এডব্লিউডি পদ্ধতি হলো জমিতে পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানোর মাধ্যমে
ধানক্ষেতে প্রয়োজনমত নিয়ন্ত্রিত সেচ দেয়া। এ পদ্ধতিতে সেচ দিলে ধানক্ষেতে ২৮% পানি সাশ্রয় করা সম্ভব। ধানক্ষেতে একটি ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিক বা বাঁশের পাইপ বসিয়ে মাটির ভিতরের পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনমত সেচ দেয়াই হলো এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য।
এই পোষ্টটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- কিভাবে AWD পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করা যায় তা জানতে পারবেন; কিভাবে সেচের পানির অপচয় রোধ করা যায় তার ধারণা পারবেন।
(১) AWD কি?
AWD কি: AWD এর পূর্ণরূপ হলো- Alternate Wetting and Drying। ধান চাষে AWD সেচ পদ্ধতি একটি সেচ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। ধানক্ষেতে একটি ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিক পাইপ বসিয়ে মাটির ভেতরের পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করে সেচ দেওয়াই এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য। এ পদ্ধতিতে চারা রোপণের পর থেকে ৩-৪ দিন পরপর কেবল জমি ভিজিয়ে রাখতে হয়।
ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য। সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সেচ নির্ভর বোরো ধানের অবদান সবচেয়ে বেশি। বোরো ধান উৎপাদনে জমিতে সব সময় দাড়ানো পানি রাখা হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে ধানের জমিতে সব সময় দাড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই। এজন্য ধানের জমিতে AWD পদ্ধতি ব্যবহার করে সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সেচ প্রদান করলে পানির অপচয় রোধ হয় এবং উৎপাদন খরচ কমে যায়।
(২) AWD ধান সেচ পদ্ধতি কিভাবে কাজ করে?
- AWD বা পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতি হলো ধান ক্ষেতে সময়মতো ও প্রয়োজনমত সেচ দেয়া।
- এ পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতে একটি ছিদ্রযুক্ত বাঁশ বা প্লাস্টিকের পাইপ বসিয়ে মাটির ভেতরের পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করে সেচ দেয়া হয়। মাটিতে পর্যাপ্ত পানি থাকলে ধান গাছ তার শিকড়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পানি নিতে পারে। পর্যবেক্ষণ পাইপে মাটির পানির পরিমান নির্ণয় করে প্রয়োজনমত সেচ প্রদান করা যায়। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে AWD ২০-২৫ ভাগ পানি সাশ্রয়ী।
- AWD পদ্ধতিতে সেচের জন্য ৭-১৫ সে.মি. ব্যাস ও ৩০ সে.মি. দীর্ঘ প্লাস্টিক বা বাঁশের পাইপ প্রয়োজন।
- পাইপের উপরের ১০ সে.মি. ছিদ্রহীন এবং নিচের ২০ সে.মি. ছিদ্রযুক্ত। ৫ সে.মি. পর পর ৩ মি.মি. ব্যাসের ছিদ্র করতে হবে।
- পাইপটি ধানক্ষেতে এমনভাবে বসাতে হবে যাতে উপরের ১০ সে.মি. মাটির উপরে থাকে যাতে সেচের পানির মাধ্যমে আবর্জনা বা খড়কুটা পাইপের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে।
- নিচের ছিদ্রযুক্ত ২০ সে.মি মাটির নীচে থাকলে যাতে মাটির ভেতরের পানি ছিদ্র দিয়ে সহজেই পাইপের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে বা বের হয়ে যেতে পারে।
(৩) AWD পদ্ধতিতে সেচ প্রদানের ধাপসমূহ
- এ পদ্ধতিতে সেচ প্রদানের জন্য জমি খুব ভালভাবে সমতল করে নিয়ে চারা রোপন করতে হয়। এরপর একই সমতলে অবস্থিত এক একর পরিমান ধানের জমির জন্য ২-৩টি জায়গায় গর্ত করে পর্যবেক্ষণ পাইপ খাড়াভাবে বসাতে হবে।
- রোপনের ১০-১৫ দিন পর্যন্ত জমিতে ২-৪ সে.মি. দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে। এরপর AWD পদ্ধতি কার্যকর করতে হবে।
