নিম্নে সন্তানের মন থেকে ভয় দূর করার উপায় বা শিশুর ভয় দূর করার পদ্ধতিঃ কিভাবে শিশুর মনের ভয় দূর করা যায়? এ সম্পর্কে এক জন মায়ের বিস্তর একটি আলোচনা/বক্তব্য তুলে ধরা হলো-
প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রে তার দ্বিতীয় বছর খুবই আনন্দময়।
এই সময়ে সে হাঁটতে এবং কথা বলতে শিখতে শুরু করে। এর ভেতর সে স্বাধীনতা এবং নতুন শক্তির সন্ধান পেতে থাকে। শিশু দিন দিন বাড়তে থাকে। তার পথে স্বাধীনভাবে খেলা করা সম্ভব হয়।
বিশ্বের সব জিনিস দেখার বাসনা তার এত বেশি হয় যে, একজন ভূপর্যটকের তত হয় না। পাখি, ফুল, নদী, সমুদ্র, মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, স্টিমার প্রভৃতি তার অপরিসীম আনন্দ ও কৌতৃহলের উদ্রেক করে। এসময় তার কৌতৃহলের শেষ নেই, প্রায়ই তার মুখে শোনা যাবে, দেখতে চাই। নিজের শোয়ার খাট কিংবা ঠেলাগাড়ি থেকে মুক্ত হয়ে শিশু বাগানের ভেতর, মাঠে অথবা সাগরতীরে ছোটাছুটি করে মুক্তির আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে ওঠে।
প্রথম বছর অপেক্ষা এখন হজম শক্তি বেশি হয়েছে, খাদ্যেও বৈচিত্র্য এসেছে। চিবানো এখন একটা নতুন আনন্দ। এসব কারণে শিশুর যদি উপযুক্ত যত নেয়া হয় এবং যদি তার স্বাস্থ্য ভাল থাকে তবে এই বয়সে শিশুর জীবন তার কাছে খুবই আনন্দময় এবং রোমাঞ্চকর।
তবে হাটা ও দৌড়ানোর মধ্যে শিশু যে নতুন স্বাধীনতার সন্ধান পায় তার সাথে একটা নতুন ভয়ও তার মনে আসে। শিশুকে সহজেই ভয় দেখানো যায়।
ডঃ মার্চাস মিচেল নামে একজন শিশু মনস্তত্বিদ তার একটি রচনায় শিশু মনের ভয় সম্পর্কে লিখেছেন- “শিশু উচ্চ শৃঙ্গ এবং পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।”
কিন্তু শিশুকে এমন যত্নের সাথে রাখা হয় যে, এর বাস্তব ভয়ের কোন কারণই থাকতে পারে না। কোন শিশুকে কখনও এমনভাবে রাখা হয় না– যেখানে তার জীবনে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ সব বাবা-মা জানেন, সত্যিকারের কোন বিপদ হলে শিশু সেখানে একেবারে অসহায়। সুতরাং শিশুর যেন সেরকম বিপদ না হয় সেদিকে সবাই সতর্ক থাকেন।
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বছরে শিশুর মনে নতুন ভয় আসে।
তর্কের বিষয় হলো এই যে, এই ভয় কি শিশুর প্রবৃত্তিগত অর্থাৎ আপনা-আপনি বিকশিত হয়, না অন্যের কাছ থেকে শিশু এটা ছোঁয়াচে রোগের মত পায়?
শিশুর প্রথম বছরে তেমন ভয় থাকে না। কিন্তু তাই বলে এটা যে প্রবৃত্তি থেকে প্রাপ্ত নয় এমন প্রমাণ করা চলে না। কেননা যে কোন বয়সে একটা পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। উগ্র ফ্রয়েডবাদীও বলবেন না যে, জন্মের সময়ই শিশুর যৌন প্রবৃত্তি পরিপূর্ণ মাত্রায় রয়েছে।
স্পষ্টতই দেখা যায় যে, শিশু হাটতে পারে না; তার চেয়ে যে চলাফেরা করতে পারে তারই ভয়ের প্রয়োজন বেশি। কাজেই যখন প্রয়োজন তখন যদি ভয় প্রকাশ পেতে থাকে তবে বিষ্ময়ের কিছু নেই৷ ভয় যদি অন্যের কাছ থেকে সংক্রামিত হয় তবে সহজ উপায়েই এটা নিবারণ করা যায়। যেমন শিশুর সামনে ভয় বা বিরক্তি প্রকাশ না করে; পক্ষান্তরে যদি কতক ভয় প্রবৃত্তি থেকে জন্মায় তবে এটা নিবারণের জন্য আরো ব্যাপক কোন গন্থা গ্রহণ করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে ডঃ মার্চাস মিচেল তার বিখ্যাত ‘জীবজন্তর শৈশব’ গ্রন্থে পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে- “সাধারণত জীবজন্তর শাবকদের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কোন ভয় থাকে না, যদি না তাদের জনক-জননী তাদেরকে ভয় করতে শিখিয়ে না দেয়।”
এক বছরের কম বয়সের শিশু কোন প্রাণীকেই ভয় করে না। এই বয়সী একটা শিশুকে ডঃ মিচেল ইঁদুরকে ভয় করতে শিখিয়েছিলেন- যখনই ইদুরটা শিশুর সামনে আসত তখনই তিনি শিশুটার পেছনে খুব জোরে ঘণ্টার আওয়াজ করতেন। আওয়াজ শুনে শিশুটি ভয় পেত। ক্রমে ইদুরের সাথে তার এই ভয়ের সংযোগ সাধিত হল। পরে শব্দ না হলেও ইদুর দেখলেই সে ভীত হয়ে পড়ত।
অন্ধকারে ভয়ের কারণ আছে বলে যাদেরকে শেখানো হয়নি এমন ছেলেমেয়েদের কাছে অন্ধকার ভয় পায় নয়। এরূপ ধারণার যথেষ্ঠ কারণ আছে যে, বেশিরভাগ ভয় যা আমরা এতদিন প্রবৃত্তিজাত মনে করতাম অপরের কাছ থেকে সঞ্চারিত হয়; বয়ষ্ক ব্যক্তিরা সৃষ্টি না করলে এরকম ভয় মোটেই দেখা দিত না।
আমার ছেলের একেবারে গোড়া থেকেই অকারণ ভয় সক্রান্ত বিষয়টি তার ভেতর থেকে দূরীভূত করার চেষ্টা ছিল আমাদের। আমি দেখেছি ডঃ মার্চাস মিচেল যা বলেছেন তাই. ঠিক। আমার ছেলের বেলাতেও এটা দেখা গিয়েছে। দ্বিতীয় বছরে সে কোন প্রাণী দেখে ভয় পেত না, কেবল একদিন ছেলেকে নিয়ে বাইরে ঘোরার সময় লক্ষ্য করলাম সে একটি গরু দেখে আমাকে জাপটে ধরে আছে। অর্থাৎ সে গরুটিকে দেখে ভয় পাচ্ছে।
