আঁশ ফসল দিয়ে বস্ত্র, চট, থলে, কার্পেট ও অনেক শৌখিন দ্রব্য তৈরি করা হয়।
এ পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- আঁশ জাতীয় ফসল কী তা বলতে পারবেন; আঁশ জাতীয় ফসলের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন; পাট চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জলবায়ু, জমি, প্রস্তুত প্রণালী সম্পর্কে অবগত পারবেন; পাট চাষের পদ্ধতি, পাট কোন মাটিতে ভালো হয়? এবং পাট চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন; পাট চাষে বীজহার, বপনের সময় ও বপন পদ্ধতি; পাট কাটার উপযুক্ত সময় সম্পর্কে অবগত পারবেন। পাটের ফলন; পাটের গুণগত মান পাওয়ার জন্য উপযোগী যথার্থ সংগ্রহের প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা লাভ পারবেন।
(১) আঁশ জাতীয় ফসল কি/কাকে বলে?
যে সকল ফসল আঁশ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে চাষ করা হয় তাদেরকে আঁশ জাতীয় ফসল (Fiber Crops) বলা হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আঁশ জাতীয় ফসলের গুরুত্ব অপরিসীম। এসব ফসল তখে উৎপাদিত আঁশ দিয়ে বস্ত্র, চট, থলে, কার্পেট, কাগজের মন্ড, দড়ি, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দ্রব্য তেরি করা হয়।
বাংলাদেশের প্রধান আঁশ ফসল তারপরই তুলার স্থান, বাংলাদেশে উৎপাদিত আশ ফসল নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
বাংলার নাম | ইংরেজি নাম | বৈজ্ঞানিক নাম |
পাট (তোষা) | Jute (Tosha) | Corehorus olitorius |
পাট (দেশী) | Jute (Local) | Corchorus Capsularis |
তুলা (কার্পাস) | Cotton | Gossypium arboreum |
তুলা (শিমুল) | Silk Cotton | Gossypium arboreum |
কেনাফ | Kenaf | Hibiscus cnnabinus |
শন পাট | Sunhemp | Crotalaria juncea |
মেস্তা | Mesta | Hibiscus sabdariffa |
(২) আঁশ জাতীয় ফসলের গুরুত্ব
- আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানী পণ্য হল বস্ত্র শিল্প এই বস্ত্রশিল্পের প্রধান কাঁচামাল হল আঁশ ফসল থেকে উৎপাদিত আঁশ।
- পাটের আঁশ দিয়ে বস্তা, চটের ব্যাগ, দড়ি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের পাট দিয়ে বিভিন্ন সৌখিন পণ্য যেমন ব্যাগ, স্যান্ডেল, ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করা হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পণ্যগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যা বিদেশে বাংলাদেশে পাটের তৈরি দ্রব্য রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
- আঁশ জাতীয় ফসল (যেমন তুলা) দিয়ে লেপ, তোষক ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
- পাটের বীজের ঔষধী গুণ রয়েছে। তুলা বীজের তেল থেকে সাবান তৈরি হয়। তুলা বীজের তেল নিষ্কাশনের সময় যে খৈল তৈরি হয় তা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- কচি অবস্থায় পাট পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয় যা অত্যন্ত পুষ্টিকর ও জনপ্রিয় সবজি।
- ব্যান্ডেজ, গজ, ব্লটিং পেপার ইত্যাদি তৈরিতেও আঁশ জাতীয় ফসল ব্যবহৃত হয়।
(৩) পাট চাষের পদ্ধতি, পাট কোন মাটিতে ভালো হয়? পাট চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটি পাট চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এদেশের প্রায় সব জেলায় পাটের চাষ হয়। গত কয়েক বছরে পাটের তৈরি বিভিন্ন পণ্য যেমন, ব্যাগ, বস্তা, জুতা এমনকি শাড়ী বিদেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিদেশের বাজারে এসব পণ্য রপ্তানীর সুযোগ সৃষ্টি উৎপাদনের জন্য এর আধুনিক চাষপদ্ধতি জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ক) জলবায়ু
- পাট উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার ফসল, পাট উৎপাদনের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা হল ২৫-৩৫ সে. এবং আপেক্ষিক আদ্রতা ৮০-৯০%।
- পাট চাষের সময় সুষমভাবে বর্ণিত ১২৫-২০০ সে. মি. বৃষ্টিপাত উপকারী চাষ অবস্থায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ক্ষতিকর।
খ) পাট কোন মাটিতে ভালো হয়?
পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব পদার্থ যুক্ত দোঁআশ মাটি পাটের জন্য ভাল। বেলে দোআশ বা এটেল দোঁআশ মাটিতে পাট চাষ করলেও ভাল ফসল পাওয়া যায়, এঁটেল মাটিতে পানি জন্মে থাকে বলে তা পাট চাষের জন্য উপযোগী নয়।
গ) জমি নির্বাচন
উঁচু, মাঝারি নিচু এবং মাঝারি নিচু জমি অর্থ্যাৎ যে জমিতে বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না বা জমে গেলেও নিষ্কাশন করা সম্ভব তেমন জমিই পাট চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
ঘ) জমি তৈরি
পাটের জন্য নির্বাচিত জমি ৫-৭ টি চাষ ও মই দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। পাটের বীজ খুবই ছোট, এবং পাট গাছের মূল মাটির ১ ফুট গভীর পর্যন্ত প্রবেশ করে বলে মাটি গভীরভাবে চাষ করতে হবে এবং মাটি ভালভাবে ঝুরঝুরে করতে হবে। সাধারণত মৌসুমের প্রথম বৃষ্টির পর জো অবস্থায় জমি চাষ করতে হয়।
ঙ) পাটের জাত
পাটের প্রধান প্রজাতি ২টি-
- দেশী পাট: Corchorus capsularis
- তোষা পাট: Corchorus olitorius
দেশি পাটের জাতসমূহ: ডি-১৫৪-২’ সিভিএল-১ (সবুজ পাট), সিভিই-৩ (আশু পাট), সিসি-৪৫ (জো পাট); এটম পাট-৩৮, বিজেআরআই দেশিী পাট-৫; বিজেআরআই দেশি-৬, বিজেআরআই দেশি পাট-৭, বিজেআরআই দেশি-৮।
তোষাপাটের জাতসমূহ: ফাল্গুনী তোষা (ও-৯৮৯৭), ওএম-১, ৩-৪, ৩-৭২, বিজেআরআই তোষা পাট-৪, বিজেআর আই তোষা পাট-৫, ৩-৭৯৫, বিজেআরআই তোষা পাট-৬ (ও-৩৮২০)।
চ) বীজ বপনের সময়
বাংলাদেশের কৃষি ঋতুর ভিত্তিতে পাট উৎপাদনের জন্য খরিপ-১ ঋতু হল উপযুক্ত সময় (মার্চ-এপ্রিল থেকে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত) দেশি পাট সাধারণত ১৫ই মার্চ থেকে ১৫ই মে এই সময়ের মধ্যে বুনতে হয়। তবে কোন জমিতে যদি জুলাই আগষ্টের দিকে বর্ষার পানি জমার সম্ভাবনা থাকে তাহলে সে জমিতে কিছুটা আগাম বীজ বোনা উচিত।
ছ) বীজ হার
সারিতে বপন-
- দেশী পাট: ৬-৭ কেজি/হেক্টর
- তোষা পাট: ৪-৫ কেজি/হেক্টর
ছিটিয়ে বপন-
- দেশি পাট: ৮-১০ কেজি/হেক্টর
- তোষা পাট: ৬-৮ কেজি/হেক্টর
জ) বীজ শোধন
বোনার আগে জীবানুমুক্ত করার জন্য বীজ শোধন করে নেয়া ভাল। প্রতি কেজি বীজের সাথে ৬ গ্রাম ‘এগ্রোসান-জিএন’ বা ‘সেরিসান’ অথবা, ২ গ্রাম ‘ক্যাপটান’ বা ‘ক্যাপটান ৭৫%’ বা ‘ব্যাভিসটিন ৫০%’ ঔষধ বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে।
ঝ) বপন পদ্ধতি
পাট ছিটিয়ে ও সারিতে দুইভাবেই বপন করা যায়। এদেশের কৃষকেরা ছিটিয়ে বপন করে বেশি, যদিও সারিতে বপন করলে ফলন বেশি পাওয়া যায় এবং পরিচর্যা করতে সুবিধা হয় লাইন করে লাগালে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সে.মি. এবং সারিতে বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৭-১০ সেমি. হওয়া উচিত।
ঞ) চারা পাতলাকরণ
সারি পদ্ধতিতে পাট লাগালে হেক্টর প্রতি ৪.৫-৫ লাখ চারা কাম্য। চারা গজানোর ১৫-২০ দিন পর একবার ঘন স্থানে যে চারাগুলো দুর্বল সেগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে। চারা গজানোর ৩০-৩৫ দিন পর আরও একবার চারা পাতলা করে দিতে হবে।
ট) আগাছা দমন