- প্রতিবার সেচ প্রদানের সময় এমন পরিমান পানি প্রয়োগ করতে হবে যাতে জমিতে ৫ সে.মি. গভীরতায় পানি থাকে। এরপর পানি কমতে কমতে যখন পানির স্তর পাইপের ভেতরে ২০ সে.মি. এর নিচে নেমে যাবে অর্থাৎ পাইপের তলার মাটি দেখা যাবে তখন আবার সেচ দিতে হবে। এ অবস্থায় আসতে মাটি ভেদে ৪-৮ দিন সময় লাগে। ফুল আসার পূর্ব পর্যন্ত এ পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হবে।
- ধানের ফুল আসার পর ২ সপ্তাহ পর্যন্ত জমিতে সব সময় ২-৪ সে.মি. দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে। এ সময়ে কোন অবস্থাতেই মাটিতে আদ্রতার ঘাটতি রাখা যাবে না।
- ধান কাটার ২ সপ্তাহ আগে সেচ বন্ধ করতে হবে।
(৪) AWD প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধান চাষের পদ্ধতি/নিয়ম
- ২৫ সেমি লম্বা ও ৭-১০ সেমি ব্যাসের বাঁশ বা প্লাস্টিকের পাইপের উপরের ১০ সেমি বাদ দিয়ে বাকি ১৫ সেমি পাইপে ৫ সেমি পর পর ৩ সুতি ব্যাসের ড্রিল বিট দিয়ে ছিদ্র করতে হবে।
- এক একর পরিমাণ একটি সমতল ধানক্ষেতে ২-৩টি পাইপ বসাতে হবে।
- পাইপটি এমনভাবে ধানক্ষেতে বসাতে হবে যেন এটির ছিদ্রহীন ১০ সেমি
মাটির উপরে থাকে। - ছিদ্রযুক্ত ১৫ সেমি মাটির নিচে থাকবে, যাতে করে মাটির ভিতরের পানি ছিদ্র দিয়ে পাইপে সহজে প্রবেশ করতে বা পাইপ থেকে বেড়িয়ে যেতে পারে।
- চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর্যন্ত জমিতে ২-৪ সেমি দাঁড়ানো পানি ধরে রাখতে হবে। এরপর সাশ্রয়ী পাইপ-পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়।
- এ পদ্ধতিতে প্রতিবার সেচের সময় এমন পরিমাণ পানি দিতে হবে যাতে জমির ৫ সেমি গভীরতায় পানি থাকে। অতপর পানির স্তর কমতে কমতে পানির গভীরতা যখন পাইপের ভিতর ১৫ সেমি নেমে যাবে অর্থাৎ পাইপের তলার মাটি দেখা যাবে তখন আবার সেচ দিতে হবে। এ অবস্থায় আসতে মাটিভেদে ৫-৮ দিন সময় লাগে। এভাবে ফুল আসা পর্যন্ত সেচ দিয়ে যেতে হবে।
- ফুল আসার পর ২ সপ্তাহ পর্যন্ত জমিতে সব সময় ২-৪ সেমি পানি ধরে রাখতে হবে।
- অতপর ধান কাটার ২ সপ্তাহ আগে সেচ বন্ধ করে দিতে হবে।
(৪) AWD পদ্ধতির সুবিধা
- ধান চাষ চলাকালীন সময়ে ৪-৫ টি সেচ সাশ্রয় করে।
- এ পদ্ধতিতে ২৫% সেচের পানি কম লাগে।
- জ্বালানী সাশ্রয় হয় প্রায় ৩০%।
- এ প্রযুক্তিতে মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং জমির জৈবিক গুনাবলির উন্নতি হয়।
- ফলন বৃদ্ধি পায় প্রায় ০.৫ টন/হেক্টর।
- এটি পরিবেশ বান্ধব কারণ ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন কম হয় এবং মশা-মাছির উপদ্রব কম হয়।
(৫) AWD পদ্ধতির অসুবিধা
- জমি সমতল এবং পাইপ স্থাপনের জন্য কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।
- পর্যবেক্ষণ পাইপে পানির স্তর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
- অনেক সময় আগাছার উপদ্রব বেশি হয়।
AWD পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা
এ পদ্ধতিতে ফলনের কোন তারতম্য হয় না, উপরন্ত পানি ও জ্বালানী (বিদ্যুৎ, ডিজেল ইত্যাদি) সাশ্রয় হয় অর্থাৎ কম খরচে বেশি লাভ। সর্বোপরি এটি একটি পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি।
সর্বশেষে বলা যায়, জমি পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও এ পদ্ধেিত সেচ কম লাগে। জমি পর্যায় ক্রমে ভেজানোও শুকানোর ফলে বায়ু চলাচল সুগম হয়। এপদ্ধতি কৃষকের কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।
ধান চাষে পর্যায়ক্রমিক ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিগুলো ধান ক্ষেতে প্রয়োজনমতো ও সময়মতো সেচ দেয়া। এ পদ্ধতিতে ২৫% সেচের পানি কম লাগে। তবে জমি সমতল ও পাইপ স্থাপনের জন্য কারিগরি জ্ঞান ও পাইপে পানির স্তর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
এডাব্লিউডি পদ্ধতি ব্যবহার করুন পানি ও জ্বালানী অপচয় রোধ করুন।
[সূত্র: ওপেন স্কুল, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ইন্টারনেট]