(১) পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত কি?
পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত কি: কোন ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে কোন সন্দেহ তৈরি হলে বা কারো অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে মৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধান করার জন্য পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত করা হয়, এর মাধ্যমে মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে জানা যায় ব্যক্তিটি আসলে কি কারণে মৃত্যুবরণ করেছিল।
গণমাধ্যমে আমরা প্রায়ই ময়নাতদন্ত শব্দটি শুনে থাকি, ইংরেজিতে একে বলা হয় পোস্টমর্টেম (Post-mortem)।
ইংরেটজ পোষ্টমর্টেম শব্দটি ল্যাটিন থেক এসেছে, এখানে পোস্ট অর্থ- পরে এবং মর্টেম অর্থ- মৃত্যু বোঝায়। ১৮৫০ সাল থেকে পোস্টমর্টেম শব্দটির প্রচলন শুরু হয়েছে।
পোষ্টমর্টেমকে বাংলায় ময়নাতদন্ত বলা হলেও, এটি মূলত আরবি এবং সংস্কৃত দুটি শব্দ মিলে গড়ে উঠেছে।
এখানে ময়না শব্দটি আরবি মুয়ানা থেকে এসেছে যার অর্থ- অনুসন্ধান করা, অনেকে আবার বলেন ময়না শব্দটি ফার্সি বা উর্দু থেকে এসেছে যার অর্থ- ভালো করে খোঁজা এবং সংস্কৃত শব্দ তদন্ত অর্থ- কোন কিছু উদঘাটন করা।
ময়নাতদন্তকে ইংরেজিতে একে পোস্টমর্টেম ছাড়াও অটোপসি (Autopsy) বলা হয়, যা গ্রিক শব্দ অটোপসিয়া থেকে এসেছে, এর অর্থ- মৃতদেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা।
ময়নাতদন্তকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন এর আসল উদ্দেশ্য হলো কোন ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ নিয়ে তৈরি হওয়া ধোঁয়াশা পরিষ্কার করা।
১৭ শতক থেকে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে পোস্টমর্টেমের রীতি চালু হয়েছে। তখনকার তুলনায় এখন আরও আধুনকিভাবে ময়নাতদন্ত করা হয়ে থাকে।
ময়না তদন্ত বা পোস্টমর্টেম কেন করা হয়, কিভাবে করা হয়, সে সম্পর্কে আমাদের খুব কমই ধারণা আছে। এখানে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হবে।
(২) পোস্টমর্টেম কেন করা হয়?
পোস্টমর্টেম কেন করা হয়: হত্যা, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনার মতো যেকোনো অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত করা হয়ে থাকে।
অনেক সময় দেখা যায় কাউকে বিষ প্রয়োগ করে ফেলে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে, এক্ষেত্রে ময়নাতদন্তে বেশ কয়েকটি বিষয় জানার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হলো মৃত্যু কিভাবে হয়েছে এবং কখন মৃত্যু হয়েছে।
অনেক সময় ব্যক্তির অস্ব্ভাবিক মৃত্যু হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় ময়নাতদন্ত করা হয়না। বাস দুর্ঘটনার মত অনেক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় যখন মৃত্যুর কারণ নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে না তখন স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াও মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়ে থাকে, কারণ পরিবারের সদস্যরা চান না তাদের স্বজনদের মৃতদেহ আবার কাটা ছেঁড়া করা হোক, তবে মৃত্যুর কারণ নিয়ে সন্দেহ থাকলে অবশ্যই ময়না তদন্ত করা হয়।
কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুর অনেক পরে এমনকি দাফন হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ সময় পরেও পুনরায় ময়নাতদন্তের উদাহরণ রয়েছে। দীর্ঘদিন পরে কোন ব্যক্তির লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হলে অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর সঠিক কারণটি বেরিয়ে আসে না।
(৩) ময়নাতদন্ত কিভাবে করা হয়?
ময়নাতদন্ত কিভাবে করা হয়: ময়নাতদন্তে একটি লাশের শরীর কেটে তার পাকস্থলি, লিভার, কিডনির বা বএরইন মত অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কেমিক্যাল পরীক্ষা করে দেখা হয়, এছাড়াও প্রয়োজন বোধে মরদেহের ডিএনএ এনালাইসিসও করা হয়।
মৃত ব্যক্তিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা, তাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল কিনা অথবা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল কিনা এরকম গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয় মাথায় রেখে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়।
বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পর ফরেন্সিক বিভাগ তার উপর ভিত্তি করে মৃত ব্যক্তির ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করে।
চিকিৎসক মৃতদেহের শরীরে তোন ধরণের অস্বাভাবিকতা দেখলে প্রয়োজনে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষার জন্য পাঠান।
মৃতদেহের ব্যবচ্ছেদ করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলে মৃতদেহ আবার সেলাই করে আগের মত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়।
বর্তমানে ডিজিটাল পোর্টেবল এক্সরে মেশিনের মত বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে মাত্র দুই মিনিটের মধ্যেও ময়না তদন্ত করা যায়।
(৪) সুরতহাল ও ময়না তদন্তের পার্থক্য কি?
সুরতহাল ও ময়না তদন্তের পার্থক্য কি: ময়নাতদন্তের সময় যাতে কোন ধরনের জালিয়াতির সুযোগ না থাকে সেজন্য প্রথমেই পুলিশ একটি সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। মৃতদেহ কি অবস্থায় পাওয়া গেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনকেই সুরতহাল রিপোর্ট বলা হয়, এই প্রতিবেদনে মৃতদেহের বাহ্যিক অবস্থার বিবরণ থাকে, যেমন লাশের গায়ে কোন ধরনের আঘাত বা ক্ষতচিহ্ন আছে কিনা, কোন ধরণের অস্বাভাবিকতা থাকলে তা কিসের কারণে হয়ে থাকতে পারে সে ধরনের বর্ণনা দেওয়া হয়। অপরদিকে, ময়নাতদন্ত হলো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে, ফরেন্সিক ল্যাবে, একজন মেডিক্যাল অফিসার দ্বারা, মৃত্য বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুলে নিয়ে বা বের করে নিয়ে বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা নিরক্ষিা করে মৃত্যু সঠিক কারণ ও মৃত ব্যাক্তি মৃহ ব্যক্তি সাথে ঘটা ভিন্ন ঘটনার সূত্র খুঁজে বের করা হয়।
কোন ব্যক্তির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হলে অথবা মৃতদেহ কবর থেকে উঠানোর প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে সুরত-হাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
(৫) ময়নাতদন্ত কে, কোথায় করে থাকে?
ময়নাতদন্ত কে, কোথায় করে থাকে: আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মেডিকেল কলেজগুলোর মর্গের ময়না তদন্ত করা হয় সেখানকার ফরেন্সিক বিভাগের চিকিৎসকরা সাধারণত ময়নাতদন্তের কাজটি করে থাকেন, এর বাইরে যে সব জেলায় ২৫০ সংখ্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল রয়েছে সেখানেও ময়নাতদন্ত করা হয়ে থাকে।
অতীতে মিশরীয় সভ্যতায় ময়নাতদন্তের মতোই মৃতদেহ কেটে তার অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোকে সংরক্ষণের মাধ্যমে এবং লাশের ত্বকে এক ধরনের বিশেষ প্রলেপ দিয়ে মমি তৈরি করা হত, যার ফলে প্রায় ৩০০০ থেক ৪০০০ বছর আগের লাশ এখনও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়।