(১) আদর্শ জীবনচরিত কি/কাকে বলে?
মহান আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর ইবাদত করা, আল্লাহর বিধিনিষেধ মান্য করা। আর এসব বিধিনিষেধ যথাযথভাবে অনুসরণ করার জন্য অবশ্যই একটি অনুসরণীয় নীতিমালা প্রয়োজন। যাকে আমরা আদর্শ বলতে পারি। এমন ব্যাক্তিবর্গকেই বলা হয় আদর্শ জীবনচরিত।
মহান আল্লাহর পক্ষ হতে আগত নবিগণের জীবনচরিত আমাদের আদর্শ। এর মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনচরিত হলো সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। এমনিভাবে যাঁরা নবি ও রাসুলগণের জীবনী অনুকরণ করে ধন্য হয়েছেন তাঁদের জীবনের ভালো দিকগুলোকেও আমরা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করব।
(২) একজন আদর্শ জীবনচরিতের উৎকৃষ্ট উদাহরণ: হযরত মুহাম্মদ (সঃ)
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মদিনায় অবস্থানকালে মাতৃভূমি মক্কার প্রতি দরদ অনুভব করেন। তাই তিনি ষষ্ঠ হিজরি সনে ১৪০০ সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা অভিমুখে বায়তুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মক্কার অদূরে হুদায়বিয়া নামক স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হন। তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও মক্কার কাফিরদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐতিহাসিকগণ এটাকে হুদায়বিয়ার সন্ধি বলে আখ্যায়িত করেছেন। পবিত্র কুরআনে এ সন্ধিকে “ফাতহুম মুবিন” (সুস্পষ্ট বিজয়) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ক) মক্কা বিজয়
হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশরা মুসলমানদের স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সন্ধিতে দশ বছর পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকার কথা উল্লেখ ছিল।
হুদায়বিয়ার সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুযায়ী আরবের বনু খুযা’আ গোত্র মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে এবং বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
বনু বকর গোত্র হুদাইবিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে কুরাইশদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা একরাতে মহানবি (সাঃ)-এর সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ বনু খুযা’আ গোত্রের উপর আক্রমণ করে। এতে বনু খুযা’আ গোত্রের কয়েক ব্যক্তি নিহত হয়। আহত হয় আরও অনেকে।
বনু খুযা’আ গোত্রের লোকজন ঘটনাটি মহানবি (সাঃ)-কে জানায়। তাঁর কাছে সাহায্যের আবেদন করে। মহানবি (সাঃ) চুক্তি অনুযায়ী তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। দূত মারফত কুরাইশদের কাছে তিনি এ ঘটনার কৈফিয়ত তলব করেন।
তিনি তাদের জানালেন-
- তোমরা খুযা’আ গোত্রকে ক্ষতিপূরণ দাও;
- অথবা, বনু বকর গোত্রের সাথে মিত্রতা চুক্তি বাতিল কর;
- অথবা, হুদায়বিয়ায় সম্পাদিত চুক্তি বাতিল কর।
কুরাইশরা শেষটাই গ্রহণ করল। হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল হয়ে গেল।
ফলে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্য হুদায়বিয়া চুক্তির বাধ্যবাধকতা আর রইল না। পরে কুরাইশরা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারল। তখন আপস-মীমাংসার জন্য কুরাইশরা আবু সুফিয়ানকে মদিনায় পাঠাল। এ পর্বে আবু সুফিয়ান ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। অপরদিকে মহানবি (সাঃ) মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।
হিজরি অষ্টম বছরের রমযান মাসে দশ হাজার সাহাবি নিয়ে মহানবি (সাঃ) মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। মহানবি (সাঃ) মক্কার অদূরে ‘মাররুজ জাহরান’ নামক স্থানে তাঁবু গেড়ে অবস্থান নেন। অপ্রত্যাশিতভাবে উপনীত এ বিশাল বাহিনী দেখে আবু সুফিয়ানসহ মক্কাবাসী হতবাক হয়ে যায়। তারা বাধা দেওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলে। বিনা বাধায় মহানবি (সাঃ) জন্মভূমি মক্কা জয় করেন।
স্বীয় জীবন ও ইসলাম রক্ষা করার জন্য মহানবি (সাঃ) একদিন মক্কা ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আজ বিজয়ী বীর বেশে তিনি জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন। সকলেই তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করল। তিনি আজ মক্কার একচ্ছত্র অধিপতি।
সত্যের বিজয় হলো আর মিথ্যার পরাজয় হলো। সত্যের পথে থাকলে বিজয় একদিন আসবেই।
খ) মহানবি (সাঃ)-এর উদারতা
মক্কার যে সকল লোক একদিন মহানবি (সাঃ) এর জীবন নাশ করতে চেয়েছিল আজ তারাই তাঁর সম্মুখে অপরাধী ও দয়া ভিখারি হিসেবে উপস্থিত।
মহানবি (সাঃ) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা আজ আমার কাছ থেকে কেমন ব্যবহার প্রত্যাশা করো।”
তারা বললো, “আপনি আমাদের দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র, আপনার নিকট দয়াপূর্ণ ব্যবহারই আমরা চাই।”
