নিম্নে সন্তান-এর চরিত্র ও অভ্যাস গঠনে মা বাবার ভূমি গ্রহণ এবং সহায়তা করার বিষয়ে একটি বিস্তর আলোচনা তুলে ধরা হলো-
সদ্যজাত শিশু কতকগুলো প্রতিবর্তা স্বভাব এবং প্রবৃত্তি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়ে থাকে। এই কারণে প্রথম দিকে তার মধ্যে অভ্যাস বলে কিছু থাকে না। মাতৃগর্ভে থাকার সময় সে যা অভ্যাস করেছিল তা নতুন পরিবেশে কোন কাজেই আসে না। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াও অনেক সময় শিখাতে হয়।
কিছু কিছু শিশু এই অভ্যাস তাড়াতাড়ি শিখতে পারে না বলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় একটা প্রবৃত্তি সচরাচর দেখা যায়; এটা হল চুষবার প্রবৃত্তি। শিশু যখন কিছু চুষতে শুরু করে তখন এই নতুন পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করে না। কিন্তু জাগ্রত অবস্থার অন্য সময়টুকু তার কাছে ফীকা বা বিস্ময়য়কর মনে হয়।
চব্বিশ ঘণ্টার বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে সে এই অস্বস্তিকর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে বা আরামবোধ করে। দিন পনেরো পরে কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ের মধ্যে নিয়মিতভাবে বারবার অভিজ্ঞতা লাভের পর কিছু পাওয়ার বাসনা তার মনে দানা বেঁধে ওঠে।
শিশু অত্যথ সংরক্ষণশীল। কোন নতুনত্ব সে পছন্দ করে না।
সে যদি কথা বলতে পারত, তবে হয়তো বলত, তুমি কি মনে কর, আমার জীবনকালের অভ্যাস সহজে ছেড়ে দেব?
যেরকম ক্ষিপ্রতার সাথে শিশু অভ্যাস আয়ত্ত করে তা বিস্ময়কর। প্রতিটি কু-অভ্যাস পরবর্তীকালে সদভ্যাসগুলোর প্রতিবন্ধক হয়ে দীড়ায়। এজন্যেই অতি শৈশবে প্রথম অভ্যাস গঠনের গুরুত্ব এত বেশি! প্রথম অভ্যাসগুলো যদি ভাল হয় তবে পরে অশেষ ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। অধিকন্তু শৈশবে কোন অভ্যাস আয়ত্ত হলে তাকে পরে প্রবৃত্তি বলে মনে হয় এবং প্রবৃত্তির মতই এটা স্থায়ী ও দৃঢ়মূল হয়ে উঠে। পরবর্তীকালে এর বিপরীত অভ্যাস গঠিত হলে তা প্রথম গঠিত অভ্যাসের মত দৃঢ় হয় না। এজন্যও প্রথম অভ্যাস গঠনের উপর খুবই গুরুত্ব দেয়া উচিত।
পূর্বে শিশুর জীবনের প্রথম বছরকে শিক্ষার আওতার বাইরে ধরা হত। যতদিন শিশু কথা বলতে না শেখে ততদিন একে জননীর বা পরিচারিকার সম্পূর্ণ তত্বাবধানে রাখা হত। মনে করা হত, শিশুর পথে কি মঙ্গলজনক তা এরা নিজেদের প্রবৃত্তি হতেই জানেন। প্রকৃতপক্ষে এরা কিছুই জানতেন না।
জীবনের প্রথম বছরেই বহু শিশু মারা যেত, যারা বেঁচে থাকত, তাদের মধ্যেও অনেকে স্বাস্থ্যহীন হয়ে উঠত। লালন-পালনের দোষে বহু খারাগ অভ্যাস গড়ে উঠত।
সম্প্রতি এসব বিষয় জানা গেছে। শিশু পালনাগারে যদি বিজ্ঞান প্রবেশ করে তবে অনেকে রুষ্ট হন। কেননা তাদের ধারণা শিশুর মঙ্গলের সম্পূর্ণ ভার মায়ের হাতে। শিশুর জীবনে মায়ের কদাচিত স্থান যে বিজ্ঞান গ্রহণ করবে তা তারা বরদাস্ত করতে চান না। কিন্তু ভাবপ্রবণতা এবং বাৎসল্যপ্রীতি একসাথে থাকতে পারে না।
যে জনক বা জননী নিজ সন্তানকে ভালবাসেন। তিনি চান যে, তীর সন্তান বেঁচে থাকুক। দরকার হলে এজন্য বুদ্ধি প্রয়োগ করতেও তিনি কুষ্ঠিত নন। কাজেই নিঃসন্তান লোকের মধ্যে এবং যারা নিজেদের সন্তানদেরকে অনাথ আশ্রমে প্রতিপালনের পক্ষপাতি- তাদের মধ্যে এ ভাবপ্রবণতা প্রবল হতে দেখা যায়।
