বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ। জাতীয় আয়ের সিংহভাগ এখনও কৃষি থেকে আসে। কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র এখনও কৃষি।
এই আলোচনাটি পড়লে আপনি- কৃষি ঋণ কি, কৃষি ঋণ কত প্রকার ও কৃষি ঋণ পাওয়ার উপায় সম্পর্কে সবিস্তারে জানতে পারবেন।
(১) কৃষি ঋণ কি?
কৃষি ঋণ কাকে বলে: কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ যেমন- অধিক উৎপাদনশীল বীজ, সার, বালাইনাশক ইত্যাদি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উৎস থেকে কৃষক যে ঋণ গ্রহণ করে তাকে কৃষি ঋণ বলে।
কৃষি ঋণ বলতে কি বুঝায়: কৃষি ঋণ হচ্ছে মূলত কৃষক কর্তৃক কৃষি উপাদান ও প্রযুক্তি ক্রয়ের জন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে শর্ত সাপেক্ষে নিদিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ গ্রহণ করা।
কৃষি ঋণ কি: কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়াও কৃষি ভূমির উন্নতি সাধন, উৎপাদিত পণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরন ইত্যাদি কাজের জন্য কৃষকের যে ঋণের প্রয়োজন হয় তাই হলো প্রধানত কৃষি ঋণ।
এদেশে কৃষকরা দরিদ্র বলে উৎপাদনের প্রয়োজনে নিজস্ব তহবিল থেকে সবসময় প্রয়োজনানুযায়ী অর্থ যোগান দিতে পারে না বিধায় তারা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নেয়।
আমাদের দেশে ঋণের অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলো অসংগঠিত অনিশ্চিত ও শোষণমূলক হওয়ায় কৃষকদেরকে বাধ্য হয়ে ঋণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলোর মুখাপেক্ষী হতে হয়।
কৃষি ঋণের প্রাতিষ্ঠানিক উৎস দেশী ও বিদেশী হতে পারে। দেশীয় উৎসের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক ও সমবায় সমিতি এবং অনুমোদিত বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (এনজিও) হলো প্রধান। বিদেশী উৎসের মধ্যে বিশ্বব্যাংক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।
(২) কৃষি ঋণ কত প্রকার?
কৃষি উৎপাদন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং সময় সাপেক্ষ পদ্ধতি। জমির কর্ষণ থেকে আরম্ভ করে উপকরণ ক্রয়, উৎপাদিত পণ্যের সংরক্ষরণ এবং বাজারজাতকরণের প্রত্যেক ধাপেই কৃষকের অর্থের প্রয়োজন হয়। এছাড়াও প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসল নষ্ট হলে কৃষককে বাঁচার জন্যও অর্থ ধার করতে হয়।
তো কৃষি ঋণ কত প্রকার: যে উদ্দেশ্যেই কৃষক ঋণ গ্রহণ করুক না কেন সময়ভেদে তা মূলত তিন ধরণের হয়ে থাকে। যথা-
- স্বল্পমেয়াদি
- মধ্যমেয়াদি এবং
- দীর্ঘমেয়াদি।
বিভিন্ন মেয়াদের ঋণ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নিম্নে প্রদান করা হলো।
ক) স্বল্পমেয়াদি কৃষি ঋণ
স্বল্পমেয়াদ বলতে সাধারণত একবছর বা বারোমাস পর্যন্ত সময়সীমা বোঝায়। সুতরাং এই সময়সীমার জন্য কৃষকের যে ঋণ চাহিদার প্রয়োজন হয় তাকে স্বল্পমেয়াদি কৃষি ঋণ বলা যেতে পারে।
সাধারণত স্বল্পমেয়াদে যেসব উদ্দেশ্যে কৃষক ঋণ নেয়, সেগুলো নিম্নরুপ হয়ে থাকে-
- সাম্য ঋণ: সাধারণত ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বা ফসল উৎপাদনের প্রয়োজনে কৃষককে এ ঋণ দেয়া হয়।
- উপকরণ সংগ্রহের জন্য ঋণ: বিভিন্ন ধরণের কৃষি উপকরণ যেমন- সার, বীজ, কীটনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য স্বল্পমেয়াদি কৃষি ঋণ নেয়া হয়।
- চাষাবাদ ছাড়াও অন্যান্য কৃষি কাজের ঋণ: চাষাবাদ বহির্ভূত কৃষিকাজ যেমন- মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপশু পালন ইত্যাদি কাজেও কৃষক স্বল্পমেয়াদি ঋণ সংগ্রহ করে। .