তখন মহানবি হযরত মুহাম্মদ বললেন, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, যাও তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন।”
দয়ালু নবি সকলকে ক্ষমা করে দিলেন। এমনকি একসময়ের ইসলামের সবচাইতে বড় শত্ৰু আবু সুফিয়ানকেও ক্ষমা করে দিলেন।
উহুদ যুদ্ধে এ আবু সুফিয়ানই কুরাইশ বাহিনীর (অমুসলিম বাহিনীর নেতা ছিল। তার নেতৃত্বেই কাফির বাহিনীর হাতে ৭০ জন মুসলমান সৈনিক শাহাদাত বরণ করেছিলেন। মহানবি (সাঃ)-এর একটি দাঁত মোবারক ঐ যুদ্ধে শহিদ হয়। এত কিছুর পরও মহানবি তাকে ক্ষমা করেছিলেন।
শুধু ক্ষমাই শেষ নয়, মহানবি (সাঃ) আরও ঘোষণা দিলেন- “স্বীয় ঘর ও কাবা শরিফের পাশাপাশি যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নিবে তারাও ক্ষমা এবং নিরাপত্তা পাবে।”
মহানবি (সাঃ) আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাকেও ক্ষমা করলেন। হিন্দা যখন মহানবি (সাঃ)-এর প্রিয় চাচা হযরত হামযা (রা.) শহিদ হওয়ার পর তাঁর নাক, কান কেটেছিল এবং বুক চিরে কলিজা বের করে চর্বণ করে চরম নিষ্ঠুরতা ও বীভৎসতার পরিচয় দিয়েছিল। তাকেসহ মক্কার সকলকে ক্ষমার এ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
গ) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কা হতে হিজরত করে আসা মুহাজির ও মদিনায় বসবাসকারী আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তৈরি করেছিলেন। ভ্রাতৃত্ব বন্ধন অটুট রাখার জন্য মহানবি মসজিদে নববিকে মিলনকেন্দ্র বানিয়ে দিলেন। এ ভ্রাতৃত্ব শুধু মুখে মুখে ছিল না বরং মুহাজিরদেরকে আনসারদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিলেন।
তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিকের ঘরে যেদিন এ ভ্রাতৃত্ববন্ধন তৈরি করেছিলেন ঐ দিন ঐ গৃহে মোট ৯০ জন সাহাবি ছিলেন। তাঁদের অর্ধেক ছিল মুহাজির আর বাকি অর্ধেক ছিল আনসার। সম্পত্তিতে মুহাজিরদের উত্তরাধিকার বিধানটি বদর যুদ্ধ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। জন্মসূত্রে আবদ্ধ না হয়ে এমন ভ্রাতৃত্ববন্ধন মানব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ঙ) বিদায় হজের ভাষণ
সূরা আন-নাস্ নাজিল হওয়ার পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বুঝতে পারলেন যে, তার জীবন প্ৰায় শেষ। তাই তিনি ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে (দশম হিজরি) ২৩শে ফেব্রুয়ারি লক্ষাধিক সাহাবিকে সাথে নিয়ে হজ করতে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। একে বিদায় হজ বলা হয়।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ৯ই জিলহজ আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত জনসমুদ্রের সামনে যে ভাষণ দেন, তাকে বিদায় হজের ভাষণ বলা হয়। উক্ত ভাষণে তিনি ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রিয় জীবন পর্যন্ত সর্বপ্রকার দায়িত্ব, লেনদেন, পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকার ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন।
নিম্নে বিদায় হজে প্রদত্ত ভাষণের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করা হলো।
আরাফাতের ময়দান সংলগ্ন ‘জাবালে রহমত’ এর উঁচু টিলায় উঠে মহানবি (সাঃ) প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করলেন, অতঃপর বললেন-
- হে মানব সকল! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। কারণ, আগামী বছর আমি তোমাদের সাথে এখানে সমবেত হতে পারব কি না জানি না।
- আজকের এ দিন, এ স্থান, এ মাস যেমন পবিত্র, তেমনই তোমাদের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র।
- মনে রাখবে অবশ্যই একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সকলকে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে।
- হে বিশ্বাসীগণ, স্ত্রীদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে। তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে তেমনই তোমাদের উপরও তাদের অধিকার রয়েছে।
- সর্বদা অন্যের আমানত রক্ষা করবে এবং পাপ কাজ হতে বিরত থাকবে ও সুদ খাবে না।
- আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না। আর অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করো না।
- মনে রেখো! দেশ, বর্ণ-গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মুসলমান সমান। আজ হতে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্ত হলো। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো আল্লাহ-ভীতি বা সৎকর্ম, সে ব্যক্তিই সবচেয়ে সেরা যে নিজের সৎকর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
- ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, পূর্বের অনেক জাতি এ কারণে ধ্বংস হয়েছে। নিজ যোগ্যতা বলে ক্রীতদাস যদি নেতা হয় তার অবাধ্য হবে না। বরং তার আনুগত্য করবে।
- দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। তোমরা যা আহার করবে ও পরিধান করবে তাদেরও তা আহার করাবে ও পরিধান করাবে। তারা যদি কোন অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলে, তবে তাদের মুক্ত করে দেবে, তবু তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে না। কেননা তারাও তোমাদের মতোই মানুষ, আল্লাহর সৃষ্টি। সকল মুসলিম একে অন্যের ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
- জাহিলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো। তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর বাণী এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ রেখে যাচ্ছি। এতে যতদিন তোমরা আঁকড়ে থাকবে ততদিন তোমরা বিপথগামী হবে না।
- আমিই শেষ নবি আমার পর কোনো নবি আসবেন না।
- তোমরা যারা উপস্থিত আছ তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেবে।
তারপর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আকাশের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী সঠিকভাবে জনগণের নিকট পৌছাতে পেরেছি? সাথে সাথে উপস্থিত জনসমুদ্র হতে আওয়াজ এলো “হ্যাঁ”। নিশ্চয়ই পেরেছেন। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো।
এর পরই আল্লাহ তায়ালা নাজিল করলেন,
“আজ আমি তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসাবে মনোনীত করলাম।”
(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩)
মহানবি (সাঃ) কিছুক্ষণ সময় নীরব থাকলেন। উপস্থিত জনতাও নীরব ছিল। অতঃপর সকলের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘আল বিদা’ (বিদায়)। একটা অজানা বিয়োগব্যথা উপস্থিত সকলের অন্তরকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।
বিদায় হজ থেকে ফিরে মহানবি (সাঃ) কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অতঃপর ১১ হিজরি সনের রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রি: ৭ই জুন সোমবার ইন্তিকাল করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর।
চ) আদর্শ মানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
জীবনের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় নিয়মনীতিকে আদর্শ বলা হয়। এ হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হলেন মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলের জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।”
(সূরা আল-আহযাব, আয়াত ২১)
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক সকল দিক দিয়েই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদের আদর্শ।
i) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ব্যক্তিগত আদৰ্শ
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, হাস্যোজ্জল ও দয়ালু ছিলেন। ধনী, দরিদ্র, ইয়াতিম, অসহায়, রাজা-প্রজা সকলের সাথে তার আচরণ ছিল অনুকরণীয়। তাঁর দয়া ও ভালোবাসা সকলের পাশাপাশি শিশুদের প্রতিও ফুটে ওঠে। তিনি শিশুদের প্রতি সদয় আচরণ করতেন। অন্যকেও তা করতে উৎসাহ দিয়েছেন।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন,
“যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”
(সুনানে তিরমিযি)
ক্রীতদাস থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, আত্মীয়-অনাত্মীয় এমনকি জীবজন্তুর প্রতিও দয়া প্রদর্শন করতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন,
“জমিনে বসবাসকারীদের প্রতি দয়া কর, তাহলে আসমানবাসীরাও তোমাদের প্রতি দয়া করবে।”
(সুনানে তিরমিযি)
এক কথায়, ক্ষমাশীলতা, উদারতা, সততা ও সত্যবাদিতা, সংযম, ন্যায়পরায়ণতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, দানশীলতা, পরোপকারিতা, দেশপ্ৰেম ও ওয়াদা পালনসহ অনুসরণীয় গুণাগুণ রাসুল (সাঃ)-এর জীবনে বিদ্যমান ছিল।
ii) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পারিবারিক আদর্শ
পরিবার সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য একজন মানুষের জীবনে যতগুলো গুণ থাকা প্রয়োজন সব গুণই মহানবি (সাঃ)-এর জীবনে ছিল। তিনি স্ত্রী-কন্যা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন সকলের জন্য আদর্শ ছিলেন।
পরিবারের যেকোনো সদস্য তাঁর কাছে সাহায্যের আবেদন করলে তিনি তাকে সাহায্য করতেন। তাদের সাথে সদা সত্য কথা বলতেন। মিথ্যাকে তিনি আজীবন ঘৃণা করতেন।
তাঁর ব্যবহারে নম্রতা প্রকাশ পেত। তিনি পরিবারের সকলের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কোনো বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতেন না।
পরিবারের কারো প্রতি রাগ করলে শুধু মুখ ফিরিয়ে নিতেন। ভালো-মন্দ কিছু বলতেন না।
তাঁর পরিবারে একাধিক স্ত্রী থাকার পরও তিনি সকলের সাথে সমান আচরণ করতেন। তাঁর আচরণের কারণে পরিবারের কোনো সদস্যের মাঝে কখনো ঝগড়া বিবাদ হয় নি।
iii) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সামাজিক আদর্শ
বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালান। তাঁর সমস্ত জীবনই ছিল সংস্কারধর্মী।
সমাজ ও জাতীয় জীবনের এমন কোনো দিক নেই যা তিনি সুন্দর ও কল্যাণমুখী করে সংস্কার করেন নি। সামাজিক অত্যাচার ও অন্ধকার অনাচারে নিমজ্জিত আরব সমাজে তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন।
জাহেলি যুগে বিভিন্ন কারণে গোত্রদ্বন্দ্ব লেগে থাকত। সামান্য কারণেই গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ বেধে যেত। তা ছাড়া আরব মরুচারী গ্রাম্য লোকেরা লুটতরাজ করত। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সমস্ত যুদ্ধের অবসান ঘটালেন এবং লুটতরাজ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন।
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নারীদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেন। ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের অনেক গোত্রে ও সমাজে নারীদের কোনো মর্যাদাই ছিল না। তারা কেবল ভোগের পাত্রী ছিল। উত্তরাধিকারী সম্পত্তি হতে তারা বঞ্চিত ছিল। মহানবি (সাঃ) নারীদের এসব দুর্গতি হতে রক্ষা করেন। তাদের ধর্মীয় সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দেন।
তিনি ঘোষণা করেন,
“মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।”
(কানযুল উম্মাল)
মহানবি (সাঃ) কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া বন্ধ করেন। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়াকে অভিশাপের পরিবর্তে সম্মানের বলে আখ্যা দেন। সুন্দরভাবে কন্যাসন্তান লালন-পালনকারীর জন্য বেহেশতের ঘোষণা দেন।
ধনী-গরিব সকলের জানাযায় অংশগ্রহণ করতেন। গোলাম-দাসী সকলের দাওয়াত গ্রহণ করতেন। তাঁর আচার-আচরণে হতাশাগ্রস্থ মানুষ দিকনির্দেশনা পেত।
এ ছাড়া তিনি সামাজিক সকল অনাচার ও বৈষম্য দূর করেন। ছোট-বড় সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সকল প্রকারের সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় যেমন-সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া ও বেহায়াপনা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেন। এভাবে তিনি সামাজিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন।
iv) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রাজনৈতিক আদর্শ
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পরিপূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসাধারণ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় আল কুরআনের সর্বজনীন গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করেন।
ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের অনেক সমাজ ও গোত্র ‘জোর যার মূল্লুক তার’ এ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। মহানবি (সাঃ) দেশ পরিচালনায় জনগণের মতামতের স্বীকৃতি দেন। যা গণতন্ত্রের মূল কথা।
তিনি ধনী, গরিব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, বর্ণ, গোত্র সকল বৈষম্যের অবসান ঘটান। রাষ্ট্রের সকলের সমঅধিকার ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি অমুসলিম নাগরিকদেরও নিরাপত্তা দেন। তাদের রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। আইনের চোখে মুসলিম-অমুসলিম, ধর্ম, বর্ণ-গোত্র সকলে সমান এ নীতির বাস্তবায়ন করেন।
তিনি রাষ্ট্রীয় ভিত্তি মজবুত করার জন্য মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মাঝে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। এ চুক্তি ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত।
v) মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অর্থনৈতিক আদর্শ
মহানবি (সাঃ) তৎকালীন আরব সমাজে প্রচলিত চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের যে প্রচলন ছিল তা নিষিদ্ধ ঘোষণাকরেন। সুদের পরিবর্তে ব্যবসাকে উৎসাহিত করেন।
আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ সুদকে হারাম (নিষিদ্ধ) আর ব্যবসাকে হালাল (বৈধ) করেছেন।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৫)
ঘুষ প্রথাও তিনি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেন।
তিনি ঘোষণা করেন, ‘ঘুষ গ্রহীতা ও ঘুষ দাতা উভয়ে জাহান্নামি।’ সমাজ থেকে তিনি প্রতারণামূলক সকল ব্যবসা বন্ধ করে দেন। সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। সম্পদে যাতে জনগণের অধিকার নিশ্চিত থাকে তার উদ্যোগ নেন।
রাজস্বের উৎস হিসেবে যাকাত, গণিমত (যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী), জিযিয়া (অমুসলিম হতে আদায়কৃত নিরাপত্তা কর), খারাজ (অমুসলিমদের ভূমিকর), উশর (মুসলিমদের উৎপন্ন ফসলের কর) ইত্যাদি গ্রহণ করেন।
[সূত্র: এনসিটিবি]