সাইলেজ স্বভাবিক ঘাসের মতোই প্রাণীকে খাওয়ানো যায়। সাইলেজ সবুজ ঘাসের চাহিদা পূরণ করে। সব বয়সের প্রাণীকে সহজে খাওয়ানো যায়। অল্প করে অভ্যাস করিয়ে বেশি করে খাওয়ানো যায়। সঠিকভাবে পরিচর্যার পাশাপাশি নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ সাইলেজ খাওয়ানো হলে গরুর মাংস উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত ঠিকাদান, কৃমিমুক্ত রাখা এবং দানাদার খাবারের সঙ্গে সাইলেজ খাওয়ানোর ফলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
সাইলেজের পুষ্টি এবং উপকারিতা জেনে খামারিরা নিজেরা এটি উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া দেশের কিছু কোম্পানি আধুনিক নিয়মে সাইলেজ উৎপাদন করে খামারিদের প্রয়োজনে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছে।
সাইলেজ অন্য খাবারের তুলনায় অনেকটা সাশ্রয়ী, বিশেষ করে শুকনো খড় খাওয়ানোর চেয়ে সাইলেজ খাওয়ানো অনেক ভালো এবং খামারিরা এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লাভবান হচ্ছে।
এ পাঠ শেষে আপনি- সাইলেজ কি, সাইলেজ কোন ধরনের খাদ্য তা জানতে পারবেন। সাইলেজ তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন। সাইলেজ তৈরির সাবধানতা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
(১) সাইলেজ কি?
সাইলেজ কি: বায়ুনিরোধক স্থানে সংরক্ষিত সবুজ ঘাসকে সাইলেজ বলে। অর্থ্যাৎ খাদ্যমানের কোনো পরিবর্তন না করে সবুজঘাস বা গাছকে ভবিষ্যতে গবাদি প্রাণির রসালো খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা।
এনসাইলেজিং কি: সাইলেজ তৈরির প্রক্রিয়াকে এনসাইলেজিং বলে।
সাইলো কি: সাইলেজ তৈরির জন্য বায়ুনিরোধক কনটেইনার বা ধারককে সাইলো বলে। অর্থ্যাৎ যে স্থানে গর্ত করে খাদ্য সংরক্ষণ করা হয় তাকে সাইলো বলে।
- সাধারণত তাজা ও সবুজ নন-লিগ্যুমজাতীয় ঘাস সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
- যে ঘাসে দ্রবণীয় শ্বেতসার বেশি থাকে তা সাইলেজ প্রস্তুত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ভূট্টা, জোয়ার, গিনি, নেপিয়ার ইত্যাদি ঘাস সাইলেজ প্রস্তুত করার জন্য উত্তম।
- শুঁটিজাতীয় ঘাসের সাইলেজ করতে হলে এর সঙ্গে অশুঁটি ঘাস মেশাতে হবে। যেমন- কাউপি, ভুট্টা মিশ্রিত করে সাইলেজ প্রস্তুত করা যায়।
- ভুট্টা সাইলেজ তৈরির জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ঘাস। যেসব ঘাসে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে সেগুলো সাইলেজের জন্য ভাল। কারণ শর্করা সহজেই গাজন হয়।
- সাইলেজে ঝোলাগুড় যোগ করে শর্করার পরিমাণ বাড়ানো যায়।
- কাঁচা ধানের খড় ও ঘাস একত্রে ৫:১ অনুপাতে মিলিয়ে সাইলেজ তৈরি করা যায়।
(২) সাইলেজ কোন ধরনের খাদ্য?
সাইলেজ কোন ধরনের খাদ্য: সাইলেজ মূলত সবুজ ঘাস সংরক্ষণ করার একটি পদ্ধতি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সবুজ ঘাসের পুষ্টি উপাদান সঠিক রেখে বায়ুশূন্য অবস্থায় সবুজ ঘাসকে ভবিষ্যতের জন্য প্রক্রিয়াজাত করে রাখার প্রক্রিয়াকে সাইলেজ বলা হয়। সাইলেজ পুষ্টিকর একটি গোখাদ্য প্রস্তুত প্রক্রিয়া, যার বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে।
সাধারনত অমৌসুমে অর্থাৎ যখন কাঁচা ঘাসের অভাব দেখা দেয় দেয় তখন গবাদিপ্রাণিকে সাইলেজ খাওয়ানো হয়। বায়ুনিরোধন স্থানে সংরক্ষিত সবুজ ঘাসকে সাইলেজ বলে। ভুট্টা, জোয়ার, গিনি, নেপিয়ার ইত্যাদি ঘাস সাইলেজ তৈরি করার জন্য উত্তম। যেসব ঘাসে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে সেইসব ঘাস সাইলেজ তৈরির জন্য সর্বোৎকৃষ্ট।
সাইলেজ পুষ্টিকর একটি গোখাদ্য প্রস্তুত প্রক্রিয়া, যার বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। ভালোভাবে পচন করা হলে সাইলেজের শর্করা খাবার পরিপাকযোগ্য এসিডে পরিণত হয়, যা গরুর খাদ্যের পুষ্টিগুণ বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সাইলেজে ব্যবহৃত সব পুষ্টি উপাদান খাবারকে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। প্রাকৃতিকভাবে চরে যাওয়া ঘাসের চেয়ে অনেক বেশি খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়। এতে শক্তির অপচয় অনেক কম হবে। দুগ্ধবতী গাভির শারীরিক এবং দুধ উৎপাদনের প্রয়োজনে প্রচুর পরিমাণে শক্তি, আমিষ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। ভালো মানসম্পন্ন সাইলেজের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ শক্তি, প্রোটিন, ভিটামিন, ফাইবার রয়েছে, যা গাভির দুধ উৎপাদন অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক ও ভালো রাখে।