বর্তমানে একটা আশার বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিশুর পালন ব্যাপারে বিজ্ঞান কি বলে বেশিরভাগ শিক্ষিত জনক-জননী তা জানতে ইচ্ছুক। অশিক্ষিত বাবা-মাও শিশুমঙ্গল কেন্দ্র থেকে এটা জেনে নিতে আগ্রহী।
এতে যে সত্যিকারের সুফল হয়েছে তা শিশু মৃত্যুর সংখ্যা যথেষ্ঠ হ্রাস পাওয়া থেকেই বোঝা যায়। এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ঠ কারণ আছে যে, যথোপযুক্ত স্তর ও নিপুণতা প্রয়োগ করলে অতি অল্প শিশুই আতুরঘরে মারা যাবে। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পাবে তাই নয়, যারা বেঁচে থাকবে তারা দেহে এবং মনে অধিকতর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে।
আমি আগেই বলেছি, একটি সদ্যজাত শিশুর অভ্যাস বলে কোন কিছু থাকে না। কারণ একটি সদ্যজাত শিশু কতকগুলো প্রতিবর্তি স্বভাব এবং প্রবৃত্তি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কোন নতুন জিনিস সে একবারে বরদাস্ত করতে পারে না। তবে চেষ্টা করলে যে কোন সদভ্যাস একটি শিশু ক্ষিপ্রতার সাথে আয়ত্ত করে ফেলতে পারে।
একটি সদ্যজাত শিশুর মানসিকতা সম্পর্কে সম্যকভাবে জানতে পারা সম্ভব নয়। তথাপি এটা অনুমান করা যায় যে, তার জগৎ কোনরকম বস্তু দিয়ে তৈরি নয়। কোন জিনিস চিনতে হলে তার একইরকম অভিজ্ঞতা বারবার দরকার।
কোন জিনিস সম্বন্ধে ধারণা জন্মাবার আগেই তা নিশ্চয় চিনতে হবে। শিশুর কাছে তার খাটের স্পর্শ, তার মায়ের স্তন বা দুধের বোতলের গন্ধ ও স্পর্শ এবং তার মায়ের কিংবা ধাত্রীর কোল কিছু সময়ের মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠে। তার মায়ের চেহারা বা খাটের আকৃতি সম্বন্ধে ধারণা পরে আসে।
সদ্যোজাত শিশু কোন জিনিস ভাল করে দেখার মত চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারে না। ক্রমে সংস্পর্শের ফলে অভ্যাস গঠনের ভেতর দিয়ে স্পর্শ, দৃষ্টি, ঘাণ এবং শব্দ একত্রে মিলে কোন বিষয় সম্বন্ধে শিশুর ধারণা জন্মায়। অর্থাৎ চোখ দিয়ে দেখে, ঘ্রান নিয়ে এবং শব্দ শুনে শিশু কোন বন্ত সম্বন্ধে ধারণা গঠন করে।
একটা চিনলে আর একটা চিনতে আগ্রহ জন্মে। তখনও কিছু সময়ের জন্য শিশুর কোন পদার্থ বা মানষের মধ্যে পার্থক্য বোধ জন্মে না। যে শিশু কখনও মায়ের দুধ পান করে, কখনও বা বোতল ভরা দুধ পান করে– সে কিছুদিন পর্যন্ত তার মা এবং বোতলের প্রতি একইরকম ভাব পোষণ করবে। এসময় কেবল নিছক দৈহিক উপায়েই শিক্ষা দিতে হবে। এসময় শিশুর আনন্দ এবং কষ্ট সবই দৈহিক। খাবার পেলে এবং কোমল উষ্ণতা মনে করলে সে আনন্দিত হয়, দেহেব ব্যথাতেই কষ্ট পায়। আনন্দের সাথে যা সংযুক্ত তা পাওয়ার আচরণের অভ্যাস এবং কষ্টের সাথে যা সংযুক্ত তা পরিহার করার জন্য আচরণের অভ্যাস এইসময় গড়ে ওঠে।
শৈশবে অভ্যাস গঠনের বিষয় আলোচনা করার সময় দুটো বিষয়ের কথা ওঠে। প্রথম এবং বিশেষ প্রয়োজনীয় হলো স্বাস্থ্য এবং দ্বিতীয় হলো শিশুর চরিত্র। আমাদের প্রত্যেকেরই কামনা, শিশু যেন সকলের প্রিয় হয় এবং জীবন-সংগ্রামে জয়ী হতে সমর্থ হয়। সৌভাগ্যক্রমে স্বাস্থ্য এবং চরিত্র উভয়েরই লক্ষ্য এটাই। একটার পথে যা শুভ অন্যটার পথেও তা কল্যাণকর। .