এর কারণ অনুসন্ধান করার জন্যে আমার হাউস কিপার মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, একদিন বাড়ির বাইরের গেটের কাছে সে আমার ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এইসময় খুব জোরে ডাকতে ডাকতে একটি গরু তার কাছ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারলাম এটাই আসলে তার গরু দেখে ভয় পাবার একমাত্র কারণ।
আমার ছেলের বয়স যখন দুই বছর তিন মাস, তখন বাজার থেকে একটি ব্যাটারি চালিত গাড়ি নিয়ে এসা হয়েছিল বাচ্চার মনোরঞ্জনের জন্য। বেশ বড়ো আকারের এই গাড়িটি চালাতে ১২টি ড্রাইসেল ব্যাটারি লাগে। একটা রিমোট কন্ট্রোলার দিয়ে গাড়িটির গতি বা দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
প্রথম প্রথম এই গাড়িটি বেশ উৎসাহের সাথেই আমার ছেলে লক্ষ্য করতে থাকে। এমনকি রিমোট কন্ট্রোলার হাতে নিয়ে (যদিও সে সেটা চালাতে জানতো না) চলমান গাড়ির পেছন পেছন সে ছুটতে থাকে টলোমলো পায়ে।
গাড়িটি তুলে রাখার চেষ্টা করতেই সে চিৎকার করে এর প্রতিবাদ জানায়। অর্থাৎ তাকে এবং এই গাড়িটিকে এখন খেলতে দিতে হবে। বিষয়টা হাসিমুখে আমরা মেনে নিলাম। হাউসকিপার মেয়েটাকে গাড়ি চালানোর নিয়মটা ভালমতো জানিয়ে দিলাম।
একদিন আমি আচমকা লক্ষ্য করলাম, আমার বাচ্চার উক্ত গাড়িটার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই। বিষয়টা অবাক করল আমাকে। আমি গাড়িটি বের করে তার সামনে আনতেই সে ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো এবং আমাকে জাপটে ধরলো। আমি তার চোখ এবং চেহারার মধ্যে সত্যিকারের ভয় দেখতে পেলাম। এর কারণ অনুসন্ধান করার জন্যে হাউসকিপার মেয়েটার কাছে জানতে চাইলাম। সে উত্তরে জানালো দুইদিন আগে গাড়িটা চালাতে চালাতে আচমকা বাচ্চাটার পায়ের উপর উঠে পড়েছিল। আর এতেই বাচ্চাটি ভয় পেয়ে কেঁদে উঠেছিল। সেই থেকে গাড়িটি দেখলেই তার সেই কথাটি মনে পড়ে যাচ্ছিল। ফলে গাড়িটি তার মধ্যে এক ধরনের ভয় সঞ্চার করছিল।
বিষয়টি জানার পর আমি সচেষ্ট হলাম গাড়িটি সম্পর্কে বাচ্চাটির ভয় দূরীকরনের কাজে। গাড়িটিকে নিয়ে আমার এবং হাউসকিপার মেয়েটির পায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে দেখালাম তার কোন ক্ষতিই হচ্ছে না। এভাবে কয়েকবার চেষ্টা করে তাকে প্রমাণ দিলাম, আসলে গাড়িটি ক্ষতিকর কোন বস্তু নয়। এটাকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই। এভাবেই তার মন থেকে ভয় দূর করতে সমর্থ হয়েছিলাম।
যাইহোক, আমার প্রতিবেশীর একটি সন্তান। বয়স তিনের নিচে। প্রতিবেশীটির স্ত্রী চাকরি সংক্রান্ত কাজে বিদেশে আছেন। ফলে বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এক কেয়ারটেকার মহিলার ওপর। এই মহিলাটি ছিল বেশ ভিতু প্রকৃতির। বিশেষ করে অন্ধকারকে সে ভয় করতো। এই কারণে একসময় উক্ত প্রতিবেশির ছেলের মধ্যে প্রথমে এই ভয় সংক্রামিত হলো। পরবর্তীতে আমি লক্ষ্য করেছি ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেই বাচ্চাটি প্রাণপনে চিৎকার করে উঠতো। এটা যে একধরনের ভয়ের চিৎকার সেটা সহজেই বুঝতে পারা যায়। বিষয়টি কয়েকবার ঘটতে দেখে আমি এতে হস্তক্ষেপ করলাম। আমি জানতে পারলাম, এটা ঘটেছে তার কেয়ারটেকার মহিলাটির ভয়ের কারণে।
পরবর্তীতে আমি এই কেয়ারটেকার মহিলার ভয় দূর করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলাম। কিন্তু একটি শিশুর মন থেকে ভয় দূর করা যতটা সহজ– এই ক্ষেত্রে আমি ততটা অগ্রসর হতে পারলাম না।
একসময় দেখা গেল আমার এই চেষ্টাতে রাগান্বিত হয়ে উক্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন কেয়ারটেকার মহিলাটি তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। আমার ঐ প্রতিবেশীটি তখন নতুন আরেকটি কেয়ারটেকার নিযুক্ত করলেন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, নতুন কেয়ারটেকার আসার পরে তার বাচ্চাটি আর অন্ধকারকে ভয় করতো না। ধীরে ধীরে অন্ধকারের প্রতি তার ভয় লোগ পেয়েছিল। এর কারণ হলো, উক্ত কেয়ারটেকার মহিলাটি অন্ধকারকে ভয় পেত না। তাছাড়া, এইবার আমি বাচ্চাটির মন থেকে অন্ধকারকে ভয় না পাবার বিষয়ে সচেষ্ট হয়েছিলাম। এইক্ষেত্রে যদি আগের কেয়ারটেকার মহিলাটিই বর্তমান থাকত, তাহলে হয়তো এই ভয় তার মনের মধ্যে আরও গেঁথে বসে যেত। এমনকি পরিণত বয়সেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো।
এগুলো হলো সংক্রামিত ভয় বা কোন ঘটনার কারণে সংগঠিত ভয় ৷ তবে অনেক শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, শিশুর মনে স্বাভাবিক এবং প্রবৃত্তি থেকে তৈরি ভয়ও জাগতে পারে। যাকে বলা হয় প্রবৃত্তিজাত ভয়। এটা বেশিরভাগ দেখা যায় রহস্যজনক বস্তুর প্রতি শিশুর ভয়ের প্রকাশ।
