ধানের ক্ষতিকর পোকামাকড় হল মাজরা পোকা, গলমাছি পোকা, পামরি পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িং, গান্ধি পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুঙ্গি পোকা।
ধানের রোগ বালাইগুলি হল পাতা ঝলসানো, খোলপোড়া, কান্ড পঁচা, খোল পচা, টুংরো রোগ, ব্লাস্ট রোগ ইত্যাদি।
এ পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- ধানের বিভিন্ন রোগের কারণ ও লক্ষণ সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন; ধানের রোগ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পারবেন। ধানের ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন; ধানের বিভিন্ন পোকা ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পারবেন।
(১) ধানের রোগ ও প্রতিকার
বাংলাদেশে ধানের ৩২টি রোগ সনাক্ত করা হয়েছে। রোগগুলি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও কৃমি দ্বারা সংঘটিত হয়।
এখানে ধানের কয়েকটি প্রধান রোগের কারণ, লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থা বর্ণনা করা হলো-
ক) ধানের পাতা পোড়া বা পাতা ঝলসানো রোগ
কারণ: ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমনে হয়।
লক্ষণ:
- চারা অবস্থায় এ রোগ হলে আক্রান্ত গাছের গোড়া পত্রফলক, বাইরের পাতা হলদে হয়ে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়।
- বয়স্ক গাছে থোড় অবস্থা থেকে পাতা পোড়া রোগের লক্ষণ দেখা যায়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করা। যেমন- বিআর-২, বিআর-৪, ব্রিধান-২৭, ব্রিধান-২৮, ব্রিধান-২৯, ব্রিধান-৩১ ইত্যাদি।
- আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলা।
- সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা।
- আক্রান্ত জমির পানি শুকিয়ে আবার সেচ দেয়া।
- ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলা।
খ) ধানের খোলপোড়া রোগ
কারন: ছত্রাক সংক্রমনে হয়।
লক্ষণ:
- ধান গাছের কুশি গজানোর সময় রোগটির প্রাদুর্ভাব হয়।
- প্রথমে খোলে ধুসর দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে তা বড় হয়ে সমস্ত খোলে ও পাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
- পত্রফলকে গোখরা সাপের চামড়ার ন্যায় দাগ তৈরি হয়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।
- নির্দিষ্ট দূরত্বে সারি করে ধান লাগাতে হবে।
- বেশি আক্রান্ত হলে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে।
- ফসল কাটার পর আক্রান্ত জমির নাড়া পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
গ) ধানের কান্ড পচা রোগ
কারন: ছত্রাক সংক্রমনে হয়।
লক্ষণ:
- খোলে কালচে গাঢ় অনিয়মিত দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে বড় হয়।
- কান্ড চিড়লে কালো গোলাকার বুটির মত দানা দেখা যায়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন- বিআর-১১, বিআর-১৪, ব্রিধান-১৭, ব্রিধান-৩০, ব্রিধান-৩১, ব্রিধান-৪০, ব্রিধান-৪২ ইত্যাদির চাষ করা।
- সুষম সার ব্যবহার করা।
ঘ) ধানের খোলপচা রোগ
কারন: ছত্রাক সংক্রমনে হয়।
লক্ষণ:
- ডিগপাতার খোলে গোলাকার বা অনিয়মিত দাগ পড়ে। দাগগুলির কেন্দ্র ধূসর ও কিনারা বাদামী হয়। দাগগুলো মিশে বড় হয়।
- শীষ আংশিক বের হয়।
- খোল পচে যায়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করা।
- রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা ও বীজ শোধন করা।
- ধান কাটার পড় খড়কুটো জমিতে পুড়িয়ে ফেলা।
ঙ) ধানের টুংরো রোগ
কারন: ভাইরাস সংক্রমনে হয়।
লক্ষণ:
- পাতার রং হালকা সবুজ হয় এবং পরে হলদে হয়।
- গাছ টান দিলে উঠে আসে।
- আক্রান্ত পাতা মুচড়ে যায় ও গাছ খাটো হয়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- সবুজ পাতা ফড়িং ভাইরাস ছড়ায়। তাই এ পোকা দমন করা জরুরী।
- রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করা।
- রোগাক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলা।
