চিংড়ি একটি সন্ধিপদী (আর্থ্রোপোডা) প্রাণী। স্বাদু জলের চিংড়ির গণ (Genus) প্যালিমন (Palaemon) এর বিভিন্ন প্রজাতিকে একত্রে চিংড়ী বলে।
বাংলাদেশে সাধারণত তিন ভাবে চিংড়ি মাছের চাষ করা যায়। যথা: এককভাবে চিংড়ি চাষ; পর্যায়ক্রমে চিংড়ি ও ধান চাষ; ও পর্যায়ক্রমে লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি চাষ।
এককভাবে চিংড়ি চাষ বলতে প্রধানত উপকূলীয় এলাকায় বাগদা চিংড়ির চাষকেই বোঝায়। যেখানে জোয়ার ভাটার প্রভাব রয়েছে সে এলাকা একক চিংড়ি চাষের জন্য উপযোগী। খুলনা জেলার চিংড়ি খামার গুলোর অধিকাংশই উপকূলীয় বাঁধের ভিতরে অবস্থিত।
চিংড়ি চাষে চাষীগণ মাছের পরিবহন, সংরক্ষণ/প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের চেইন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় মধ্যসত্বভোগী থেকে মুক্তি পায় না, উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য বা ন্যায্যমূল্য পায় না, চিংড়ির মান অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হয় না, দাদন ব্যবসার শর্ত থেকেও মুক্তি পায় না।
আপনি একজন স্মার্ট চাষী হিসেবে, ব্যবসায় সফল হতে হলে, আধুনিক পদ্ধতি মাছ চাষ করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভাববে চাষকৃত চিংড়ি আধুনিক পদ্ধতিতে পরিবহন, সংরক্ষণ/প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুবা আপনি যথেষ্ট পরিমান শ্রমের মূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন।
এ পাঠ শেষে আপনি- চিংড়ি মাছের পরিবহন সম্পর্কে জানতে পারবেন। চিংড়ি মাছে সংরক্ষণের/প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পদ্ধতির নাম সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন। চিংড়ি মাছের বাজারজাতকরণ পক্রিয়া বুঝতে পােরবেন।
(১) চিংড়ি চাষে, উক্ত চিংড়ি মাছের পরিবহন
চিংড়ি পরিবহন বলতে বোঝায় চিংড়ি আহরণের পর আহরণের স্থান হতে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় বা ভোক্তা বা ক্রেতার নিকট পৌঁছানো।
চিংড়ি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস। চিংড়ি পঁচনশীল প্রাণি তাই চিংড়িকে পঁচন থেকে রক্ষা করে চাহিদা অনুযায়ী বাজারজাত করতে হয়। এতে করে চিংড়ি চাষিরা লাভবান হবে এবং দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে। তাই উপযুক্ত পদ্ধতিতে চিংড়ি পরিবহন ও বাজারজাত করার প্রয়োজন।
ক) চিংড়ি পরিবহন ও বাজারজাতকরণের প্রয়োজনীয়তা
- খাওয়ার উপযোগী চিংড়িকে ক্রেতার নিকট চাহিদা অনুযায়ী পৌঁছানো।
- বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা।
- এক স্থানের চিংড়ি দিয়ে অন্য স্থানের চাহিদা পূরণ করা।
- চিংড়িকে পঁচনের হাত থেকে রক্ষা করা।
- সারা বছর বাজারে বা ভোক্তার নিকট চাহিদা অনুযায়ী চিংড়ি সরবরাহ করা।
- চিংড়ির দাম ভালো পাওয়া।
- দেশের রাজস্ব ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা।
- দেশের মানুষের আর্থ-সামাাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা।
খ) চিংড়ি পরিবহনের সময় করণীয় বিষয়