ডঃ উইলিয়াম স্টার্ন নামক আরেক শিশু মনস্তত্তবিদ তার ‘শৈশবের মনস্তত্ব’ বইতে রহস্যজনক বস্তুর প্রতি শিশুদের ভয় সম্পর্কে লিখেছেন- “পূর্ববর্তী শিশু-মনোবিজ্ঞানবিদ্গণ একধরনের ভয়ের কথা, বিশেষ করে অতি শৈশবে এরকম ভয়ের স্বরূপ কি তা আলোচনা করেননি। জানা বিপদ ভয় অপেক্ষা অপরিচিত বিষয়ের ভয়ই শিশুদের মধ্যে বেশি স্বভাবগত বলে মনে হয়।”
শিশু যদি এমন কোন জিনিস দেখতে পায় যা তার পরিচিত ধারণার সাথে না মেলে তবে তিন প্রকার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হতে পারে। যথা-
ক) নতুন জিনিসটা এত অপরিচিত মনে হবে যে, এর প্রতি সে মোটেই আকৃষ্ট হবে না।
খ) দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তার মনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারবে না। তখন এর মনে জাগ্রত হবে বিস্ময়, জানার বাসনা, নানা চিন্তা, বিচার এবং অনুসন্ধানের মনোভাব।
গ) নতুন জিনিস তার আগের ধারণাকে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়ে তার মনে গভীর অসন্তোষ ও অজানার প্রতি ভয়ের ভাব সৃষ্টি করবে।
এই অজানার প্রতি ভীতি প্রবৃত্তিজাত ভয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। জীবকূলের আত্মরক্ষার পথে প্রয়োজনীয় বলেই এটা এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে সঞ্চারিত হয়।
উইলিয়াম স্টার্ন তার বইতে শিশুদের ভয় পাওয়ার অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। তার মধ্যে ছাতা খুললে ভয় পাওয়া এবং কলের পুতুল বা গাড়ি দেখে ভয় পাওয়ার কথাও আছে। প্রথমোক্তটি গরু-ঘোড়ার মধ্যেই বেশি। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি গরু বা ঘোড়ার দলকে একটা ছাতার সাহায্যে উর্ধ্বশ্বাসে ধাবিত করা যায়।
ডঃ স্টার্ন যেমন বর্ণনা করেতেন- “আমার নিজের ছেলের মধ্যেও তেমন ভয়ের প্রকাশ আমি মাঝে মাঝে লক্ষ্য করতাম। তার বয়স যখন ৩ বছর, সেই সময় তার মধ্যে আচমকা ছায়া-ভীতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এইসময় কোথাও কোন স্পষ্ট বা অস্পষ্ট চলমান ছায়া দেখলে সে ভয়ে আঁতকে উঠে তার কাছের মানুষকে জাপটে ধরতো ৷ আমি তার এই ভয় ভাঙ্গাবার জন্যে এক কৌশলের অবতারণা করেছিলাম। আমি মেঝেতে এবং দেয়ালে আঙুল দিয়ে ছায়া ফেলতাম এবং তাকে দিয়ে অনুরূপ করাতাম। এভাবে তার মধ্যে থেকে ছায়া-ভীতি দূর হয়েছিল। শিগগিরই সে বুঝেছিল ছায়া জিনিসটা কি। পরবর্তীতে দেখা গেছে দেয়ালে কোন চলমান বস্তর ছায়া পড়লে সে ভয় পাবার বদলে একধরনের আনন্দ অনুভব করতো।”
যন্ত্রচালিত অন্য কোন খেলনা সম্পর্কেও এই একই বক্তব্য খাটে। আমার বাচ্চার দ্বিতীয় জন্মদিনে আমার আম্মা একটা আরামদায়ক শক্ত বসার আসন পাঠিয়েছিল। এটাতে কেউ বসলেই একধরনের মিষ্টি বাজনার শব্দ বের হতো। আধঘন্টা ধরে সেই মিউজিক চলতে থাকতো। তবে ইচ্ছা করলে এই মিউজিক বন্ধ করে দেয়া যেত।
ব্যাটারী চালিত এই আসনটি দেখতেও বেশ সুন্দর ছিল। কিন্তু আমার ছেলেকে এই আসনে বসাতেই সে চিৎকার করে উঠল। আসনটা তার জন্যে ক্ষতিকর কোন কিছু না করলেও পরবততীতে সে এটা দেখামাত্র ভয় পেতে শুরু করলো। তার ভয় ভাঙ্গাবার জন্যে আমরা সবাই মিলে অল্প অল্প করে এটার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলাম।
তার মন থেকে ভয় সম্পূর্ণ দূর না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামিনি। একসময় দেখা গেল যে আসনটা তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল- সেই আসনটাতে নির্বিঘ্নে বসে আমাদের ছেলে তার আনন্দ প্রকাশ করছে। সে উক্ত আসনে বসলে যে মিউজিক বাজছে এটা আবিষ্কারের আনন্দেই ছেলেটা উচ্ছ্বসিত।
সুতরাং আপনার বাচ্চার মন থেকে অবাস্তব ভয় দূর করুন। কখনও আপনার বাচ্চাকে জুজুবুড়ি কিংবা ভূত বা অলীক কোনকিছুর মাধ্যমে ভয় দেখাবেন না। আসলে বাচ্চাকে ভয় দেখাবার কোন দরকারই নেই। তবে বাচ্চা কোন কিছুকে ভয় পাবে না এটাও ঠিক নয়। আমি আগেই বলেছি, বাচ্চার মন থেকে অকারণ ভয় দূর করতে হবে। কিন্ত কোনকিছুকেই বাচ্চা ভয় পাবে না তা নয়। বিশেষ করে বিভিন্ন বিপদজনক বিষয়গুলো সম্পর্কে বাচ্চাকে ভয় পেতে শেখাতে হবে।