- সবুজ পাতা ফড়িং দমনের জন্য অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
চ) ধানের ব্লাস্ট রোগ
কারন: ছত্রাক সংক্রমনে হয়।
লক্ষণ:
- পাতায় ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে।
- দাগের চারিদিকে গাঢ় বাদামী এবং মাঝের অংশ সাদা ছাই বর্ণের হয়।
- কান্ডের গিঁটে, খোল ও পাতার সংযোগস্থান কালো দাগ সৃষ্টি করে।
- শিষের গোড়ায় কালো দাগের সৃষ্টি করে এবং গোড়া পচে যায় এতে চিটা ও অপুষ্ট দানা হয়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- জমিতে সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন- বিআর-৩, বিআর-১৪, বিআর-১৫, বিআর-১৬, বিআর-২৪ ইত্যাদি চাষ করা।
- রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা ও বীজ শোধন করা।
- পটাশ জাতীয় সার উপরি প্রয়োগ করা।
(২) ধানের বিভিন্ন পোকা ও প্রতিকার
প্রায় ৩৩টি প্রজাতির পোকাকে ধানের প্রধান ক্ষতিকর পোকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিন মৌসুমেই প্রায় একই ধরনের পোকা আক্রমন করে যদিও আক্রমনের মাত্রা ভিন্ন। আউশ ও আমন মৌসুমে পোকার প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
নিচে কয়েকটি প্রধান পোকার ক্ষতির লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি আলোচনা করা হলো-
ক) ধানের মাজরা পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
- মাজরা পোকার মথ ধানের পাতায় ডিম পাড়ে।
- ডিম ফুটে কীড়া বের হয়ে কান্ড ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে কান্ডের নীচের দিকে কেটে দেয়।
- আক্রমন শীষ বের হবার পূর্বে হলে ’ডেটহার্ট’ এবং শীষ আসার সময় হলে ‘হোয়াইট হেড’ লক্ষণ প্রকাশ করে।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলা।
- আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা।
- জমিতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসবার ব্যবস্থা করা।
- জমিতে ১০-১৫% মরা ডগা অথবা শতকরা ৫% সাদা শীষ দেখা গেলে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
- মাজরা পোকা প্রতিরোধী জাত যেমন বিআর-১, বিআর-১০, বিআর-১১, বিআর-২২, ব্রিশাইল ইত্যাদি চাষ করা।
খ) ধানির গলমাছি বা নলিমাছি পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
- কীড়া ধান গাছের বাড়ন্ত কুশিকে আক্রমন করে এবং আক্রান্ত কুঁশি পিয়াজের মত হয়।
- কুঁশিতে শীষ বের হয় না।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- রোপনের পর জমি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
- আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্ণবয়স্ক পোকা দমন করতে হবে।
- ৫% কুশি পিয়াজ পাতার মত হলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
গ) ধানের পামরি পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
- পামরি পোকা পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ও কীড়া এ দু-অবস্থায় ধান গাছ আক্রমন করে।
- কীড়া পাতা ছিদ্র করে সবুজ অংশ খায়।
- পূর্ণবয়স্ক পোকা ধানের পাতার উপর সমান্তরাল দাগ করে সবুজ অংশ কুরে কুরে খেয়ে ফেলে।
- পাতা শুকিয়ে পুড়ে যাওয়ার মত হয়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- হাতজাল অথবা মশারিরর কাপড় দিয়ে পূর্ণবয়স্ক পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে।
- গাছের পাতা ছেঁটে দিয়ে কীড়া মারা যায়।
- পাতার ৩৫% ক্ষতি হলে অথবা প্রতি গোছায় ধানগাছে ৪টি পূর্ণবয়স্ক পোকা থাকলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ঘ) ধানের বাদামি গাছ ফড়িং পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
- বাদামি গাছ ফড়িং ধান গাছের গোড়ায় বসে রস শুষে খায়।
- আক্রান্ত গাছ প্রথমে হলদে এবং পরে পুড়ে যাওয়ার মত রং ধারন করে মারা যায়। একে হপার বার্ণ বলে।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- আলোক ফাঁদের সাহায্যে পূর্ণবয়স্ক পোকা দমন করা।
- অধিক দূরত্বে চারা রোপন করা (২৫ x ২৫ সে.মি)।
