মাঠ ফসল অন্যান্য ফসলের চেয়ে এর গুরুত্ব সর্বাধিক। চাষযোগ্য জমির অধিকাংশ ব্যবহৃত হয় মাঠ ফসল উৎপাদনের জন্য। মাঠ ফসল ধান, গম, পাট, আখ, সরিষা, ছোলা, ভুট্টা, মুসর, খেসারী, চীনা, কাউন ইত্যাদি।
বাংলাদেশে মাঠ ফসলের সমগ্র চাষযোগ্য জমির শতকরা ৮০ ভাগই দানাজাতীয় ফসলের চাষ হয়ে থাকে। এসব মাঠ ফসলের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এই পোষ্টটিতে দানা জাতীয় প্রধান মাঠ ফসল উন্নত ধানের জাত সমূহ ও ধানের চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ধান বাংলাদেশের প্রধান দানাজাতীয় ফসল এবং প্রধান খাদ্য। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। বিশ্বের প্রধান প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশ হলো চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ। বিশ্বের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯২ শতাংশ ধান এশিয়ার এ দেশগুলোতে উৎপন্ন হয়।
এ পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- ধান উৎপাদন মৌসুম সম্পর্কে জানতে পারবেন; মৌসুম ভেদে ধানের বিভিন্ন জাতের নাম জানতে পারবেন; ধানের বিভিন্ন জাতের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা জানতে পারবেন; আধুনিক ধানের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন; ধান লাগানোর সময় সম্পর্কে জানতে পারবেন; বীজতলায় চারা তৈরি ও পরিচর্যা সম্পর্কে জানতে পারবেন; ধান রোপনের কৌশল, ধান চাষে পানি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন; ধান কর্তন, মাড়াই ও সংরক্ষণ সম্পর্কে জানতে পারবেন।
(১) ধান চাষের মৌসুম
গ্রীষ্মকালে আউশ, বর্ষাকালে আমন ও শীতকালে বোরো ধানের চারা লাগানো হয় এবং যথাক্রমে বর্ষার শুরুতে, শীতের শুরুতে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে ফসল কাটা হয়।
বাংলাদেশের মাটি, আবহাওয়া, জলবায়ু সব কিছুই ধান চাষের উপযোগী। চাষাবাদের মৌসুম অনুযায়ী ধানের চাষ তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-
- আউশ ধান (Aus rice): খরিপ ১ মৌসুমে এ ধান মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত চাষ করা হয়।
- আমন ধান (Aman rice): খরিপ ২ মৌসুমে জুন থেকে ডিসেম্বর মাসে পর্যন্ত চাষ করা হয়।
- বোরো ধান (Boro rice): রবি মৌসুমে নভেম্বর থেকে মে মাসে এ ধান চাষ করা হয়।
বাংলাদেশের মোট ধানী জমির শতকরা প্রায় ১১ ভাগ জমিতে আউশ, ৪১ ভাগ জমিতে বোরো ও ৪৮ ভাগ জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। উৎপাদন হয় বোরোতে শতকরা প্রায় ৪৮ ভাগ, আমান ৪২ ভাগ ও আউশে ১০ ভাগ। বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদনশীলতা বেশি।
(২) উন্নত ধানের জাত সমূহ
বাংলাদেশে প্রধানত দু’জাতের ধান দেখা যায়। যথা-
- স্থানীয় জাত এবং
- উন্নত/উচ্চ ফলনশীল জাত/উফশী জাত।
ক) ধানের স্থানীয় জাত
ধানের স্থানীয় জাতের বৈশিষ্ট্য হলো-
- এ জাত সাধারণত নির্দিষ্ট এলাকায় চাষ করা হয়।
- ধান গাছ লম্বা হয় তাই হেলে পড়ে।
- পাতা লম্বাটে, হেলে পড়ে।
- কান্ড নরম এবং কুশির সংখ্যা কম।
- রোগ ও পোকা মাকড় আক্রমনের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
- এ জাতের ফলন কম, হেক্টর প্রতি ১.৫-২.৫ টন।
- জীবনকাল বেশি।
- মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করার ক্ষমতা কম।
ধানের স্থানীয় জাতের উদাহরণ হলো-
- আউশ মৌসুমে: কটকতারা, হাসিকলমি, ধারিয়াল ইত্যাদি।
- আমন মৌসুমে: হরিনমুদা, লাল মোটা, সাদা মোটা, কালিজিরা বোরো মৌসুমে: দুধসর, বাজাইল, হবিগঞ্জ ইত্যাদি।
খ) উন্নত ধানের জাত
ধানের উন্নত/উচ্চ ফলনশীল/উফশী জাত সমূহের বৈশিষ্ট্য হলো-
- গাছ শক্ত ও খাটো হয় ফলে সহজে হেলে পড়ে না।
- পাতা সরু, খাটো ও খাড়া হয়।
