আল-কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব। কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষের সার্বিক জীবনবিধান ও দিকনির্দেশনা এতে বিদ্যমান। সুতরাং এর সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ স্বয়ং এর সংরক্ষণের ভার গ্রহণ করেছেন।
তিনি ঘোষণা করেন,
“আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্য আমিই এর সংরক্ষক।”
(সূরা আল-হিজর, আয়াত ৯)
আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং আল-কুরআনের সংরক্ষক। তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ কিতাব সংরক্ষণ করেন। এজন্যই আজ পর্যন্ত এ কিতাবের একটি হরফ (অক্ষর), হরকত বা নুকতারও পরিবর্তন হয়নি। এটি যেভাবে নাজিল হয়েছিল আজও ঠিক সেভাবেই বিদ্যমান। আর কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে।
(১) আল-কুরআন সংরক্ষণ
আল-কুরআন আরব দেশে মহানবি (সাঃ)-এর উপর নাজিল হয়। এ সময় মহানবি (সাঃ) সাথে সাথে নাজিলকৃত আয়াত মুখস্থ করে নিতেন। এরপর বারবার তিলাওয়াতের মাধ্যমে তা স্মৃতিতে ধরে রাখতে চেষ্টা করতেন। আল-কুরআন মুখস্থকরণে রাসুল (সাঃ)-এর দ্রুতপাঠ ও ব্যাকুলতা দেখে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সান্ত্বনা দেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“তাড়াতাড়ি ওহি আয়ত্ত করার জন্য আপনি দ্রুত আপনার জিহ্বা তাঁর সাথে সঞ্চালন করবেন না। এটা সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই।”
(সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত ১৬-১৭)
এরপর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যাকুলতা দূরীভূত হয় এবং তিনি সহজেই কুরআনের আয়াতগুলো মুখস্থ করে সংরক্ষণ করতে লাগলেন।
আল-কুরআন নাজিল হলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবিগণকেও তা মুখস্থ করতে বলতেন। সাহাবিগণ তা মুখস্থ করতেন, দিনরাত তিলাওয়াত করতেন, নামাযে পাঠ করতেন এবং পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তান ও বন্ধু-বান্ধবদেরও মুখস্থ করাতেন। গভীর রাতে তাঁদের ঘর থেকে কুরআন তিলাওয়াতের গুনগুন আওয়াজ শোনা যেত। অনেক সময় রাসুলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং তাঁদের গৃহপার্শ্বে গিয়ে তিলাওয়াত শুনতেন।
কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবি করিম (সাঃ) সাহাবিগণকে নানা স্থানে প্রেরণ করতেন। যেমন হিজরতের পূর্বে তিনি হযরত মুসআব ইবনে উমায়র (রা.) ও আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-কে কুরআন শিক্ষাদানের জন্য মদিনায় প্রেরণ করেন। এভাবে মুখস্থ করার মাধ্যমে আল-কুরআন সর্বপ্রথম সংরক্ষণ করা হয়।
উল্লেখ্য, তৎকালীন আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই তীক্ষ্ণ। তারা কোনো জিনিস শিখলে তা আর কখনো ভুলত না। ফলে এ অসাধারণ স্মরণশক্তির কারণে পবিত্র কুরআন সহজেই তাদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়।
এছাড়া সেসময় লিখিতভাবেও আল-কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আরবদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক লোকই ছিল শিক্ষিত। তা ছাড়া সেসময় লেখার উপকরণও ছিল দুষ্প্রাপ্য। এজন্য সেসময় আল-কুরআন একত্রে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়নি। তবে আল-কুরআনের কোনো অংশ বা আয়াত নাজিল হলে সাথে সাথেই লিখে রাখা হতো। খেজুর গাছের ডাল, পশুর চামড়া ও হাড়, পাথর, গাছের পাতা ইত্যাদি ছিল তখনকার লেখনীর উপকরণ। সাহাবিগণ এগুলোতেই আল-কুরআনের আয়াত লিখে তা সংরক্ষণ করতেন।
যেসব সাহাবি লেখাপড়া জানতেন তাঁরা প্রায় সকলেই কুরআন লিখার মর্যাদা লাভ করেছিলেন। আল-কুরআন লিপিবদ্ধকারী সাহাবিগণকে বলা হয় কাতিবে ওহি বা ওহি লেখক। তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় মোট ৪২ জন। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.)। এছাড়াও হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হযরত উমর ফারুক (রা.), হযরত উসমান (রা.), হযরত আলি (রা.), হযরত মুআবিয়া (রা.), হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.), হযরত মুগিরা ইবনে শু’বা (রা.), হযরত আমর ইবনে আস (রা.), হযরত যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আরকাম (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। এঁদের কেউ না কেউ সদা সর্বদা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে থাকতেন এবং কুরআনের কোনো অংশ বা আয়াত নাজিল হলে সাথে সাথে তা লিখে নিতেন। এভাবে লেখনীর মাধ্যমেও আল-কুরআনকে সংরক্ষণ করা হয়।