শিশু যখন চিৎকার করে তখনই না খাইয়ে নিয়মিত সময় অন্তর খাওয়ানোর উপকারিত আজকাল প্রত্যেক শিক্ষিতা মা-ই জানেন। এ রীতি প্রচলিত হয়েছে এজন্য যে, এটা শিশুর হজম প্রক্রিয়ার জন্যে বিশেষভাবে উপকারী।
এ কারণেই নিয়মিত খাবার দেয়ার পথে যথেষ্ঠ এবং নৈতিক শিক্ষার পথে এটা বাঞ্ছনীয়।
বয়ঙ্ক ব্যক্তিরা যতটুকু মনে করেন শিশুরা তার চেয়ে অনেক বেশি চতুর। যদি তারা দেখে যে, চিৎকার করলেই আরামদায়ক কিছু পাওয়া যায় তবে তারা চিৎকার করবেই। পরবর্তীকালে সে সবকিছু নিয়েই খুঁতখুঁত করার বা আবদার করার অভ্যাসের ফলে যখন তারা অপরের কাছে অপ্রস্তুত হয় এবং নিজেদের ঈন্সিত জিনিস পায় না, তখন তারা কষ্ট ও পায় ও বিক্ষিপ্ত হয়। জগত তাদের কাছে উদাসীন এবং সহানুভূতিহীন বলে মনে হয়। তারা আদর পাবে এবং এর ফলে শৈশবে যে কুশিক্ষা পেয়েছিল তা-ই দৃঢ়তর হবে।
ধনী লোকের বেলায়ও এটা সত্য। শৈশবে যদি উপযুক্ত শিক্ষা না পায় তবে পরবর্তীকালে তারা মনোবাসনা পূর্ণ না হওয়ায় হয় অসস্তষ্ট হবে, অথবা স্বার্থপর ও অত্যচারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
যে মুহুর্তে শিশুর জন্ম হয় তখনই নৈতিক শিক্ষাদান করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় কেননা তখন তার কোন বাসনা গঠিত হয়নি। কাজেই তখন এ শিক্ষা দিতে গিয়ে তার কোন বাসনাকে খর্ব করতে হবে না। পরবর্তীকালে এ শিক্ষা দিতে গেলেই কতকগুলো অভ্যাসের বিরুদ্ধে এটা প্রয়োগ করতে হবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই এটা শিশুর ক্রোধের উদ্রেক করে।
শিশুর সাথে ব্যবহারে অবহেলা ও আদর এই দুটোর মধ্যে সমতা রাখা দরকার। তার স্বাস্থ্যের জন্য যা প্রয়োজন তা অবশ্যই করতে হবে। ঠান্ডা বাতাসে থাকলে তাকে তুলে শুকনো গরম জায়গায় রাখতে হবে। কিন্তু কাঁদার পথে যথেষ্ঠ কোন দৈহিক কারণ না থাকা সত্বেও যদি সে কাঁদতে থাকে, তাকে কাঁদতেই দিতে হবে। তা না হলে অল্পদিনের মধ্যেই সে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। তাকে পরিচর্যা করা সময় অযথা হৈচৈ বা অত্যাধিক আদর ও প্রীতি দেখানোর কোন প্রয়োজন নেই।
কোন বয়সেই শিশুকে অতিরিক্ত আদর আপ্যায়ন দেখানো উচিত নয়। প্রথম থেকেই তাকে একজন ভারী বয়ষ্ক ব্যক্তিরূপে দেখতে হবে।
বয়ঙ্ক ব্যক্তির মধ্যে যে অভ্যাস অসহনীয় মনে হয়, শিশুর মধ্যেই তাই প্রীতিকর বোধ হতে পারে। অবশ্য শিশু যথার্থ বয়ষ্ক ব্যক্তির অভ্যাস গঠন করতে পারে না। তবে এরকম অভ্যাস গঠনে যা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতে পারে তা এড়িয়ে যাওয়াই উচিত।
সর্বোপরি কখনই শিশুর মনে আত্ম-প্রাধান্যের ভাব জন্মাতে দেয়া ঠিক নয়। কেননা এই ভাব গড়ে উঠলে পরবর্তী বয়সে সে যখন অন্য সকলের কাছ থেকে বিশেষ আপ্যায়ন পাবে না, তখন তার মনে আঘাত লাগবে।