সাইলেজের মধ্যে এনার্জি, আমিষ ও প্রয়োজনীয় ফ্যাট বিদ্যমান থাকায় গাভির পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সাইলেজ সঠিক মাত্রায় খাওয়ানো হলে প্রজনন প্রক্রিয়া ভালো থাকে।
বর্ষা মৌসুমে সবুজ ঘাসে ময়েশ্চার বেশি থাকার কারণে শুকাতে সমস্যা হয়, আর শুকনো হলে পুষ্টিমান কমে যায়। তাই সারা বছর সঠিক পুষ্টিমানসমৃদ্ধ ঘাস গরুকে খাওয়াতে সাইলেজ হতে পারে উত্তম প্রক্রিয়া।
কাঁচা ঘাসের তুলনায় এই প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করে রাখা ঘাসের গুণগত ও খাদ্যমান বেশি। দেশীয় ঘাস যেমন: দূর্বা, বাকসা, আরাইল, সেচি, দল ইত্যাদি গাছের পাতা যেমন: ধৈঞ্চা, ইপিল-ইপিল উন্নত জাতের ঘাস যেমন: নেপিয়ার, পাকচং, জার্মান, ভুট্টা, সুদান, পারা, সরগম ইত্যাদি সাইলেজ তৈরি করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
(৩) সাইলেজ তৈরির পদ্ধতি
নিম্নে সাইলেজ তৈরির পদ্ধতির ১০টি ধাপ উল্লেখ করা হলো-
- ফডারের ফুল আসার পূর্বের কান্ড যখন খুব নরম ও রসালো থাকে ঠিক তখন সাইলেজ তৈরির জন্য কাটতে হবে।
- ঘাসগুলো ১৫-২০ সেমি. পরিমাণ করে কেটে নিতে হবে।
- সাইলোর তলায় পলিথিন দিলে আগে বিছিয়ে নিতে হবে। পলিথিন না দিলে পুরু করে খড় বিছাতে হবে। এরপর দু-পাশে পলিথিন না দিলে ঘাস সাজানোর সঙ্গে সঙ্গে খড়ের আস্তরণ দিতে হবে।
- নিচু জায়গায় সাইলো করা যাবে না। তাতে পানি জমে সাইলেজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
- সবুজ ঘাস কাটার পর সাইলোপিটে গর্ত করে (সেইলেজ এর জন্য এর জন্য তৈরিকৃত গর্ত) সাইলেজ বায়ুরোধক অবস্থায় স্তরে স্তরে সাজানো হবে।
- ঘাসে দ্রবনীয় কার্বহাইড্রেটের পরিমাণ কম মনে হলে অথবা অশুটি ঘাসের সাথে শুঁটিজাতীয় ঘাস মিশ্রিত করে সাইলেজ প্রস্তুত করার সময় ঝোলাগুড় বা চিটাগুড় স্তরে স্তরে মিশ্রিত করতে হবে।
- প্রতি স্তরে সাজানোর সময় সাইলোর ভেতরে নেমে পা দিয়ে ভালোভাবে প্যাকিং করতে হবে যেন ভিতরে ফাঁকা না থাকে।
- চেপে চেপে বসানো ঘাসের ওপর একস্তর খড় বা নিম্নমানের ঘাস দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
- তারপর শক্ত পলিথিন দিয়ে ঢেকে এমনভাবে মাটি চাপা দিতে হবে যাতে ভেতরে পানি ঢুকতে না পারে। সম্ভব হলে সাইলোর উপরে চালের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বৃষ্টির পানিতে সাইলোজ ভিজে না যায়।
- সাইলেজ তৈরি হলে তা সবুজ রংয়ের হবে এবং পচা ঘাসের মত দেখাবে।
বিঃদ্রঃ সাইলেজ কাঁচা ঘাস বা শুকনা খড়ের সাথে মিলিয়ে খাওয়ানো যায়। ৩/৪ সপ্তাহ পর থেকেই গবাদি প্রাণিকে সাইলেজ খাওয়ানো যেতে পারে।
(৪) সাইলেজ তৈরিতে সাবধানতা
- ফডারের জাত নির্বাচন: অশুঁটি জাতীয় ফডার দিয়ে সাইলেজ করা ভালো। শুঁটি ও অশুঁটি ফডার মিশ্রিত করলে চিটাগুড় মিশিয়ে দিতে হবে।
- ফসল সংগ্রহের সময়: সাইলেজ প্রস্তুতির জন্য সবুজ ঘাসের কান্ড নরম ও রসালো অবস্থায় ফুল আসার পূর্বে কাটতে হবে। শুকনো দ্রব্য ৩০-৩৫% থাকতে হবে।
- সঠিকভাবে সাইলো প্রস্তুতকরণ: সাইলো পিট নির্মাণ কাঠামো সঠিক হতে হবে। সাইলো পিটে বায়ূরোধক অবস্থা বজায় রাখতে হবে। এয়ার পকেট যেন তৈরি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
উপরোক্ত আলোচনায় আমরা সাইলেজ কি, সাইলেজ কোন ধরনের খাদ্য, সাইলেজ তৈরির পদ্ধতি, সাইলেজ তৈরিতে সাবধানতা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে অবগত হলাম।
আমাদের বাংলাদেশের চারণভূমির পরিমাণ দিন দিন ক্রমেই কমছে। দানাদার খাদ্যের দামও ক্রমাগত বাড়ছে। এমন অবস্থায় খামারিদের প্রাণিখাদ্য বিশেষ করে ঘাস খাওয়ানোর জন্য ঘাস সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঘাসের অভাব পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সাইলেজ।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।