শিশুদের প্রত্যন্ত ভয়ের কারণ থাকলে সেটা সম্পর্কে তাকে অবহিত করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন একা একা রাস্তায় হাটলে গাড়ি এসে চাপা দিতে পারে, বেশি উঁচুতে উঠে নিচে লাফিয়ে পড়লে তার হাত-পা ভেঙ্গে যেতে পারে, গরম কোন কিছু ধরলে তার হাত পুড়ে যেতে পারে, বাথরুমের কমোটে একা একা বসতে গেলে পিছলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে, বাবার রেজার দিয়ে সেভ করতে গেলে মুখ কেটে যাবার অন্তাবনা আছে ইত্যাদি বিপদজনক বিষয়গুলো সম্পর্কে তাকে ভয় পেতে শেখান। যে বিষয়গুলোর সাথে প্রত্যন্ত ভয় এবং ক্ষতির সম্ভাবনা আছে সেগুলো সম্পর্কে বাচ্চাকে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে শেখাতে হবে। অবশ্যই আচমকা ভয় দেখিয়ে কোন কাজ হবে না।
একবার এক উপজাতী বন্ধুর আমন্ত্রণে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি দুর্গম এলাকায় বেড়াতে যাই। আমার বাচ্চার বয়স তখন তিন বছর আট মাস। আমরা যেখানে থাকতাম সেই বাড়িটি একটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত ছিল। পেছনেই ছিল সমুদ্র। পাহাড়ের একেবারে শীর্ষদেশ পর্যন্ত ওঠার জন্য পাহাড়ের গা কেটে সিঁড়ি বানানো আছে। কিন্ত একেবারে শীর্যদেশে উঠলে আমাদের গায়ের ভেতর কেমন যেন ছম ছম করতো।
অনেক নিচে পাহাড়ের গোড়ায় সমুদ্রের সফেন জলরাশী দেখলে কেমন যেন আমাদের নিজেদেরই ভয় লাগতো। ওখান থেকে পড়ে গেলে কেউ বাঁচবে না এই ভয় আমাদের মত বয়ক্ক মানুষদেরই গ্রাঁস করতো।
কিন্তু আমার বাচ্চার মনে উচ্চতা সম্পর্কে কোন ভয় ছিল না। তাই সে অবলীলায় আমাদের সাথে উপরে উঠে আসতো। তার চেহারায় কোন ভয়ের লক্ষণও দেখা যেত না। আমরা যখন সেখানে গিয়ে বসে বসে নিচের সমুদ্ধ দেখতাম তখন সে স্থির না থেকে পাহাড়ের একেবারে ধারের দিকে যাবার জন্যে বায়না ধরতো। তাকে বাধা দিতে গিয়ে তাকে আমি বললাম, তুমি যদি পাহাড়ের একেবারে ধারে যাও, তাহলে নিচে পড়ে যাবে। পড়ে গেলে কীচের ফুলদানির মতো ভেঙে যাবে।
কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে আমার বাচ্চার হাতের ধাক্কা লেগে সিঁড়ির পাশে রাখা কাঁচের সৃদুশ্য দামী ফুলদানি নিচে পড়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল।
বিষয়টা খুবই ব্যথিত করেছিল তাকে। এমনকি সেই কিছুটা ভয়ও পেয়েছিল। এখানে সেই বিষয়টা কৌশলে কাজে লাগালাম। আর সত্যিই দারুণ ফল গেলাম সেই কৌশলে। সে আমাদের পাশে বসে থেকে কয়েকবার আবৃত্তি করার মতো বললো, “পড়ে যাবে, ভেঙ্গে যাবে।” তারপর সে সেখান থেকে আমাদেরকে সরে যাবার জন্যে বলতে শুরু করলো।
আমি অনেক পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চাদের দেখেছি, তাদের মধ্যে ভয়ডর বলতে কোনকিছুর অবকাশ নেই। যেমন গ্রামাঞ্চলে এই বয়সী অনেক বাচ্চাকে ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু গাছের ডাল থেকে পানিতে লাফ দিয়ে পড়তে দেখেছি। এভাবে লাফ দেয়াটা যে তার জীবনের জন্যে মারাত্মক পরিণাম ডেকে আনতে পারে সে সেটা জানে না।
পানিতে সোজাসুজি তার বুক পড়লে সে ফুসফুস ফেটে মারাও যেতে পারে। কিন্তু এই পরিণাম সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। তার অর্থ হচ্ছে, এই ভয় সম্পর্কে তাকে কোন শিক্ষা দেয়া হয়নি। গ্রামাঞ্চলে বড়ো হয়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের অভিভাবকদের একধরনের নিস্পৃহতাই এর জন্যে দায়ী। হয়তো ছোটবেলায় উচু জায়গা থেকে লাফ দেবার বিষয়ে তাদেরকে নিষেধ করা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এর পরিণামে যে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে সে বিষয়ে তাদেরকে জানানো হয়নি। এই কারণে তাদের মধ্যে এই ভয় সঞ্চারিত হয়নি।
শিশুভিত্তিক শিক্ষার ব্যাপারে এর গুরুত্ব খুব বেশি। ভয় থাকার তেমন কোন প্রয়োজন না থাকলেও বাস্তব বিপদ সম্পর্কে আশঙ্কা থাকা খুব দরকার। কিছুমাত্রার ভয়ের সাথে মিশ্রিত না থাকলে শিশু বিপদের আশঙ্কা অনুভব করতে পারে না। কিন্তু উপদেষ্টা বা শিক্ষকের মধ্যে এই ভয়ের সামান্য প্রকাশ না থাকলে শিশুর মনে এটা কোন রেখাপাত করে না। শিশুব তত্বাবধানকারী বয়স্ক ব্যক্তিদের শিশুদের সামনে কখনই অকারণে কোন অবাস্তব ভয়ের বিষয়ে ভীত হওয়া উচিত নয় তবে বাস্তব ভয়ের আশঙ্কা সম্পর্কে শিশুদের জ্ঞাত কবানো উচিত।
মনে হয় সকলের বাচ্চার ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে ভয়কে জয় করার আনন্দ তাদের অপরিসীম। বালকের গর্ববোধ জাগানো সহজ, সাহস দেখানোর জন্য প্রশংসা পেলে সারাদিন সে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে থাকে। ভীতু ছেলেরা পরবর্তী বয়সে অন্য সকলের ঘৃণার পাত্র হয়ে মানসিক কষ্ট বোধ করে কিন্তু তখন তাদের পথে নতুন অভ্যাস গঠন করাও কঠিন।
এজন্য আমার মনে হয় অল্পবয়স থেকেই ভয় দমন করার ব্যাপারে আত্নসংযম, অভ্যাস এবং দৈহিক পটুতা শিক্ষা দেয়া উচিত। এজন্য যদি কঠোর ব্যবং অবলম্বন করতে হয় তাও বরং বাঞ্ছনীয়।
বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী সম্পর্কে আমার আস্থা যতটুকু– অনাস্থাও তার থেকে খুব একটা কম নয়। আমি অনেক সরকারী প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখেছি– শিক্ষাপ্রদানের চেয়ে সেখানে বিধিনিষেধের বেড়াজালেই বেশিরভাগ কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা ঘেরা থাকে। শাসনের এক সুকঠিন শৃঙ্খলে তারা আবদ্ধ থাকে। বিশেষ করে এইসব কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীকে জোর করে শিক্ষা প্রয়োগ করে থাকে একশ্রেণীর শিক্ষক-শিক্ষিকা। এটা কোনমতেই উচিত নয়। এটা থেকে শিক্ষার প্রতি একধরনের ভয় সৃষ্টি হয়ে যায় তাদের মনে।
শিক্ষাক্ষেত্রে কখনই ভয় সৃষ্টি করে পড়ানো সম্ভব নয়। শিক্ষার প্রতি এইধরনের অবাস্তব ভয় যদি প্রবল হয়ে ওঠে তাহলে সে কখনই পরীক্ষা দিতে আগ্রহী হবে না।
সে কখনও যাচাই করে দেখতে চাইবে না এতে কোন বাস্তব ভয় আছে কিনা। শিক্ষার ক্ষেত্রে ভয় জয় করার জন্যে শিশুর উপর জোর খাটানো যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষার প্রতি ভয় জাগানো কোনক্রমেই উচিত নয়।
যা আগে বিপদজনক বলে মনে হয়েছিল, এরকম ঘটনা যদি বারবার অনুষ্টিত হয় অথচ কোন বিপদ না ঘটে তবে এর সাথে শিশুর পরিচয় ঘটে। এই পরিচয়ই ভয় নাশ করে। এই ভীতিনাশক অভিজ্ঞতা কেবল একবার দিলেই চলবে না। বারবার ঘটাতে হবে যেন এর সম্বন্ধে কোন ভয়ের অবকাশ না থাকে।
কোনরকম জোর না করে যদি এরকম অভিজ্ঞতা দেয়া যায় তবে ভালই। তা যদি সম্ভব না হয় তবে অপরাজিত ভয় পোষণ করা অপেক্ষা জোর করে দূর করাই ভাল।
পিতামাতা তাদের ভুল থেকে শিক্ষালাভ করেন। ছেলেমেয়েরা যখন বড় হয়ে ওঠে তখনই তীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং কিভাবে শিক্ষা দেয়া উচিত ছিল তা তখন উপলব্ধি করেন। কিন্তু তখন আর কোন উপায় থাকে না। তাদের ছেলেমেয়েদের নতুন করে শিক্ষা নেবার আর সেই বয়স থাকে না।
আমার ছেলের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর, সেই সময় আমি পারিবারিক ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে ভীষণ ব্যস্ত। গভীর রাত অবধি কাজ করতে হয়।
এমনকি বাড়িতে থাকলেও অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। এই অবস্থায় আমাদের বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো বা তার দেখাশোনা করা আমাদের পথে ঠিক সম্ভব হচ্ছিল না। তখন আমরা এই ভার দিয়ে দিয়েছিলাম আমাদের অনেকদিনের বিশ্বাসী পরিচারিকার হাতে।
পরিচারিকার তত্বাবধানে তাকে তার নিজের শোয়ার ঘর হতে অন্য ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
প্রথম প্রথম সারারাত আমাদের বাচ্চা চমৎকারভাবে ঘুমাতো। এক রাতে খুব জোরে ঝড় বইছিল। ভীষণ শব্দ করে তার ঘরের একটা জানালা ছিটকিনি খুলে গিয়ে প্রচন্ড জোরে বাড়ি খেয়েছিল দেয়ালের সাথে। এই শব্দে সে ভীযণ ভয়ে জেগে উঠে চিৎকার করে উঠেছিল। আমি সাথে সাথে ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম সে হয়তো কোন দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে উঠেছে, তাই কাদছে। আমি তার গায়ে হাত রাখতেই বাচ্চাটি আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এইসময় তার হৃদস্পন্দন খুব দ্রুততালে বইছিলো। কিছুক্ষণ আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকার পর তার ভয় দূর হলো। এইসময় ঘরে ইলেকট্রিসিটি না থাকায় সে বলল অন্ধকারে তার ভয় লাগছে। অথচ ইতিপূর্বে সে অন্ধকার ঘরেই ঘুমাতো। চোখে আলো লাগলে দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ঘুমাতো।
তার কথামতো ঘরে একটা চার্জ লাইট নিয়ে এসে দেয়া হলো। সেদিনের মতো সে চুপচাপ শুয়ে ঘুমিয়ে গেল। কিন্তু এই একই ঘটনা ঘটলো পরের রাতেও। সেদিন কোন শব্দ বা ঘর অন্ধকার ছিল না। তবুও সে চিৎকার করলো। আমি বিষয়টা অন্য দৃষ্টিতে দেখলাম। বুঝলাম বাচ্চাটি আসলে শুধু ভয় পেয়ে যে চিৎকার করছে তা নয়। নিজের গুরুত্ব কতটুকু সেটা যাচাই করছে। সে চাইছে তাকে নিয়ে বাড়ির সবাই একটু হৈ চৈ করুক।
বিষয়টা আমি বুঝতে পেরে, তারপর আমার ছেলেকে বোঝাতে শুরু করলাম। তাকে বললাম, অন্ধকারে ভয়ের কিছুই নেই। কোন কারণে যদি তার ঘুম ভেঙে যায় তাহলে যেন সে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। কোন ভয়ের বা জটিল কোন কিছু না ঘটলে এরপর থেকে আমরা আর তার কাছে রাতে আসবো না। আমরা একটা জরুরী কাজের জন্যই তাকে অন্য ঘরে শুইয়ে রেখেছি।
আমার কথা সে মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর থেকে বিশেষ কারণ ছাড়া আর কোন রাতে সে কেঁদে ওঠেনি। রাতে ঘরে ইমার্জেন্সিভিত্তিক আলো রাখা হয়েহিল। তবুও ইলেকট্রিসিটি চলে যাবার পরে সেই আলো জ্বালাতে হয়নি।