(২) আল-কুরআন সংকলন
মহানবি (সাঃ)-এর সময়ে আল-কুরআন মুখস্থ ও লেখনীর মাধ্যমে পুরোপুরি সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু সে সময় তা একত্রে গ্রন্থাবদ্ধ করা হয়নি। বরং তাঁর তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধ টুকরোগুলো নানাজনের নিকট সংরক্ষিত ছিল। হযরত আবু বকর (রা.)-ই সর্বপ্রথম কুরআন সংকলনের উদ্যোগ নেন।
হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা। তাঁর সময়ে নবুয়তের কতিপয় মিথ্যা দাবিদার বা ভণ্ড নবি ও যাকাত অস্বীকারকারীর আবির্ভাব ঘটে। তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এরূপই একটি যুদ্ধ ছিল ইয়ামামার যুদ্ধ। এটি মুসায়লিমা কাযযাব নামক ভণ্ড নবির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এ যুদ্ধে বহুসংখ্যক কুরআনের হাফিয সাহাবি শাহাদাত বরণ করেন। এতে হযরত উমর (রা.) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি ভাবলেন যে, এভাবে হাফিয সাহাবিগণ শাহাদাত বরণ করতে থাকলে একসময় কুরআন মুখস্থকারী লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে কুরআন বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দেবে। সুতরাং তিনি হযরত আবু বকর (রা.)-কে কুরআন সংকলন করে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার পরামর্শ দান করেন। পরামর্শ শ্রবণে হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, হে উমর! রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে কাজ করে যাননি তা আপনি কীভাবে করতে চাচ্ছেন? হযরত উমর (রা.) বললেন, আল্লাহর শপথ! এতে কল্যাণ রয়েছে। এভাবে হযরত উমর (রা.)- বারবার অনুরোধ করায় হযরত আবু বকর (রা.) কুরআন সংকলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি প্রধান ওহি লেখক সাহাবি হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.)-কে এ গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন।
হযরত যায়দ (রা.) কুরআন সংকলনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নিম্নোক্ত চারটি পন্থা অবলম্বন করেন:
- হাফিয সাহাবিদের তিলাওয়াতের মাধ্যমে প্রতিটি আয়াতের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতা যাচাইকরণ।
- হযরত উমর (রা.)-এর হিফযের সাথে মিলিয়ে আয়াতের বিশুদ্ধতা যাচাইকরণ।
- রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপস্থিতিতে লিখিত হওয়ার ব্যাপারে ন্যূনতম দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ।
- চূড়ান্তভাবে লিখিত আয়াতগুলো অন্যান্য সাহাবির সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির সাথে তুলনা ও যাচাইকরণ।
এভাবে চরম সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) পবিত্র কুরআন সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে সংকলন করেন। এটাই ছিল সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ আল-কুরআন। কুরআনের এ কপিটি হযরত আবু বকর (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল। তাঁর ইন্তিকালের পর এটি হযরত উমর (রা.)-এর তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত ছিল। হযরত উমর (রা.)-এর শাহাদাতের পর পবিত্র কুরআনের এ পাণ্ডুলিপিটি তাঁর কন্যা, উম্মুল মুমিনিন হযরত হাফসা (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল।
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর খেলাফতকালে কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে নানা মতানৈক্য দেখা দেয়। এর মূল কারণ ছিল বিভিন্ন গোত্রীয় রীতিতে কুরআন পাঠ। মহানবি (সাঃ) সহজ করণার্থে আরবদের ৭টি রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। আরবগণ এ ৭টি রীতিতে পাঠের বিষয়টি জানতেন বলে প্রথমদিকে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ইসলামি খেলাফতের ব্যাপক বিস্তারের ফলে অনারবগণ মুসলমান হতে লাগল। তারা আরবি ভাষার এসব আঞ্চলিক রীতিসমূহ সম্পর্কে সচেতন ছিল না। ফলে ভিন্ন ভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এমনই এক ঘটনা ঘটে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান অঞ্চলে জিহাদের সময়। এ সময় ভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠে মুসলমানদের মধ্যে ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটে। হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা.) ঘটনাটি খলিফা হযরত উসমান (রা.)