নিম্নে ইমাম বুখারী (র) সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হলো-
ইমাম বুখারী (র) জন্ম ও শৈশব
ইমাম বুখারীর পুরো নাম হলো- আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল-বুখারী। পরবর্তীতে তিনি জন্মস্থানের নামেই পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপিঠ বর্তমান রাশিয়ার উজবেকিস্তানের অন্তর্গত ইসলামি সভ্যতার লীলাভূমি বুখারায় ১৩ শাওয়াল ১৯৪ হিজরি সনে (৮১০ খ্রি.) জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশবে ইমাম বুখারী (র) পিতাকে হারিয়ে মাতার স্নেহে লালিত-পালিত হন। অতি অল্প বয়সেই ইমাম বুখারীর দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। এতে তাঁর মাতা দারুণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এক রাতে তাঁর মাতা স্বপ্নে দেখতে পেলেন হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁকে এসে বলছেন, ‘মুহাম্মাদের মাতা! একটি সুসংবাদ জেনে নাও, তুমি আল্লাহর দরবারে অতি মাত্রায় কান্নাকাটি করার কারণে আল্লাহ তোমার ছেলের চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে দিয়েছেন।’ সকালে উঠে তিনি সত্যি সত্যি দেখতে পেলেন বুখারী চোখের আলো ফিরে পেয়েছেন।
শিক্ষা
ইমাম বুখারী (র) অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তাঁর মেধা ও স্মরণশক্তি সম্বন্ধে বলা হয়, তিনি মাত্র একবার পড়লে যে কোন কিতাব মুখস্থ হয়ে যেত। শৈশবেই তিনি হাদিসশাস্ত্র অধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করেন।
তাঁর সম্পর্কে তিনি স্বয়ং বলেন, ‘মক্তবে পড়ার সময়ই আমার মনে হাদিস মুখস্থ করার বাসনা জাগে।’
ইমাম বুখারী ছোটবেলা থেকেই হাদিস মুখস্থ করতে থাকেন। ১৬ বছর বয়সেই তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক ও হাকীম তকীর হাদিসগ্রন্থ সম্পূর্ণ মুখস্থ করে ফেলেন। হিজরি ২১০ সনে ইমাম বুখারী (র) বুখারায় অবস্থানকালে খ্যাতিমান মুহাদ্দিসগণের নিকট থেকে হাদিস সংগ্রহ করে মা ও ভাইকে নিয়ে হাজ্জে গমন করেন। তিনি হাদিস শিক্ষার করার লক্ষে ৬ বছর মক্কায় অবস্থান করেন।
ইমাম বুখারী (র)-এর শিক্ষকমন্ডলী
ইমাম বুখারী (র) বাগদাদে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের নিকট হাদিস শিক্ষা করেন। তা ছাড়া আহমাদ ইবনে আলআরজাকী, আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াযীদ, ইবরাহীম ইবনে মানযার, হাম্মাদ, আবু সাবেত প্রমুখের নিকট হাদিস শিক্ষা করেন।
ছাত্রবৃন্দ
ইমাম বুখারীর ছাত্রদের মধ্যে ইমাম মুসলিম নিশাপুরী, আবু আবদুর রহমান আননাসায়ি, আবু ঈসা মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা তিরমিযি, মুহাম্মাদ ইবনে নাছর যারওয়ারী (র) অন্যতম।
কর্মজীবন
ইমাম বুখারীর কর্মজীবন অতিবাহিত হয় হাদিস সংগ্রহ, মুখস্থকরণ এবং সংকলন ও শিক্ষা দানে বুঝানো হয়।
তাঁর কর্মজীবন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি যখন ১৮ বছর বয়স অতিক্রম করি তখন সাহাবি ও তাবেঈদের বিচারফায়সালা সম্পর্কে একটি গ্রন্থ এবং এরপর মদীনায় রাসূল (স)-এর রওযা মোবারকের নিকট বসে আত-তারীখ রচনা করি।’