খ) মধ্যমেয়াদি কৃষি ঋণ
সাধারণত এক বছরের উর্দ্ধ থেকে পাঁচ বছর সময়সীমায় যে কৃষি ঋণ দেয়া হয় তাকে মধ্যমেয়াদি কৃষি ঋণ বলা হয়।
মধ্যমেয়াদি কৃষি ঋণ যেসব উদ্দেশ্যে দেয়া হয় হলো-
- বিভিন্ন ধরণের কৃষি যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ যেমন: লাঙ্গল, ট্রাকটর, পাওয়ারট্রিলার, গরু-মহিষ ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য এ ঋণের প্রয়োজন হয়।
- কৃষি ব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভূমি কর্ষণ যন্ত্র ছাড়াও শস্য মাড়াই যন্ত্র, গভীর নলকূপ ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য এ ঋণ নেয়া হয়।
- কৃষি উপকরণ এবং উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য যানবাহন যেমন- অটোরিক্সা, ছোট ট্রাক, ভ্যানগাড়ি ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য মধ্যমেয়াদি ঋণ নেয়া যায়।
গ) দীর্ঘমেয়াদি কৃষি ঋণ
পাঁচ বছর সময়কালের উর্দ্ধ সময়ে পরিশোধ করা হয় এমন ঋণ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি কৃষি ঋণ বলা হয়। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ব্যবহার করে কৃষক তার জমির সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পানি নিষ্কাশন সমস্যা দূরীকরণ, ভূমি উন্নয়ন, কৃষি খামারের অবকাঠামো প্রস্তুতকরণ প্রভৃতি করে থাকে।
(৩) কৃষি ঋণ পাওয়ার উপায়
পূর্বে একটু ধারণা দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের কৃষকেরা প্রতিষ্ঠানিক ও অপ্রতিষ্ঠানিক উৎস থেকে সাধারণত কৃষি ঋণ গ্রহণ করে থাকে। নিম্নে কৃষি ঋণ পাওয়ার উপায় বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো।
ক) প্রতিষ্ঠানিক উৎস সমূহ
কৃষি ঋণ সরবরাহ করার জন্য যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানিক উৎস রয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ-
- বাংলাদেশ ব্যাংক: বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি কৃষকদেরকে কৃষি ঋণ প্রদান করে না। কিন্তু দেশের কেন্দ্রীয় হিসাবে
- অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক: কৃষি ব্যাংক, বিভিন্ন ঋণ প্রদানকারী সংস্থার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে কৃষি ঋণ সরবরাহ করে থাকে।
- বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সংস্থা যেমন: বিআরডিবি, সমবায় সমিতি সমূহকে বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত অল্প সুদে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে কৃষি ঋণ বিতরণে উৎসাহিত করে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘কৃষি ঋণ বিভাগ’ এবং ‘কৃষি ঋণ স্থিতিশীলকরণ বিভাগ’ নামে দুটি বিভাগ চালু আছে।
- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক: বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক তার ছয়শোরও অধিক শাখার মাধ্যমে সারাদেশের কৃষকদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে কৃষি ঋণ সরবরাহ করে থাকে।
- গ্রামীন ব্যাংক: প্রচলিত বাণিজ্যিক বাংকের বাইরে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলে গ্রামীন বাংক। পল্লী অঞ্চলের গরিব মানুষদের বিভিন্ন রকম অর্থনৈতিক কান্ডে উৎসাহী করার জন্য ঋণ প্রদান করাই হলো এ ব্যাংকের কাজ।
- কর্মসংস্থান ব্যাংক: কর্মসংস্থান ব্যাংক তার সবকটি শাখার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করে থাকে।
- সমবায় ব্যাংক: সাধারণত নানা ধরণের সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষি ঋণ প্রদান করে থাকে।
- বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি): বিআরডিবি এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রাম ভিত্তিক সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষকদেরকে সংগঠিত করে তাদেরকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করে একটি উৎপাদনমুখী শক্তিতে পরিণত করা। বিআরডিবি তাদের কাজের সুবিধার্থে কৃষক সমবায় সমিতিসমুহকে নিয়ে উপজেলা/থানা পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি গঠন করে। বিআরডিবি কৃষকদের মূলধন গড়ে তোলার জন্য সমবায় সমিতির শেয়ার ক্রয় এবং সাপ্তাহিক ক্ষুদ্র সঞ্চয় সুবিধাও প্রদান করে। প্রয়োজনে সমবায় কর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির কাজও করে থাকে।
খ) অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ
কৃষকদের কৃষি ঋণ সরবরাহে অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ঋণ প্রাপ্তিতে কম জটিলতা, তাৎক্ষণিক ঋণ প্রাপ্তির সুবিধা ও ঋণ পরিশোধের কোন নির্ধারিত সময়সীমা না থাকায় গ্রামের অধিকাংশ দরিদ্র কৃষক এসমস্ত উৎসসমূহ থেকে ঋণ গ্রহণে বেশী আগ্রহী হয়।
অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলোর বিবরণসহ ঋণের ধরণ নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
- আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব: কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণের অন্যতম প্রধান উৎস হলো বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন। এ ঋণ গ্রহণের সুবিধা হলো, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ঋণের জন্য কোন সুদ দিতে হয় না। ঋণের ক্ষেত্রে কোন রকম গ্যারান্ট্রিরও প্রয়োজন হয় না। তবে এ ঋণ সবার ক্ষেত্রে সহজলভ্য নয়।
- গ্রাম্য মহাজন ও ব্যবসায়ী: কৃষকের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে জরুরীভাবে ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে এ ঋণ সহজে পাওয়া যায়। গ্রামের এক শেণি দাদন ব্যবসায়ী ও মহাজনেরা অলংকার, জমি-জমা ও অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে উচ্চ সুদহারে ঋণ প্রদান করে থাকে।
- দালাল ও ব্যাপারী: কৃষি পণ্যের বাজারে দালাল ও ব্যাপারীরা কৃষকদেরকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে থাকে। এজন্য তারা চড়াহারে সুদ আদায় করে। দালাল ও ব্যাপারীরা অধিকাংশ সময়ে কৃষকদের কাছ থেকে জমির ফসল অল্প দামে আগাম ক্রয় করে রাখে। ফলে কৃষক কখনই ফসলের নায্যমূল্য পায় না। বরং প্রায়শই কৃষকরা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
(৪) কৃষি ঋণের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের কৃষকেরা গরিব বিধায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে সবসময় অর্থের সংস্থাপন করতে পারে না। ফলে কৃষি উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হয়। এজন্য কৃষি ঋণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
নিম্নে কৃষি ঋণের প্রয়োজনীয়তাগুলো আলোচনা করা হলো-
- কৃষি উপকরণাদি ক্রয়সহ শস্য সংগ্রহ, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো, সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজের জন্য ঋণের জন্য প্রয়োজন।
- উৎপাদিত কৃষি পণ্যের নায্যমূল্য পাওয়ার জন্য ফসল গুদামজাতকরণ, পণ্যের পরিবহণ ও বিপণনের জন্য কৃষি ঋণ প্রয়োজন।
- প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঋণ।
- পারিবারিক ব্যয় মেটানো।
- ঋণ পরিশোধ।
উপরোক্ত আলোচনাটি থেকে আমরা কৃষি ঋণ কি, কৃষি ঋণ কত প্রকার ও কৃষি ঋণ পাওয়ার উপায় সম্পর্কে জানলাম। বাংলাদেশের কৃষি এখনও ক্ষুদ্রচাষী ভিত্তিক। তাই কৃষি উৎপাদনে ক্ষুদ্রচাষীদের জন্য কৃষি ঋণ অত্যাবশ্যক।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।