একজন সচেতন বাবা কিংবা মায়ের জন্যে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো, আদর ও অনাদরের মধ্যে সুস্থ সমতা রেখে শিশুদের শিক্ষা দেয়া।
শিশুর যাতে কোন প্রকার স্বাস্থ্যহানী না ঘটে সেজন্য সদাজাগ্রত সতর্কতা এবং যত্ন দরকার। সন্তানের প্রতি মমতা অত্যাধিক না হলে এগুলো প্রায়ই দেখা যায় না।
কিন্তু যেখানে এরকম সতর্কতা ও যত পরিচর্যা আছে সেখানে হয়তো বিশেষ বিজ্ঞতার সাথে এগুলো প্রয়োগ করা হয় না। স্নেহশীল বাবা-মায়ের কাছে সন্তান একটা মহাসামগ্রী।
বাবা-মা যদি সন্তানের প্রতি আচরণে বিশেষ সংযত না হয় তবে শিশু এটা বুঝতে পারে এবং নিজেকে মহামূল্যবান মনে করে নিজের সম্বন্ধে কাল্পনিক উচ্চধারণা গড়ে তোলে।
একথা তো ঠিক যে, পরবর্তীকালে সামাজিক পরিবেশে সে বাবা-মায়ের কাছে যেরকম পেয়েছে সেরকম আদর-যত্ন পাবে না। বাঁধা-মায়ের অহেতুক স্নেহের আতিশয্য তার মনে যে ধারণা সৃষ্টি করেছিল যে, সে. সকলের আদরের মধ্যমনি- তা অবশেষে তাকে নিরাশ করবে।
কাজেই বাবা-মায়ের কর্তব্য হলো শুধু শিশুর প্রথম বছর নয়, পরেও সন্তানের কোন অসুখ-বিসুখ হলে উৎকণ্ঠা প্রকাশ না করে স্বাভাবিকভাবে আনন্দের সাথেই তা গ্রহণ করা উচিত।
আগের দিনে শিশুর অসুখ হলেই তাকে অন্য সকলের কাছ থেকে আলাদা করে জামাকাপড় দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বিছানায় শুইয়ে রাখা হতো; কিংবা কোলে করে অথবা দোলনায় দোলানো হতো। তার স্বতৎস্ফুর্ত আচরণে বাধা পড়ত। সন্তান মানুষ করার এই গন্থা ছিল আগাগোড়া ভুল এই পদ্ধতি শিশুকে অসহায় পরজীবী আদুরে পুতুলে পরিণত করে।
যথার্থ নিয়ম হল, শিশুর স্বতঃস্ফুর্ত কাজে উৎসাহ দিন। কিন্তু অন্যের ওপর দাবি করলে তখন তাকে থামান।
আপনি শিশুর জন্য কতটুকু করেন বা কি পরিমাণ কষ্ট করেন তা শিশুকে দেখতে দেবেন না।
যেখানে সম্ভব সেখানে শিশু বয়ষ্ক ব্যক্তির উপর জুলুম করে নয়, নিজের চেষ্টাতেই সাফল্য লাভ করুক। এতে সে আত্মতৃপ্তি লাভ করবে।
আধুনিক শিক্ষায় আমাদের উদ্দেশ্য হল– বাইরের শাসন ও শৃঙ্খলা যথাসম্ভব কমিয়ে দেয়া। এর জন্য একটি শিশুর ভেতর থেকে আত্মশৃঙ্খলা জাগানো দরকার।
একটি শিশুর আত্মশৃঙ্খলা তার জন্মের প্রথম বছরে আয়ত্ত করানো যেমন সহজ– তেমনটা আর কোন সময়ে নয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিশুকে যখন ঘুম পাড়াতে চান তখন একে দোলনায় রেখে দোলানো বা কোলে করে ঘুরে বেড়াবার দরকার নেই। এমনকি আপনি যেখানে থাকলে সে শুয়ে থেকে আপনাকে দেখতে পাবে এমন জায়গাতেও থাকবেন না।
