Skip to content

 

ইসলামের অর্থব্যবস্থা

ইসলামের অর্থব্যবস্থা

আলোচ্য বিষয়:

অর্থব্যবস্থা মানব জীবনের অপরিহার্য বিষয়। ইসলামি অর্থনিতি ইসলামি জীবন দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

মানব জীবনের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে যে শাস্ত্র আলোচনা করে তাই অর্থব্যবস্থা। আল-কুরআন ও সুন্নাহতে মানব জীবনের অর্থনৈতিক সকল সমস্যার সমাধান দেয়া হয়েছে।

আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রচিত অর্থব্যবস্থাই ইসলামি অর্থব্যবস্থা। এটি একটি কল্যাণমুখী ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা যেখানে সকল শ্রেণি, পেশা ও মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

এখানে ইসলামি অর্থব্যবস্থার পরিচয়, বৈশিষ্ট্য, যাকাত, উশর খারাজ, সাদকা এবং ইসলামি ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমরা জানবো।

(১) ইসলামি অর্থব্যবস্থা

ক) পরিচয়

অর্থনীতি হচ্ছে ধন বিজ্ঞান। দ্রব্যের উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগ সংক্রান্ত বিজ্ঞান। ইংরেজি প্রতিশব্দ (Economics)।

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ-এর মতে, অর্থনীতি হলো, জাতিসমূহের সম্পদের কারণ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অনুসন্ধানে নিয়োজিত শাস্ত্র।

আলফ্রেড মার্শাল-এর মতে, অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যার মধ্যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যকলাপ আলোচিত হয়।

অর্থনীতিকে সাধারণত উৎপাদন বণ্টন এবং দ্রব্য ও সেবার মানবীয় ভোগ আচরণের তত্ত্ব হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করা হয়।

ইসলামি অর্থনীতি ইসলামি জীবনব্যবস্থার এক অপরিহার্য অংশ। ইসলামি অর্থনীতি ইসলামি আদর্শ, জীবন দর্শন ও সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নীতি-পদ্ধতি অনুসরণে সৃষ্টির লালন-পালনের যাবতীয় জাগতিক সম্পদের সামগ্রিক কল্যাণধর্মী ব্যবস্থাপনাই ইসলামি অর্থনীতি।

ইসলামি অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে।

প্রফেসর এম এ হামিদ ইসলামি অর্থনীতির সংজ্ঞায় বলেন-

ইসলামি অর্থনীতি হলো, ইসলামি বিধানের সেই অংশ যা প্রক্রিয়া হিসেবে দ্রব্য ও সেবাসামগ্রি উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের প্রসঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক আচরণকে সমন্বিতভাবে অধ্যয়ন করে।

অতএব, উক্ত সংজ্ঞার আলোকে আমরা বলতে পারি-

  • ইসলামি অর্থনীতির উৎস আল-কুরআন ও সুন্নাহ।
  • ইসলামি অর্থনীতি জাগতিক সম্পদ উৎপাদন, বণ্টন ও ব্যবস্থাপনার একটি প্রক্রিয়া।
  • মানব সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক বিষয়গুলো ইসলামি অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়।

ইসলামি অর্থনীতি মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন উভয় প্রকার কল্যাণের কথা বলে।

খ) ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীতে ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, মধ্যবর্তী ও কল্যাণময় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছে। যার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

নিম্নে ইসলামি অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো-

i) কুরআন, সুন্নাহ ভিত্তিক

ইসলামি অর্থব্যবস্থা কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। কুরআন, সুন্নাহ ইজমা ও কিয়াসের উপর ভিত্তি করে এ অর্থব্যবস্থা পরিচালিত হয়। ইসলামি শরিয়াহ-এর পরিপন্থি কোন নীতিমালা এ অর্থব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়।

ii) সম্পদের মালিকানা সামগ্রিকভাবে আল্লাহর

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিকানা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। মানুষ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সম্পদের আয়-উপার্জন ও ভোগ-ব্যবহারে অধিকারী মাত্র।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আসমান যমীনে যা কিছু আছে, তা সবই আল্লাহ তায়ালার জন্যে।”

(সূরা আল-বাকারা ২:২৮৪)

iii) ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃতি

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানা স্বীকৃত। আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়াহর বিধি-নিষেধ অনুসরণ করে যে সম্পদের উপার্জন করবে তার মালিক হবে ব্যক্তি নিজেই। এতে কারও অধিকার থাকবে না।

iv) সুদ হারাম

ইসলামি অর্থ ব্যবস্থায় সকল প্রকার সুদ এবং সকল প্রকার সুদী লেনদেনকে হারাম করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন।”

(সূরা আল-বাকারা ২:২৭৫)

হাদিসে এসেছে,

“হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘সুদ গ্রহণকারী, সুদ প্রদানকারী, এর হিসাব রক্ষক এবং এর সাক্ষীদের সবাইকে অভিসম্পাত করেছেন।’ তিনি বলেছেন, এরা সবাই সমান অপরাধী।”

(সহিহ মুসলিম)

v) আয়-উপার্জনে বৈধ পন্থা অবলম্বণ

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় আয়-উপার্জনের সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি রয়েছে। অবৈধ ও অন্যায়ভাবে আয়-উপার্জনকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। একমাত্র বৈধ ও ন্যায়সম্মত পথেই অর্থোপার্জনের নির্দেশ রয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করোনা।”

(সূরা আল-বাকারা ২:১৮৮)

vi) অপব্যয় ও অপচয় নিষিদ্ধ

ইসলাম সকল প্রকার অপব্যয় ও অপচয়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“আহার করবে ও পান করবে কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।”

(সূরা আ‘রাফ ৭:৩১)

তিনি আরও বলেন,

“কিছুতেই অপব্যয় করোনা। যারা অব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই।”

(সূরা বনি ইসরাঈল ১৭:২৬,২৭)

vii) যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা

ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- এটি যাকাতভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা। একজন ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাকে যাকাত দিতে হবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও।”