সেই সময় যদি আমরা অতিরিক্ত আদর দিয়ে তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসতাম, তাহলে কয়েক বছর পরে একা ঘরে ঘুমাতে সে অসম্মতি জানাতো। শুধু তাই নয়, নিজের ওপর একধরনের আস্থাহীন ভয় অনুভব করতো সে পরবর্তী সময়ে। সেই ভয় কাটানো খুব একটা সহজ কাজ ছিল না।
অনেক সময় শিশুদের ভেতর সাহস জন্মে অন্য শিশুকে কিছু সাহসী কাজ করতে দেখলে।
আমার মনে আছে, আমি একবার আমার বাচ্চাটিকে নিয়ে গিয়েছিলাম শিশুপার্কে। তখন তার বয়স মাত্র দুই বছর দুই মাস। বাচ্চাটি শিশু পার্কে গিয়ে মানুষজনদের হৈচৈ দেখে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল। কোল থেকে নামতেই চাইছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তার মধ্যে থেকে এই অস্বস্তি আমি দূর করে দিয়েছিলাম। তাকে দেখিয়েছিলাম, তার মতো বয়সী অন্যান্য শিশুরা কেমন সুন্দর মায়ের হাত ধরে হাটছে। এটা দেখে আমার বাচ্চার ভয় কেটে গেল। সে আমার কোল থেকে নেমে হাটতে শুরু করলো। আমি বুঝলাম, আমার শিশুর ভয় দূর করার বিষয়ে অপর শিশুর উপস্থিতি বা কাজটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সেদিনই আর একটি ঘটনা ঘটলো। আমি বাচ্চাটিকে নিয়ে কোন খেলনা মেশিনে উঠব, এটা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল এমন কোন মেশিনে ওঠা দরকার যেটাতে সে ভয় পাবে না। ভাবতে ভাবতে আমি বাচ্চাটিকে স্প্রিং-এর লাফানো চত্বরে নিয়ে এলাম।
কেয়ারটেকারকে টিকিট দেখিয়ে বাচ্চাটিকে সেখানে নিয়ে গেলাম। তাকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে লাফাতে বললাম। কিন্তু বাচ্চাটি আমাকে জোর করে আঁকড়ে ধরে রাখল। তার হৃদস্পন্দন আমি অনুভব করছিলাম। বেশ দ্রুততালে সেটা বইছে। বুঝলাম তার মনে ভয় জন্ম নিয়েছে। নতুন কিছু দেখলে শিশুর মনে একধরনের ভয় জন্ম নেয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়।
বাচ্চাটির ভয় দূর করার কাজে আবার সেই আগের কৌশল অবলম্বন করলাম। তার কাছাকাছি আরও বেশ কয়েকটি বাচ্চা লাফালাফি করছে এ স্প্রিংযুক্ত বিছানায়। সেটা দেখিয়ে তাকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাচ্চাটির একটু একটু করে ভয় কেটে যেতে লাগল। প্রথম দিকে আমার হাত ধরে সে স্প্রিং বেডে লাফাতে লাগলো আস্তে আস্তে।
তারপর একসময় পাশের বেডের বাচ্চাটির লাফানো দেখে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে খেলতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মুখের উজ্জ্বল হাসি দেখে আমার খুব ভাল লাগলো।
এরপর থেকে আমি যতবারই তাকে নিয়ে শিশুপার্কে গিয়েছি। এ স্প্রিং বেডের কাছে তাকে নিয়ে যেতে হয়েছে। এমনও দেখা গেছে একটানা ২০ থেকে ৩০ মিনিট সে লাফিয় কসরৎ করেছে স্প্রিং বেডে। এই ঘটনাটিও ঘটেছে পার্শ্ববর্তী শিশুদের কাজ দেখে।
সুতরাং শিশুর জন্মের প্রথম কয়েক বছর তাকে দৈহিক সাহস শিক্ষা দেয়ার উপযুক্ত শিক্ষক হলো অন্য একটি শিশু। এই শিশুটি যত সহজে আপনার বাচ্চাকে অনুপ্রাণিত করতে পারবে, তত সহজে আপনি পারবেন না। যদি শিশুর বড় ভাই বোন থাকে তারাই উদাহরণ দেখিয়ে বা উপদেশ দিয়ে তাকে উৎসাহিত করবে। তারা যা করতে পারে শিশুও তা অনুকরণ করবে।
স্কুলে দৈহিক ভীরুতাকে সকলেই অবজ্ঞা করে। বয়ষ্ক শিশুদের এ বিষয়ে আর জোর দেয়ার প্রয়োজন নেই।
বালকদের মধ্যে অন্তত এই ভাবই প্রচলিত। মেয়েদের মধ্যেও সেইকম হওয়া উচিত। তাদেরও ছেলেদের মত সাহস থাকা বাঞ্চনীয়। সৌভাগ্যক্রমে বালিকাদেরকে এখন আর মেয়েলি শিক্ষা দেয়া হয় না। এবং তাদের দৈহিক শক্তি বিকাশের পূর্ণ সুযোগ তারা পায়। তথাপি বালক ও বালিকাদের মধ্যে এ বিষয়ে সামান্য পার্থক্য আছে। আমার বিশ্বাস এই যে, এরকম পার্থক্য থাকা উচিত নয়।
আমি যখন সাহস বাঞ্চনীয় মনে করেছি তখন সাহসের আচরণমূলক ব্যাখ্যাই আমার মনে এসেছে।
অন্যেরা যে কাজ ভয়ে করতে পারে না সে কাজ যে করে তাকে সাহসী বলা যায়।
সে যদি মোটেই ভয় না করে তাহলে সবচেয়ে ভাল।
শুধু ভয়কে দমন করাকেই আমি সত্যিকারের সাহস কিংবা শ্রেষ্ঠ সাহস বলি না। নৈতিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো, যাতে ছেলেমেয়ে বাঞ্ছনীয় আচরণ করে– সে জন্য তাদের সদভ্যাস গঠন। এটাই আগে আত্মসংযম এবং ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে করানো হতো। ইচ্ছাশক্তি দ্বারা যে সাহস প্রদর্শিত হয় তা স্নায়বিক বিকলতা সৃষ্টি করে। যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের গোলাভীতি ছারা সৃষ্টি মনোবিকলতার বহু দৃষ্টান্ত আছে।
