Skip to content

 

মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা

মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা

জীব জগতের উদ্ভিদ প্রাণি নির্বিশেষে প্রতিটি জীবই তাদের নিজ নিজ পরিবেশ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। মাছ জলজ মেরুদন্ডী প্রাণি বিধায় জীবনধারণ, শরীর গঠন ও বৃদ্ধির জন্য জলজ পরিবেশ থেকেই খাদ্য গ্রহণ করে থাকে।

আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য খাদ্য একটি অপরিহার্য উপাদান। মাছের কাঙ্খিত উৎপাদন এবং মাছের বংশ বৃদ্ধিতে সঠিকভাবে মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা, রোগ ব্যবস্থাপনা, উন্নত কলাকৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাছের জীবন চক্রের বিভিন্ন দিক যেমন- শারীরবৃত্ত, খাদ্য ও খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস, খাদ্য প্রয়োগের হার ও পদ্ধতি, পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলী এবং মাছ চাষে এর প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন।

এখানে আমরা মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব।

(১) মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা

যে সকল দ্রব্য গ্রহণের ফলে মাছের দেহের বৃদ্ধিসাধন, ক্ষয়পূরণ, তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয় এবং বংশ বৃদ্ধি ঘটে সেগুলোকে মাছের খাদ্য বলে।

  • আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্যে মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা একটি অপরিহার্য উপাদান। পরিমিত পরিমাণে খাদ্যের যোগান দিয়ে মাছের কাঙ্খিত উৎপাদন করা যায়। মাছের বংশ বৃদ্ধিতে খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা পালন করে থাকে।
  • সুষম খাদ্য গ্রহণে মাছে বৃদ্ধি তবরাণ্বিত হয় এবং মাছ যথাসময়ে যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। এতে মাছের জননগ্রন্থি (gonad) পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় এবং ডিম্বাণু ও শুক্রাণু উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যায়।
  • মাছে জীবনযাত্রার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, যথা: রক্ত সংবহন, শ্বাসকার্য পরিচালনা, অভিস্রবণীয় চাপ নিয়ন্ত্রণ, প্রলম্বন (suspension) ও পানির ভিতরে স্থিতিবস্থায় অবস্থানের জন্যে প্রচুর পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন হয়। মাছ গৃহীত খাদ্য থেকেও শক্তি পেয়ে থাকে। শৈশবস্থা থেকেই সঠিকভাবে মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছকে নিয়মিত ও সুষম খাদ্য সরবরাহ করা উচিত।
  • খামারে মাছের ক্ষেত্রে সরবরাহ হঠাৎ ব্যহত হলে এবং দীর্ঘসময় খাদ্য প্রদান বন্ধ থাকলে বন্ধ্যাত্বের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুস্থ-সবল পোনা উৎপাদনের জন্যে পরিপক্ব মাছকে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাদ্য প্রদান করা উচিত।
  • মাছ চাষের জন্য জলাশয়ে প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগান দান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের খাদ্যচক্রকে সচল রাখে। এতে করে জলাশয়ে মাছের বিভিন্ন প্রকার খাদ্য উপাদান চক্রাকারে ও অবিরত ভাবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। ফলে মাছের দেহের স্বাভাবিক পুষ্টি সাধন ও বৃদ্ধি ঘটে থাকে।
  • প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের স্বাভাবিক খাদ্য হওয়ায় মাছ সহজেই তা গ্রহণ করে থাকে। প্রাকৃতিক খাদ্যের পুষ্টিমান বেশি এবং সহজেই হজম হয়। ফলে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিবর্তন হার সূচক সংখ্যামান কম, যা অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করে।
  • গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, ইত্যাদি জৈব সার সহজলভ্য ও দামে সস্তা। এসব জৈব সার ব্যবহারে পানিতে প্রচুর পরিমানে প্লাঙ্কটন উৎপাদিত হয় যা জলাশয়ের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে থাকে।
  • গবেষণায় দেখা গেছে যে, পুকুরে উৎপাদিত প্রাকৃতিক খাদ্য কার্প জাতীয় মাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। পুকুরে প্রয়োগকৃত সম্পূরক খাদ্য অনেক সময় সুষম হয় না তাই মাছ চাষে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