(সূরা বাকারা ২:৪৩)

viii) গুদামজাত ও সঞ্চয়ের নিষেধাজ্ঞা

মূল্য বৃদ্ধি বা অধিক মুনাফা লাভের আশায় পণ্য গুদাম জাত করাকে নিষিদ্ধ করেছে। যাকাত আদায় না করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলোকে ইসলাম কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জিভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।”

(সূরা তাওবা ৯:৩৪)

রাসূল (স) ইরশাদ করেন,

“পাপাত্মা ছাড়া কেউ গুদামজাত করে না।”

(সহীহ মুসলিম)

ix) জুয়া, লটারি ও হারাম ব্যবসায় নিষিদ্ধ

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সকল প্রকার হারাম ব্যবসায়, লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, জুয়া, লটারি, জবরদখল, ঘুষ, দুর্নীতি আত্মসাত প্রভৃতির মাধ্যম উপার্জনকে হারাম করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“হে মু’মিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্যবস্তু; শয়তানের কার্য। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর- যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।”

(সূরা মায়িদা ৫:৯০)

x) উত্তরাধিকার বণ্টন ব্যবস্থা

ইসলামি অর্থ ব্যবস্থায় সুষ্ঠু উত্তরাধিকার বণ্টনের ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ ব্যয়-বণ্টনের কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয়।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীর ও অংশ আছে, তা অল্পই হউক অথবা বেশিই হউক, এক নির্ধারিত অংশ।”

(সূরা নিসা ৪:৭)

গ) ইসলামি অর্থব্যবস্থার গুরুত্ব

ইসলামি জীবন দর্শনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ইসলামের অর্থব্যবস্থা। ইসলামি অর্থব্যবস্থার একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থা। মানুষের অর্থনৈতিক সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান ও দিক নির্দেশনা রয়েছে ইসলামি অর্থব্যবস্থায়। মানবতার সার্বিক কল্যাণে ইসলামি অর্থব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।

i) কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থা

ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এখানে মানবকল্যাণকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে।

মানব কল্যাণের লক্ষ্যে ইসলামি অর্থব্যবস্থার যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মানুষের জন্য ক্ষতিকর ও অকল্যাণকর কোন কিছুই ইসলামি অর্থব্যবস্থা অনুমোদন করে না। যেমন- মদ, জুয়া, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, জবরদখল ইত্যাদি।

অতএব, ইসলামি অর্থব্যবস্থা একটি ভারসাম্যপূণ যুগোপযোগী অর্থব্যবস্থা। এর মাধ্যমে মানুষ সুখে, স্বাচ্ছন্দ্যে জীযন যাপন করতে পারে।

ii) সুষম বণ্টন ব্যবস্থা

ইসলামি অর্থব্যস্থায় সম্পদ যাতে কোন একজন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণির কাছে পুঞ্জিভূত না হয় সে জন্য ইসলাম সুষম বণ্টন নীতি প্রণয়ন করেছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী কেবল তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে।”

(সূরা হাশর ৫৯:৭)

iii) দারিদ্র বিমোচনে

ইসলামি অর্থব্যবস্থা যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। বিত্তশালীদের সম্পদে অসহায় ও দরিদ্রের অধিকার রয়েছে।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তোমাদের ধন সম্পদে প্রশ্নকারী ও বি তদের নির্ধারিত অধিকার রয়েছে।”

(সূরা মা‘আরিজ ৭০:২৪-২৫)

তাছাড়া ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সকল নাগারিকের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে দরিদ্রতা হ্রাস পায়। .

iv) অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা

অন্যায়ভাবে কোন ব্যক্তিকে তার অধিকার থেকে বি ত করা যাবে না। যেমন উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে ওয়ারিশগণের নিকট তাদের প্রাপ্য সঠিকভাবে প্রদান করতে হবে। শ্রম ও শ্রমিকের পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এভাবে সমাজের সকল ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

v) কর্মসংস্থানের সৃষ্টি

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় যাকাত ও অন্যান্য দান সাদকার অর্থসংগ্রহ করে সমাজে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানাও কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়। এতে বেকারের হাত কর্মীর হাতে ও ভিক্ষুকের হাত দাতার হাতে পরিণত হয়। ফলে সমাজে আর্থিক নিরাপত্তা ও স্বচ্ছলতা তৈরি হয়। শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকে।

vi) অপরাধ প্রবণতা হ্রাস

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। বেকারত্ব হ্রাস পায়। ফলে সমাজ থেকে চুরি, ডাকাতি, মাদকাসক্তি ছিনতাই, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ যাবতীয় অসামাজিক কর্মকা- হ্রাস পায়। এতে অপরাধ প্রবণতা কমে আসে।

vii) মৌলিক চাহিদা পূরণ

ইসলামি অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়নের ফলে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। অবহেলিত, উপেক্ষিত, পিছিয়ে পড়া জনসমষ্টিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা হয়। ফলে জনসাধারণ মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়।

viii) সামাজিক সম্প্রীতি ও সাম্য

ইসলামি অর্থ দর্শনের মূল লক্ষ্য হলো, সামাজিক সম্প্রীতি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা। সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করার পূর্বশর্ত হলো সামাজিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি।

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সমাজে প্রত্যেক মানুষ অপরের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজন মনে করে। সর্বদা অন্যের অভাব ও প্রয়োজন মোচনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসে। ফলে সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য সৃষ্টি হয় এবং নিরাপত্তাও শান্তি বিরাজ করে।

এছাড়া দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ, হারাম বস্তুর ব্যবসা হ্রাস, সুদ ঘুষ বন্ধ, অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি, সম্পদ গড়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ, ও ঋণখেলাপী হ্রাসে ইসলামি অর্থব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।

ঘ) সারসংক্ষেপ

  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে। এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ, মধ্যবর্তী ও কল্যাণকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
  • এ ব্যবস্থায় সকল প্রকার সুদি লেনদেন ও হারামবস্তুর ব্যবসায় নিষিদ্ধ। বেকারত্ব, দারিদ্রদূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলামি অর্থব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।