- মাটি থেকে বেশি পরিমানে পুষ্টি উপাদান গ্রহন করতে পারে।
- ধান পাকার পরও পাতা সবুজ থাকে।
- উফশী ধানে রোগ ও পোকার আক্রমন কম হয়।
- কুশির সংখ্যা বেশি ফলে ফলনও বেশি।
- জাত বিশেষে বছরের যে কোন সময় চাষ করা যায়।
- ফলন অনেক বেশি; মৌসুম ভেদে হেক্টর প্রতি ফলন ৩.৫-৮ টন।
বাংলাদেশে মোট ৮১টি উফশী জাত রয়েছে যার মধ্যে ৭৫টি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট এবং ১৬টি বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে।
নিচের তালিকাতে এ সকল উন্নত জাতগুলির নাম, জন্মানোর মৌসুম, গড় জীবনকাল, গড় ফলন এবং চালের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো।
ধানের উন্নত/উচ্চ ফলনশীল/উফশী জাত সমূহের উদাহরণ হলো-
জাত | মৌসুম | জীবনকাল | চালের বৈশিষ্ট্য | ধানের গড় ফলন (টন/হেক্টর) |
বি আর ১ (চান্দিনা) | বোরো,আউস | ১৫০, ১২০ | খাটো, মোটা | ৫.৫, ৪.০ |
বি আর ২ (মালা) | বোরো, আউস | ১৬০, ১২৫ | মাঝারী চিকন ও সাদা | ৫.০, ৪.০ |
বি আর ৩ (বিপ্লব) | বোরো,আউস,আমন | ১৭০, ১৩০, ১৪৫ | মাঝারী চিকন ও পেটে সাদা দাগ আছে | ৬.৫, ৪.০, ৪.০ |
বি আর ৪ (ব্রিশাইল) | আমন | ১৪৫ | মাঝারী মোট ও সাদা | ৫.০ |
বি আর ৫ (দুলাভোগ) | আমন | ১৫০ | ছোট, গোলাকৃতি ও সুগন্ধি | ৩.০ |
বি আর ৬ | বোরো, আউস | ১৪০, ১১০ | লম্বা , চিকন ও সাদা | ৪.৫, ৩.৫ |
বি আর ৭ (ব্রিবালাম) | বোরো, আউস | ১৫৫, ১৩০ | লম্বা , চিকন | ৪.৫, ৪.৫ |
ব আর ৮ (আশা) | বোরো, আউস | ১৬০, ১২৫ | মাঝারী মোটা ও পেটে দাগ আছে | ৬.০, ৫.০ |
বি আর ৯ (সুফলা) | বোরো,আউস | ১৫৫, ১২০ | লম্বা, মাঝারী মোটা ও সাদ | ৬.০, ৫.০ |
বি আর ১০ (প্রগতি) | আমন | ১৫০ | মাঝারী চিকন | ৬.৫ |
বি আর ১১ (মুক্তা) | আমন | ১৪৫ | মাঝারী মোটা | ৬.৫ |
বি আর ১২ (ময়না) | বোরো, আউস | ১৭০, ১৩০ | মাঝারী মোটা ও সাদ | ৫.৫, ৪.৫ |
বি আর ১৪ (গাজী) | বোরো, আউস | ১৬০, ১২০ | মাঝারী মোটা ও সাদ | ৬.০, ৫.০ |
বি আর ১৫ (মোহিনী) | বোরো, আউস | ১৬৫, ১২৫ | মাঝারী চিকন ও সাদা | ৫.৫, ৫.০ |
বিআর ১৬ (শাহীবালাম) | বোরো, আউস | ১৬৫, ১৩০ | লম্বা, চিকন ও সাদা | ৬.০, ৫.০ |
বি আর ১৭ (হাসি) | বোরো | ১৫৫ | মাঝারী মোটা | ৬.০ |
বিআর ১৮ (শাহজালাল) | বোরো | ১৭০ | মাঝারী মোটা ও সাদা | ৬.০ |
বি আর ১৯ (মঙ্গল) | বোরো | ১৭০ | মাঝারী মোটা | ৬.০ |
বি আর ২০ (নিজামী) | আউস | ১১৫ | মাঝারী মোটা ও স্বচ্ছ | ৩.৫ |
বি আর ২১ (নিয়ামত) | আউস | ১১০ | মাঝারী মোটা ও স্বচ্ছ | ৩.০ |
বি আর ২২ (কিরণ) | আমন | ১২৫ | খাটো, মোটা ও সাদা | ৫.০ |
বি আর ২৩ (দিশারী) | আমন | ১২৫ | লম্বা, চিকন ওসাদা | ৫.৫ |
বি আর ২৪ (রহমত) | আউস | ১০৫ | লম্বা, চিকন ওসাদা | ৩.৫ |
বিআর ২৫ (নয়াপাজাম) | আমন | ১৩৫ | খাটো, মোটা ও সাদা | ৪.৫ |
বি আর ২৬ (শ্রাবণী) | আউস | ১১৫ | চিকন, লম্বা ও সাদা | ৪.০ |
ব্রি ধান ২৭ | আউস | ১১৫ | মাঝারী মোটা | ৪.০ |
ব্রি ধান ২৮ | বোরো | ১৪০ | মাঝারী চিকন ও সাদা | ৫.০ |
ব্রি ধান ২৯ | বোরো | ১৬৫ | মাঝারী চিকন ও সাদা | ৭.৫ |
ব্রি ধান ৩০ | আমন | ১৪৫ | মাঝারী চিকন ও সাদা | ৫.০ |
ব্রি ধান ৩১ | আমন | ১৪০ | মাঝারী মোটা ও সাদা | ৫.০ |
ব্রি ধান ৩২ | আমন | ১৩০ | মাঝারী মোটা ও সাদা | ৫.০ |
ব্রি ধান ৩৩ | আমন | ১১৮ | খাটো মোটা ও পেটে দাগ আছে। | ৪.৫ |
ব্রি ধান ৩৪ | আমন | ১৩৫ | খাটো, মোটা ও সুগন্ধি | ৩.৫ |
ব্রি ধান ৩৫ | বোরো | ১৫৫ | খাটো, মোটা | ৫.০ |
ব্রি ধান ৩৬ | বোরো | ১৪০ | লম্বা,চিকন | ৫.০ |
ব্রি ধান ৩৭ | আমন | ১৪০ | মাঝারী চিকন, সুগন্ধি | ৩.৫ |
ব্রি ধান ৩৮ | আমন | ১৪০ | লম্বা,চিকন , সুগন্ধি | ৩.৫ |
ব্রি ধান ৩৯ | আমন | ১২২ | লম্ব, চিকন | ৪.৫ |
ব্রি ধান ৪০ | আমন | ১৪৫ | মাঝারী মোটা | ৪.৫ |
ব্রি ধান ৪১ | আমন | ১৪৮ | লম্বাটে মোট, স্বচ্ছ ও সাদা | ৪.৫ |
ব্রি ধান ৪২ | আউস | ১০০ | মাঝারী , সাদা | ৩.৫ |