কিন্তু আপনি যদি সোহাগ দেখিয়ে কোলে করে ঘোরেন কিংবা আরামদায়ক দোল দেন, তবে পরে ঘুম পাড়াতে চাইলে আপনাকে আবার সেইরকম করতে হবে। এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে বুঝবেন শিশুকে ঘুম পাড়ানো কি ঝকমারি কাজ । আপনি বরং তাকে শুকনো জামা পরিয়ে, পরিষ্কার শুকনো বিছানায় শুইয়ে দিন। তারপর শান্তস্বরে কয়েকটা মন্তব্য করে চলে আসুন। কয়েক মিনিট সে কাদতে পারে; কিন্তু যদি কোনরূপ অসুখ না থাকে তবে সে কিছুক্ষণ পরেই থামবে । তখন যদি দেখতে যান, দেখতে পাবেন– আপনার আদরের শিশু গভীর ঘুমে মগ্ন রয়েছে। কোলে করে ঘোরা বা আদর করে চাপড়ানোর চেয়ে এই প্রক্রিয়ায় শিশু অনেক বেশি ঘুমাবে।
বয়ফ লোকেরা শিশুদেরকে আদর আহাদ দিতে গিয়ে যেন বাড়াবাড়ি না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শিশুরা নিজেদেরই চেষ্টায় যে আনন্দ লাভ করতে পারে তাতে বরং উৎসাহ দিতে হবে। প্রথম থেকেই যাতে এরা হাত-পা ছুঁড়ে মাংসপেশীর সঞ্চালন করতে পারে তার সুবিধা করে দিতে হবে। শিশু কীদলেই ব্যস্ত হয়ে তার সব আবদার বা বায়না পূরণ করার দিকে সচেষ্ট থাকলে একদিক থেকে এতে শিশুর ক্ষতিরই সমূহ সম্ভাবনা।
মনে রাখতে হবে, শিশুর ক্রন্দন আংশিকভাবে প্রতিবর্তী মাত্র। দৈহিক কষ্ট পেলেই স্বভাবতই সে কেঁদে ওঠে । আনন্দ পাওয়ার উপায় হিসেবেও কখনও কখনও শিশু কেঁদে থাকে। প্রথম প্রথম অবশ্য কেবল কষ্ট অনুভব করেই কীদে। শিশু যখন কষ্ট বা ব্যথা পেয়ে কাদতে থাকে– তখন তার কষ্টের কারণ দূর করলেই তার কান্না থেমে যায় এবং আনন্দ পায়।
এভাবে কীদার সাথে আনন্দের অনুভূতির যোগ সাধিত হয়। এরপরে শিশু দৈহিক কোনরকম ব্যথা বোধ না. করলেও আনন্দ কামনা করে কাদতে শুরু করে। এটা তার বুদ্ধিবৃত্তির বা বুদ্ধি জয়ের একটা প্রথম পরিচয়। কিন্তু যতই চেষ্টা করুক, প্রকৃত বেদনা বা কষ্ট বোধ করলে যেভাবে চিৎকার দেয়া সেরূপ চিৎকার কিন্তু কার মুখ দিয়ে বের হয় না। মায়ের কানে এ পার্থক্য ধরা পড়ে এবং তিনি যদি বুদ্ধিমতী হন তবে যে কান্না দৈহিক কষ্টের দ্যোতক নয় তা উপেক্ষাই করবেন।
শিশুকে কোলে করে নাচিয়ে কিংবা এর কানের কাছে মিষ্টি স্বরে গান করে আনন্দ দেয়া সহজ এবং শিশুর কাছেও তা আরামদায়ক। এরকম পেলে শিশু শিগগিরই আরো নতুন নতুন পদ্ধতিতে বেশি বেশি আরাম দাবি করবে এবং এটা না হলে ঘুমাবে না। কিন্তু কেবল খাবার সময় ছাড়া সারা দিনমান শিশুর ঘুমিয়ে কাটানো উচিত। এই উপদেশ কঠোর মনে হতে পারে কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এটা ভবিষ্যতে শিশুর স্বাস্থ্য ও আনন্দেরই কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়।
আধুনিক সন্তান লালন-পালন পদ্ধতির সাথে আগের সেই পুরনো রীতিনিয়মের ফারাক বিস্তর।
