঙ্খিত ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার করা যায়।
- উন্নত জাতের বা কাঙ্খিত ষাঁড়ের বীর্য দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা যায।
- উন্নত জাতের ষাঁড় সঙ্গমে অক্ষম হলেও বীর্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা যায়।
- বকনা বা গাভীর গর্ভধারণের হার বেশি হয়।
- কাঙ্খিত ষাঁড়ের বীর্য দিয়ে দেশ এবং দেশের বাইরের যে কোনো স্থানে বকনা বা গাভীর প্রজনন করানো সম্ভব হয়। ৮। প্রাকৃতিক প্রজনন অপছন্দকারী বা ষাঁড়ের সংস্পর্শে শুয়ে পড়া বকনা বা গাভীকে এ পদ্ধতিতে প্রজনন করা সহজ।
- গবাদি পশুর বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে হাইব্রিড বা সংকরজাত তৈরি করা যায়।
- ষাঁড়ের বীর্য ও বকনা বা গাভীর যোনি পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা করা সম্ভব হয় ইত্যাদি।
(৭) কৃত্রিম প্রজননের অসুবিধা
- প্রজননকারীকে অভিজ্ঞ ও দক্ষ হতে হয়।
- সুনির্দিষ্ট যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়।
- ত্রুটিযুক্ত বীর্য দ্বারা প্রজনন করালে সফলতা আসে না।
- সঠিক পদ্ধতিতে প্রজনন না হলে গর্ভধারণের হার কমে যায়।
- কাঙ্খিত জাতের ষাঁড়ের বীর্য না হলে আশা বিফলে যায়।
- সঠিক উপায়ে বীর্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না করতে পারলে বীর্য নষ্ট হয়ে যায়।
- নীরব গরম হওয়া বকনা বা গাভীকে শনাক্ত করা কঠিন হয় বলে প্রজনন কার্য ব্যহত হয়।
- সঠিক সময়ের মধ্যে গরম বকনা বা গাভীকে প্রজনন করাতে ব্যার্থ হলে গর্ভধারণ করানো যায় না।
- প্রজননকারীর অদক্ষতার কারণে প্রজনন কার্য ব্যহত হয়।
- প্রতিকূল আবহাওয়ায় বীর্য সংরক্ষণ ও পরিবহণে অসুবিধা হয় ইত্যাদি।
(৮) কৃত্রিম প্রজননের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
- অনুন্নত গরুর জাতকে উন্নত জাতে রূপান্তরিত করা যায়।
- উন্নত জাতে রূপান্তরিত করায় দুধ ও মাংসের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়।
- গবাদিপশুর প্রজনন সংকট প্রতিরোধ করা যায়।
- বকনা বা গাভীর গর্ভধারণের হার বেশি হয়।
- কাঙ্খিত জাতের হাইব্রিড বা সংকর বাচ্চা উৎপাদন করা যায়।
- গবাদিপশুর বিভিন্ন ধরনের যৌন রোগ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায়।
- কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমে অনেক বেকার লোকের কর্মসংস্থান হয়।
- বছরে একটি ষাঁড় থেকে সংগৃহীত বীর্য দ্বারা ১০,০০০ টি বকনা বা গাভীকে প্রজনন করানো যায়।
- কৃত্রিম প্রজনন সফল হওয়ায় কৃষকের ঘরে ঘরে উন্নত জাতের ষাঁড় পালনের প্রয়োজন পড়ে না।
- কাঙ্খিত উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ সংরক্ষণ করে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় ইত্যাদি।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা কৃত্রিম প্রজনন কি? গাভীকে বীজ দেওয়ার সঠিক সময়, কৃত্রিম প্রজননের ধাপসমূহ, কৃত্রিম প্রজননের সফলতার কারণ, কৃত্রিম প্রজননে ব্যার্থতার কারণ, কৃত্রিম প্রজননের সুবিধা, কৃত্রিম প্রজননের অসুবিধা, কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্ব প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারলাম।
যে শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় জীব তার বংশ রক্ষা করে তাকে প্রজনন বলা হয়। এই প্রজনন দু’ভাবে হতে পারে যথাপ্রাকৃতিক ও কৃত্রিম প্রজনন। কৃত্রিম উপায়ে ষাড় থেকে বীর্য সংগ্রহ করার পর উন্নত উপায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই বীর্য দিয়ে ডাকে আসা বকনা বা গাভীকে প্রজনন করিয়ে গর্ভবতী করার প্রক্রিয়াটিকেই কৃত্রিম প্রজনন বলা হয়।
বাংলাদেশে অনেক কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। এসব কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে ডাকে আসা দেশীয় অনুন্নত বকনা বা গাভীকে উন্নত ষাড়ের বীর্য দিয়ে কৃত্রিম প্রজনন করা হয়। অনুন্নত গরুর জাতকে উন্নত জাতে রূপান্তরিত করার জন্য কৃত্রিম প্রজনন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।