পাট বীজ বপনের ৮ সপ্তাহের মধ্যেই ২-৩ বার নিড়ানী দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে। তাছাড়া চারা পাতলাকরণের সময়ও আগাছা দমন করে নিড়ানী দিয়ে মাটি আলগা করে দিতে হবে।
ঠ) সার প্রয়োগ
পাটের ভাল ফলনের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। পাট চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নীচের টেবিলে দেওয়া হলো-
সারের নাম | একর প্রতি সারের পরিমাণ |
গোবর | ৫-৬ কেজি |
ইউরিয়া | ১৭০-২০০ কেজি |
টিএসপি | ৫০-৮০ কেজি |
এমপি | ৬০-৯০ কেজি |
জিপসাম | ৫০-৮০ কেজি |
জিঙ্ক সালফেট | ১১-৩০ কেজি |
ড) পাট চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
- জমি তৈরির সময় সম্পূর্ণ গোবর, জিংকসালফেট ও জিপসাম জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- বীজ বপনের আগে শেষচাষের সময় টিএসপি ও এমপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- ইউরিয়া সার তিন ভাগ করে প্রথম ভাগ চারা গজানোর ৬-৭ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৪৫ দিন পর এবং শেষভাগ ৬০ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৪৫ দিন পর এবং সার প্রয়োগের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন সার কচি পাতার উপর না পড়ে। তাহলে পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- প্রতিবার আগাছা দমন করে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রস থাকা অবস্থায় ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ঢ) সেচ ও নিকাশ
- বীজ বপন করার সময় জমি যদি বেশি শুষ্ক হয় তাহলে হালকা সেচ দিতে হবে।
- পাটের চারার দৈহিক বৃদ্ধির সময় বৃষ্টি না হলে বা জমিতে রস না হলে হালকা সেচ দিতে হবে।
- পাট জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না, এতে চারাগাছ মারা যায় এবং বয়স্ক সারের শিকড় নষ্ট হয়ে পাটের গুণগত মান খারাপ হয়ে যায়। তাই পাটের জমিতে কোন অবস্থাতেই পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবে না এবং দ্রুত তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- সফল পাট উৎপাদনের জন্য পাট কাটার উপযুক্ত সময় এবং সংগ্রহ পরবর্তী অন্যান্য প্রযুক্তি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
ণ) পাট কাটা
- আঁশ উৎপাদনের জন্য সাধারণত বীজ বোনার ৪-৫ মাসের মধ্যে পাট কাটতে হয়।
- বর্ষার পানিতে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে প্রয়োজনে আরও আগে পাট কাটতে হতে পারে গাছে ফুল আসা শুরু করলেও বোঝা যায় পাট পরিপক্ক হয়েছে।
- ফুল থেকে ফল হওয়ার সময় পাট কাটলে ফলন বেশি হয় এবং ভাল মানের আঁশ পাওয়া যায়।
- সাধারণত কাস্তে বা হেঁসো দিয়ে পাটগাছ একেবারে গোড়া থেকে কাটতে হয়।
ত) ফলন
- দেশি পাটের ফলন হেক্টর প্রতি ৪-৫৫ টন এবং তোষা পাটের ফলন প্রতি হেক্টর ৪.০-৪৫.০ টন।
- প্রক্রিয়াজাত করে কাঁচা পাটের শতকরা ৫ ভাগ আঁশ এবং ১৫ ভাগ পাটকাঠি পাওয়া যায়।
(৪) পাটে চাষে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও দমন ব্যবস্থাপনা
ক) পাটের বিছাপোকা