কিন্তু আমার ভাবতে অবাক লাগে, ছোটবেলায় আমার মা-খালাদের দেখেছি, দীর্ঘদিন পর্যন্ত তারা শিশুদেরকে গরম কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখতেন। শিশু যেন তার হাত-পা ছুঁড়তে না পারে– সেই কারণেই এই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এটা দেখে মনে হয় সন্তান যেন আলস্যকে জয় করতে পারেনি। কেননা হাত-পা মুক্ত থাকলে শিশুর কাছাকাছি থাকা মানুষটিকে সতর্ক থাকতে হয়। শিশুর ঠিকমত নজরদারী করতে হয়। যখন শিশু দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারে তখন থেকেই সে চলমান জিনিস দেখতে আনন্দ পায়, বিশেষ করে হাওয়ায় কোন কিছু দুলতে দেখলে সে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে খুশি হয়। কিন্তু যতদিন না শিশু যা দেখে তা ধরতে পারে ততদিন এর আনন্দদানের জিনিস খুব বেশি থাকে না।
তারপর অকস্মাৎ একটা নতুন আনন্দের সন্ধান পায়– এটা হল কোন জিনিস ধরার আনন্দ। কিছুদিন শিশু জাগ্রত অবস্থায় অনেকটা সময় কিছু ধরে বা ধরার চেষ্টা করার আনন্দে অতিবাহিত করে। এইসময় সে ঝুমঝুমি হতে আনন্দ পায়। এর কিছু আগে সে হাত-পায়ের আঙুল জয় করেছে। প্রথমে শিশুর হাত-পায়ের আঙুলগুলোর যে সঞ্চালন তা সম্পূর্ণ প্রতিবর্তী। অর্থাৎ শিশুর নিজের ইচ্ছায় এটা সঞ্চালিত হয় না। পরবর্তীতে শিশু বুঝতে পারে এই হাত-পায়ের সঞ্চালন তার আয়ত্তে। একজন সাম্রাজ্যবাদী কোন বিদেশ জয় করলে যেরূপ আনন্দিত হন, হাত-পায়ের ওপর কতৃত্ব বিরাজ করে শিশুর সেরূপ আনন্দ অনুভব করে।.
এগুলো তখন তার কাছে আর বাইরের কোন অর্থহীন বস্তু নয়। তার নিজের অধিকারে। নিজের আয়ত্ব। শিশুর কাছে উপযুক্ত জিনিস তার হাতের কাছে থাকলে এইসময় থেকে সে অনেক প্রকার আনন্দ লাভ করতে পারে। এই ধরনের শিশু কিন্তু তখন থেকেই শিক্ষার জন্যে উপযুক্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য দেখতে হবে সে যেন উল্টে না পড়ে, পিন গিলে না ফেলে কিংবা অন্য কোনপ্রকারে আঘাত না পায়।
শিশুর বয়স যখন ২ থেকে ৩ মাস তখন সে হাসতে শেখে এবং মানুষ ও জড়পদার্থের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। এসময় থেকে মায়ের সাথে তার সম্বন্ধ গড়ে উঠতে থাকে; মাকে দেখলে সে আনন্দ প্রকাশ করে এবং সাড়া দেয়। খুব কম সময়ের মধ্যে তার মনে প্রশংসা ও অনুমোদন পাওয়ার বাসনা জেগে ওঠে।
আমার নিজের ছেলের বয়স যখন ৪ মাস তখন এই বাসনার গুপ্ত প্রকাশ দেখতে পেয়েছি আমি। সেদিন আমি ছেলেকে নিয়ে আমার লেখার টেবিলের সামনে বসে ছিলাম।
এমন সময় লক্ষ্য করলাম তার মধ্যে একধরনের আগ্রহ জন্মাচ্ছে– আমার টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা কাগজপত্র আর বিভিন্ন জিনিসের ওপর। আমি তাকে সেদিকে একটু ঝুঁকিয়ে দিলাম।
আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করলাম, কয়েকবার চেষ্টার পর সে আমার লেখার টেবিল থেকে খোলা কলমটা তুলে নিল এবং আমার লেখার একটি খাতা সামনে মেলে রাখা ছিল– সেখানে কলম দিয়ে দাগ দিতে শুরু করলো।