(২) ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সম্পদ উৎপাদন, ভোগ ও বিনিময় নীতি

ক) ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সম্পদ উৎপাদনের মূলনীতি

ইসলাম কর্মকে উৎসাহিত এবং বৈরাগ্যবাদকে অনুৎসাহিত করে। ইসলামে আয়-উপার্জন ও উৎপাদনকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“সালাত আদায় হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে।”

(সূরা জুমু’আ ৬২:১০)

মহানবি (সাঃ) ফজর সালাত আদায়ের পর জীবিকার সন্ধান না করে ঘুমাতে নিষেধ করেছেন। ইসলাম যেন জীবিকা উপার্জনে উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি সম্পদ উৎপাদনে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। এখানে সম্পদ উৎপাদনের নীতি সম্পর্কে জানবে।

i) হারাম পণ্য উৎপাদন

ইসলামি শরিয়াত যেসব পণ্য দ্রব্য হারাম করেছে তার উৎপাদনকেও হারাম করেছে। যেমন মাদক দ্রব্য, শূকর ইত্যাদি।

মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভেজাল দ্রব্য উৎপাদন যে সব উপায় অবলম্বন করলে মানব দেহের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন ক্ষতি হয়, সে সব উপায় অবলম্বন করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। অতএব ভেজাল পণ্য যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর তা উৎপাদন নিষিদ্ধ।

ii) ভূমির ব্যবহার

খাদ্য ও শিল্পপণ্যের কাঁচামাল ভূমি হতেই উৎপাদিত হয়ে থাকে। তাই একে ব্যবহার না করে ফেলে রাখা যাবে না।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করেছেন; অতএব তোমরা এর দিগ-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিযিক (জীবনোপকরণ) হতে খাবার গ্রহণ কর।”

(সূরা মূলক ৬৭:১৫)

iii) শ্রম

শ্রম উৎপাদনের একটি মৌলিক উপাদান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন,

“শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তোমরা তার মজুরি দাও।”

(ইবনে মাজাহ)

ঘ) ভোগ নীতি

i) মধ্যপন্থা অবলম্বন

অর্থব্যবস্থায় সম্পদ ভোগের ক্ষেত্রে ইসলাম মধ্যপন্থা অবলম্বন করার নির্দেশ দেয়। ভোক্তার দুই প্রান্তিক আচরণ ইসরাফ (اِ ْس َر ْ اف) অপব্যয় ও বুখল ( ُبخ ْ ُ ل) কার্পণ্য উভয়ই কুরআন মাজীদে অগ্রাহ্য হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তুমি তোমার হাত তোমার গলায় আবদ্ধ করে রেখো না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিত করো না, তা হলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে।”

(সূরা বনী ইসরাঈল ১৭:২৯)

ii) অপব্যয় না করা

ভোগের ক্ষেত্রে অপব্যয় ও অপচয় করা যাবে না।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আহার করবে ও পান করবে কিন্তু অপচয় করবে না।”

(সূরা আ‘রাফ ৭:৩১)

iii) হালাল দ্রব্য গ্রহণ এবং হারাম দ্রব্য বর্জন

একজন মুসলিম সবসময় সম্পূর্ণ সচেতনভাবে শুধু হালাল দ্রব্য ভোগ করে এবং হারাম দ্রব্য বর্জন করে।

iv) বিনিময় নীতি

জীবন ধারণের জন্য পরস্পর পণ্য ও দ্রব্যসামগ্রী আদান-প্রদান ও বিনিময় করতে হয়। ইসলামে এ বিনিময়ের ব্যাখ্যা এবং নীতি ও বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে।

ইসলামের বিনিময় নীতির কয়েকটি দিক হলোসন্তুষ্টচিত্তে বিনিময়: যেকোন বিনিময় ও লেনদেন পারস্পরিক সন্তুষ্টচিত্তে হতে হবে। অন্যায় ও নির্যাতনমূলক এবং কারও উপর চাপ সৃষ্টি করে জবরদস্তিমূলক বিনিময় ইসলামে অবৈধ।

iv) মুজদদারি ও মুনাফাখোরি অবৈধ

বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি ও অধিক মুনাফা লাভের জন্য জনগণের সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল না করে মজুদদারি, ব্যবসায়-বাণিজ্যে একচেটিয়াবাদ বৈধ নয়।

v) প্রতারণা জঘন্যতম অপরাধ

ক্রয়-বিক্রয়, লেনদেন ও বিনিময়ের সময় মাপে কম-বেশি, প্রতারণা এবং অন্যান্য অসুদপায় অবলম্বন করা জঘন্যতম অপরাধ।

vi) সুদ-ঘুষ নিষিদ্ধ

সুদি লেন-দেনকে আল্লাহ তায়ালা হারাম করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন।”

(সূরা বাকারা ২:২৭৫)

ঘুষের লেনদেনকে ও ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সম্পদ উৎপাদন, ভোগ ও বিনিময় এর ক্ষেত্রে ইসলামি নীতি অনুসরণ করলে সমাজের সকল মানুষ আর্থিক শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবে।

ঙ) সারসংক্ষেপ

হারাম পণ্য যেমন মদ শুকর উৎপাদন ও হারাম। তেমনিভাবে ভেজাল দ্রব্য উৎপাদন ইসলামে নিষিদ্ধ। ভোগের ক্ষেত্রে ইসলাম মধ্যপন্থা অবলম্বন করার নির্দেশ দেয়। অপচয় ও কৃপণতা উভয়ই আল-কুরআনে অগ্রাহ্য। সুদি লেন-দেন কে আল্লাহ তা’য়ালা হারাম করেছেন। ঘুষের লেন-দেনকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

(৩) ইসলামি অর্থব্যবস্থার সাথে অন্যান্য অর্থব্যবস্থার তুলনা

প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জীবনযাপনে অর্থব্যবস্থা মানুষের জীবনধারাকে প্রভাবিত করছে। সমাজব্যবস্থা, নীতি- নৈতিকতা, ধর্ম, শিক্ষা-সর্বত্রই অর্থনীতি প্রভাব বিস্তার করে আসছে।

