এই পোষ্টটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- SRI পদ্ধতিতে কিভাবে ধান চাষ করা যায় তার বর্ণনা জানতে পারবেন; SRI পদ্ধতির সাথে গতানুগতিক জলাবদ্ধ অবস্থায় ধান চাষের তুলনা করতে পারবেন।
(১) SRI পদ্ধতি বলতে কি বুঝায়?
SRI (শ্রী) এমন একটি পদ্ধতি যেখানে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে কম কৃষি উপকরণ যেমন- বীজ, সার ও পানি ব্যবহার করেও অধিক ফলন পাওয়া যায়।
SRI হলো পানি সেচের মাধ্যমে ধান চাষের এমন একটি কৃষি পরিবেশিক পদ্ধতি যেখানে ফসল, মাটি, পানি এবং উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের ভিন্নতর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধানের ফসল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হয়।
শ্রী (SRI) এর পূর্ণরূপ হলো System of Rice Intensification। শ্রী (SRI) একটি আধুনিক ধান চাষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ১০- ১৫ দিন বয়সের ধানের চারা বর্গাকার পদ্ধতিতে রোপণ করা হয়। প্রতি গুছিতে ১-২টি চারা রোপণ করা হয়। এতে করে জমিতে সার (২৫-৩০%) ও বীজের পরিমাণ (৭৫-৮০%) কম লাগে।
SRI পদ্ধতিতে চাষ করার কৌশল সর্বপ্রথম ১৯৮০ সালের দিকে মাদাগাস্কারে উদ্ভাবিত হয়। এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন, রোপন, সেচ, সার, কীটনাশক কম লাগে। কিন্তু নিবিড় পরিচর্যা করতে হয় এবং ফলন বেশি হয়।
(২) SRI পদ্ধতিতে ধান চাষের মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য
- এ পদ্ধতিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে ৮-১২ দিন বয়সের চারা একটি করে রোপন করতে হয়।
- বীজতলা থেকে চারা তোলার সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে চারা ভেঙ্গে না যায়; চারা তোলার পর পরই রোপন করতে হবে।
- চারা বর্গাকারে ২৫-৪০ সে.মি দূরত্বে লাগাতে হবে; অর্থাৎ সারি থেকে সারি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব সমান। বর্গাকারে লাগানো গাছ পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পাবে এবং আগাছা দমন সহজ হবে।
- জমিতে পর্যাপ্ত পরিমানে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে এবং যদি প্রয়োজন হয় তবে রাসায়নিক সারও প্রয়োগ করতে হবে।
- মাটি পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো (AWD) পদ্ধতিতে সেচ দিতে হবে। এতে মূলের বৃদ্ধি ভালো হবে ও মাটির অনুজীবের কার্যাবলী বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও মিথেন গ্যাস উৎপাদন কম হবে।
- ধানের থোড় অবস্থা থেকে ফসল পাকার ১৫ দিন আগ পর্যন্ত ধানের জমিতে ১-২ সে.মি. এর একটি পানির স্তর রাখতে হবে।
(৩) SRI পদ্ধতিতে ধান চাষের কৌশল
SRI পদ্ধতিতে ধান উৎপাদন কৌশলগুলো নিচে ধাপে ধাপে আলোচনা করা হলো-
১। চারার বয়স: SRI পদ্ধতিতে খুব কম বয়সের (৮-১২ দিনের) চারা রোপন করা হয়। প্রতি গুছিতে একটি করে চারা রোপন করা হয়। কম বয়সের চারা শক্ত থাকে বলে মারা যায় না এবং আগাম থোড় বের হয় না। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ১০-১৫ দিন আগে ধান পরিপক্ক হয়।