এইসময় তার মুখে যে হাসি আমি দেখতে পেয়েছিলাম, সেটা একজন পরিণত বয়ষ্ক মানুষের মুখের গর্বের হাসি। আমি তখন আমার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করলাম, এই ছেলে যেন বড়ো হয়ে কলমকে সত্যিকারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
আমার এই কাজটি কিন্তু একধরনের প্রশংসাযুক্ত প্রকাশভঙ্গি। অনেক মা হয়তো এই অবস্থায় তার শিশুর হাত থেকে কলমটা ছিনিয়ে নিতেন। কিংবা ভৎসর্ণা করতেন কলম হাতে নিয়েছে বলে। একদিনের জন্যে হয়তো এটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় শিশুর কাছে। কিন্ত বিষয়টা মাঝেমাঝে ঘটলে শিশুমনে একটা ব্যতিক্রমী বলে ছাপ পড়ে যেতে পারে।
হিংসা ও নিন্দা একটি শিশুর কাছে যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। এটি তার শিক্ষকের কাছে একটি মারাত্মক অস্ত্র বলে বিবেচিত। কারণ এই অস্ত্র অত্যন্ত সাবধানে শিশুদের ওপর প্রয়োগ করতে হয়।
শিশুর প্রথম বছরে তাকে কখনও নিন্দা করা ঠিক হবে না। পরেও এটা খুব কম প্রয়োগ করতে হবে। প্রশংসা বরং কম ক্ষতিকর। কিন্ত এটা অতি অল্পতেই যখন তখন প্রয়োগ করলে এর মূল্য অনেক কমে যায়। শিশুকে অতিরিক্ত মাত্রায় উৎসাহিত করার জন্যেও এটা প্রয়োগ করা উচিত নয়।
শিশু যখন প্রথম হাটে এবং বোধগম্য কথা বলে তখন খুব কম বাবা-মা প্রশংসা না করে থাকতে পারেন। তাছাড়া শিশু যখন চেষ্টা করে কোন কঠিন বিষয়ে কৃতকার্য হয় তখন পুরষ্কার হিসেবে প্রশংসা তার সত্যই প্রাপ্য। অধিকন্তু শিশুকে এটা বুঝতে দেয়া ভাল যে, আপনি তার শিক্ষার বাসনার প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন।
প্রথম অবস্থায় শিশু থাকে দুর্বল, তাকে আশস্ত করার এবং সকল আপদ থেকে রক্ষা করে আরামে রাখার প্রয়োজন আছে। শৈশবাবস্থার শেষ দিকে শিশুর নতুনের প্রতি ঝোঁক বাড়ে কিন্ত প্রথম বছরের অস্বাভাবিক জিনিসমাত্রই তার ভীতি উৎপাদন করে। যদি পারেন, শিশুকে ভয় অনুভব করতে দেবেন না।
যদি সে অসুস্থ হয় এবং আপনি উদ্বিগ্ন হন, আপনার উদ্বেগ সযত্নে গোপন রাখবেন যাতে শিশু মোটেই বুঝতে না পারে। এমন কিছুই করবেন না যা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। শিশু যদি না খায়, না ঘুমায়, কিছুক্ষণ মলমৃত্র ত্যাগ না করে তবে উদ্বেগের ভাব দেখাবেন না। কারণ এরকম করলে শিশুর মনে আত্মপ্রাধান্যের ভাব জেগে উঠতে পারে।
এটা কেবল শিশুর প্রথম বছরেই প্রযোজ্য নয়, পরেও মেনে চলা উচিত। শিশুকে কখনই বুঝতে দেবেন না যে, আপনি চান শিশু কোন একটা স্বাভাবিক কাজ করুক– যা তার নিজের পথেও আনন্দদায়ক। যেমন খাওয়া এবং তা করে সে আপনাকে আনন্দ দিক।