এক কথায়, মানব জীবনের কোনো দিক ও বিভাগ অর্থনীতির আওতাবহির্ভূত নয়। এই অর্থনৈতিক কর্মকা- সবসময় কোন না কোনো নীতি বা আদর্শকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে।

অর্থনৈতিক ধারা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, তিনটি উল্লেখযোগ্য অর্থব্যবস্থা সমাজে প্রচলিত ছিল এবং আজও বর্তমান আছে। এগুলো হলো-

  1. পুঁজিবাদী অর্থনীতি
  2. সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং
  3. ইসলামি অর্থনীতি।

ক) পুঁজিবাদী অর্থনীতি

পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রথম ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানার সীমাহীন অধিকার। এতে সকল প্রকার উৎপাদন-উপায় এবং যন্ত্রপাতি ইচ্ছামত ব্যবহার ও প্রয়োগের পূর্ণসুযোগ লাভ করা যায়।

কার্ল মার্কসের মতে, পুঁজিবাদ হচ্ছে উৎপাদন, বন্টন ও বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যক্তি-মালিকানার বিধান। এর মূল উদ্দেশ্য অর্থোপার্জন। যেভাবে ইচ্ছা অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করতে পারবে। অধিক অর্থ উপার্জনের মূল উদ্দেশ্য থেকে পুঁজিবাদের জন্ম। সমাজে মজুদদারি, সুদী কারবার, ধোঁকাবাজি ও জালিয়াতি-প্রতারণা পুঁজিবাদের চিন্তা-চেতনার ফসল।

খ) সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি পুঁজিবাদী অর্থনীতির ঠিক বিপরীত। পুঁজিবাদের ব্যর্থতা ও কুফলের ফলে সমাজতন্ত্রের উদ্ভব। এ অর্থব্যবস্থার মূল হলো, ধন-সম্পদের যাবতীয় উপায়-উপাদান সমাজের ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত তথা রাষ্ট্রের মালিকানাধীন থাকবে। এখানে ব্যক্তি মালিকানার কোনো সুযোগ নেই। মানুষের সব অধিকারকে হরণ করে কেন্দ্রীভূত করার ফলে মানুষ একটি নিরেট বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

গ) ইসলামি অর্থনীতি

পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের বিপরীত ইসলামি অর্থব্যবস্থা একটি ভারসাম্যপূর্ণ মানবতা বান্ধব ব্যবস্থা।

ইসলামি অর্থনীতিবিদগণের মতে, যে সমাজ বিজ্ঞান ইসলামি দর্শনের আলোকে অর্থনৈতিক সমস্যা পর্যালোচনা করে, তা-ই ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা।

ব্যাপক অর্থে বলা যায় ইসলামি বিধি-বিধানের আলোকে উৎপাদন, উপার্জন, বণ্টন, ভোগ ও ব্যবহার সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনার জ্ঞান ও বাস্তব কার্যক্রম গ্রহণ করে যে অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় তা-ই ইসলামি অর্থনীতি।

ঘ) ইসলামি অর্থব্যবস্থার সাথে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও সমাজবাদী অর্থব্যবস্থার তুলনা বা পার্থক্য

i) উৎসগত

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: এর নীতিমালা, তত্ত্ব ও সূত্রমানব রচিত।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়া থেকেমানুষ এ মতবাদ রচনা করে।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে রচিত।

ii) সংজ্ঞাগত

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: পুঁজিবাদ হলো উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যক্তি- মালিকানার বিধান। এর মূল উদ্দেশ্য অর্থোপার্জন।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: অধিকতর সুষ্ট উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো কেন্দ্রিয় কর্তৃপক্ষ জনগণের যথাযথ আনুগত্যের ওপর ভিত্তিশীল যে পলিসি অবলম্বন করে, তাই সমাজতন্ত্র।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: ইসলামি অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান, যা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করে।

iii) মালিকানা

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: এতে অবাধ ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বীকৃত।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: এতে ব্যক্তি মালিকানার স্থান নেই। সকল কিছু রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তি মালিকানা অর্থাৎ সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। ব্যক্তি মালিকানা নিয়ন্ত্রিত।

iv) ভোগ-ব্যবহার

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: অনিয়ন্ত্রিত ও সীমাহীন ভোগ বিলাসের সুযোগ।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ভোগ বিলাস। ব্যক্তির স্বাধীনতা নেই।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: অবৈধ উপায়ে ভোগ বিলাসকে হারাম করা হয়েছে। ভোগের চেয়ে ত্যাগের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।

v) সুদী কারবার

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: এর ভিত্তি হলো সুদ। সুদই অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও বীমা সুদের মাধ্যমে লেনদেন করে থাকে।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: সুদকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়েছে।

vi) সম্পদের ধারণা

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: বৈধ-অবৈধ যে কোন পন্থায় অর্জিত সকল কিছুই সম্পদ।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: কল্যাণ অকল্যাণ বিবেচ্য নয়। যে কোন উপায়ে অর্জিত সকল কিছুই সম্পদ।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: অবৈধ ও হারাম বস্তু সম্পদ নয়। যেমন মাদকদ্রব্য।

vii) বন্টন ব্যবস্থা

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: অসম বণ্টন ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শ্রেণি বিভেদের জন্ম দেয়।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বণ্টন ব্যবস্থা
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: ইনসাফপূর্ণ বণ্টন ব্যবস্থা।কেউ বঞ্চিতন হয় না।

viii) নৈতিকতা

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: সম্পদ উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতার কোনো বিধি-নিষেধ নেই।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: এখানেও নীতি-নৈতিকতা বিবেচ্য নয়। রাষ্ট্রের আদেশই নীতি আকারে জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: অনৈতিকতার কোনো স্থান নেই। শরিয়ত নির্দেশিত নীতির বাইরে সম্পদ অর্জন ও ভোগের সুযোগ নেই।

ix) আদর্শগত

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: নির্দিষ্ট আদর্শিক ভিত্তি নেই।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: সমাজতান্ত্রিক আদর্শের আলোকে প্রণীত।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে প্রণীত।

x) শ্রমনীতি

  • পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা: শ্রমিককে শোষণ করা হয়। শ্রমিক মালিক সম্পর্ক শোষক ও শোষিতের।
  • সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: জনগণ শ্রমিক আর রাষ্ট্রীয় মালিক। উভয়ের মাঝে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা: ঘাম শুকানোর পূর্বে শ্রমিকের প্রাপ্য আদায় করতে হয়। মালিক ও শ্রমিক পরস্পর সহযোগী ও সহমর্মী।

