পৃথিবীতে মানুষ যাতে সত্য-সরল পথে পরিচালিত হয়ে আদর্শ সমাজ গঠন করতে পারে সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা যুগে-যুগে অগণিত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। হযরত আদম (আ) থেকে হযরত ঈসা (আ) পর্যন্ত অনেকগুলো আসমানি কিতাব নাযিল হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল-কুরআন নাযিল হয়েছে।
সকল আসমানি গ্রন্থের নির্যাস হচ্ছে আল-কুরআন। গ্রন্থটি কিয়ামত পর্যন্ত সকল দেশের সকল জাতির সকল সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম।
নিম্নে সংক্ষিপ্ত আকারে আদর্শ সমাজ গঠনে আল-কুরআনের অবদান তুলে ধরা হলো-
(১) ব্যক্তিগত জীবনে
ব্যক্তি থেকে শুরু হয় পরিবার, তারপর সমাজ। ব্যক্তি জীবন যদি সুস্থ, সুন্দর ও আদর্শবান হয় তাহলে সুস্থ-সুন্দর ও আদর্শ সমাজ গড়ে উঠে। আল-কুরআনে ব্যক্তি জীবনের সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আলোচনা রয়েছে।
মানুষের অকীদা-বিশ্বাস ও লক্ষ্য নির্ধারণের নির্ভর করে তার জীবনের সুখন্ডশান্তি, উন্নতি এবং মুক্তি। আল-কুরআন মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, শিরক, বিদ‘আত, কুফরি, মুনাফেকি, হিংসা-বিদ্বেষ, চোগলখুরি, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, মিথ্যা, অশ্লীলতা, খুনখারাবি প্রভৃতি অপকর্ম থেকে মুক্ত থেকে ব্যক্তি জীবনকে সুন্দর ও আদর্শবান করার তাগিদ দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“মানুষের নফসের ও সেই সত্তার শপথ, যিনি তা সুঠাম করেছেন। পরে তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে পবিত্র করে সেই সফলকাম হয়। আর যে নিজেকে কলুষিত করে সেই ব্যর্থ হয়”।
(সূরা শাম্স ৯১:৭-১০)
(২) পারিবারিক জীবনে
পরিবার হলো সামাজিক জীবনের ভিত্তি। ইসলাম পারিবারিক জীবন ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব প্রদান করেছে। পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাকে সুন্দর ও সুদৃঢ় করার জন্য আল-কুরআনে বহু বিধান রয়েছে।
মানব বংশ বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ তা‘আলা আলকুরআনের মাধ্যমে পবিত্র ও কলুষমুক্ত দাম্পত্য জীবন যাপনের জন্য বৈবাহিক ব্যবস্থার বিধান দিয়েছেন। অন্যায় ও হারাম পথে চলা এবং অসামাজিক কাজকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
ইসলাম বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানব-মানবির চরিত্র পবিত্র রাখার ব্যবস্থা করেছে। মানব মর্যাদা ও মানব বংশধারার পবিত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক ও বিজ্ঞান সম্মত ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তোমাদের জন্য তোমাদের স্বজাতিদের মধ্যে থেকে জুড়ি সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে পরম প্রশান্তি লাভ করতে পারে এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।”
(সূরা রূম ৩০:২১)
(৩) সামাজিক জীবনে
সৃষ্টির প্রথম থেকেই সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সামাজিক জীবন যাপন নিশ্চিত করার জন্য যাবতীয় আনচার অত্যাচার, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন, ঝগড়া-বিবাদসহ সব ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সমাজের সকল মানুষের সাথে সৎভাব বজায় রাখার জন্য আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশির অধিকার নিশ্চিত করেছে আল-কুরআন। আল-কুরআনে উপস্থাপিত সামাজিক বিধান প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজ জীবনে কোন সমস্যাই থাকবে না। শান্তির সমাজে পরিণত হবে।
(৪) রাষ্ট্রীয় জীবনে
সমাজের বৃহত্তর সংগঠন হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় জীবনের সুখন্ডশান্তি ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে সরকার ও প্রজা সাধারণের মাঝে সুমধুর সম্পর্ক, আইন শৃংখলার বিধান এবং পারস্পরিক সংহতির উপর। আল-কুরআন সরকার ও সরকার প্রধানকে জনগণের সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য শুরা ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের নির্দেশনা দান করেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“এবং কাজে-কর্মে আপনি তাদের সাথে পরামর্শ করুন”
(সূরা আলে ইমরান, ৩:১৫৯)
আল্লাহ তা‘আলা হলেন উত্তম বিধানদাতা। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন। তাই মানুষের নিজের আইন তৈরি করার অধিকার নেই। মানুষের কাজ হলো আল্লাহ তা‘আলার দেওয়া প্রত্যেকটি বিধান পালন করা। আল্লাহর বিধানের কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। সেই বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হলে মানুষ সুখ শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবে।
(৫) আন্তর্জাতিক জীবনে
বিশ্ব মানব সমাজের বৃহত্তর অঙ্গন হচ্ছে আন্তর্জাতিকতা। মানুষের আন্তর্জাতিক জীবনের সুখন্ডশান্তি বির্ভর করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, রাষ্ট্র ও জাতির পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর। কেননা পৃথিবীতে রয়েছে রকমারি, ভাষা, বর্ণ, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা সভ্যতা ও জাতীয়তা। তাই ইসলাম পরস্পরের প্রতি সহনশিলতা ও মানব প্রেমের নীতি অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। সকল জাতি ও রাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানই হচ্ছে ইসলামের মূলকথা।
সকল মানুষই আল্লাহর বান্দা ও আদম সন্তান। অতএব বিশ্বের সকল মানুষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে সকল মানুষের মঙ্গল কামনা করাই ইসলামের নীতি। বিনা অপরাধে দুনিয়ার যে কোন মানুষকে শাস্তি বা কষ্ট দেওয়া মহাপাপ। আর সে যে কোন ধর্ম, বর্ণ গোত্র, ভাষা ও জাতির হোক না কেন।
ইসলামি অন্তর্জাতিকতাবাদের মূলীতি হলো- সন্ধি ও সহাবস্থান, আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয়দান, অন্য জাতির সাথে বন্ধুসূলভ আচরণ, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মজলুম মুসলমানকে সাহায্য করা।
(৬) রাজনৈতিক জীবনে
মানুষ আজ ইসলামের ছায়াতল থেকে দূরে সরে যাওয়ায় নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। মানুষ এ সকল সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নানাবিধ আইন প্রণয়ন করছে। কুরআন-হাদিসের শিক্ষা ও মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে অসৎ লোকেরা দেশ শাসন করছে। ফলে সমস্যা আরো জটিল হতে জটিলতর হচ্ছে। কারণ মানুষের সসীম জ্ঞান দিয়ে কখনো সকলের স্বার্থ রক্ষা হতে পারে না। তাই রাজনৈতিক জীবনে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কুরআনের বিধানই হতে হবে সকল কর্মকান্ডের মূল উৎস। যদি তা না করা হয় তবে রাজনৈতিক জীবন কলুষিত, সীমাহীন দুর্নীতি ও শোষণ-বঞ্চনার শিকার হবে।
(৭) ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনে
মানুষ কেবল দেহ সর্বস্ব জীব নয়। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবন মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক। আধ্যাত্মিক জীবনের সমস্যাবলির সঠিক ও নির্ভুল সমাধান রয়েছে আল-কুরআনে।
আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে,
“হে মানবজাতি! তোমাদের নিকট তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে উপদেশ ও তোমাদের অন্তরে যা আছে তার আরোগ্য এবং মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত এসেছে।”
(সূরা ইউনুস-১০: ৫৭)
(৮) অর্থনৈতিক জীবনে
আল-কুরআনে অর্থনৈতিক বহু বিষয়ের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সমাধান রয়েছে। আল-কুরআন অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার যে নীতিমালা পেশ করেছে তা অনুসরণ করলে সমাজের মধ্যে ধনী-গরীবের ব্যবধান কমে আসবে।
ইসলাম সুদ প্রথার বিলোপ সাধন করে যাকাত ব্যবস্থা চালু করেছে। অবৈধ উপার্জনকে ইসলাম চিরতরে নিষিদ্ধ করেছে। গরীব-মিসকীন, অনাথ ও অসহায়দের জন্য বিভিন্ন প্রকারের দান ও সাদাকার বিধান দিয়েছে।
ইসলাম চায় না যে, মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে থাকুক। ইসলাম সম্পদ বন্টনের ব্যাপারে যে চিরস্থায়ী ও উদারনীতি ঘোষণা করেছে তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ এই পৃথিবীতে শান্তিময় সমাজ গড়ে তুলতে পারবে।
আল-কুরআন মানুষের সকল সমস্যার মোকাবেলা করে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীকে আলোর পথে এনেছে। কেননা, আলকুরআনে রয়েছে সকল সমস্যার মৌলিক সমাধান। আল-কুরআন ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ও বিভাগে বিভিন্ন সমস্যার সঠিক, যথার্থ ও যুগোপযুগী সমাধান দিয়েছে। এ পবিত্র গ্রন্থে জীবন সমস্যা সমাধানের যে মৌলনীতিমালা বিবৃত হয়েছে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স) তাঁর জীবনে তা অনুসরণ, অনুশীলন ও বাস্তবায়ন করে বিশ্বমানবতার সম্মুখে একটি আদর্শ উপস্থাপন করে গেছেন, যা অনুসরণ করলে যে কোন সমাজ আদর্শ সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]