-কে অবহিত করেন। এমতাবস্থায় হযরত উসমান (রা.) প্রধান সাহাবিগণের পরামর্শক্রমে কুরআন সংকলনের জন্য চারজন সাহাবির একটি বোর্ড গঠন করেন। এঁরা ছিলেন হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.),সাঈদ ইবনে আস (রা.) এবং আব্দুর রহমান ইবনে হারিস (রা.)। এ বোর্ডের নেতৃত্ব হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) এর উপর ন্যস্ত করা হয় ৷
হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) সর্বপ্রথম হযরত হাফসা (রা.)-এর নিকট থেকে কুরআনের প্রথম পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে আসেন এবং এ থেকে আরও সাতটি কপি তৈরি করেন। অনুলিপি তৈরিতে সাহাবিগণ হাফিযগণের কেরাতের সাথে মিলিয়ে পুনরায় এর নির্ভুলতা যাচাই করতেন। অতঃপর মূল কপিটি হযরত হাফসার (রা.) নিকট ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং তৈরি অনুলিপিগুলোর একটি খলিফার নিকট কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা হয় আর বাকিগুলো বিভিন্ন শাসনকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে আল-কুরআন বিকৃতি ও গরমিলের হাত থেকে রক্ষা পায়। এরপর বিক্ষিপ্তভাবে রক্ষিত কপিগুলো একত্র করে তা পুড়িয়ে বিনষ্ট করে ফেলা হয়। এভাবে হযরত উসমান (রা.)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আল-কুরআন সংকলিত হয়। এ মহান কাজের জন্য তাঁকে ‘জামিউল কুরআন’ বা কুরআন একত্রকারী (সংকলক) বলা হয়।
কুরআনের এ সংকলনসমূহে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশনার কোনোরূপ পরিবর্তন করা হয়নি। বরং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যেভাবে কোন আয়াতের পর কোন আয়াত হবে বলে গেছেন সেভাবেই সংকলন করা হয়। এভাবে সূরাসমূহেও রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বর্ণিত ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সাজানো হয়। বস্তুত আল্লাহ তায়ালাই রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে এরূপ ধারাবাহিকতা শিক্ষা দিয়েছিলেন। জিবরাইল (আঃ) যখনই কোনো আয়াত নিয়ে আসতেন তখনই ঐ আয়াত কোন সূরার কোথায় স্থাপন করতে হবে তা বলে দিতেন। সে অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবিগণের দ্বারা লিখিয়ে নিতেন। পবিত্র কুরআনের পাণ্ডুলিপি তৈরিতে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। ফলে লাওহে মাহফুজে যেভাবে কুরআন বিন্যস্ত রয়েছে বর্তমান কুরআন মজিদও ঠিক সে বিন্যাসেই বিদ্যমান রয়েছে।
হযরত উসমান (রা.)-এর সময়ে তৈরিকৃত কুরআনের পাণ্ডুলিপিতে হরকত বা স্বরচিহ্ন ছিল না। ফলে অনারব মুসলমানগণ কুরআন তিলাওয়াতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হন। ইরাকের উমাইয়া বংশীয় শাসনকর্তা হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ পবিত্র কুরআনে হরকত সংযোজন করে এ অসুবিধা দূর করেন। বস্তুত এটা কুরআনে কোনো নতুন সংযোজন নয়। বরং আগে হরকতসহ পড়া হলেও তা লিখা হতো না। কেননা আরবগণ এমনিই তা বুঝতে পারতেন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ উচ্চারিত এসব হরকতসমূহ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করে দেখিয়ে দেন মাত্র। ফলে অনারবগণের জন্যও কুরআন তিলাওয়াতের বাধা অপসারিত হয়।
উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে পবিত্র কুরআন আরও নবতর ও সহজ উপায়ে সংকলন করা হয়। মুদ্ৰণ যন্ত্ৰ আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত হাতের লিখার মাধ্যমেই আল-কুরআন সংকলন করা হতো। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পরবর্তীতে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আল-কুরআনের লক্ষ লক্ষ কপি মুদ্রণ করা হতে থাকে। এমনকি বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ভাষায় এর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-গ্রন্থও প্রকাশিত হয়।
[সূত্র: এনসিটিবি]