অতি শৈশবকালে যে ভয় দমিত হয়েছিল তাই পরে এমন নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল যে, মনঃসমীক্ষণ দ্বারা তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। আমি একথা বলতে চাই না যে, আত্মসংযমের কোন প্রয়োজন নেই।
বরং একথা ঠিক যে, আত্মসংযম ছাড়া পূর্বাপর সামঞ্জস্য রেখে জীবনধারণ করাই অসম্ভব। আমার বক্তব্য এই যে, এরকম অবস্থার সম্মুবীন হওয়ার জন্য আগে থেকে শিক্ষা দেয়া হয়নি। শুধু সেইরকম অভাবিত বা অদৃষ্টপূর্ব অবস্থায় উপযুক্ত আচরণের জন্য আত্রসংযমের ব্যবহার প্রয়োজন।
সকলকে সবরকম বিপদের সম্মুবীন হওয়ার মত শিক্ষা দেওয়াও সম্ভব নয়। রাজ্যের সকল অধিবাসীকে যুদ্ধের সময় কিরূপ সাহস প্রদর্শন উরতে হবে তা শেখাতে যাওয়া মুর্খতারই শামিল। যুথের ন্যায় সর্বাত্বক বিপদ যুদ্ধকালে স্থায়ী এবং কদাচিৎ ঘটতে থাকে। কাজেই যুবকদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্রেঞ্চের মধ্যে কিরূপ আচরণ করতে হবে তা অভ্যাস করাতে গেলে অন্য সকল রকম শিক্ষা খর্ব করতে হয়।
ডক্টর রিভার্স নামের একজন আমেরিকান মনস্ততৃবীদ বলেছেন- “কোন বিপদজনক অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার একটা উপায় হল দৈহিক পটুতা এবং যারা এটা উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করতে পারে তারা অন্তত সজ্ঞানে ভয় অনুভব করে না। এরূপ অভিজ্ঞতার যথেষ্ঠ মূল্য আছে। এটা আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি করে এবং ভয়কে জয় করার কৌশল আয়ত্ব করতে উৎসাহ দেয়। সাইকেল চালনার মতো সহজ কৌশলও একটি বালকের মনে এরকম অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে।”
দৈহিক সাহস দেখানোর আরো নিশ্চিত উপায় আছে। কোনরকম হৈচৈ আহা উহু না করে আঘাত সহ্য করা এর একটা দৃষ্টান্ত।
ছোটখাট আঘাত পেলে শিশুদের প্রতি যদি সমবেদনা না দেখানো হয়, তবে এই ধরনের সাহস গড়ে তোলা যায়। পরবতীকালে অত্যধিক সমবেদনা পাওয়ার বাসনা থেকে নানা উত্তেজনাময় বায়ুরোগের কারণ ঘটতে পারে।
অনেকে একটু আদর-আপ্যায়ন, একটু কোমল ব্যবহার পাওয়ার আশায় রোগের ভান করে। সামান্য একটু আঁচড় লাগিয়ে বা কেটে গেলেই শিশুদেরকে কাদতে উৎসাহ না দিয়ে এরকম মনোভাব প্রতিরোধ করা যায়। এ ব্যাপারে বালকদের প্রতি যেমন অতি মৃদু ও কোমল ব্যবহার সঙ্গত নয়, বালিকাদের প্রতিও তেমনিই।
কিছু কিছু অবাস্তব ভয় আছে যেগুলো শুধু শিশু নয় কিছুসংখ্যক কুসংক্কারাচ্ছন্ন বয়ষ্ক অশিক্ষিতদেরকেও গ্রাস করে থাকে। অবশ্য এইসব বয়ফদের ক্ষেত্রে শিশু বয়সের শিক্ষাও প্রভাব ফেলে।
যেমন শিশু বয়স থেকেই এইসব অশিক্তিত কুসংক্ষরাচ্ছন্ন লোকেরা চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ, যক্ষা, কলেরা বা এই ধরনের কোন রোগ সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়ে। পরবর্তী জীবনেও এই সম্পর্কে কোন কথা এলে বা প্রসঙ্গ আসলে তাদের মনে সেই ভীতভাব পূর্ণভাবে জেগে ওঠে। ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে এই ধরনের ভীতি বড়ই বিপদজনক জীবনের প্রথমেই যদি এটাকে সমূলে উৎপাটিত করা সম্ভব হতো তাহলে এই ভীতি তার পরবর্তী জীবনকে গ্রাস করতো না।
এই ধরনের ভীতি দূর করার প্রধান উপায় হলো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান। তবে প্রথম দৃষ্টিতে যা প্রাকৃতিক বা রহস্যময় তার সবকিছুতেই যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে তার কোন মানে নেই। বরং ভেবে দেখতে হবে সৃষ্ট বিষয়টিকে উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার আওতায় আনা যায় কিনা। ব্যাখ্যায় কোনফাঁ ক থাকলে বা ভুল হলে শিশুর মনে সেই বিষয় সম্পর্কে একটা আস্থাহীনতা দেখা দিতে পারে। অথবা বক্তার প্রতি তার বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি হতে পারে।
কতকগুলো ব্যাখ্যা দিলে শিশু অনুমান করবে যে, অন্য ঘটনারও অনুরূপ কারণ আছে এবং এটা বলা সম্ভব হবে যে, এখন আর ব্যাখ্যা দেয়া যাচ্ছে না। কোনকিছুতে অজ্ঞতা প্রদর্শন না করে সেটাকে অন্যভাবে বুঝিয়ে বলাটা জরুরী।
শিশুকে বোঝাতে হবে অনেক ধরনের ভয় অজ্ঞতা থেকেই সৃষ্টি এবং ধৈর্য ও মানসিক চেষ্টার মাধ্যমে এই অজ্ঞতাজনিত ভয়কে সহজেই দূর করা সম্ভব। যত শিগগির এই ধারণা শিশুমনে গ্রোথিত করা যায় ততই মঙ্গল।
এটা বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, শিশুর ভীতি উৎপাদন করে এমন কোন জিনিসের রহস্য শিশুর জানা হয়ে গেলে সেটা আর শিশুর জন্যে ভয়ের কোন কারণ থাকে না। সেটা একটা আনন্দের বিষয় হয়ে দীড়ায়। এভাবে দেখা গেছে, যখনই কোন রহস্য আর কুসংস্কার বৃদ্ধি করে না তখন থেকেই এটা শিশু পাঠের অনুপ্রেরণা জোগায়।