ঙ) সারসংক্ষেপ

  • প্রত্যেক ব্যক্তিই হবে নিজের উপার্জিত ধন-সম্পদের মালিক। এতে অন্যের কোনো অধিকার নেই। ইচ্ছেমতো ভোগ-ব্যয় করতে পারবে। এটিই হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূল কথা।
  • সমাজবাদী অর্থ ব্যবস্থার মূল কথা হলো এখানে ব্যক্তি মালিকানার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রনে সকল কিছু ফলে এ ব্যবস্থায় জনগণের চিন্তা, মত ও কর্মের সমস্ত স্বাধীনতা রহিত হয়েছে এবং মানুষ যন্ত্র-মানবে পরিণত হয়েছে।
  • এ দু’টি মতবাদের বিপরীতে ইসলাম মানব জাতির জন্য একটি সুন্দর ভারসাম্য মূলক কল্যাণময় ব্যবস্থা দিয়েছে। এখানে ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। ফলে মানুষ এ স্বাধীনতা একটি নৈতিক মানের ভেতর দিয়েই কেবল ভোগ করতে পারে। এ স্বাধীনতা মোটেও অনিয়ন্ত্রিত নয়।

(৪) ইসলামি অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎসসমূহ

ইসলামি রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, প্রতিরক্ষা, প্রশাসনিক ব্যয় ইত্যাদি খাতে অর্থ ব্যয় করে থাকে। সুতরাং ইসলামি রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থের যোগান দিতে হয়। এ অর্থের প্রধান উৎস হচ্ছে যাকাত, উশর, খারাজ ও সাদাকাত ইত্যাদি।

ক) যাকাত

যাকাত ইসলামের তৃতীয় রুকন। ইসলামি অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রথম উৎস। ধনীদের সম্পদের উপর নির্দিষ্ট নিয়ম ও পরিমাণে যাকাত ফরয হয়ে থাকে।

যাকাতের শাব্দিক অর্থ পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। আল্লাহ তায়ালার আদেশ অনুযায়ী নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নিজের সম্পত্তি হতে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাতের হকদারদের নিকট প্রদান করাকে যাকাত বলে।।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

“আল্লাহ তাদের (ধনীদের) সম্পদের উপর যাকাত ফরয করেছেন। তাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী তাদর নিকট থেকে যাকাত উসূল করে তা তাদের দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হবে।”

(সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)

প্রত্যেক ‘সাহিবে নিসাব’ মুসলমানের ওপর যাকাত আদায় করা ফরয। সোনা-রূপা, কারেন্সি, জমির ফসল, ব্যবসায়ের পণ্যদ্রব্য, গৃহপালিত গবাদি পশু, গরু-ছাগল, উট, মহিষ, ভেড়া-দুম্বা ইত্যাদি নির্দিষ্ট পরিমাণে পৌঁছলে যাকাত দিতে হয়।

যাকাত বণ্টনের আটটি খাত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“সদকা (যাকাত) তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটি আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”

(সূরা তাওবা ৯:৬০)

অতএব, বর্ণিত ৮টি খাত ব্যতীত অন্য কোন খাতে যাকাত প্রদান করা যাবে না। সমাজের দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাতের বিকল্প নেই।

খ) উশর

আল্লাহ তায়ালা যমীনকে মানুষের জন্য জীবন-জীবিকার প্রথম উৎস বানিয়েছেন। এ জন্য আমাদেরকে আল্লাহ তা‘য়ালার শোকর আদায় করতে হবে। আর সেই শোকর আদায়ের মাধ্যম হচ্ছে জমির উৎপন্ন ফসল থেকে যাকাত আদায় করা। আর ফসলের যাকাতকে বলা হয় উশর।

আরবি ( ُع ْش ٌر) উশর অর্থ এক দশমাংশ বা দশভাগের এক ভাগ। সাধারণ জমিতে উৎপাদিত ফসলের যাকাতকে উশর বলা হয়।

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, মুসলমানদের আবাদকৃত জমিতে উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশ যাকাত হিসেবে প্রদান করাকে উশর বলা হয়।

উশর প্রদানের নির্দেশ আল-কুরআন দ্বারা প্রমাণিত।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“হে মু’মিনগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দিই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর।”

(সূরা বাকারা ২:২৬৭)

উশরি ভূমি দুই প্রকার-

এক. এমন সব জমি যাতে নদীনালা, খালবিল অথবা বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয়ে ফসল উৎপাদিত হয়। এগুলোর জন্য উশর বা ১০% প্রযোজ্য।

দুই. এমন সব ভূমি যাতে কৃষককে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়, কৃত্রিম উপায়ে মেশিনের সাহায্যে কুপ খনন করে সেচ দিতে হয়। এগুলোর যাকাতের পরিমাণ হলো নিসফে উশর বা বিশভাগের এক ভাগ বা ৫%।

গ) খারাজ

খারাজ ( َخرا َ ْج) হলো ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমদের ভূমিকর।

ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমদের মালিকানা ও ভোগদখলকৃত জমি থেকে যে রাজস্ব আদায করা হয় তাকে খারাজ বলে।

খারাজের বিধান খারাজ নির্ধারণ করার পূর্বে ইসলামি রাষ্ট্রকে ভূমি বিশেষজ্ঞ দ্বারা অতি সতকর্তার সাথে নিম্নোক্ত কার্যাবলী সমাধান করতে হবে-