(২) মাছের খাদ্যের প্রকারভেদ

প্রকৃতিতে মাছের বহু ধরনের খাদ্য বিরাজমান। এর মধ্যে যেমন রয়েছে জলজ ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণি তেমনি রয়েছে দ্রবীভূত পুষ্টি উপাদানসহ অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণিজ পোষক। স্থলভাগেও অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণিজ দ্রব্য রয়েছে।

মাছের খাদ্যকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

  1. প্রাকৃতিক খাদ্য: পুকুরের নিজস্ব এবং সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফাইট্রোপ্লাঙ্কটন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপদান সরবরাহের ফলে জলাশয়ে যে খাদ্য উৎপাদন হয় তাকে প্রাকৃতিক খাদ্য বলে।
  2. সম্পূরক খাদ্য: অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক খাদ্য যোগানের পাশাপাশি পুকুরের বাইরে থেকে মাছকে কিছু খাদ্য দেওয়া হয়। বাইরে থেকে দেওয়া এসব খাদ্যকে সম্পূরক খাদ্য বলা হয়। চালের কুঁড়া, গমের ভুষি, সরিষার খৈল ইত্যাদি সম্পূরক খাদ্য।
See also  মাছ চাষের আধুনিক পদ্ধতি
চিত্র- মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য, বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ প্লাঙ্কটন
চিত্র- মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য, বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ প্লাঙ্কটন

(৩) মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য

জীবের পুষ্টির সবগুলো উপাদানের সংমিশ্রণে প্রয়োজনীয় আনুপাতিক হারে যে খাদ্য তৈরি করা হয় তাকে সুষম খাদ্য বলে।

আমাদের দেশে সম্পূরক খাদ্যের উপাদানের জন্য যে উপাদানগুলো ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে সরিষার খৈল, চালের কুঁড়া, গমের ভুষি, চিটাগুড় ইত্যাদি প্রধান।

গবেষণার মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ এবং আঁতুর পুকুরে পোনা মাছ চাছের জন্য স্বল্পমূল্যের উন্নতমানের সুষম সম্পূরক খাদ্য তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে।

পানিতে যেসব অতিক্ষুদ্র অণুবীক্ষণিক জীবকণা ভাসমান অবস্থায় থাকে তাদেরকে প্ল্যাঙ্কটন বলে। 

প্লাঙ্কটন দুই ধরনের। যেমন-

  1. উদ্ভিদ কণা বা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন (Phytoplankton) 
  2. প্রাণী কণা বা জুওপ্ল্যাঙ্কটন (Zooplakton)

ক) উদ্ভিদ কণা

পানিতে যেসব অতিক্ষুদ্র উদ্ভিদ কণা ভাসমান অবস্থায় সেগুলোই হলো প্লাঙ্কটন। এগুলোকে খালি চোখে দেখা যায় না বিধায় আণুবীক্ষণিক যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে হয়।

উদ্ভিদ কণা সূর্যালোকের সাহায্যে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের খাদ্য নিজেরা তৈরি করে। এ সময় এরা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন ত্যাগ করে। ফলে পুকুরের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হয়। এছাড়া এসব উদ্ভিদ কণা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

উদ্ভিদ কণাসমূহ প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে বিধায় এদেরকে প্রাথমিক উৎপাদক বলা হয়।

মাছের জন্যে উপকারী উদ্ভিদ কণা বা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনগুলো হলো নাভিকুলা, পোডিয়েস্ট্রাম, স্পাইরোগাইরা, ও ইউগ্লিনা, ফেকাস, এনাবিনা ইত্যাদি।

খ) প্রাণিকণা

যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণি ভাসমান থাকে তাদেরকে প্রাণিকণা বা জুপ্লাংটন বলে। 

এসব প্রাণিকণা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক খাদ্যের মধ্যে শুধুমাত্র প্রাণিকণা হতে মাছ প্রায় শতকরা ৪০-৭০ ভাগ প্রাণিজ আমিষ পেয়ে থাকে।