ক্ষতির লক্ষণ: সাধারণত বৈশাখ মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত এদের আক্রমণ দেখা যায়। এরা কচি ও বয়স্ক সবধরনের পাতার সবুজ আঁশ খেয়ে ফেলে।
দমন ব্যবস্থা:
- পাটের পাতায় ডিমের গাদা দেখলে পাতা গুলো সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ‘ডায়াজিনন ৬০% তরল’/‘নভুক্রিন ৪০% তরল’ অথবা অন্য যেকোন অনুমোদিত কীটনাশক প্রতি হেক্টর জমির জন্য ৩০লিটার পানিতে ৪৫ গ্রাম ঔষধ মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করতে হবে।
- বিছাপোকা যেন ছড়িয়ে যেতে না পারে সেজন্য আক্রান্ত জমির চারপাশে নালা তৈরি করে তাতে ‘কেরোসিন মিশ্রিত পানি’ নালায় দিতে হবে।
খ) উড়চুঙ্গা পোকা
ক্ষতির লক্ষণ: জমিতে গর্ত করে বাস করে এবং সেখান থেকে বের হয়ে চারা গাছের গোড়া কেটে দেয়।
দমন ব্যবস্থা:
- জমিতে পানি সেচ দিলে গর্ত থেকে পোকা বের হয়ে আসবে, তখন সেগুলোকে ধ্বংস করতে হবে।
- ‘বিষটপ’ ব্যবহার করে এই পোকা দমন করা যায়
- ‘রিপকর্ড ১০ ইসি’ অনুমোদিত মাত্রায় ক্ষেতে প্রয়োগ করতে হবে।
গ) পাটের ঘোড়া পোকা
ক্ষতির লক্ষণ: পাটের ডগার কচি পাতা খেয়ে ফেলে, ফলে শাখা প্রশাখা বের হয় ও আঁশের মান খারাপ হয়।
দমন ব্যবস্থা:
- পোকার আক্রমণ হলে ‘কেরোসিন ভেজানো দড়ি’ গাছের উপর দিয়ে টেনে নিলে পোকার আক্রমণ কম হয়।
- খেতে ডাল বা লাঠি পুতে পাখির বসার ব্যবস্থা করলে শালিক ময়না ইত্যাদি পাখি ঐ সব ডালে এসে বসবে এবং পোকা খেয়ে তাদের সংখ্যা কমিয়ে দিবে।
- ‘ডায়াজিনন ৬০% তরল’/‘ইনলাক্স ২৫% তরল’ অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
ঘ) চেলে পোকা
ক্ষতির লক্ষণ: এদের আক্রমণে গাছের ডগা মরে যায় ও শাখা প্রশাখা বের হয় এরা কান্ডের উপর ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। আক্রান্ত স্থান থেকে আঠা বের হয় এবং পোকার মলের সংগে মিশে আঁশের উপর কালো দাগ তৈরি হয়, ফলে আঁশের মান কমে যায়।
দমন ব্যবস্থা:
- ক্ষেতের আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতেহবে।
- আক্রান্ত পাঠগাছ নষ্ট করে ফেলতে হবে
- অনুমোদিত কীটনাশক যেমন ‘রীডা’ ১০ লিটার পানিতে ২৫ মিলি মিশিয়ে প্রতি শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে।
ঙ) মাকড়
ক্ষতির লক্ষণ: আগার কচি পাতার রস চুষে খায়, ফলে পাতা কুঁকড়ে যায় এবং শুকিয়ে যায়।
দমন ব্যবস্থা:
- ‘কাঁচা নিম পাতার রস’ এবং ‘পানি’ ২:৫ অনুপাতে মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
- আক্রমণ বেশি হলে ‘থিওভিট ৮০% পাউডার’ ১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম পরিমাণ মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।
(৫) পাট চাষে রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা
ক) পাটের গোড়াপঁচা রোগ
লক্ষণ: গাছের গোড়ায় লালচে দাগ তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে গোড়া সম্পূর্ণ পঁচে গিয়ে গাছ উপড়ে পড়ে যায়।
প্রতিকার: ব্লিটক্স ২.৫ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করতে হবে।
খ) কান্ড পঁচা রোগ