(এক) ভূমি জরিপ, (দুই) ভূমির প্রকৃতি ও গুণাগুণ পরীক্ষা, (তিন) সেচ, শ্রম ইত্যাদি।

এমনভাবে খারাজ নির্ধারণ করতে হবে যেন কারো ওপর অবিচার ও অত্যাচার করা না হয়।

খারাজের কোন নির্দিষ্ট হার নেই। এটা ইসলামি সরকার পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইনসাফের সাথে নির্ধারণ করবে। শুধু সামর্থবান অমুসলিমের ওপরই খারাজ ধার্য হয়।

ঘ) সাদাকাত

সাদাকাত ( َص َد ْ َ ق ات) বহু বচন। এক বচন সাদাকাহ ( َص َد ٌ َ ق ة) আভিধানিক অর্থ, সদকা, দান, খয়রাত, যাকাত।

আল্লাহ তা‘য়ালার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে যে কোনো ধরনের দানকে সাদাকাহ বলা হয়।

সাদাকাহ সাধারণত কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- ফরয, ওয়াজিব ও নফল সাদাকাহ।

  • যাকাত হলো ফরয সাদাকাহ।
  • সাদাকাতুল ফিতর ও মান্নতের সাদাকাহ ওয়াজিব সাদাকাহ।
  • ফরয ও ওয়াজিব সাদাকাহ ব্যতীত সব ধরনের দানই নফল সাদাকাহ।

সাদাকাতুল ফিতর হলো ঈদুল ফিতরের দিন ধনীগণ শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত হারে দরিদ্র্যের মধ্যে যে ফিতরা বা দান সাদাকাহ করে থাকে।

দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মানব কল্যাণে সাদাকাহার গুরুত্ব অপরিসীম। সাদাকাহর মাধ্যমে মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থাকে সুন্দর সমৃদ্ধ করে তোলা যায়। তাই ইসলাম যাকাত, ফিতরার পাশাপাশি নফল সাদাকাহার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে।

ঘ) সারসংক্ষেপ

  • যাকাত ইসলামের অন্যতম রুকন। এটি একটি আর্থিক ইবাদাত। ধনীদের একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে অভাবগ্রস্তদের দেওয়াকে যাকাত বলে। ফসলের যাকাতকে উশর বলা হয়।
  • ইসলামি রাষ্ট্রের অমুসলিমদের ভূমি কর হলো খারাজ।
  • যে কোন ধরনের দান হলো সাদাকাত। আল-কুরআনে যাকাতকে সাদাকাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি আর্থিক সামর্থবানদের জন্য বাধ্যতামূলক।
  • তাছাড়াও রয়েছে ওয়াজিব সাদাকাহ যেমন সাদাকাতুল ফিতর ও মান্নাতের সাদাকাহ। এছাড়া বাকী সব ধরনের দান হচ্ছে ঐচ্ছিক বা নফল। সাদাকার মাধ্যমে কল্যাণমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৫) ইসলামি ব্যাংকিং

ক) পরিচয়

ইসলামি শরিয়ার আলোকে ব্যাংকিং বা ব্যাংক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো ইসলামি ব্যাংক।

ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (OIC)-এর মতে-

Islami Bank is a financial institution whose statutes, rules and procedures expressly state its commitment to the priniciples of islamic shariah and to the banning of the receipt and payment of interest of any its operations.

অর্থাৎ, ইসলামি ব্যাংক এমন এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা এর মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতির সকল পর্যায়ে ইসলামি শরিয়ার নীতিমালা মেনে চলতে বদ্ধপরিকর এবং কর্মকা-ের সকল স্তরে সুদ বর্জন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’

অন্য এক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ইসলামি ব্যাংক এমন এক কোম্পানি যা ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবসায় নিয়োজিত; ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবসায় এমন ধরনের ব্যবসায় যার লক্ষ্য ও কার্যক্রমের কোথাও এমন কোনো উপাদান নেই, যা ইসলাম অনুমোদন করেনি।

অতএব, ইসলামি ব্যাংকিং আর্থিক মধ্যস্থতার এমন একটি পদ্ধতি, যা তার লেনদেন সম্পূর্ণরূপে ইসলামি শরিয়াহ অসুসরণ করে।

খ) ইসলামি ব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

  • ইসলামি শরিয়ার আলোকে এর সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা।
  • সকল আর্থিক লেনদেনে সম্পূর্ণরূপে সুদ বর্জন করা।
  • কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
  • ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে অংশীদারিত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা।
  • সকল বিনিয়োগ কার্যক্রমে ইসলামি নীতি ও পদ্ধতির অনুসরণ করা।
  • ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং অর্থনীতিতে ন্যায়নীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা।
  • ইসলামি অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করা।

গ) গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রধান দু’টি বিষয় হলো-

(এক) সুদ হারাম হওয়া

(দুই) সুদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি।

i) সুদ হারাম

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“আল্লাহ ব্যবসায় (ক্রয়-বিক্রয়) কে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন”।

(সূরা বাকারা ২:২৭৫)

কোন মুসলিম এ কথা জানার পর তার পক্ষে সুদভিত্তিক লেনদেনের সাথে জড়িত থাকা ইমানের পরিপন্থি। শুকরের গোশত খাওয়া যেমন হারাম, খুন, জখম যেমন হারাম, সুদ তেমনি হারাম।

সুতরাং সুদভিত্তিক লেনদেনের বিকল্প হিসেবে ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা একটি ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণময় পদ্ধতি।

ii) সুদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি

দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয় হলো সুদভিত্তিক ব্যাংকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি।

  • সুদ নির্ভর প্রতিষ্ঠান সুদের মাধ্যমে সমাজের মানুষকে শোষণ করে।
  • সুদের কারণে ব্যবসায়ীর নৈতিকতা নষ্ট হয়। পণ্যের ওপর সুদের বাড়তি মূল্য যোগ হওয়ায় বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যায়।

অতএব, ধর্মীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে বাঁচার জন্য ইসলামি ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

ঘ) সারসংক্ষেপ

  • যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামি শরিয়ার আলোকে পরিচালিত হয় তা-ই ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
  • অর্থনীতিতে, ব্যবসায়বাণিজ্য ও লেনদেনের সকল পর্যায়ে ন্যায়নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনয়ন করাই ইসলামি ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য।
  • সুদের কুফল থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য ইসলামি ব্যাংকয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

(৬) ইসলামি ব্যাংকিং এর সাথে অন্যান্য ব্যাংকিং-এর পার্থক্য

ক) ইসলামি ব্যাংক-এর সাথে অন্যান্য ব্যাংকিং-এর পার্থক্য

শরিয়াহ নীতি অনুসরণ করার কারণে ইসলামি ব্যাংকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি এবং কাজের ফলাফল প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংক থেকে স্বতন্ত্র।

ইসলামি ব্যাংক শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য কাজ করে না, অর্থনৈতিক সুবিচার ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

প্রচলিত ব্যাংক থেকে ইসলামি ব্যাংকের মৌলিক পার্থক্যগুলোর প্রধান প্রধান দিক নিচে উল্লেখ করা হলো-

ক্রমিকইসলামি ব্যাংকপ্রচলিত ব্যাংক
১.ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত।শরিয়াহর নীতি অনুপস্থিত।
২.সম্পূর্ণরূপে সুদমুক্ত করতে বদ্ধপরিকর।সুদের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল।
৩.ব্যবসায় ও বিনিয়োগ হবে হালাল পদ্ধতিতে।হালাল-হারামের প্রশ্ন নেই- যে কোন পদ্ধতিতেবিনিয়োগ করা যাবে।
৪.গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে অংশীদার ও বিনিয়োগকারীর।বাহক ও ব্যাংকের মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতার
৫.আমানতকারী বিনিয়োগের ঝুঁকি বহন করে।আমানতকারী ঋণ বা বিনিয়োগের ঝুঁকি বহন করে না
৬.অর্থকে পণ্য বিবেচনা করে না। ইসলামি ব্যাংক অর্থের সাহায্যে ব্যবসায় করে।অর্থ পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ব্যাংক অর্থের ব্যবসায় করে।
৭.ইসলামি ব্যাংকিং একটি কল্যাণমূলক ব্যাংক ব্যবস্থা।প্রচলিত ব্যবস্থায় জুলুম ও শোষণের জন্ম হয়।
৮.ব্যাংকের লেনদেন ও বিনিয়োগ শরিয়াহ বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত।শরিয়াহ বোর্ডের প্রচলন নেই।
৯.ব্যাংক তার সম্পদের ওপর যাকাত দেয়।যাকাত দেয়া হয় না।
১০.বৈদেশিক মুদ্রার তাৎক্ষণিক ক্রয়-বিক্রয় হয় অগ্রিম ক্রয়বিক্রয় হয় না।বৈদেশিক মুদ্রার তাৎক্ষণিক বা অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়ে কোনো বাধা নেই।
১১.খেলাফি বিনিয়োগ গ্রাহক থেকে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করা হয় না।খেলাফি ঋণগ্রহীতা থেকে অধিক সুদ আদায় করা হয়।
১২.সুদের ভিত্তিতে কলমানির লেনদেন ইসলামি ব্যাংকে নিষিদ্ধ।কড়া সুদে কলমানির লেনদেন হয়ে থাকে।
১৩.ইসলামি ব্যাংক অত্যাবশ্যকীয় উৎপাদন ও সামাজিক কল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগের উৎসাহিত করে।প্রচলিত ব্যাংকে এসব বিষয় বিবেচনা না করে মুনাফার উপরই অধিক গুরুত্ব দেয়।
১৪যে সব পণ্যের উৎপাদন সমাজের জন্য ক্ষতির বলে গণ্য করা হয়, সে গুলোতে অধিক মুনাফা হলেও এ ধরনের পণ্যের উৎপাদনে ও ব্যবসায় বিনিয়োগ করে না।প্রচলিত ব্যাংক এসব বিষয় কোনো বাছ-বিচার করে না, বরং মুনাফা অর্জনই এর মূল লক্ষ্য।

খ) সারসংক্ষেপ

  • ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রচলিত ব্যাংক থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থার সকল কার্যক্রম সুদমুক্ত। কিন্তু প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে সুদভিত্তিক।
  • ইসলামি ব্যাংকিংএ গ্রাহক ব্যাংক সম্পর্ক অংশীদারিত্ব ভিত্তিক। প্রচলিত ব্যাংকিংয়ে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক ঋণ, গ্রহীতা ও ঋণদাতার।
  • ইসলামি ব্যাংকিংএ বিনিয়োগ হালাল হতে হবে। প্রচলিত ব্যাংক হালাল বা হারামের প্রশ্ন নেই।

(৭) ইসলামি অর্থব্যবস্থায় বীমা

ক) পরিচয়

মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ অর্থব্যবস্থা। জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি মুকাবেলায় একটি বৈজ্ঞানিক পথ ও পদ্ধতির নাম বীমা। বীমা প্রকৃত অর্থে মানুষের জীবনে বিভিন্ন বিপত্তির ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা মোকাবেলার একটি আর্থিক নিরাপত্তা পদ্ধতি। বীমার ধারণা ইসলামি মূলনীতির কাঠামোর মধ্যে গ্রহণযোগ্য।

ইংরেজি (Insurance) শব্দটির বাংলা পারিভাষিক অর্থ ‘বীমা’।

বীমার সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায়,

বীমা হলো দু’ পক্ষের মধ্যে এমন একটি চুক্তি যা দ্বারা এক পক্ষ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করার পরিবর্তে কোন ক্ষতিকর ঘটনায় মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে মৃত্যু বা একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমায় পৌঁছলে অন্য পক্ষকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে অথবা সম্পদের ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতির টাকা পরিশোধ করার অঙ্গীকার প্রদান করে।