মাছের জন্যে উপকারী প্রাণিকণা বা জ্প্লুাঙ্কটন হলো ডেফনিয়া, বসনিয়া ফিলিনিয়া, ডায়াপটোমাস সাইক্লপস ইত্যাদি।

চিত্র- জুওপ্লাঙ্কটন
চিত্র- জুওপ্লাঙ্কটন

মাছের খাদ্যকে সাধারণত প্রাকৃতিক খাদ্য, সম্পূরক খাদ্য, উদ্ভিজ্জ খাদ্য, প্রাণীজ খাদ্য, মিশ্র খাদ্য এবং তৈরি খাদ্যে ভাগ করা যায়। অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক খাদ্য যোগানের পাশাপাশি পুকুর বা জলাশয়ের বাইরে থেকে মাছকে যে খাদ্য দেওয়া হয় তাকেই সম্পূরক খাদ্য বলে। মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা, রোগ ব্যবস্থাপনা, আধুনিক কলাকৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছের উৎপাদান বৃদ্ধির জন্য খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।

(৪) মাছের সুষম সম্পূরক খাদ্য তৈরিকরণ

মূলতত্ত্ব: মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ও অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য প্রাকৃতিক খাদ্য যথেষ্ট নয়। এই ঘাটতি পূরণে সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োজন হয়। মাছের জন্য বাইরে থেকে যে খাদ্য পুকুরে দেওয়া হয় তাকে সম্পূরক খাদ্য বলে। এই খাদ্যে মাছের প্রয়োজনীয় শ্বেতসার, আমিষ, খনিজ লবণ, স্নেহ ইত্যাদি সঠিক পরিমাণ থাকে।

প্রয়োজনীয় উপকরণ: ১. ফিশমিল, ২. মাছের গুঁড়া, ৩. চালের কুঁড়া, ৪. সরিষার খৈল, ৫. গম, ৬. বালতি, ৭. ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ, ৮. চিটাগুড়, ৯ পানি ইত্যাদি।

খাদ্যের উপকরণের তালিকা:

খাদ্য উপকরণেরপরিমাণ
১. চালের কুড়াঁ৩.৩০ কেজি
২. গম২.০০ কেজি
৩. সরিষার খৈল৩.০৫ কেজি
৪. মাছের গুড়া১.০০ কেজি
৫. চিটাগুড়৬০০ গ্রাম
৬. ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ৫০ গ্রাম
মোট =১০ কেজি

কার্যপদ্ধতি:

  1. প্রথমে প্রয়োজনমত সরিষার খৈল একটি পাত্রের পানিতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।
  2. ভিজা খৈল, পরিমাণ মতো চালের কুঁড়া ও চিটা গুড় একত্রে মিশিয়ে ছোট ছোট বল তৈরি করতে হবে।
  3. পাত্রটি পুকুরে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পানির ৩০ থেকে ৪৫ সে.মি. নিচে বাঁশের সাথে বেঁধে ডুবিয়ে রাখতে হবে।
  4. প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য দু’ভাগ করে সকালে ও বিকালে পানির নিচে পাত্রে দিতে হবে।
  5. খাদ্য প্রদানের স্থানকে মাঝে মাঝে পরিষ্কার করে দিতে হবে।
  6. পোনার ক্ষেত্রে ১০-১৫% ভেজা খাদ্য মোল্ড আকারে পুকুরের চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে।

সাবধানতা:

  1. সকল উপকরণ সঠিক ও নির্ভুলভাবে মেপে দিতে হবে।
  2. খাদ্য তৈরির স্থান পরিষ্কার হতে হবে।
  3. খাদ্য উপকরণ যেন নষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  4. তৈরিকৃত খাদ্য সঠিকভাবে মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনানীতি সমূহ মেনে মাছকে সরবরাহ করতে হবে।
See also  মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির ফর্মুলা তালিকা উপাদান এবং খাদ্য প্রস্তুত ও প্রয়োগ পদ্ধতি

