ডালিয়া বিভিন্ন রং, সুন্দর এবং আকারের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শীতকালীন মৌসুমি ফুল। বাগান, টবে, বর্ডার প্লান্ট হিসেবে বাসগৃহ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার শোভাবর্ধনের জন্য এই ফুলের চাষ করা হয়। এর আকর্ষণীয় আকার, বর্ণ বৈচিত্র্যের জন্য এর বাণিজ্যিক ব্যবহারও বেড়ে চলেছে। ফুল এর উৎপত্তিস্থল মেক্সিকো সুইডেনের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী আন্দ্রের ডাল এর নাম অনুসারে এর নাম ডালিয়া হয়েছে।
এ পাঠ শেষে আপনি- ডালিয়ার জাত, বংশবিস্তার সম্পর্কে ধারণা পারবেন; ডালিয়ার জলবায়ু ও মাটি সম্পর্কে জানতে পারবেন; ডালিয়ার চাষ পদ্ধতি শিখতে পারবেন।
নিম্নে ডালিয়া ফুল চাষ পদ্ধতি সুন্দর ও সহজভাবে উপস্থাপন করা হলো-
(১) ডালিয়া ফুলের জাত
ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল সোসাইটি ডালিয়া জাতগুলোকে ১০টি শ্রেণিতে ভাগ করেছে সেগুলো হলো-
- সিঙ্গেল ফ্লাওয়ার্ড: যেমন- ককেট, ফ্রামে
- এনিমোন ফ্লাওয়ার্ড: যেমন-কমেট
- কোলারেট: যেমন-লেডি ফ্রেন্ড, স্টারলেট কুইন
- পিউনি ফ্লাওয়ার্ড: যেমন-বিশপ অব ল্যান্ডডাফ
- ডেকোরেডিভ: যেমন-পিটার র্যামসে, লিবারেটর
- বল: যেমন-এ্যালটামি, রিস্কা মাইনার
- পম্পন: যেমন-অ্যাসকগ, জীনলিস্টার
- ক্যাটটাস: যেমন-এ্যালবার্ট, আরবকুইন
- সেমিক্যাকটাস: যেমন-আলফ্রেড সি
- বিবিধ: যেমন-পিঙ্ক গ্রাফি
(২) ডালিয়া চাষে মাটি ও জলবায়ু
প্রচুর সূর্যালোক সম্পন্ন ঠান্ডা আবহাওয়া ডালিয়া চাষের জন্য উপযোগী। উর্বর ও সুনিষ্কাশিত দোঁআশ মাটি উত্তম।
(৩) ডালিয়া ফুলের বংশ বিস্তার
সাধারণত অঙ্গজ বংশ বিস্তারের মাধ্যমে চারা তৈরি করা হয়। কন্দমুল ও শাখা কলম থেকে চারা করা হয়।
- বীজ: শুধুমাত্র সিঙ্গেল জাতের ক্ষেত্রে বীজ থেকে চারা করা যেতে পারে।
- কন্দমুল: কন্দমুলকে সরাসরি টবে বা জামিতে রোপন করা যায়। কন্দমুল কে টুকরো করেও রোপন করা যায় তবে প্রতিটি টুকরোতে একটি চোখ থাকতে হবে। আবার কন্দুমলের প্রতিটি চোখ থেকে অনেকগুলো চারা বের হয় সেগুলোকে কেটে আলাদা করে টবে বা জমিতে রোপন করা যায়।
- শাখা কলম: কন্দমুল থেকে গাছ জন্মালে দুই তিনটি পাতাসহ ৭-৮ সে.মি. কেটে মে থেকে জুন মাসে শাখা কলম করে চারা রোপন করা যায়।
(৪) ডালিয়া চাষে মাটি বা জমি তৈরি
ডালিয়া ফুল বেড ও টবে দুইভাবে চাষ করা যায়। জমি ভালোভাবে চাষ করে মাটি ঝুর ঝুরে করে নিতে হবে। মৃত্তিকা বাহিত রোগ জীবাণু থেকে রক্ষার জন্য মাটি শোধন করে নিতে হবে।
(৫) ডালিয়া ফুলের চারা লাগানো
সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চারা লাগানো হয়। জাতের উপর ভিত্তি করে চারা থেকে চারা ৪০-১০০ সে.মি. এবং সারি থেকে সারি ৭০-১০০ সে.মি. দূরত্বে চারা লাগানো উচিত।
(৬) ডালিয়া চাষে সার প্রয়োগ
- ফুলের কাঙ্খিত আকার হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিমাণে সার দেয়া প্রয়োজন। প্রতি শতকের গোবর সার ২০ কেজি, টিএসপি ১ কেজি, এমপি ৫০০ গ্রাম প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- পটাশ ও ফসফরাস এবং অর্ধেক পরিমাণ ইউরিয়া ৩৫-৪০ দিন পর প্রয়োগ করতে হয়।
- তবে ইউরিয়া মাঝে মাঝে পাতায় স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
(৭) ডালিয়া গাছের আন্তঃপরিচর্যা
- পানি সেচ বা অতিরিক্ত পানি নিস্কাশনের জন্য নালা তৈরি করতে দিতে হবে।
- ডালিয়া কান্ড নরম এবং এর ফুল বড় বলে গাছ যেন হেলে না পড়ে বা বাতাসে ভেঙ্গে না যায় সেজন্য শক্ত করে খুঁটি বেঁধে দিতে হয়। তিন দিকে ৩টি খুঁটি ত্রিভুজের মতো পুতে দিলে গাছ সোজা হয়ে বেড়ে উঠে।