লক্ষণ: পাতা ও কান্ডে গাঢ় বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত যে কোন স্থানেই এ রোগ দেখা যায়। পরে গাছ মরে যায়।
প্রতিকার: ৩৫ গ্রাম ‘কম্পেনিয়ন ঔষধ’ ১২ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করে রোগের আক্রমণ কমানো যায়।
গ) কালো পট্টি রোগ
লক্ষণ: কান্ডে কালো রিং বা কেটনীর মত দাগ পড়ে আক্রান্ত স্থান ঘষলে আঙ্গুলে কালো গুড়োর দাগ লেগে যায়।
প্রতিকার:
- বীজ বপনের আগে বীজ শোধন করতে হয়।
- আক্রান্ত গাছ উঠিয়ে ধ্বংস করতে হবে
- ‘প্রোপিকোনাজল’ ০.৫ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ঘ) শুকনো ক্ষত রোগ
লক্ষণ: রোগের আক্রমণে চারাগাছ ঝলসে যায়। বড় গাছের কান্ডে কালো কালো দাগ পড়ে, আক্রান্ত স্থান ফেটে যায় এবং শক্ত হয়ে যায়।
প্রতিকার: ৩৫ গ্রাম ‘ডাইথেন এম ৪৫’ প্রতি ১২ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করলে রোগের আক্রমণ করে যায়।
ঙ) ঢলে পড়া রোগ
লক্ষণ: চারা গাছ ঢলে পড়ে যায়।
প্রতিকার:
- আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট করতে হবে।
- জমির পানি নিষ্কাশন করতে হবে।
- ‘ব্লিটক্স’ ২.৫ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে রোগের আক্রমণ কমানো যায়।
চ) মোজাইক রোগ
লক্ষণ: ভাইরাসের আক্রমণে পাতার হলদে ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। পাতার শিরাত হলদে হয়ে যায়।
প্রতিকার:
- আক্রান্ত গাছ জমি থেকে উঠিয়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
- সাদা মাছি এ রোগ ছড়ায়, তাই এই মাছি দমন করতে হবে।
- রোগমুক্ত সুস্থ বীজ বপন করতে হবে।
(৬) চাষকৃত পাট সংগ্রহের পদ্ধতি
ক) পাটগাছ বাছাইকরণ ও আটি বাঁধা
- কাটা পাটগুলোর মধ্যে ছোট বড় চিকন মোটা পাটগুলোকে আলাদা করতে হবে কারণ ছোট ও চিকন পাট গাছ মোটা ও বড় গাছ অপেক্ষা দ্রুত পচে। তাই পচন প্রক্রিয়া যাতে সুষম ও সটিক হয় সেজন্য এ সমস্ত বিভিন্ন ধরনের পাটকে পৃথক করে আলাদা আলাদা আঁটি বাঁধতে হবে।
- সাধারণত ১৫-২০ সে.মি. ব্যসের আঁটি বাঁধা হয়। পাতা ঝরানো ও গোড়া ডুবানোর পাটের আঁটি বেঁধে জমিতে ৩/৪ দিন ফেলে রেখে পাতা ঝরানো হয়। এই সময় গাছগুলো কিছুটা শুকিয়ে যাবে। পাট গাছের গোড়ার দিক অন্য অংশের চেয়ে বেশি মোট বলে পঁচতে সময় বেশি লাগে। এজন্য অনেকসময় জাক দেবার আগে আটিগুলোর গোড়ার দিকের ৬০-৭০ সে.মি. অংশ খাড়াভাবে পানিতে ৩/৪ দিন ডুবিয়ে রাখা হয়।
- জাগ দেওয়া পাট গাছ পঁচানোর জন্য আটিগুলোকে সাজিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখাকে জাগ দেওয়া বলে। পরিষ্কার ও অল্প স্রোতযুক্ত পানিতে জাগ দেওয়া ভাল।
- জাগ দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন, জাগের উপর কমপক্ষে ১০-১৫ সে.মি. পানি থাকে এবং নীচে যথেষ্ট পানি থাকবে যেন জাগ মাটির সংস্পর্শে না আসে। যদি এ ধরনের জলাশয় না পাওয়া যায় তাহলে বন্ধ পানিতেও জাগ দেওয়া যায় এবং সেক্ষেত্রে প্রতি ১০০ আটির জন্য ১ কেজি ইউরিয়া সার জাগের উপর ছিটিয়ে দিলে পাট তাড়াতাড়ি পঁচে।