(৫) মাছের পুকুরে খাদ্য সরবরাহ

  • পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণ না থাকলে অধিক পরিমাণে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হয় এবং প্রাকৃতিক খাদ্য বেশি পরিমাণ থাকলে কম পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করতে হয়।
  • পুকুরের পানির গুণাগুণের সাথে সাথে খাবারের পরিমাণের সম্পর্ক  রয়েছে। পুকুরে যেসব খাদ্য সরবরাহ করা হয় তার সবটুকু মাছ সরাসরি খাদ্য হিসেব গ্রহণ করতে পারে না। খাদ্যের কিছু অংশ পানিতে মিশে পানির গুণাগুণকে প্রভাবিত করে। এতে করে অনেক সময় পানির গুণাগুণ খারাপ হতে পারে, ফলে মাছের মৃত্যুও হতে পারে।
  • পুকুরের পানির গুণাগুণ ঠিক রাখার কোন সুব্যবস্থা না থাকলে প্রতি একরে ১৫ কেজির বেশি খাবার দেয়া ঠিক না।
  • সেক্কি ডিস্কের পাট ১০ সে.মি. এর কম হলে পুকুরে খাবার সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে। সেক্কি ডিস্কের পাট পুনরায় ২০ সে. মি.বা তার অধিক হলে আবার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।

(৬) মাছের খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি

মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনার অন্যন্য বিষয়গুলো মাঝে খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাদ্য প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য হলো মাছের অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা। প্রয়োগকৃত খাবারের সবটুকু মাছ গ্রহণ করলেই কেবল অধিক লাভ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।

  • মাছের খাদ্যভাস ও মাছ চাষ পদ্ধতির ওপর খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি নির্ভরশীল।
  • মাছ চাষ নিবিড় না আধা নিবিড় তার ওপর নির্ভর করে খাদ্যের প্রয়োগ মাত্রা। মাছের খাদ্য গ্রহণ মাছের আকারের ওপর নির্ভরশীল। মাছের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে খাবার গ্রহণের পরিমান ও মাত্রা কমতে থাকে।
  • পানির তাপমাত্রা ও দ্রবীভূত অক্সিজেনের ওপরও মাছের খাদ্য গ্রহণের মাত্রা নির্ভরশীল। পানির তাপমাত্রা বাড়লে খাদ্য গ্রহণের মাত্রা বাড়ে। তবে মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রায় খাবার প্রয়োগের মাত্রা কমিয়ে দিতে হবে।
  • নমুনায়নের মাধ্যমে মাছের গড় ওজন ঠিক করে মাছের খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা নির্ণয় করতে হয়। সাধারণত মাছের দেহের ওজনের ৩-৫% খাবার প্রয়োগ করা হয়। ছোট আকারের মাছের জন্য খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা বড় মাছের তুলনায় ঘন ঘন হতে হবে।
  • মাছকে প্রধানত তিন ভাবে খাদ্য প্রয়োগ করা যায়। যথা- হাত দিয়ে খাওয়ানো, চাহিদা অনুযায়ী খাওয়ানো এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে। 
  • আমাদের দেশে এখনো হাত দিয়ে খাওয়ানো পদ্ধতিই বহুল প্রচলিত। অন্য ২টি পদ্ধতি বানিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অনেক দেশে ব্যবহৃত হয়।