(জিতেন্দ্র লাল বড়–য়া, জীবন বীমা পরিচয়, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭, পৃ. ৬)

ইসলামি বীমার সংজ্ঞায় বলা যায়,

ইসলামি শরিয়ার বিধান ও বাস্তব প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে ইসলামি আকিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বীমা ব্যবস্থার নাম ইসলামি তাকাফুল (ইসলামি বীমা)।

(শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, ইসলামি অর্থনীতি)

ইসলামি বীমা একটি সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা, যেখানে পারস্পরিক কল্যাণ সাধনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ঝুঁকি থেকে ব্যক্তি ও সমাজ উপকৃত হয়ে থাকে।

ইসলামি জীবনবীমা এমন একটি পদ্ধতি, যাতে একদল মানুষ তাদের মধ্যকার কোন সদস্যের দুর্ঘটনাজনিত শারীরিক অক্ষমতা কিংবা মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট ক্ষতির বোঝা লাঘবের জন্য একে অপরের সাথে সহযোগিতা করে।

খ) প্রকারভেদ

বীমা সাধারণ দুই প্রকার হয়ে তাকে যেমন- জীবনবীমা ও সাধারণ বীমা।

জীবনবীমা প্রকৃত অর্থে মানুষের জীবনে বিভিন্ন বিপত্তির ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় একটি আর্থিক নিরাপত্তা পদ্ধতি।

নৌ-বীমা, অগ্নি-বীমা, দুর্ঘটনা বীমা, দায়বীমা ইত্যাদি জীবন বহির্ভূত (Non Life) বা সাধারণ বীমা (General Insurance)। সাধারণ বীমা হচ্ছে এক ধরনের ক্ষতিপূরণের চুক্তি।

গ) ইসলামি বীমার উদ্দেশ্য

বর্তমান সময়ে মানুষের প্রত্যেকটি কাজে-কর্মে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। বীমা চুক্তির মাধ্যমে বীমা গ্রহীতা ও সব ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করে। এ নিরাপত্তা ও প্রশান্তিবোধ মানুষের জীবনকে গতিময় করে তোলে।

ভবিষ্যতের অপ্রত্যাশিত ক্ষতি, লোকসান কিংবা দুর্দশার বিপরীতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ সমাজগঠন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পূর্বশর্ত। মহানবি (সাঃ) অসহায়দের সহায়তা করতেন এবং তাঁর সাহাবীদেরকে তাদের কষ্ট নিবারণের আদেশ দিতেন।

হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেন,

“যে ব্যক্তি কোন মুমিনের জাগতিক একটি কষ্ট দূর করে, আল্লাহ তা‘য়ালা তার পরকালীন একটি কষ্ট নিবারণ করবেন।”

(সহিহ বুখারি)

ইসলাম সর্বক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বের বিষয়টি সমর্থন করে। তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বীমার অন্তর্নিহিত পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য।

সকল ক্ষেত্রে ‘আমর বিল মারূফ (সৎকাজের আদেশ)’, এবং ‘নাহীআনিল মুনকার (অসৎকাজের নিষেধ), এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘আত্মশুদ্ধি’ ও তাকওয়া অর্জন, সকল কর্মকান্ডে শরিয়ার বিধান মান্য করা, ‘আদল ও ইহসান’ এর প্রয়োগ, ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা, ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের প্রয়াস, মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ নিশ্চিত করার সাথে সাথে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভ করা ইসলামি বীমা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য।

ঘ) ইসলামি বীমার বৈশিষ্ট্য

  • সলামি বীমা কোম্পানি প্রকৃত অর্থে অংশগ্রহণকারী সকল জমাকৃত অর্থের জিম্মাদার ও ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন
  • করে।
  • সম্ভাব্য পলিসিহোল্ডারদের (অংশগ্রহণকারী) সংগঠিত করার ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করে এবং সমন্বয়কারী ও সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
  • বীমা প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণকারীদের তহবিল পরিচালনা করে থাকে। এ স্কিমে অংশগ্রহণকারীরা একে অপরকে সহযোগিতা
  • করার জন্য ‘তাবাররু তহবিলে’ অর্থ প্রদান করতে সম্মত হয়।
  • তাকাফুল ব্যবস্থা সুদের উপাদান থেকে মুক্ত এবং আল-মুদারাবা ও আল-তাবাবরু নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।
  • বিনিয়োগের পুরো ব্যবস্থাটাই শরীয়ার নির্দেশনার আলোকে করতে হয়।
  • ইসলামি জীবনবীনমার ক্ষেত্রে সাধারণত নমিনি আর্থিক সুবিধাবলী প্রাপ্তির নিরঙ্কুশ অধিকারী হয় না, বরং সে নিছক একজন জিম্মাদার (ট্রাস্টি) বা সম্পাদনকারী (এক্সিকিউটর) হিসেবে বিবেচিত হয়, যার দায়িত্ব ইসলামের উত্তরাধিকার বিধানের আলোকে পলিসির অর্থ অংশগ্রহণকারীর সকল উত্তরাধিকারের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া।

ঙ) সারসংক্ষেপ

  • জীবনে আছে নানা ঝুঁকি ও বিপত্তি। ঝুঁকি নিরসনের একটি বৈজ্ঞানিক পথ ও পদ্ধতির নাম বীমা। ইসলামি বীমা বা তাকাফুল হলো অংশগ্রহণকারী সকল সদস্যের পারস্পরিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার একটি ধারণা। এটা দুর্ভাগ্যপীড়িত ও অভাবগ্রস্তদের আর্থিক সহযোগিতার সামাজিক বাধ্যবাধকতাও পূরণ করে।
  • ইসলামি শরিয়ার আলোকে সাম্য, ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একটি আর্থ-সামাজিক পদ্ধতি কীভাবে কাজ করতে পারে তাকাফুল বা ইসলামি বীমা হলো তার একটি উদাহরণ।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts

You cannot copy content of this page