চিংড়ি পরিবহনের সময় নিচের পরিচর্যাগুলো অনুসরণ করতে হবে।
i) নৌকা বা জাহাজের উপর পরিচর্যা
- চিংড়িকে আকার ও প্রজাতি অনুসারে পৃথক করতে হয়।
- এমনভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যেন আঘাত না পায়।
- ব্যবহারকারীর জন্য পাত্র, ঝুড়ি এমনভাবে হতে হবে যেন সহজে পরিষ্কার করা যায়।
- সূর্যালোক যেন না পড়ে সেভাবে রাখতে হবে।
- ক্লোরিনযুক্ত (৫-১০ পিপিএম) পানিতে ধুয়ে নিলে ভালো হয়।
- প্রতিবার চিংড়ি রাখার পূর্বের জিনিসপত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
- ডেক, চিংড়ির ঘর, বালতি, পাত্র, বরফ ভাঙ্গাঁর কাঠ বা লাঠি ইত্যাদি কে ¬ারিন পানি দ্বারা ধুয়ে নিতে হবে।
- চিংড়ি বেশিক্ষণ বাইরে রাখা যাবে না।
ii) চিংড়ি খালাস ও পরিবহনের সময় পরিচর্যা
- চিংড়ি খালাস করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন চিংড়ির গায়ে কোন আঘাত না লাগে।
- খালাসের পর চিংড়িকে পরিষ্কার স্থানে রাখতে হবে এবং পূনরায় বরফ দেওয়ার প্রয়োজন হলে দ্রুত দিতে হবে।
- চিংড়ি পরিবহনের সময় প্লাস্টিক বাক্স ব্যবহার করাই উত্তম। কাছাকাছি পরিবহনের ক্ষেত্রে তাপ প্রতিরোধ বাক্স ব্যবহার করাই উত্তম।
- দূরে চিংড়ি পরিবহনের ক্ষেত্রে শীতল ভ্যান ব্যবহার করা উত্তম এবং যত দ্রুত সম্ভব পরিবহন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
- চিংড়ি খালাসের সময় বাক্সের উপর দাঁড়ানো বা স্তুপাকারে রাখা যাবে না।
- ঢাকনাওয়ালা ও তলায় ছিদ্রযুক্ত ধাতু নির্মিত পাত্র যথাযথভাবে বরফ দিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
(২) চিংড়ি চাষে, উক্ত চিংড়ি মাছের সংরক্ষণ/প্রক্রিয়াজাতকরণ
চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ বলতে সাধারণ অর্থে আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়িকে দীর্ঘসময় গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রেখে সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে বোঝায়।
চিংড়ি আহরণের পর দ্রুত প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। চিংড়িতে রয়েছে আমিষ, শ্বেতসার, ফ্যাট, খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন। চিংড়ি আহরণের পর যথাসময়ের মধ্যে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত না করলে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে। বিদেশের ক্রেতারা ক্রয় করতে চায় না। এতে রপ্তানির সমস্যা দেখা দেয়।
নিম্নে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ আধুনিক পদ্ধতি একটি ফ্লো-চার্টের মাধ্যমে আলোচনা করা হলা-
- প্রথমে সমুদ্রে উপকূলবর্তী এলাকা বা ঘের থেকে ঝুড়ি বা বাক্স ভর্তি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান্টে আনা হয় এবং ছোটবড়, ভালো-খারাপ ইত্যাদির ভিত্তিতে মাথা ছাড়িয়ে গ্রেডিং করা হয়।
- এরপর গ্রেডিং করা মাছকে বরফ গলিয়ে ক্লোরিনযুক্ত চলমান পানি দ্বারা (২০ পি.পি.এম) ধৌত করা হয়। যদি একসঙ্গে বেশি মাছ আসে তবে যে মাছগুলো ধৌত করা হবে সেগুলো ঠান্ডা ঘর থেকে বের করে বাকিগুলো ঠান্ডাঘরে রাখতে হবে। মোট কথা চিংড়ি বেশিক্ষণ বাইরে রাখা যাবে না।