  • হাত দিয়ে খাবার প্রয়োগ শ্রম সাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। তথাপি এ পদ্ধতির কতগুলো সুবিধা রয়েছে। এ পদ্ধতিতে খাবারের প্রতি মাছ কিরূপ সাড়া দেয় তা খাদ্য প্রয়োগকারী স্বচক্ষে দেখতে পারে যা মাছ চাষে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভিজা খাবার প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাত ছাড়া অন্য পদ্ধতি কষ্টসাধ্য। একই ব্যক্তি হাত দিয়ে প্রতিদিন খাবার প্রয়োগ করলে মাছগুলো ঐ ব্যক্তির উপস্থিতিতে পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে উঠে।
  • সাধারণত পুকুরের কোন নির্দিষ্ট স্থানে মাছকে খাবার দিতে হয়। এর ফলে মাছ অল্প দিনের মধ্যে জেনে যায় পুকুরের কোন জায়গায় গেলে সহজে খাবার পাওয়া যাবে।
  • কিছু দিন একস্থানে খাবার প্রয়োগের পর আবার অন্য স্থানে কিছুদিন খাবার দেয়া ভালো। একই স্থানে সবসময় খাবার দিলে অব্যবহৃত খাবার জমে পঁচে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হতে পারে। তাই কিছুদিন পর পর পরীক্ষা করে দেখতে হবে মাছ সব খাবার খেয়েছে কিনা।
  • উপরের অংশ খোলা এরূপ বাক্সে বা পাত্রেও খাবার প্রয়োগ করা যায়। এতে মাঝে মাঝে দেখা যায় মাছ সমস্ত খাবার খেয়েছে কি না।
  • একদিনের খাবার একবারে না দিয়ে সকালে ও বিকালে অথবা সকালে, দুপুরে ও বিকালে (৩ বারে) দেওয়া উত্তম।
  • পুকুর বা জলাশয়ে মজুদকৃত মাছের দৈহিক ওজন অনুযায়ী খাবার দিতে হয়। মাছ কী পরিমান খাবার গ্রহণ করেছে তার পরিমাণ নির্ধারণ করে সঠিক মাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়।
  • নার্সারি পুকুরে পোনা মাছের ক্ষেত্রে পাউডার বা দানাদার খাদ্য মাছের দেহের ওজনের ১০-১৫% হারে প্রতিদিন ৩-৪ বার পুকুরের চার পাশে ৩-৪টি নির্দিষ্ট স্থানে ছড়িয়ে দিতে হবে।
  • মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে দানাদার খাদ্য মাছের দেহের ওজনের ৩-৫% হারে প্রতিদিন ২-৩ বার পুকুরের চার পাশে ৩-৪টি স্থানে ছিটিয়ে দিতে হবে।
  • কার্প জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাদ্য গোলাকার পিন্ড আকারে এবং মাংসাশী ও রাক্ষুসে মাছের ক্ষেত্রে পিলেট আকারে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
  • একই সাথে পুকুরের বিভিন্ন স্থানে খাদ্য দিতে হবে। খাদ্য দ্রব্য সরাসরি ছিটিয়ে না দিয়ে ডুবন্ত খাবার ট্রে বা পাটাতনে দিতে হবে।
  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য দিতে হবে।
  • প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্য একবারে না প্রয়োগ করে কয়েকবারে ভাগ করে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি দিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সম্ভব হলে ভাগ করে তিন বারে দিলে ভালো। অল্প পরিমানে ও বেশিবার খাবার প্রয়োগ করলে খাবারের অপচয় হয় না।
  • খাদ্য দিনের আলোতে দিতে হবে। সূর্যোদয়ের আগে বা সূর্যাস্তের পরে খাদ্য দেওয়া ঠিক নয়।
See also  মাছ ও চিংড়ির সম্পূরক খাদ্য তৈরির পদ্ধতি