আমার বাচ্চার বয়স যখন তিন বছর তখন তাকে দেখেছি আমাদের বাড়ির পেছনের ফুল বাগানে রাখা লম্বা বেঞ্চটিতে সে মাঝে মাঝে বিকেলে বসে থাকতো একা একা। আর ওভাবে সে বসে বসে তন্ময় হয়ে মালির পিচকারি দিয়ে ফুলগাছে পানি দেয়া দেখত। আমি বিষয়টা লক্ষ্য করতাম। কিন্তু তার তন্ময়তার মাঝে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করিনি।
একসময় সে উঠে গিয়ে নিজের হাতে পিচকারিটা পরীক্ষা করে দেখতে চাইল। আমি বিষয়টা আগে থেকে অনুমান করে মালিকে বলে রেখেছিলাম। মালি তাকে সাথে সাথে পিচকারিটা দেখিয়েছিল। সেই সাথে বুঝিয়েছিল কিভাবে এটা থেকে পানি বের হয়। এখন সে মাঝে মাঝে মালির পিছন পিছন ঘোরে, আর হাত দিয়ে পিচকারিটাকে ধরতে চায়। অথচ মাত্র তিনমাস আগে এই পিচকারি দিয়ে তার গায়ে পানি ছিটিয়েছিলাম বলে সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল।
এইভাবে শিশুকে অনেক রহস্যই বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব। তাহলেই তার মধ্যে থেকে অবাস্তব ভয়ের বিষয়টা মুছে যাবে।
তবে কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো শিশুমনে মারাত্বক প্রভাব বিস্তার করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক হলো মৃত্যুরহস্য।
একটি শিশু সহজেই লক্ষ্য করতে পারে, গাছপালা এবং জীবজন্ত মরে যায়। তার বয়স চার বছর হওয়ার আগেই তার পরিচিত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে। তার মন যদি সক্রিয় হয় তবে তার মনে হতে পারে যে, তার বাবা-মায়েরও একদিন মৃত্যু হবে। এমনকি সে নিজেও মরবে। এ চিন্তাগুলো তার মনে বহু প্রশ্ন তুলতে পারে। এগুলোর উত্তর দেয়া আবশ্যক। যিনি পরলোকে বিশ্বাস করেন– তীর পক্ষে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ। কিন্তু যিনি বিশ্বাস করেন না তিনিও যেন নিজের বিশ্বাসের বিপরীত কোন অভিমত না দেন।
পিতা মাতার পথে শিশুদের কাছে মিথ্যা বলার কোন সঙ্গত কারণ নেই। এটা বলাই সবচেয়ে ভাল যে, মৃত্যু হলো মহাঘুম বা চির বিশ্রামের সময়। এই ঘুমে কেউ ঘুমিয়ে পড়লে কেউ আর জেগে উঠে না। কোনরকম গান্তীর্যের অবতারণা না করে এমনভাবে বলুন যে, মৃত্যু একটা সাধারণ ঘটনা। শিশু যদি নিজের মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তাযুক্ত হয় তাকে বলুন যে, অনেকদিন পর্যন্ত তার পক্ষে মৃত্যুর কোন সম্ভাবনা নেই।
দুঃখপূর্ণ হলেও মৃত্যু অনিবার্য এবং এর কষ্ট সহ্য করতেই হবে। মৃত্যু সম্পর্কে এই ধরণের ভাব বাল্যকালে শিশুর মনে সঞ্চার করার চেষ্টা মোটামুটি অসম্ভব হলেও শিশু যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন করে তাহলে আপনি তাকে এড়িয়ে যাবেন না।
শিশুকে বুঝিয়ে দিন যে, মৃত্যুর মধ্যে তেমন কোন রহস্য নেই। শিশু যদি স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন হয় এবং স্বাস্থ্যবান হয় তবে সে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে মাথা ঘামাবে না। এ প্রসঙ্গে কথা উঠলে খোলাখুলিভাবে আপনি যা বিশ্বাস করেন তা সরলভাবে বললেবন এবং শিশুর মনে এই ধারণা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবেন যে, বিষয়টা খুব আনন্দপ্রদ নয়। তবে সেই সাথে এটাও তার মনে গেঁথে দেবার ব্যবস্থা করবেন যে, মৃত্যুচিস্তায় বিভোর হয়ে থাকাটা কারুর জন্যেই মঙ্গলজনক নয়।
আপনি যদি আপনার সন্তানের ভীতি দূর করতে চান, তাহলে আপনাকে নির্ভিক হতে হবে। আপনি যদি মেঘগর্জনে ভয় পান, তবে প্রথমবার আপনার শিশু আপনার সামনে থেকে মেঘগর্জন শুনবে, তখনই তার মধ্যে ভয় সঞ্চারিত হবে। আপনি যদি সামাজিক বিপদ সম্পর্কে ভীতি প্রকাশ করেন, আপনি কি বিষয়ে বলছেন তা বুঝতে না পারায় আপনার সন্তান আরো বেশি ভীত হয়ে পড়বে। আপনি যদি কোন রোগ সম্পর্কে শঙ্কিত হন, আপনার সন্তান আরো বেশি শঙ্কিত হবে। এটা কখনও করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার সন্তানকে বিশ্বের একজন মুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িন আপনার।
আপনি যদি নিতান্তই দুর্বল চিত্তের অধিকারী হন, তাহলে আপনার নিভের মন থেকে ভয় দূর করতে না পারলেও চেষ্টা করবেন আপনার সন্তান যেন এটা সন্দেহ করতে না পারে। তার সামনে আপনার ভয় সংক্রান্ত কোন বহিঃপ্রকাশ প্রদর্শন করবেন না। সর্বোপরি তাকে এমন উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেবেন এবং তার মনে বহু বিচিত্র বিষয়ে এমন জীবন্ত উৎসাহ সঞ্চার করুন যেন সে পরবর্তী জীবনে নিজের ব্যক্তিগত বিপদের আশঙ্কা না করে দেশের জন্যে দশের উপকারের নিমিত্তে যুগশ্রেষ্ঠ মহান ব্রত অবলম্বন করতে পারে।
সবসময় মনে রাখবেন, জীবন বিপদ-সংকুল কিন্তু বিজ্ঞ ব্যক্তি অবশ্যস্তাবী বিপদ উপেক্ষা করে বলেই তারা বিপদকে প্রতিরোধ করার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারে।