মহান অল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন। প্রতিনিধির কাজ হলো পৃথিবীতে মহান অল্লাহর নির্দেশানুযায়ী কর্মকান্ড পরিচালনা করা।
ইসলামে যেমন ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা আছে, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনা বিধিমালাও রয়েছে।
ইসলামি রাষ্ট্র কোনো মানুষের চিন্তা বা গবেষণার ফসল নয়; বরং তা বিশ্ব স্রষ্টা মহান অল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দেওয়া পদ্ধতি। আল্লাহর দেওয়া ও রাসূলের প্রদর্শিত পদ্ধতির ভিত্তিতে মানুষ তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এরই মধ্যে নিহিত রয়েছে মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা।
ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলিম নাগরিকদের ন্যায় অমুসলিম নাগরিকরাও নাগরিক অধিকার ভোগ করে থাকে। ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম সংবিধান হলো মদিনা সনদ। রাষ্ট্র পরিচালনায় মদিনা সনদের গুরুত্ব অত্যধিক।
(১) ইসলামি রাষ্ট্র
ক) ইসলামি রাষ্ট্রের পরিচয়
ইসলামি রাষ্ট্র বলা হয় এমন রাষ্ট্রকে যে রাষ্ট্র ইসলামি নীতি তথা কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামি শরিয়তের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়।
ইসলামি রাষ্ট্রের অধিবাসী কেবল মুসলমান হওয়া শর্ত নয়, বরং রাষ্ট্র শাসকের মুসলিম হওয়া ও ইসলাম অনুসরণ করাই সেজন্য যথেষ্ট। সামগ্রিক দৃষ্টিতে ইসলামি রাষ্ট্রকে বলা হয় (دا ر الاسلام) দারুল ইসলাম।
আবুল হাসান আল মাওয়ার্দীর মতে, দ্বীনের পাহারাদারী, সংরক্ষণ ও দুনিয়ার সুষ্ঠু পরিচালনা ও নবুওয়াতের প্রতিনিধিত্ব করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই ইসলামি রাষ্ট্র।
খ) ইসলামি রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
ইসলামি রাষ্ট্র অপরাপর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র। তাই এ রাষ্ট্র স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
ইসলামি রাষ্ট্র একটি ধর্মভিত্তিক আদর্শিক গণতান্ত্রিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ইসলামি রাষ্ট্র কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা, ভাষা বা বর্ণভিত্তিক নয়, এটি একটি আদর্শিক চেতনাভিত্তিক। দুনিয়ার যে সব মানুষ একই আদর্শ অর্থাৎ তাওহিদ ও রিসালাতে বিশ্বাসী তারা সবাই ইসলামি রাষ্ট্রের সদস্যভুক্ত হতে পারে।
এ রাষ্ট্র কুরআন ও সুন্নাহর পরিপূর্ণ নীতির বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত। ইসলামি রাষ্ট্রে আইনপ্রণেতা কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াসের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করে থাকেন।
ইসলামি রাষ্ট্রে মহান অল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে সরকার ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করবেন।
মহান অল্লাহ বলেন,
“কর্তৃত্ব তো আল্লাহরই।”
(সূরা আন‘আম ৬:৫৭)
ইসলামি রাষ্ট্রের শাসক হবেন নির্বাচিত। জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই শাসক নির্বাচিত হবেন। একটি নির্বাচিত শূরা বা পরামর্শ পরিষদ সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ দান ও সহযোগিতা করবেন।
ইসলামি রাষ্ট্রের গোটা প্রশাসন ব্যবস্থাকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন স্তরের প্রশাসনে কর্মরত কর্মচারিগণ নিজেদেরকে জনগণের সেবক হিসেবেই মনে করে।
ইসলামি রাষ্ট্র কোনো স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একক কোনো সিদ্ধান্তে রাষ্ট্র চলে না। এ রাষ্ট্র পরিচালিত হয় যোগ্যতাসম্পন্ন, মুত্তাকি ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গঠিত মজলিসে শূরার সদস্যদের মতামত নিয়ে।
মহান অল্লাহ বলেন,
“নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কাজ সমাধান করে।”
(সূরা শুরা ৪২:৩৮)
গ) ইসলামি রাষ্ট্রের গুরুত্ব
ইসলামি রাষ্ট্র জনগণের সব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে। এ রাষ্ট্র মুসলিম জনগণকে ইসলামের অনুশাসন মানতে সহায়তা করে। অমুসলিম নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা ও নিজ ধর্ম পালনে রয়েছে স্বাধীনতা। তাই রাষ্ট্রে শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েম করতে হলে ইসলামি রাষ্ট্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামি শরিয়তে রয়েছে মানব জীবনের সব দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইন ও বিধান।
শরিয়তের এমন অনেক বিধান রয়েছে যা কার্যকরী করতে হলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করে সেগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভবপর নয়। কাজেই শরিয়তের বিধান জারি ও কার্যকর করার জন্য ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা অপরিহার্য।
ইসলামি রাষ্ট্রের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই সম্ভব আদর্শ সমাজ গঠন। কেননা এরূপ একটি রাষ্ট্র কায়েম হলে ইসলামের পক্ষে ক্ষতিকর ও শরিয়ত বিরোধী কাজকর্ম বন্ধ করা সম্ভব।
সালাত ও যাকাত ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ দুটো মৌলিক বিধান। এ দু’টো ইমানের পরিচয়। ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছেরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সালাত প্রতিষ্ঠা ও যথাযথভাবে যাকাত সংগ্রহ ও সুষ্ঠু বণ্টনের ব্যবস্থা করা।
মহান অল্লাহ বলেন,
“আমি এদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে।”
(সূরা আল হজ্জ ২২:৪১)
মহান অল্লাহ তাঁর দ্বীন পাঠিয়েছেন যাতে অন্যান্য সব ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা এবং মতবাদের ওপর বিজয়ী করা যায়। মহান অল্লাহর দ্বীন কারো অধীন থাকতে পারে না। তাই ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অত্যধিক।
ঘ) ইসলামি রাষ্ট্রের গঠন প্রণালী
সব রাষ্ট্রের-ই যেমন গঠন প্রণালী থাকে। তেমনি ইসলামি রাষ্ট্রের গঠন প্রণালী রয়েছে। আর তা হলো-
i) রাষ্ট্রপ্রধান
ইসলামি রাষ্ট্রে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্র প্রধান থাকবেন। যিনি যোগ্য, সৎ, খোদাভীরু ও খাঁটি ইমানদার হবেন।
ii) শাসনতন্ত্র
ইসলামি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের ভিত্তি হবে আল-কুরআন ও সুন্নাহ। এ রাষ্ট্রের প্রতিটি বিধিবিধান প্রণীত ও পরিচালিত হবে আল-কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী।
iii) মজলিসে শূরা
রাষ্ট্রপ্রধানকে রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় কর্মকা-ে পরামর্শ দেয়ার জন্য একটি মজলিসে শূরা বা পরামর্শ সভা থাকবে। জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মতিক্রমে মজলিসে শূরার সদস্যবৃন্দ নির্বাচিত ও নিযুক্ত হবেন। যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে রাষ্ট্রপ্রধান উক্ত সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে তাদের অভিমত নিয়ে শরিয়তের নির্দেশ মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।
iv) ইসলামি শরিয়তের অনুসরণ
রাষ্ট্রপ্রধান ও মজলিসে শূরা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তা ইসলামি মূল্যবোধ মোতাবিক কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক হতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ বা কৃতিত্ব অর্জনের জন্য ইসলামি বিধানবহির্ভূত কিছু করতে পারবে না।
সরকার পরিচালনা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের উন্নতি-অগ্রগতি সব কিছুতে ইসলামি শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে ইসলামি রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য।
ঙ) সার সংক্ষেপ
- রাষ্ট্র-ব্যবস্থা মানুষের কল্যাণময় জীবনের বৃহত্তর সংগঠন। মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্ন হতে নিজেদের তৈরি করা যেসব সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় সুশৃঙ্খল-সুনিয়ন্ত্রিতভাবে জীবনযাপন করছে, তন্মধ্যে রাষ্ট্র সর্বাপেক্ষা বৃহৎ, সর্বজনীন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।
- ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কুরআন ও সুন্নাহর আইন জারি ও প্রতিষ্ঠা করাই মূল লক্ষ্য। এরূপ ইসলামি রাষ্ট্রই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শান্তি ও মুক্তি দিতে সক্ষম। তাই ইসলামি রাষ্ট্রকে নাগরিকদের ইহ-পারলৌকিক জীবনের সফলতা অর্জনের উপায় বলে মনে করা হয়।
(২) খিলাফত
ক) খিলাফতের পরিচয়
খিলাফত ( ِخ َلافَ ٌ ـة) শব্দটি আরবি। এর অর্থ প্রতিনিধিত্ব, স্থলাভিষিক্ততা ইত্যাদি। খিলাফত হলো ইসলামি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল পদ। মহানবি (সাঃ)এর ওফাতের পর তাঁর প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠার কার্যই হলো খিলাফত।
মহান অল্লাহর একত্ববাদের ভিত্তিতে তাঁরই আইন-বিধান ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে অর্থাৎ জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করার নামই খিলাফত।
মূলতঃ খিলাফত হলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উত্তরাধিকরী হয়ে তাঁর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা। তাঁর নির্দেশনানুযাযী মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দান করা। যেমন মহানবির (সাঃ) ইনতিকালের পর হযরত আবুবকর (রা.) হযরত ওমর (রা.) হযরত উসমান (রা.) হযরত আলী (রা.) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।
খ) খোলাফায়ে রাশেদার পরিচয়
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ইন্তেকালের পর যে চারজন বিশিষ্ট সাহাবি মহামহিম অল্লাহ ও রাসূলের (সাঃ) নির্দেশিত পদ্ধতি অনুযায়ী ইসলামি রাষ্ট্রের শাসনকার্যাদি সঠিক পন্থায় পরিচালনা করে গেছেন, তাঁরা খোলাফায়ে রাশেদীন নামে পরিচিত। তাঁরা হলেন-
- হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) (৬৩২ – ৬৩৪ খ্রি.),
- হযরত ওমর ফারুক (রা.) (৬৩৪ – ৬৪৪ খ্রি.),
- হযরত উসমান (রা.) (৬৪৪ – ৬৫৬ খ্রি.) ও
- হযরত আলী (রা.) (৬৫৬ – ৬৬১খ্রি.)।
ইসলামি জীবনব্যবস্থার পরিপূর্ণ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন হয়েছিল খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে। আর তাঁদের ত্রিশ বছরের (৬৩২-৬৬১ খ্রি:) খিলাফত কালই ছিল ইসলামি শাসনব্যবস্থার আদর্শ-সোনালি যুগ।
গ) খোলাফায়ে রাশেদার নীতি
মহানবি (সাঃ) ৬২২ সালে মদিনাকে কেন্দ্র করে যে ইসলামি শাসনতন্ত্রের গোড়াপত্তন করেন তা তাঁর বিশ্বস্ত সাহাবা খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে (৬৩২-৬৬১) ক্রমবিকাশ লাভ করে একটি উন্নত শাসনব্যবস্থায় রুপান্তরিত করে। খেলাফায়ে রাশেদীনের ৩০ বছরের শাসনকালে ইসলামের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও উন্নত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
খোলাফায়ে রাশেদার শাসননীতি ছিলো নিম্নরূপ-
i) মজলিসে শূরা বা পরামর্শ পরিষদ
রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ব্যাপারে এবং রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে খলিফাকে সাহায্য করার জন্য একটি পরামর্শ পরিষদ ছিল। একে মজলিসে শূরা বা উপদেষ্টা পরিষদ বলা হত।
মুহাজিরিন ও আনসারদের বয়োবৃদ্ধ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গ, বেদুঈন নেতা এবং মদিনার বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে এটি গঠিত হয়। খলিফাগণ এ মন্ত্রণা পরিষদের পরামর্শানুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
ii) শাসনকার্যে জনগণের অংশগ্রহণ
শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে সাধারণ নাগরিকও অংশগ্রহণ করতে পারতো। অনেক ক্ষেত্রে জনগণের মতামত যাচাই করে খলিফাগণ কর্মচারী নিয়োগ করতেন। কর্মচারীদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের অভিযোগ থাকলে তা শ্রবণ করা হত এবং অনুসন্ধানের পর কোনো কর্মচারী দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে শুধু বরখাস্তই করা হতো না, বিধিমত শাস্তিও প্রদান করা হতো।
iii) রাজস্ব নীতি
মহানবি (সাঃ) এমনকি হযরত আবু বকর (রা.)-এর সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস খুব সীমিত ছিল। তাই রাজস্ব আয়ের নিয়মিত কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তখন রাষ্ট্রীয় তহবিলে সামান্য যা কিছু আয় হতো তা সঙ্গে সঙ্গে আবার জনসাধারণের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হতো।
কিন্তু খলিফা ওমর (রা.)-এর সময় যখন ইসলামি সাম্রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হলো তখন নিয়মিত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। হযরত ওমর (রা.)-এর সময় থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য স্বতন্ত্র লোক নিয়োগ করা হতো। আদায়কৃত রাজস্ব খলিফার নির্দেশ অনুযায়ী সৈনিকদের বেতন ও জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হতো। অবশিষ্ট অর্থ কেন্দ্রীয় রাজধানীতে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
iv) শিক্ষানীতি
খোলাফায়ে রাশেদীন শিক্ষা বিস্তারের প্রতিও যথেষ্ট সুনজর রাখতেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রতিটি মসজিদে শিক্ষক নিয়োগ করা হতো। কুরআন, হাদিস ও ফিকহ সম্বন্ধে এসব মসজিদে শিক্ষা দেয়া হতো।
হযরত ওমর (রা.) জনসাধারণের জন্য সর্বপ্রথমে শিক্ষার সুব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি খিলাফতের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কুরআন, হাদিস, ফিকহ্ ছাড়াও ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, গণিত, দর্শন প্রভৃতি চর্চা করা হত।
v) প্রতিরক্ষা নীতি
খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়কালে প্রতিরক্ষা বিভাগ ছিল যথাপোযুক্ত। খলিফাগণ তাদের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে দেশে প্রতিরক্ষা বিভাগকে সন্তোষজনক অবস্থায় রাখেন।
খলিফা ওমর (রা.) সর্বপ্রথম রাত্রিকালে পাহারা দেয়ার রীতি প্রবর্তন করেন। হযরত আলী (রা)-এর সময় নিয়মিত পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়।
খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় সমগ্র খিলাফত নয়টি জুন্দ বা সামরিক বিভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলো ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক ঘাঁটি ছিল।
ঘ) সার সংক্ষেপ
খিলাফত হলো মহান অল্লাহ প্রদত্ত মহান দায়িত্ব। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিকে খিলাফত বলা হয়। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশিত পন্থায় চার খলিফার যুগে রাষ্ট্র পরিচালিত হতো। এ যুগকে বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ বলা হয়।