(৭) মাছের খাদ্য স্বভাব

বাংলাদেশে চাষযোগ্য প্রজাতির মাছগুলো পুকুরে বা জলাশয়ের প্রধানত: তিনটি স্তরের খাবার গ্রহণ করে থাকে। উপরের স্তর, মধ্যের স্তর এবং নিচের স্তর।

  • উপরের স্তর: উপরের স্তরে যেসব মাছ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে সেগুলো হলো কাতলা, সিলভার কার্প।
  • মাঝের স্তর: রুই মাছ মাঝের স্তরের খাবার গ্রহণ করে থাকে।
  • নিচের স্তর: মৃগেল, মিরর কার্প ও কমন কার্প (কার্পিও) নিচের স্তরের খাবার গ্রহণ করে থাকে।
  • সর্ব স্তর: গ্রাস কার্প ও সরপুঁটি বিভিন্ন স্তুরের খাবার গ্রহণ করে থাকে।

বিভিন্ন প্রজাতির মাছের খাদ্য স্বভাব বিভিন্ন ধরনের।

  • কাতলা মাছ: কিশোর ও পূর্ণ বয়স্ক উভয় ক্ষেত্রেই প্রাণিজ প্ল্যাঙ্কটন খায়। তবে কিছু কিছু শৈবালও খেয়ে থাকে।
  • রুই মাছ: পানির মধ্যভাগের খাবার গ্রহণ করে বিধায় একে কলাম ফিডার বলা হয়। রুই মাছ উদ্ভিদভূক্ত মাছ। এরা ছোট অবস্থায় শুধু প্রাণিজ প্ল্যাঙ্কটন এবং বড় অবস্থায় প্ল্যাঙ্কটন ও পঁচনশীল জৈব পদার্থ খেয়ে থাকে।
  • মৃগেল মাছ: বয়স্ক অবস্থায় সাধারণত তলদেশের জৈব পদার্থ খেয়ে থাকে। তবে এরা প্লাঙ্কটনও খেয়ে থাকে।
  • সিলভার কার্প: ছোট অবস্থায় রোটিফার নামক জুওপ্লাঙ্কটন এবং বড় অবস্থায় ফাইটোপ্লাঙ্কটন খেয়ে থাকে।
  • গ্রাস কার্প: ছোট অবস্থায় প্রাণিজ প্লাঙ্কটন এবং বড় অবস্থায় জলজ আগাছা খেয়ে থাকে।
  • কমন কার্প বা কার্পিও মাছ: এরা সর্বভূক। এরা পুকুরের তলদেশের খাবার খেয়ে থাকে। এরা ১০ সে.মি. লম্বা হলেই এক বিশেষ খাদ্যভ্যাস গ্রহণ করে। এরা গব গব করে কাদা মুখে নেয় এবং উহার জৈব অংশ ছেকে নিয়ে বাকীটুকু ফেলে দেয়। ফলে কার্পিও মাছ যে পুকুরে চাষ করা হয় সে পুকুরের পানি সব সময় খোলা থাকে।
  • তেলাপিয়া মাছ: কিশোর অবস্থায় সর্বভূক্ত। এরা ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও জুপ্লাঙ্কটনকে প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
  • শোল, গজার, বোয়াল, আফ্রিকান মাগুর মাছ: এগুলো রাক্ষুসে মাছ বিধায় এদের খাদ্য স্বভাব ভিন্ন হয়। এরা ছোট অবস্থায় জুপ্লাঙ্কটন খেয়ে থাকে বড় অবস্থায় শামুক, কীটপতঙ্গ ও ছোট ছোট মাছ খেয়ে থাকে। তাছাড়াও ফিশ মিল, সরিষার খৈল, চালের কুড়া, গমের ভূষি প্রভৃতি সম্পূরক খাদ্যও এরা গ্রহণ করে থাকে।

প্রিয় পাঠক, ‍উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা আমরা মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা, মাছের খাদ্যের প্রকারভেদ, মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য, মাছের সুষম সম্পূরক খাদ্য তৈরিকরণ, মাছের পুকুরে খাদ্য সরবরাহ, মাছের খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি, মাছের খাদ্য স্বভাব প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে একটা বিস্তর ধারণা লাভ করলাম।

অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োগ করলে অপচয় হতে পারে যার ফলে পানির গুণগতমান দ্রুত নষ্ট হয় যা নানা ধরনের রোগ ও মৃত্যু হার বেড়ে যাওয়ার কারণ। আবার প্রয়োজনের তুলনায় কম খাদ্য সরবরাহ করলে বা খাবারে ঘাতটি থাকলে মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ও অধিক উৎপাদন নিশ্চিত হবে না। তাই উভই দিক বিবচেনা করে সঠিকভাবে মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

খামারকে লাভজনক করতে অপচয় রোধের ব্যাপারে মাছ চাষিদের সচেতন হতে হবে। সঠিকভাবে মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনার দ্বারা খাদ্যের অপচয় কমাতে হবে; খাদ্যের পচনজনিত কারণে পানির গুণগত মান নষ্ট না হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে; দৈহিক ওজন ও দৈনিক বৃদ্ধি সম্পর্কে অবগত থাকা ও খাদ্যের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা ধাকতে হবে; সঠিক রোগ ব্যাবস্হাপনার মাধ্যমে মাছের মৃত্যুহার কম করতে হবে; মাছের উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে যথেষ্ট মুনাফা নিশ্চিত করতে হবে।

[সূত্র: ওপেন স্কুল]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page