২। রোপন দূরত্ব: এ পদ্ধতিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫-৪০ সে.মি. করে বর্গাকারে চারা রোপন করা হয়। এতে গাছ আলো বাতাস বেশি পায়, কুশি বেশি হয় এবং ফলনও বেশি হয়।
৩। সার প্রয়োগ: এ পদ্ধতিতে প্রচুর জৈব সার প্রয়োগ করা হয়। যদি প্রয়োজন হয় তবে রাসায়নিক সার স্বল্প পরিমানে প্রয়োগ করা হয়। জৈব সার প্রয়োগের ফলে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুনাবলির উন্নতি হয় এবং মাটির উর্বরতা বাড়ে।
৪। আগাছা দমন: এ পদ্ধতিতে রাইস উইডার দিয়ে আগাছা দমন করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় যা পচে জৈব সার তৈরি করে। চারা রোপনের ১০-১২ দিন পর আগাছা দমন শুরু করতে হয়।
৫। সেচ ব্যবস্থাপনা: পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে জমিতে সেচ দিতে হয়। SRI পদ্ধতিতে যখন গাছের প্রয়োজন হয় তখনই পরিমানমত সেচ দেয়া হয়।
৬। শস্য সংগ্রহ: ফসল পরিপক্ক হবার সাথে সাথে সংগ্রহ করতে হবে। ধান কাটার ১৫ দিন পূর্বে থেকে জমি শুকিয়ে ফেলতে হবে।
(৪) SRI পদ্ধতির সুবিধা
- কৃষি উপকরণ কম লাগে।
- একটি করে চারা রোপন করা হয় বলে বীজ হার কম; ৬-৭ কেজি/হেক্টর। সাধারন পদ্ধতির চেয়ে ৭০-৮০% বীজ কম লাগে।
- সেচের পানি কম লাগে।
- সব সময় পানি বদ্ধ অবস্থায় থাকে না বলে মিথেন গ্যাস কম তৈরি হয়।
- জমি পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানোর ফলে মাটিতে বায়ু চলাচল সুগম হয় এবং গাছের মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
- অধিক জৈব সার ব্যবহার করা হয় ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
- রোগ বালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়।
- ধানের জীবনকাল ১-২ সপ্তাহ কমে যায়।
- ফলন বৃদ্ধি পায়।
(৫) SRI পদ্ধতির অসুবিধা
- SRI পদ্ধতিতে ধান চাষের জন্য কৃষকের কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।
- এ পদ্ধতিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করা হয় যা বড় খামার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। তাছাড়া কৃষকরা রাসায়নিক সারের উপর বেশি বিশ্বাসী।
- চারা রোপনের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় কারন চারা অনেক ছোট থাকে যা তোলা থেকে শুরু করে লাগানো সব ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকতে হয়।
- লবণাক্ত জমিতে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা যায় না।
(৬) গতানুগতিক ধান চাষের সাথে SRI পদ্ধতির তুলনা
গতানুগতিক ধান চাষ পদ্ধতি | SRI পদ্ধতি |
১। বেশি বয়সের চারা রোপন করা হয় (৩০-৪০ দিন) | ১। খুব কম বয়সের চারা রোপন করা হয় (৮-১২ দিন) |
২। প্রতি গুছিতে ৩-৪টি করে চারা রোপন করা হয়। | ২। প্রতি গোছায় মাত্র একটি চারা মাত্র রোপন করতে হয়। |
৩। চারা থেকে চারার দূরত্ব ১০-১৫ সে.মি. ও সারিথেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সে.মি. দিতে হয়। | ৩। চারা থেকে চারা ও সারি থেকে চারির দূরত্ব ২৫-৪০সে.মি. দিতে হয়। |
৪। চারা আয়তাকারে লাগানো হয়। অনেক সময়কোন আকার অনুসরন করা হয় না। | ৪। চারা বর্গাকারে লাগানো হয়। |
৫। বীজ বেশি লাগে (২৫-৩০ কেজি/হেক্টর)। | ৫। বীজ কম লাগে (৬-৭ কেজি/হেক্টর)। |
৬। রাসায়নিক সার বেশি দেয়া হয়। | ৬। জৈব সার বেশি দেয়া হয়। |
৭। নিড়ানি বা হাত দিয়ে আগাছা দমন করা হয়। | ৭। রাইস উইডার দিয়ে আগাছা দমন করা হয়। |
৮। প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়। | ৮। পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়। |
৯। জীবনকাল বেশি। | ৯। জীবনকাল ১-২ সপ্তাহ কম। |
১০। মিথেন গ্যাস বেশি নির্গত হয় ফলে পরিবেশ দূষণবেশি হয়। | ১০। মিথেন কম নির্গত হয় ফলে পারিবেশ বান্ধব। |
(৭) কয়েকটি টব ব্যবহার করে পানি বদ্ধ অবস্থায় ধান চাষের সাথে SRI এর তুলনা
উদ্দেশ্য: SRI পদ্ধতির সাথে গতানুগতিক জলাবদ্ধাবস্থায় ধান চাষের পার্থক্য বুঝতে পারবেন; এবং দুই পদ্ধতিতে ধানের বৃদ্ধি ও ফলনের পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
মূলতত্ব: SRI হলো কৃষি পরিবেশিক পদ্ধতি যেখানে পরিবর্তিত ফসল, মাটি, পানি ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধানের ফলন বৃদ্ধি করা হয়। এ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো ধান ক্ষেতে অবিরাম প্লাবিত পানি রাখার পরিবতের্ সর্ব নিম্ন পরিমান পানি প্রদান করা এবং মূল ও কুশি জন্মানোর জন্য অধিক জায়গা বরাদ্দের উদ্দেশ্য বগার্ কারে খুব ছোট চারা রোপন করা। পানিবদ্ধ অবস্থায় ধান চাষ গতানুগতিক পদ্ধতি এবং SRI পদ্ধতিতে ধান চাষ একটি আধুনিক পদ্ধতি।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: ১. মাটির তৈরি মাঝারী আকারের ৪টি টব। ২. বোরো ধানের চারা ৩. জৈব ও রাসায়নিক সার ৪. দোআঁশ মাটি ৫. পানি ৬. নিড়ানি ৭. খাতা, কলম ইত্যাদি।
কার্যপদ্ধতি:
- প্রথমে দোআঁশ মাটির সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরিমান জৈব সার এবং সামান্য পরিমান রাসায়নিক সার নিয়ে খুব ভালোভাবে মিশান।
- এরপর SRI পদ্ধতির জন্য দু’টি বড় টব এ মাটি দিয়ে ২/৩ ভাগ পর্যন্ত ভর্তি করুন।
- এরপর গতানুগতিক পদ্ধতির জন্য শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার মিশিয়ে অন্য দু’টি বড় টব ২/৩ অংশ পর্যন্ত ভর্তি করুন।
- SRI পদ্ধতির জন্য প্রথমে কাদা করে ৩০ সে.মি. দূরে ১টি করে ১০-১২ দিনের চারা রোপন করুন।
- গতানুগতিক পদ্ধতির জন্য কাদা করে ২৫-৩০ দিন বয়স্ক ৩-৪ টি চারা ১৫ সে.মি. দূরে রোপন করুন।
- SRI পদ্ধতির জন্য টব দু’টিতে পর্যায়ক্রমিক ভিজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করুন।
- গতানুগতিক পদ্ধতির জন্য সব সময় পানি বদ্ধ অবস্থার সেচ প্রদান করুন অর্থ্যাৎ সবসময় পানি ভতি করে রাখুন।
- উভয় পদ্ধতির ধানের চারার পরিচর্যা করুন।
- উভয় পদ্ধতিতে লাগানো ধানের চারার বৃদ্ধি ও অন্যান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করুন এবং সিদ্ধান্ত নিন।
সিদ্ধান্ত: SRI পদ্ধতিতে লাগানো ধান গাছগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বেশি কুশি উৎপন্ন হচ্ছে। অন্যদিকে গতানুগতিক জলাবদ্ধ অবস্থার ধান গাছের বৃদ্ধি ও কুশি উৎপাদন কম হচ্ছে।
সর্বশেষে বলা যায়, SRI পদ্ধতিতে পানি সেচ ব্যবস্থাপনা ধান চাষের একটি এমন কৃষি পরিবেশিক পদ্ধতি যা ধানের ফলন বৃদ্ধি করে। এ পদ্ধেিত সেচ কম লাগে।
[সূত্র: ওপেন স্কুল, ADRA Bangladesh, lkp.org.in ও ইন্টারনেট]