এরককম করলে সে বুঝবে যে একটা নতুল ক্ষমতা সে হাতে পেয়েছে। এবং যা সে আপনা-আপনিই করতে পারে। এটা করানোর জন্যে তাকে অন্যে আদর-আপ্যায়ন তোষামোদ করুক এটাই সে মনে, মনে কামনা করবে। অনুমান করবেন না যে, শিশুর এরকম আচরণ বোঝার মতো বুদ্ধি নেই। এর ক্ষমতা কম, বুদ্ধিও সীমাবদ্ধ কিন্তু যেখানে সে এটা প্রয়োগ করতে পারে সেখানে তার বুদ্ধি বয়ষ্ক ব্যক্তির মতোই। প্রথম ১২ মাসের মধ্যে শিশু যতটুকু শেখে পরবতীকালে এ পরিমাণ সময়ের মধ্যে সে আর ততটুকু শিখতে পারে না। অত্যন্ত সক্রিয় বুদ্ধি না থাকলে কখনই এটা সম্ভব হত না।
নিয়মানুবর্তিতা এবং রুটিন মত কাজ শিশুর জীবনে বিশেষ করে প্রথম বছরের জন্য অত্যন্ত জরুরী। প্রথম থেকে ঘুম, খাওয়া এবং মলমৃত্র ত্যাগে নির্দিষ্ট অভ্যাস গঠন করাতে হবে। এছাড়া পরিবেশের সাথে পরিচিত শিশুর মনের দিক দিয়ে বিশেষ উপকারী। এটা তাকে জিনিস চিনতে সাহায্য করে এবং তার মনে একধরনের নিরাপত্তা বোধ জাগিয়ে তোলে।
আমার অনেক সময় মনে হয়েছে যে, প্রকৃতির নিয়ম সবসময় একইরকম থাকে বলে যে বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে– নিরাপত্তার বাসনা থেকেই তার উৎপত্তি। যা ঘটবে বলে জানা আছে– তার সাথে আমরা এঁটে উঠতে পারি, কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম যদি অকস্মাৎ পরিবর্তিত হয়ে যেত তবে আমরা বাঁচতাম না।
শিশুর শেখার বাসনা এত বেশি যে, বাবা-মা কেবল এর সুযোগ করে দিলেই যথেষ্ঠ। শিশুকে আত্মবিকাশের সুযোগ দিন। সে নিজের চেষ্টাতেই অগ্রসর হবে। শিশুকে হামাগুড়ি দিতে, হাটতে অথবা তার পেশি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত অন্য কোন কিছু শেখাতে হবে না। আমরা অবশ্য কথা বলানো শেখাব কিন্তু এতে কোন উপকার হয় কিনা সন্দেহ।
শিশুরা নিজেদের বুদ্ধির সাথে সমতা রেখে শিখতে থাকে। জোর করে শেখানোর চেষ্টা করা ভুল। চেষ্টা করে প্রাথমিক অসুবিধাগুলো জয় করে কৃতকার্য হওয়ায় যে অভিজ্ঞতা তাই সারাজীবন ধরে চেষ্টার প্রেরণা জোগায়। এই অসুবিধাগুলো এমন হওয়া উচিত নয় যা শিশু জয় করতে না পেরে নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে কিংবা এমন সহজ হওয়াও উচিত নয় যা শিশু বিনা চেষ্টাতেই জয় করতে পারে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এটাই হল মৌলিক নীতি।
আমরা নিজেরা যা কিছু করি কেবল তা দ্বারাই শিখে থাকে। বয়ষ্ক ব্যক্তি এটুকু করতে পারেন– শিশু যা করতে চাইবে, এমন কিছু কাজ নিজে করে দেখালেন। যেমন ঝুমঝুমি বাজানো, তারপর কেমন করে ঝুমঝুমি বাজাতে হয় শিশু নিজে চেষ্টা করে শিখুক।
অন্যে যা করে তা দেখে শিশু সেরূপ চেষ্টা করতে উৎসাহী হয় মাত্র। অন্যের কিছু করাটাই শিশুর শিক্ষা নয়, শিক্ষার প্রেরণামাত্র।