ব্রি ধান ৪৩ | আউস | ১০০ | মাঝারী মোটা সাদা | ৩.৫ |
ব্রি ধান ৪৪ | আমন | ১৪৫ | মোটা | ৬.৫ |
ব্রি ধান ৪৫ | বোরো | ১৪৫ | মাঝারী মোট ও সাদা | ৬.৫ |
ব্রি ধান ৪৬ | আমন | ১২৪ | মাঝারী মোটা | ৪.৭ |
ব্রি ধান ৪৭ | বোরো | ১৫০ | মাঝারী মোটা | ৬.১ |
ব্রি ধান ৪৮ | আউস | ১১০ | মাঝারী মোটা | ৫.৫ |
ব্রি ধান ৪৯ | আমন | ১৩৫ | মাঝারী চিকন | ৫.৫ |
ব্রি ধান ৫০ (বাংলামতি) | বোরো | ১৫৫ | মাঝারী চিকন | ৫.৫ |
ব্রি ধান ৫১ | আমন | ১৪২ | মাঝারী চিকন | ৪.৫ |
ব্রি ধান ৫২ | আমন | ১৪৫ | মাঝারী মোটা | ৪.৫ |
ব্রি হাইব্রিড ধান ১ | বোরো | ১৫৫ | মাঝারী চিকন স্বচছ ও সাদা | ৮.৫ |
ব্রি হাইব্রিড ধান ২ | বোরো | ১৪৫ | মাঝারী মোটা ও আগাম | ৮.০ |
ব্রি হাইব্রিড ধান ৩ | বোরো | ১৪৫ | মাঝারী চিকন স্বচছ ও সাদা | ৯.০ |
ব্রি হাইব্রিড ধান ৪ | আমন | ১১৮ | মাঝারী চিকন স্বচছ ও সাদা | ৬.৫ |
(৩) ধানের চাষ পদ্ধতি
বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে ধানের চাষ করা হয়। এর মধ্যে ধানের জমি শতকরা ১১ ভাগ আউশ, ৪৮ ভাগ আমন ও ৪১ ভাগ বোরো ধান চাষ করা হয়। কিন্তু উৎপাদনের দিক থেকে বোরো শতকরা ৪৮ ভাগ, আমন ৪২ ভাগ ও আউশ ১০ ভাগ। বোরো মৌসুমে ধান চাষ হয় সবচেয়ে বেশি এবং আউশে সবচেয়ে কম। তিন মৌসুমে ধান চাষ প্রায় একই রকম। নিম্নে ধান চাষের আধুনিক পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো।
ক) ধান চাষের জলবায়ু
ব্যাপক ও বিস্তৃত জলবায়ুতে ধান চাষ করা যায়। ধান চাষের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ২০-৩৫° সে.। এর মধ্যে বীজ অংকুরোদগমের জন্য ৩০-৩৫° সেন্টিগ্রেড। অঙ্গজ বৃদ্ধির জন্য ২৫-৩১° সে. পুস্পায়নের জন্য ৩০-৩৩° সে. এবং পরিপক্কতার জন্য ২০-২৯° তাপমাত্রা উপযোগী।
বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭৫-৯৫%। মাঝারি বৃষ্টিপাত ও উজ্জ্বল সূর্যালোক ধান চাষের জন্য প্রয়োজন। বৃষ্টিপাত কম হলে সেচের মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ করতে হয়। আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৪০% এর কম ও ৯৫% এর বেশি হলে পুস্পায়ন ব্যহত হয়।
খ) ধান চাষের জন্য উপযুক্ত মাটি ও ভূমি বন্ধুরতা
ভারী বুনটের মাটি যার পানি ধারন ক্ষমতা বেশি এবং যে মাটি অর্ধজলাবস্থার উপযোগী তা ধান চাষের জন্য ভালো। তবে দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিও ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। মাটিতে ৪০-৬০% কর্দম কনা থাকলে ভালো হয়।
সেচ ও নিস্কাশন ব্যবস্থা থাকলে যে কোন মাটিতেই ধান চাষ করা যায়। উঁচু, মাঝারি উঁচু ও নিচু সব ধরনের জমিতেই ধান চাষ করা যায়। তবে মাঝারি উঁচু জমি উত্তম। মাটির অম্লমান ৫.০-৬.০ উত্তম।
গ) ধানের চাষের জমি নির্বাচন
আউশ ধান চাষের জন্য উঁচু, মাঝারি উঁচু ও নিচু জমি উপযোগী। মাটির বুনট পলি দোঁআশ, পলি এঁটেল ও এঁটেল হলে ভালো। মাঝারি উঁচু ও নিচু জমিতে রোপা আমন চাষ করা যায়। তবে সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে উঁচু জমিতেও রোপা আমন ধান চাষ করা যায়।
দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ ও এঁটেল মাটি আমন ধান চাষের জন্য উপযোগী। ভারী বুননের মাটি যার পানি ধারন ক্ষমতা বেশি এবং যে মাটি অর্ধ-জলাবস্থায় উপযোগী তা বোরো ধান চাষের জন্য উত্তম। মাটিতে ৪০- ৬০% কর্দম কনা থাকলে ভাল হয়। সেচের ব্যবস্থা থাকলে উঁচু, মাঝারি উঁচু এবং নিচু যে কোন জমিতেই বোরো ধান চাষ করা যায়। মাটির অম্লমান (pH) ৫.০ হতে ৬.০ হলে ভাল।
ঘ) চাষের জন্য ধানের জাত নির্বাচন
ভূমির প্রকার, কৃষি পরিবেশিক অবস্থা এবং রোপনের সময়ের উপর ভিত্তি করে ধানের জাত নির্বাচন করতে হয়। যেমন-
- রোপা আউশ ধান চাষের জন্য বিআর ২৬ (শ্রাবনী) ও ব্রিধান ৪৮ এবং অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে ব্রিধান ২৭ নির্বাচন করতে হয়।