- আগাম পাকে এমন জাতের ধান চাষ করা।
- অধিক আক্রমন হলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা।
ঙ) ধানের সবুজ পাতা ফড়িং পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
- পূণবয়স্ক ও বাচ্চা উভয় অবস্থায় এ পোকা ধানের পাতার রস শুষে খায়।
- গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ও গাছ খাটো হয়।
- এ পোকা টুংরো ভাইরাস ছড়ায়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।
- হাতজাল ব্যবহার করে পোকা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।
- প্রতিরোধী জাত যেমন বিআর-১, বিআর-২, বিআর-৫, বিআর-৬, বিআর-১০, বিআর-১২ জাতের ধান চাষ করা।
চ) ধানের গান্ধি পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
- ধানের দানায় দুধ সৃষ্টির সময় আক্রমন করে।
- পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা পোকা উভয়ই ধানের দানায় খোসা ছিদ্র করে ধানের দুধ শুষে খায়।
- ধান চিটা হয় এবং চিটার গায়ে বাদামি গোলাকার দাগ দেখা যায়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা।
- হাতজাল ব্যবহার করা।
- পাখি বসার জন্য ডালপালা পুঁতে দেয়া।
- ধানের প্রতি গোছায় ২-৩ টি গান্ধী পোকা দেখা গেলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা।
ছ) ধানের পাতা মোড়ানো পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
- পাতা মোড়ানো পোকার কীড়া ধানের পাতা লম্বালম্বি মুড়িয়ে পাতার সবুজ অংশ খেয়ে পাতায় লম্বা সাদা দাগ করে।
- পাতা পুড়ে যাওয়ার মত দেখায়।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা।
- ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা।
- ২৫% পাতার ক্ষতি হলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা।
জ) ধানের চুঙ্গি পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
- চুঙ্গি পোকা পাতার উপরের অংশ কেটে ছোট ছোট চুঙ্গি তৈরি করে ভেতরে থাকে।
- গাছের পাতা সাদা হয়ে যায় ও পাতার উপরের অংশ কাটা থাকে।
- দিনের বেলায় চুঙ্গিগুলো পানিতে ভাসতে থাকে।
প্রতিকার/দমন ব্যবস্থা:
- আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে মথ সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।
- হাতজাল ব্যবহার করে চুঙ্গিসহ কীড়া সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।
- আক্রান্ত জমির পানি সরিয়ে ফেলতে হবে এবং জমি শুকিয়ে ফেলতে হবে।
- বেশি আক্রমন হলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনাটির দ্বারা আমরা ধানের রোগ ও প্রতিকার এবং ধানের বিভিন্ন পোকা ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা অর্জন করলাম।
মেঘলা আবহাওয়াতে অনেক সময় গাছের পাতা ঝলসে যায় এবং ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হয়। এক্ষেত্রে ‘হিনোসান’, ‘ব্যাভিষ্টিন’ ও ‘ট্রপার’ প্রয়োগ করা যেতে পারে। পাতা ঝলসানো রোগ এবং ব্লাস্ট রোগের তীব্রতা কমানোর জন্য বিঘা প্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করা যেতে পারে। ক্ষেতে রোগাক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে ফেলতে হবে।
বীজতলায় থ্রিপস পোকার আক্রমণ দেখা দিলে বিঘা প্রতি ১৩৩ মিলিলিটার ‘মেলাথিয়ন’ প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের পর পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে জমিতে ডাল-পালা পুঁতে দিতে হবে, যাতে পাখি বসে ফসলের ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে ফসল রক্ষার কাজে সহায়তা করতে পারে। হাত জাল দিয়ে পোকা ধরা এবং আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা দমন করা যায়। ক্ষতির মাত্রা অর্থনৈতিক দ্বার প্রান্তে উপনীত হলে অনুমোদিত কীটনাশক পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করে পোকা দমন করতে হবে। জমিতে জমানো পানি থাকা অবস্থায় চুঙ্গি পোকার আক্রমণ দেখা দিলে পানি সরিয়ে দিতে হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।