(৮) ডালিয়া চাষে সেচ
ডালিয়া গাছের জন্য পর্যাপ্ত পানি দিতে হবে। ফুল ফোটা পর্যন্ত নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে।
(৯) ডালিয়ার স্টপিং, থিনিং এন্ড টাইমিং
- স্টপিং: চারার ডগা কেটে পাশ থেকে শাখা বের হয় তাকে স্টপিং বলে। স্টপিং এর মাধ্যমে একাধিক শাখা তৈরি করে অনেকগুলি ফুল পাওয়া যায়।
- থিনিং: প্রয়োজনীয় সংখ্যক শাখা রেখে বাকিগুলোকে কেটে ফেলাকে থিনিং বলে।
- টাইমিং: হলো প্রয়োজনে বা প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে ফুল ফোটানোর সময় নিয়ন্ত্রণকে টাইমিং বলে।
(১০) ডালিয়ার ডিসবাডিং
প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে গাছের ফুল সীমিত বা বড় আকারের জন্য কেন্দ্রীয় বা কয়েকটি কুঁড়ি রেখে বাকি সব কুঁড়ি বাদ দেয়াকে ডিসবাডিং বলে।
(১১) ডালিয়া চাষে রোগ ও পোকা মাকড় দমন
ক) রোগ দমন
- পাউডারি মিলডিউ রোগ হলে পাতায় সাদা পাউডারের মত দেখা যায়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া থাকলে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ০.১% বেভিস্টিল স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
- এছাড়া ও ঢলে পড়া, ড্যাম্পিং অফ, কান্ড পচা রোগ দেখা যায়। এসব ছত্রাক বাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য চারা লাগানোর পূর্বে মাটি শোধন করে নেয়া উচিত।
খ) পোকা মাকড় দমন
- ডালিয়া গাছে জাবপোকা আক্রমণ করলে পাতা, কুড়ি ও ফুলের রস চুষে নিয়ে উৎপাদন হ্রাস করে। এর সাথে সাথে ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। ম্যালাথিয়ন, বাসুডিন মাত্রা অনুযায়ী স্পে করতে হবে।
- মাকড় পাতার রস চুষে খেয়ে পাতা বাদামী রং হয় এবং পাতা শুকিয়ে যায়। এক্ষেত্রে মেটাসিস্টক্স বা কেলথেন স্প্রে করা যেতে পারে।
(১২) ডালিয়া ফুল সংগ্রহ
খুব সকালে বা সন্ধ্যার দিকে ধারালো ছুরি দ্বারা ফুল সম্পূর্ণ ফোটার আগেই সংগ্রহ করতে হবে। সাথে সাথে অর্ধেক পানিতে ভরা পাত্রে ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। গাছটি কেটে না ফেলে আরও কিছুদিন রাখলে আবার ডাল বের হয়ে ফুল আসবে।
(১৩) ডালিয়ার কন্দমুল তোলা ও সংরক্ষণ
- ফুল ফোঁটা শেষ হলে গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করলে ১৫-২০ সে.মি. রেখে গাছটি কেটে দিতে হবে।
- এরপর কন্দ মুলগুলো উঠিয়ে নিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে শুকানো বালির মধ্যে সংরক্ষণ করতে হবে।
- ডালিয়ার মুল ৪-৭ সে. তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে ভালো থাকে।
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা আমরা ডালিয়া ফুল চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণঅ অর্জন করলাম।
ডালিয়ার রং আকারের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শীতকালীন মৌসুমি ফুল টবে, গৃহে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণের শোভা বর্ধনের জন্য চাষ হয়ে থাকে। ডালিয়া বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে। বংশবিস্তার সাধারণত কন্দমুলের মাধ্যমে অথবা শাখা কলমের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। সময়মত স্টপিং, টাইমিং ও থিনিং করা প্রয়োজন। ফুল বড় করার জন্য ডিজবাডিং করা হয়ে থাকে। ফুল ফোটা শেষ হলে কন্দমুল তুলে সংরক্ষণ করতে হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।