- বোনা আউশ ধান বৃষ্টিবহুল এলাকার জন্য বিআর ২১ (নিয়ামত), বিআর ২৪ (রহমত) ও ব্রিধান ২৭ এবং খরাপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রিধান ৪২ এবং ব্রিধান ৪৩ নির্বাচন করতে হয়।
- নিচু জমির জন্য জলমগ্নতা সহনশীল জাত যেমন ব্রিধান ৫১, ব্রিধান ৫২, বৃষ্টি নির্ভর রোপা আমনের জন্য খরাসহিষ্ণু জাত যেমন ব্রিধান ৫৫; নাবী আমনের জন্য বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রিধান ৪৬; লবনাক্ততা সহনশীল জাত ব্রিধান ৪০, ব্রিধান ৪১, ব্রিধান ৫৩, ব্রিধান ৫৫; সুগন্ধি চালের জন্য বিআর ৫, ব্রিধান ৩৪, ব্রিধান ৫০ ইত্যাদি।
- আগাম বোরো ধানের জাত শীতসহিষ্ণু হলে ভালো যেমন ব্রিধান ৩৬; হাওড় অঞ্চলের জন্য বিআর ১৭, বিআর ১৮, বিআর ১৯ ভালো; লবনাক্ততা সহিষ্ণুজাত যেমন ব্রি-ধান ৫৫, ব্রিধান ৬১, ব্রিধান ৬৭, বিনাধান ৮, বিনাধান ১০, বিনাধান ১১, বিনাধান ১২, বিনাধান ১৩, বিনাধান ১৪ ও বিনাধান ১৫। এছাড়া বিশেষ পুষ্টিগুন সম্পন্ন জাত যেমন জিংক সমৃদ্ধ জাত ব্রিধান ৬২, ব্রিধান ৬৩, উচ্চমাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ জাত ব্রিধান ৬৬।
ঙ) ধানের বীজতলা তৈরির নিয়ম
ধানের বীজতলা তৈরির কিছু সাধারন নিয়ম হলো-
- দোআঁশ ও এঁটেল মাটি যেখানে প্রচুর আলো বাতাস আছে এমন জমি বীজতলার জন্য উপযোগী।
- বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন। তবে অনুর্বর জমি হলে প্রতি বর্গমিটার ২ কেজি হারে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। এর পর জমিতে ৫- ৬ সে.মি. পানি দিয়ে দু-তিনটি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন পানি বদ্ধ অবস্থায় রেখে দিতে হবে। জমিতে ব্যবহৃত জৈব সার পচে গেলে পুনরায় চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে।
- একটি আদর্শ বীজতলায় ৪টি বেড থাকবে। প্রতিটি জমির দৈর্ঘ্য বরাবর এক মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে এবং দু-বেডের মাঝে ২৫-৩০ সে.মি. ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে।
- বেডের উপরের মাটি কাঠ বা বাঁশ দিয়ে সমান করে নিতে হয়। বেডের মধ্যবর্তী নালা সেচ ও নিস্কাশন এবং চারার পরিচর্যার জন্য ব্যবহৃত হয়।
মৌসুম ভেদে ধানের চারা উৎপাদনের জন্য চার ধরনের বীজতলা তৈরি করা যায়। যেমন-
- শুকনো বীজতলা
- কাদাময় বীজতলা
- ভাসমান বীজতলা ও
- ডাপোগ বীজতলা।
i) শুকনো বীজতলা
- মাটির উপযুক্ত আর্দ্রতা অর্থাৎ জো অবস্থায় ৫-৬ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করা হয়। এরপর জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১ মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হয়।
- দু-বেডের মাঝে ২৫-৩০ সে.মি. চওড়া জায়গার মাটি বেডের উপর উঠিয়ে দিতে হবে। এতে প্রতিটি বেড ১৫ সে.মি. উচু হবে এবং মাঝের ফাঁকা জায়গাটি নালার আকার ধারন করবে। এই নালা পরবর্তীতে সেচ ও নিস্কাশন এবং বীজতলার পরিচর্যার কাজে লাগবে।
- এরপর মাটি ভালভাবে সমান করে শুকনো বীজ বপন করা হয়।
ii) কাদাময় বীজতলা
- উর্বর দোআঁশ ও এঁটেল দোআঁশ মাটি এ বীজতলার জন্য উত্তম।
- জমিতে দাড়ানো পানি থাকলে ভাল তা না হলে সেচের মাধ্যমে ৫-৬ সে.মি. পানি দিয়ে ২-৩ বার চাষ ও মই দিয়ে এক সপ্তাহ পানিসহ রেখে দিতে হয়। এর ফলে আগাছা ও খড় পচে যাবে। এরপর আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদাময় বীজতলা তৈরি করতে হয়।
- শুকনো বীজতলার মতো করেই বেড তৈরি করতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বীজতলায় কাদা বেশি না হয়। কাদা বেশি হলে বীজ ডুবে যাবে এবং বীজ ভালভাবে গজাবে না। এ রকম অবস্থা হলে বেড তৈরির ৩-৪ ঘন্টা পর বীজ বপন করতে হবে। এক্ষেত্রে জাগ দেয়া অংকুরিত বীজ বপন করতে হয়।
iii) ভাসমান বীজতলা
- আমন মৌসুমে বিশেষ অবস্থার মোকাবেলার জন্য ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। বন্যাজনিত কারনে বীজতলা করার জায়গা পাওয়া না গেলে ভাসমান বীজতলায় চারা উৎপন্ন করা যায়।
- বন্যাকবলিত জমি, পুকুর, ডোবা বা খালের পানির উপর বাঁশের মাচা বা কলাগাছের ভেলা তৈরি করে তার উপর ২-৩ সে.মি. উঁচু কাদার প্রলেপ দিয়ে কাদাময় বীজতলার মত ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যায়।
- এ বীজতলায় কাদাময় বীজতলার মতই অংকুরিত বীজ বুনতে হয়। বীজতলা যাতে বন্যার পানিতে ভেসে না যায় এজন্য এটি খুটির সাথে বেঁধে রাখতে হয়।
iv) ডাপোগ বীজতলা
- বন্যাকবলিত এলাকায় চারা উৎপাদনের আরেকটি কৌশল হলো ডাপোগ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পাকা অথবা কাঁচা বারান্দা, করিডোর, বাড়ির উঠান অথবা যে কোন শুকনো জায়গায় ডাপোগ বীজতলা তৈরি করা যায়।
- এ পদ্ধতিতে নির্ধারিত স্থানে চারিদিকে মাটি, ইট, কাঠ বা কলাগাছের বাকল দিয়ে ঘিরে নিতে হবে। তারপর কলাপাতা বা পলিথিন বিছিয়ে তার উপর ঘন করে অংকুরিত বীজ বপন করতে হয়।
- বীজে সঞ্চিত খাদ্যই চারার প্রাথমিক খাবার। তাই এই চারার বয়স ১৫-১৮ দিন হলেই রোপন করতে হয়।
- এ বীজতলায় মাটি থাকে না তাই ৫-৬ ঘন্টা পর পর পানি দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি পানি জমে না থাকে।
চ) বীজতলায় বীজ বপনের সময়
বোনা আউশ ধান রোপনের সময়: বোনা আউশ ধানের বীজ মধ্য মার্চ থেকে মে এর প্রথম সপ্তাহে জমিতে বপন করতে হয়। চারার বয়স ২০-২৫ দিন হলে মূল জমিতে রোপন করতে হয়।
রোপা আউশ ধান রোপনের সময়: রোপা আউশ চাষের জন্য বীজতলায় মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বীজতলায় বীজ ফেলতে হয়। চারার বয়স ২০-২৫ দিন হলে মূল জমিতে রোপন করতে হয়।
রোপা আমন ধান রোপনের সময়: রোপা আমন ধান ১৫ই জুলাই হতে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত মুল জমিতে রোপন করা হয়। কাজেই রোপন সময়ের একমাস আগে বীজতলায় বীজ বুনতে হবে যেন রোপনের সময় চারার বয়স ২৫-৩০ দিন হয়।
বোরো ধান রোপনের সময়: বোরো ধানের ক্ষেত্রে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বীজতলায় বীজ ফেলতে হয় এবং চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হরে রোপন করতে হয়।
ছ) বীজের পরিমান
বীজের পরিমান নির্ভর করে বপন অথবা রোপন দূরত্ব, বীজের আকার ও আয়তন ইত্যাদির উপর। যেমন-
- সারিতে বপনের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সে.মি. হলে বীজ প্রয়োজন ৫০-৬০ কেজি/হেক্টর।
- ডিবলিং পদ্ধতিতে বপনের ক্ষেত্রে ২৫ সে.মি. দূরে দূরে সারি ও ২০ সে.মি. দূরে দূরে বীজ বপন করলে বীজের প্রয়োজন হয় ৩০-৩৫ কেজি/হেক্টর।
- রোপা আউশের জন্য বীজতলায় চারা তৈরিতে বীজের প্রয়োজন ২০-৩০ কেজি/হেক্টর।
জ) ভালো ধান বীজ বাছাই
ভালো ফলনের জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে ভালো বীজ। বপনের জন্য সুস্থ ও পুষ্ট বীজ নির্বাচন করতে হবে। এজন্য দশ লিটার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে নিয়ে এ দ্রবনে ১০ কেজি বীজ ছেড়ে হাত দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে দিয়ে পুষ্ট বীজ নীচে জমা হবে। অপুষ্ট হাল্কা বীজ ভেসে উঠবে। ভারীগুলো ভালোভাবে পরিস্কার পানিতে ৩-৪ বার ধুয়ে নিতে হবে।
ঝ) বীজ শোধন ও জাগ দেওয়া
- বাছাইকৃত বীজ দাগমুক্ত ও পরিপুষ্ট হলে সাধারণভাবে শোধন না করলেও চলে। তবে শোধনের জন্য ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবানুমুক্ত হয়।
- বীজ শোধনের জন্য ২-৩ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে এক কেজি পরিমান বীজ ডুবিয়ে ১২ ঘন্টা রেখে দিতে হয়। এরপর বীজ পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হয়।
- আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘন্টা বা দুই দিন ও বোরো মৌসুমে ৭২ ঘন্টা বা তিন দিনের বীজের অংকুর বের হয় এবং তা বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হয়।
ঞ) বীজতলায় বীজ বপনের ঘনত্ব
- শুকনো বীজতলার জন্য প্রতি বর্গমিটার ১৫০ গ্রাম শুকনো বীজ বুনতে হয়। বীজ ছিটিয়ে বোনার পর বীজগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। শুকনো বীজতলায় শুকনো বীজ বুনতে হয়। কিন্তু অন্যগুলিতে অংকুরিত বীজ বুনতে হয়। এজন্য বীজ জাগ দেয়ার প্রয়োজন হয়। ভেজা বীজতলায় বীজ বপনের পর ৪-৫ দিন পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হয়।
- ভেজা বীজতলায় প্রতি বর্গমিটার ৮০-১০০ গ্রাম হারে বীজ বপন করতে হয়। এক বর্গমিটার বীজতলার চারা দিয়ে ২০-৩০ বর্গমিটার রোপন করা যায়।
- ডাপোগ বীজতলায় ঘন করে বীজ বুনতে হয় প্রতি বর্গমিটারে ২.৫- ৩.০ কেজি বীজ।
ট) বীজতলার পরিচর্যা
- বীজতলায় নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে এবং আগাছা দমন করতে হবে।
- চারা হলদে হলে প্রতি বর্গমিটার ৭ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
- ইউরিয়া প্রয়োগের পরও চারা সবুজ না হলে সালফারের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম হারে জিপসাম সার ছিটিয়ে দিতে হবে।
- এছাড়া বীজতলায় পোকামাকড় ও রোগবালাই এর উপদ্রব হলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঠ) ধান চাষের জমি তৈরি
- জমির জো অবস্থা থাকলে মার্চ-এপ্রিল মাসে আউশ ধানের বীজ বপন করা যায়। জমিতে প্রয়োজনমত পানি দিয়ে ২-৩টি চাষ ও মই দিয়ে জমি কাদাময় করতে হয়।
- আউশ ধানে আগাছার প্রকোপ বেশি হয় বলে প্রথম চাষের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা, খড় ইত্যাদি পচে যাবে।
- রোপা আউশের জন্য মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টি বা সেচের পানির সহায়তায় কর্দমাক্ত করে জমি প্রস্তুত করতে হয়। রোপা আমনের জন্য মধ্য জুন থেকে মধ্য আগস্ট এ সময়ের মধ্যে বৃষ্টি বা সেচের পানির সাহায্যে জমি প্রস্তুত করা হয়।
- বোরো ধানের জন্য মধ্য ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারী এ সময়ের মধ্যে সেচের পানির সাহায্যে থকথকে কর্দমাক্ত করে জমি তৈরি করতে হয়। জমি তৈরির সময় জমির উপরিভাগ ভালভাবে সমতল করতে হয় যাতে সেচের পানি সব জায়গায় পৌছে।
ড) ধানের চাষে সার ব্যবস্থাপনা
সারের মাত্রা আবহাওয়া, মাটি, ধানের জাত, জীবনকাল, ফলন দেয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। ভালো ফলনের জন্য সময়মত ও পরিমানমত সার প্রয়োগ করতে হয়।
নিচে মৌসুম ভেদে ধানের বিভিন্ন জাতের সারের ‘হেক্টর প্রতি কেজি’তে পরিমান দেয়া হলো-
(নিচে দেওয়া হেক্টর প্রতি কেজি সারের পরিমাণকে ২৪৭ ভাগ করলে, শতক প্রতি কেজির পরিমাণ পাওয়া যাবে।)
(আবার শতক প্রতি কেজি সেরর পরিমাণেকে ৩৩ দ্বার গুণ করলে, বিঘা প্রতি কেজি সারের পরিমাণ পাওয়া যাবে।)
মৌসুম | ধানের জাত | ইউরিয়া | টি.এস.পি | পটাশ | গন্ধক | দস্তা |
বোনা আউশ | বিআর ২০, বিআর ২১, বিআর ২৪, ব্রিধান ২৭ | ১৩০ | ৯০ | ৭০ | ৬০ | ১০ |
রোপা আউশ | বিআর ১, বিআর ৩, বিআর ৭, বিআর৮, বিআর ৯, বিআর ১২, বিআর ১৪, বিআর ১৫, বিআর ১৬, বিআর ২৬, ব্রিধান ২৭ | ১৩৫ হতে ১৫০ | ১০০ | ৭০ | ৬০ | ১০ |
রোপা আমন | বিআর ৩, বিআর ৪, বিআর ১০, বিআর ১১, বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রিধান ৩০, ব্রিধান ৩১ | ১৮০ | ১০০ | ৭০ | ৬০ | ১০ |
রোপা আমন | বিআর ৫, বিআর ২৫, ব্রিধান ৩২, ব্রিধান ৩৩, ব্রিধান ৩৪, ব্রিধান ৩৭, ব্রিধান ৩৮, ব্রিধান ৩৯ | ১৫০ | ১০০ | ৭০ | ৬০ | ১০ |
বোরো | বিআর ১, বিআর ৬, ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ৩৬ | ২২০ | ১২০ | ৮৫ | ৬০ | ১০ |