ইমাম বুখারী (র) ইসলামি বিশ্বের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতেন।
আল্লামা যাহবী (র) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তিনি হাদিস সংগ্রহে বাগদাদ, বলখ, মক্কা, বসরা, কুফা, আসকালান, হিমস এবং দামেস্কে গমন করেন। ইলমে হাদিসের জন্যে তিনি তদানীন্তন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন।’
ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা
ইমাম বুখারী অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি তাঁর সমুদয় অর্থসম্পদ শিক্ষার্থী ও দরিদ্রদের মাঝে ব্যয় করেন।
ইমাম তিরমিযি (র) বলেন, ‘ইমাম বুখারী (র) ছিলেন উম্মতের ভূষণ আর ইমাম মুসলিম (র) ছিলেন- তাঁর পদচুম্বনে অভিলাষী।’
চরিত্র
ইমাম বুখারী (র) ছিলেন অতিশয় ভদ্র প্রকৃতির লোক। আত্মসম্মানবোধে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। রাজা- বাদশাহগণের তোষামোদে তিনি বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হননি। একবার বুখারার শাসক খালেদ ইবনে যাহলী তাঁর ঘরে গিয়ে তাকে হাদিস শিক্ষাদানে অনুরোধ জানান। কিন্তু ইমাম বুখারী (র) তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করায় তাঁকে বোখারা ছাড়তে বাধ্য করেন। ইমাম বুখারী তা মাথা পেতে মেনে নেন।
মেধা প্রখরতা
ইমাম বুখারীর (র) প্রখর মেধার অধিকারি ছিলেন- একবার সমরকন্দে চারশত মুহাদ্দিস বুখারীর হাদিস জ্ঞান পরীক্ষা করার জন্য হাদিসের ‘সনদ’ ও ‘মতন’ উল্টা-পাল্টা করে উপস্থাপন করলে ইমাম বুখারী (র) সবগুলো সঠিক ভাবে উপস্থাপন করেন। এতে মুহাদ্দিসগণ বিস্মিত হন। ইমাম মুসলিম তাঁকে “হাদিস রোগের চিকিৎসক” বলে আখ্যায়িত করেন।
হাদিস সংকলনে তাঁর অবদান
হাদিস সংকলনে ইমাম বুখারীর অবদান আকাশ ছোঁয়া।
এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি সিরিয়া, মিসর ও জর্জিয়ায় দু’বার করে উপস্থিত হয়েছি। বসরায় চারবার, কুফা ও বাগদাদে অসংখ্যবার গিয়েছি এবং হেজাজে ছয় বছর অবস্থান করেছি।’
সহীহ বুখারী সংকলনের অনুপ্রেরণা
সহীহ বুখারী সংকলনের ব্যাপারে ইমাম বুখারী (র) দু’টি মন্তব্য করেন-
ক) একবার তাঁর ওস্তাদ ইসহাক ইবন রাহওয়াই (র)-এর মজলিসে এক ব্যক্তি বলল, ‘কেউ যদি রাসূল (স)-এর হাদিস গ্রন্থ প্রণয়ন করত, যা হবে বিশুদ্ধ তাহলে সকলের উপকার হতো।’ একথা শুনে তিনি সহীহ বুখারী সংকলনে আত্ম নিয়োগ করেন।
খ) তিনি এক রাতে এমন একটি স্বপ্ন দেখলেন যার ব্যাখ্যায় বলা হয়, ‘তুমি রাসূল (স)-এর সকল সত্য রক্ষা করবে।’ আর সেই সত্য হলো রাসূল (স)-এর সকল হাদিস শুদ্ধভাবে সংকলন করা।
ইন্তেকাল
তিনি ২৫৬ হিজরি মোতাবেক ৮৭০ খ্রি. সমরকন্দের খরতংগ শহরে ৬২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
সারসংক্ষেপ
ইমাম বুখারি (র) হাদিস জগতে মহান দিকপাল। তাঁর বিস্ময়কর প্রয়াস ও সাধনায় হাদিস শাস্ত্র বিশুদ্ধ ও সহীহভাবে আমরা পেয়েছি। বিশ্ববাসী বিশুদ্ধ হাদিসের ওপর আমল করতে পারছেন।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]