- এরপর মাথাসহ ও মাথাবিহীন চিংড়িকে আলাদা করে ১০ পিপিএম ক্লোরিন মিশ্রিত অবস্থায় ধৌত করার পর ওজন নিয়ে চিংড়িগুলো প্যানিং ট্রেতে সুন্দর করে সাজানো হয় এবং ৩-৫ পিপিএম ক্লোরিন মিশ্রিত ঠান্ডা পানি দিয়ে প্যানিং ট্রে ভরে পলিথিন দ্বারা ঢেকে দেয়া হয়।
- তারপর প্যানিং ট্রেগুলো প্লেটা বা কন্ট্রাক্ট ফ্রিজারে নির্দিষ্ট চেম্বারে স্থাপন করে- ৩৫ থেকে-৪০ সে. তাপমাত্রায় হিমায়িত করা হয়। সময় লাগে ১৫ মিনিট থেকে ২-৩ ঘণ্টা এবং প্যানিং ট্রেতে ৪-৮টি ব্লক করা যায়। প্রতি ব্লকের ওজন বিভিন্ন মাপের করা যায় যেমন: ১ কেজি, ১.৮ কেজি ইত্যাদি। এ গ্লেজিং মাছকে শুষ্ক বোধ করে এবং পচনকে বাধাগ্রস্ত করে। ২-৩ ঘণ্টার কম সময় হিমায়িত করলে মাছের গুণগত মান ভালো থাকে না।
- গ্লেজিং করার পর চিংড়ির ব্লকগুলোর অভ্যন্তরীণ মোড়ক (ইনার কার্টুনে) ভরে সিল করা হয় এবং কার্টুনের গায়ে বিভিন্ন তথ্য থাকে, যেমন- কোম্পানির নাম, চিংড়ির প্রকৃত ওজন, চিংড়ির নাম ও গ্রেড, ব্যাচ বা কোড নম্বর, পাউন্ড প্রতি চিংড়ির সংখ্যা, রপ্তানিকারকের ঠিকানা।
- ৬ বা ১০টি ইনার কার্টু একটি মাস্টার কার্টুনের মধ্যে ভরে পলি প্রপাইলিন (পিপি) বেল্ট দিয়ে মোড়ক বাঁধা হয়। তারপর হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয় রপ্তানির জন্য এবং রপ্তানি করা হয়।
(৩) চিংড়ি চাষে, চিংড়ি মাছের বাজারজাতকরণ
চিংড়ি বাজারজাতকরণ বলতে সাধারণ অর্থে আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ির গুনগত মান অক্ষুন্ন রেখে সংরক্ষণ করে বাজারে বিক্রি করাকে বোঝায়।
ক) চিংড়ি বাজারজাতকালীন অসুবিধাসমূহ
চিংড়ি বাজারজাতকরণের চেইন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় চেইনের অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী যেমন- পোনা, খাদ্য, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সরবরাহে নানা ধরনের মধ্যসত্বভোগী সংশ্লিষ্ট থাকায় সমষ্টিগতভাবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য ও চিংড়ির মান অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হয় না। চিংড়ি সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞানতা, চিংড়ি খামার হতে বিক্রয় কেন্দ্রের দূরত্ব, বাজার দরের তথ্য না পাওয়া, সর্বপরি দাদন ব্যবসার শর্তের কারণে চাষি চিংড়ির ন্যায্যমূল্য পায় না।
খ) চিংড়ির বাজার অবকাঠামো
আমাদের চিংড়ির বিপণন ব্যবস্থা অধিক মধ্যসত্বভোগীর কারণে বেশ জটিল। এ ব্যবস্থায় চাষি পর্যায় থেকে ফড়িয়া, পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ছোট ডিপো, বড় ডিপো, আড়তদার, পাইকার, কমিশন এজেন্ট হয়ে সবর্ শেষ প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় চিংড়ি সরবরাহ হয়ে থাকে।
নিম্নে বাংলাদেশের চিংড়ি বাজারজাতকরণ পদ্ধতি একটি ফ্লো-চার্টের মাধ্যমে আলোচনা হলো-
- চিংড়ি চাষী: চিংড়ি খামারের অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার উপর নির্ভর করে চাষীগণ সরকারি খামারে ফড়িয়াদের নিকট অথবা ছোট ডিপো বা আড়তে চিংড়ি বিক্রয় করেন।