বোরো | বিআর ৩, বিআর ৮, বিআর ৯, বিআর১২, বিআর ১৪, বিআর ১৫, বিআর ১৬, ব্রিধান ২৯, ব্রিধান ৩৫ | ২৭০ | ১৩০ | ১২০ | ৭০ | ১০ |
বোরো | বিআর ১৭, বিআর ১৮, বিআর ১৯ | ১৩৫ | ১০০ | ৭০ | ৬০ | ১০ |
জমির উর্বরতার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা নির্ধারন করা হয়। এছাড়া জমিতে গোবর বা আর্বজনা পচা সার হেক্টর প্রতি ৮-১০ টন ব্যবহার করা হলে রাসায়নিক সারের মাত্রা প্রায় অর্ধেক নামিয়ে আনা সম্ভব।
ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সব সার জমি তৈরির সময় শেষে চাষের পূর্বে প্রয়োগ করতে হয়। গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে নাইট্রোজেনের প্রয়োজন হয় বলে ইউরিয়া সার ধাপে ধাপে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সারকে সমান তিনভাগে ভাগ করে চারা রোপনের ১০-১৫, ৩০-৩৫ ও ৪৫-৫০ দিন পর জমিতে উপরি প্রয়োগ করতে হয়।
ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় নিম্নের বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখতে হবে-
- সার দেয়ার সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা প্রয়োজন, শুকনো জমিতে অথবা অতিরিক্ত পানি থাকলে সার প্রয়োগ করা ঠিক নয়।
- সারের উপরি প্রয়োগের পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার করলে অথবা হাত দিয়ে মিশিয়ে দিলে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
- শেষ কিস্তির সার ধানের কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে প্রয়োগ করা উচিত।
- ইউরিয়া সারের প্রভাব পরবতীর্ ফসলে থাকে না বলে প্রত্যেক ফসলেই মাত্রানুযায়ী ইউরিয়া ব্যবহার করতে হবে।
- ইউরিয়া প্রয়োগের পরও ধান গাছ যদি হলদে দেখায় তবে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। এ অবস্থায় জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ঠ) ধানের চারা উঠানোর নিয়ম
- চারা উঠানোর পূর্বে বীজতলায় বেশি করে পানি দিয়ে মাটি নরম করে নিতে হবে। খুব যত্ন সহকারে চারা তুলতে হবে যাতে শিকড় ও কান্ড ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
- চারাগুলো ছোট ছোট আঁটি করে বেঁধে নিতে হবে।
- চারা তোলার পর কোনো কারনে লাগানো না গেলে চারার আঁটিগুলো ছায়াযুক্ত স্থানে ছিপছিপে পানিতে রাখতে হবে।
ণ) ধারনর চারা রোপনের বয়স ও দূরত্ব
- রোপা আউশ ও আমনের চারা ২০-২৫ দিন বয়সে লাগাতে হয়। কিন্তু বোরোর ক্ষেত্রে একটু বেশি বয়সের ৪০-৪৫ দিনের চারা রোপন করতে হয়।
- সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সে.মি ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫-২০ সে.মি। চারা মাটির ২-৩ সে.মি. গভীরে রোপন করতে হয়। এর চেয়ে বেশি গভীরতা হলে গাছে কুশি উৎপাদন কমে যায়।
- সারি করে চারা লাগালে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা সহজ হয়।
ত) ধান চাষে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা
- রোপা ধানে সবসময় দাড়ানো পানি রাখার দরকার নেই। চারা রোপনের পর ৬-৭ সে.মি. পানি রাখতে হবে।
- চারা রোপনের ৬-৭ দিন পর্যন্ত ৩-৫ সে.মি. সেচ দিলে আগাছা দমন হয়।
- কুশি উৎপাদন পর্যায়ে ২-৩ সে.মি. এবং থোর আসার সময় ৭-১০ সে.মি. সেচ দেয়া উত্তম। দানা পুষ্ট হওয়া শুরু হলে আর সেচ দিতে হয় না।
- রোপা আমন সাধারণত বৃষ্টি নির্ভর। আমন মৌসুমে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির পানি যেন সরাসরি জমির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে না পারে এজন্য উচু আইল তৈরি করে দিতে হয়। কারণ বৃষ্টির পানি জমির পুষ্টি উপাদান ধুয়ে নিয়ে যায়।