- জাগ দেওয়ার সময় প্রথমে এক প্রস্থ আটি বিছিয়ে দেওয়া হয়। তারপর দ্বিতীয় প্রস্থ আঁটি আড়াআড়িভাবে সাজানো হয়। এভাবে আটিগুলোকে সাজিয়ে পাশাপাশি গোড়া মাথা নিয়মে পাট গাছ দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর এগুলোকে পানিেেত ডুবিয়ে দেওয়া হয়। জাগ ডুবানোর জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায় হল জাগের দুই পাশের আবহাওয়ায় ১২-২৫ দিনে পাট পচে।
খ) আঁশ ছাড়ানো ও ধৌতকরণ
আঁশ সহজেই পৃথক হয়ে গেলে এবং একটির সাথে অন্যটি লেগে না থাকলে বুঝলে হবে পাট পচে গিয়েছে। শুকনো স্থানে একটি বা দুটি পচানো পাটগাছ থেকে একটু আশ ছাড়িয়ে তারপর সম্পূণ গাছ থেকে আঁশ ছাড়ানো হয়। এভাবে কয়েকটি পাট গাছ থেকে আঁশ ছাড়িয়ে ভালভাবে ধৌত করা হয়।
গ) আঁশ শুকানো ও সংরক্ষণ
রৌদ্রযুক্ত স্থানে বাঁশের আড়, ঘরের চাল বা রেলিং এ ঝুলিয়ে পাট শুকানো হয়। ধুলাবালি বা কাঁদা না লাগে, ভালভাবে শুকিয়ে তা একত্রে বেঁধে রাখা হয়। ভেজা পাট কখনই গুদামজাত করা ঠিক নয়, কারণ এতে আঁশের গুণগত মান নষ্ট হয়।
ঘ) পাট পঁচানোর রিবন রেটিং পদ্ধতি
পাট পঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি না পাওয়া গেলে এই পদ্ধতিতে পাট পচানো যায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনিস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন সেখানে কাঁচা অবস্থাতেই পাট থেকে ছাল ছাড়িয়ে পরে অল্প পানিতে তা পঁচানো হয়।
এই পদ্ধতিতে-
- প্রথমে পাট থেকে পাতা ঝরে যাওয়ার পর হাতুড়ির সাহায্যে পাট গাছের গোড়া থেতলে দেওয়া হয়।
- এরপর একটি বাঁশের খুটির মাথা ইংরেজি ঠ অথবা ট অক্ষরের মত তৈরি করে খুটিটি পুতে নিতে হয়।
- এরপর ছালসহ পাটগাছ V অথবা U এর মাঝখানে রেখে ছাল দুই দিকে টান দিলে কাঠি থেকে পাটের ছাল পৃথক হয়ে যায়। এভাবে কয়েকটি গাছ থেকে ছাল ছাড়িয়ে সেগুলো একত্রে আঁটি বাঁধা হয়।
- এই আটিগুলো পরবর্তীতে একটি বড় চাড়ি বা অন্য কোন পাত্রে পানির মধ্যে রেখে পচানো হয়।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা আঁশ জাতীয় ফসল কি/কাকে বলে; আঁশ জাতীয় ফসলের গুরুত্ব; পাট চাষের পদ্ধতি; পাট কোন মাটিতে ভালো হয়; পাট চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি; পাটে চাষে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও দমন ব্যবস্থাপনা; পাটের রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা; চাষকৃত পাট সংগ্রহের পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারলাম।
পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। পাট ও পাট জাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাট সাধারণত: দেশি পাট ও তোষা পাট প্রজাতির হয়ে থাকে। পাটের ক্ষতিকর পোকার মধ্যে বিছাপোকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও উড়চুঙ্গা, পাটের ঘোড়া পোকা, চলে পোকা, মাকড় ইত্যাদি। রোগের মধ্যে গোড়াপঁচা রোগ, কান্ড পঁচা রোগ, কালো পট্টি রোগ, ঢলে পড়া রোগ, মোজাইক রোগ প্রধান। রিবন রেটিং পদ্ধতি পাটের ছাল পৃথক করা হয় পরে পাত্রের পানির মধ্যে পঁচানো হয়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।