- ফড়িয়া: ফড়িয়াগণ সরাসরি চিংড়ি চাষীদের নিকট থেকে চিংড়ি ক্রয় করে ছোট ও বড় ডিপোতে বিক্রয় করে থাকে। আড়তদার: চিংড়ি চাষী যারা ফড়িয়া বা আড়তদার এর নিকট দাদন গ্রহণ করে না বা চুক্তিবদ্ধ থাকে না, তারা তাদের উৎপাদিত চিংড়ি সরাসরি আড়ত বা নিলাম কেন্দ্রে বিক্রয় করতে পারেন।
- ডিপো মালিক: ডিপো মালিকগণ চিংড়ি চাষী বা ফড়িয়াদের নিকট থেকে চিংড়ি ক্রয় করে থাকেন। ডিপো মালিকগণ চিংড়ি ক্রয় করার জন্য চাষী ও ফড়িয়াদের ঋণ প্রদান করেন।
- পাইকার: সাধারণত পাইকাররা বিপুল সংখ্যক চিংড়ি আড়তদারের নিকট থেকে সংগ্রহ করে থাকে। কোনো কোনো পাইকার কমিশন এজেন্টের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করে থাকে। তাছাড়া আড়তদারে নিকট থেকে নিলামের মাধ্যমে ও দরকষাকষির মাধ্যমে চিংড়ি ক্রয় করে প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় প্রেরণ করেন।
- কমিশন এজেন্ট: কমিশন এজেন্টগণ একাউন্টহোল্ডার হিসেবে কাজ করে থাকেন। যারা বড় ডিপো মালিক বা পাইকারের সাথে রপ্তানিকারকদের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করেন। কমিশন এজেন্টগণ সাধারণত প্রতি কেজি চিংড়ির জন্য ৫ টাকা হারে রপ্তানিকারকের নিকট থেকে কমিশন পেয়ে থাকেন।
- প্রক্রিয়াকরণকারী/রপ্তানিকারক: সাধারণত প্রক্রিয়াকরণকারী কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে পাইকার বা বড় ডিপো থেকে চিংড়ি ক্রয় করে প্রক্রিয়াজাত করেন এবং বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। তারা অভ্যন্তরীণ এবং বৈদশিক বাজারের মধ্যে চিংড়ি বৈদেশিক রপ্তানি বাজারের মধ্যে চিংড়ি সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থার জন্য চূড়ান্ত ব্যক্তি হিসেবে কাজ করে।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা চিংষি চাষে উক্ত চিংড়ি মাছের পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ পক্রিয়া সম্পর্কে জানলাম।
চিংড়ি পচনশীল দ্রব্য, তাই এদের আহরণের পর দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের জন্য সঠিক প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাতকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
টিনজাতকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে চিংড়িকে সম্পূর্ণরুপে বায়ুশূন্য পাত্রে আবদ্ধ করে অতি উচ্চ তাপমাত্রা প্রয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে জীবাণু মুক্ত করা হয়।
ধুমায়িতকরণ হলো চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের এমন একটি পদ্ধতি যেখানে কাঠ পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন ধোয়ায় তাপমাত্রা এবং ধোঁয়া কণার যৌথ ক্রিয়ার মাধ্যমে মাছের দেহ থেকে পানি অপসারিত হয়।
সাধারণত পরিপক্ক ও চর্বিযুক্ত মাছ এবং চিংড়ি ধূমায়নের জন্য কাঁচামাল হিসেবে বেশি উপযোগী। বাংলাদেশে সরকারী উদ্যোগের অংশ হিসেবে মৎস্য উন্নয়ন সংস্থা আহরিত চিংড়ী অভ্যন্তরীণ ও আন্র্তজাতিক উভয় বাজারেই বাজারজাতকরণ করে থাকে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।