- বর্তমানে পরিবর্তিত জলবায়ুতে বৃষ্টির সময় কাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেখা যায় রোপনের সময় বৃষ্টির পানির অভাবে জমি তৈরি করা যায় না অথবা অতি বৃষ্টির জন্য জমিতে অনেক দাড়ানো পানি থাকে যার জন্য চারা রোপন করা যায় না।
- বর্তমানে রোপা আমনে সম্পূরক সেচ বিশেষ করে শীষ উদগম থেকে দানা পুষ্ট হওয়া পর্যন্ত সময়ে প্রয়োগ করে ফসল ফলানো হয়। এতে ফলন বেড়ে যায়।
- মাঠ পর্যায়ে কৃষক বোরো ধান চাষে ২৫-৩০ বার সেচ প্রদান করে যা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত। বোরো ধান চাষে একবার ৫-৭ সে.মি. পানি দেয়ার পর জমিতে দাড়ানো পানি শেষ হওয়ার তিন দিন পর পুনরায় সেচ দিলে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পানি কম লাগে।
- বোরো চাষে পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে (AWD) সেচ দিলে গাছে মূলের বৃদ্ধি ভালো হয় ও সেচ খরচ ও কমানো যায়।
থ) ধানের জমির আগাছা দমন
- সাধারণত বোরো ও রোপা আমনের চেয়ে আউশ মৌসুমে বিশেষ করে বোনা আউশে আগাছার উপদ্রব বেশি হয়। এজন্য আউশ মৌসুমে প্রথম বৃষ্টিপাতের পর জমিতে দু-একটি চাষ দিয়ে পতিত রাখলে আগাছার বীজ গজিয়ে উঠে। কিছুদিন পর পুনরায় মই দিয়ে ধান বপন করলে আগাছার উপদ্রব কম হয়।
- রোপা জমিতে ৫-১০ সে.মি. পানি রাখলে জমিতে আগাছা কম হয়। বোরো ধানে দাড়ানো পানি থাকে বলে আগাছার উপদ্রব কম হয়। তারপরও আগাছা হলে আগাছা পরিস্কার করতে হয়।
- আগাছা পরিস্কারের সময় হাত দিয়ে মাটি নেড়ে দিলে বাতাস চলাচলের সুযোগ পায় যা গাছের মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।
- জমিতে দাড়ানো পানি না থাকলে আগাছার প্রকোপ বেড়ে যায়।
- সারিতে রোপনকৃত রোপা আমনে জাপানি রাইস উইডার দিয়ে আগাছা দমন করা যায়। আগাছানাশক প্রয়োগ করেও আগাছা দমন করা যায়।
দ) ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণ
- ধানের শিষের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ অংশের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে এবং ধানের রং সোনালি হলে ধান কাটতে হয়।
- ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য ধান পরিপক্ক হবার পরপরই যত দ্রুত সম্ভব ধান কাটতে হবে। এরপর মাড়াই করে খড়কুটা বেছে পরিস্কার করে ধান পরপর ৪-৫ দিন শুকাতে হবে।
- ধান শুকানোর সময় ধানের আর্দ্রতা ১২% এ চলে আসলে চিটা, আবর্জনা, ভাঙ্গা ধান, ধুলাবালি পরিস্কার করে নিতে হবে। এরপর ধান ছায়ায় ঠান্ডা করে ড্রামে, মটকায়, পলিকোটেড বায়ুরোধক পাত্রে রাখতে হবে।
ধ) চাষকৃত ধানের ফলন
মৌসুম ভেদে ধানের ফলন ভিন্ন হয়। বোরো মৌসুমে ধানের ফলন সবচেয়ে বেশি ও আউশ মৌসুমে সবচেয়ে কম। উচ্চ ফলনশীল জাতের বোরোতে গড়ে হেক্টর প্রতি ৫-৬ টন, রোপা আমনে ৪-৫ টন এবং আউশে ৩-৪ টন।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা আমরা বিস্তরভাবে উন্নত ধানের জাত সমূহ ও ধানের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানলাম।
ধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল। এদেশে মোট আবাদী জমির প্রায় ৭৬% জমিতে ধান চাষ হয়। বাংলাদেশে আউশ, আমন, বোরের মৌসুমে ধান চাষ হয়ে থাকে। সেচ ব্যবস্থা থাকলে উঁচু, মাঝারী উঁচু জমিসহ নীচু জমিতে ধান চাষ করা সম্ভব। অধিক ফলানোর জন্য মৌসুম ও এলাকাভিত্তিক উপযুক্ত জাত নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। বীজের মান নিশ্চিত হয়ে মৌসুমের জন্য কম বয়সের চারা উৎপন্ন করে যথাসময়ে জমিতে চারা রোপণ করতে হবে। ধান উৎপাদনকালীন সময় বিভিন্ন আন্তঃপরিচর্যা যেমন: সেচ প্রদান আগাছা দমন, পোকামাকড়, রোগবালাই দমন ইত্যাদি কার্যক্রম যথাযথভাবে করতে হবে। পরিপক্ক ধান কর্তনের পর উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় মাড়াই ও শুকানোর পর সঠিকপাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]