(৩) খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধানের যোগ্যতা ও গুণাবলি এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ক) রাষ্ট্রপ্রধানের যোগ্যতা
ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের যোগ্যতা ও গুণাবলি দু’ভাগে বিভক্ত। একটি আইনগত অপরটি নৈতিক। ক. আইনগত যোগ্যতা ও গুণাবলি
ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের আইনগত গুণাবলি নিম্নরূপ-
i) মুসলিম হওয়া
ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে মুসলিম হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাজের গুরুদায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“অল্লাহ অঙ্গীকার করেছেন যে, তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে অবশ্যই তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেন।”
(সূরা নূর ২৪:৫৫)
ii) পুরুষ হওয়া
ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে পুরুষ হতে হবে। কেননা এ রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় মসজিদ ও ঈদগাহে নামাযের ইমামতি করার দায়িত্ব তাঁর।
iii) প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া
ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু বা কিশোর রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে না। শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার মত উপর্যুক্ত বয়স থাকতে হবে।
iv) সুস্থ হওয়া
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। দায়িত্ব পালনে অক্ষম এমন কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তাই রাষ্ট্রকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করানোর জন্য রাষ্ট্রপ্রধানকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকতে হবে।
v) সুস্থ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া
সুস্থ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যতম গুণাবলি। নির্বোধ, মানসিক প্রতিবন্ধী বা হাবাগোবা ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবে না। তিনি বুদ্ধি, ভাষা, শ্রুতি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হবেন না। এ ধরনের অসুস্থ মানুষ সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনে অক্ষম।
vi) ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী হওয়া
ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। তা না হলে ইসলামি নীতিমালা অনুসরণ করা সম্ভব হবে না। তাকে সমকালীন অন্যান্য শাসনব্যবস্থা এবং ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে।
vii) রাষ্ট্রের নাগরিক স্থায়ী অধিবাসী হওয়া
রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার জন্য তাকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দেশের স্থায়ী অধিবাসী হতে হবে। তাই কেউ স্থায়ী অধিবাসী না হলে তাঁর পক্ষে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। আর সাধারণ মানুষও বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না খ. নৈতিক বা চারিত্রিক গুণাবলি
খ) রাষ্ট্রপ্রধানের গুণাবলি
ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের চারিত্রিক বা নৈতিক গুণাবলি হবে নিম্নরূপ-
i) মুত্তাকি হওয়া
ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাকে মুত্তাকি হতে হবে। অল্লাহর অসন্তুষ্টির ভয়ে সব খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকাও মুত্তাকির উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য।
মহান আল্লাহ বলেন-
“তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী।”
(সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩)
ii) আমানতদার হওয়া
আমানত হলো কোনো বস্তুর যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা। এ গুণ ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষেই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। অতএব রাষ্ট্রপ্রধানকে পূর্ণ আমানতদারীর সাথে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
iii) পদলোভহীন হওয়া
ইসলামি জীবনব্যবস্থায় দায়িত্ব পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে দায়িত্বহীনতার জন্য জনগণের কাছে যেমন জবাবদিহি করতে হয়, তেমনি আখিরাতেও জাহান্নামের শাস্তির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। সেজন্য ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই পদলোভহীন হতে হবে।
iv) ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া
ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হবে। ন্যায়নীতি অবলম্বন ছাড়া সুষ্ঠু শাসন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ন্যায়নিষ্ঠবান ছাড়া বিচার ফয়সালা, দায়িত্ব বণ্টন, রাষ্ট্রপ্রধানকে সুপরামর্শ দেয়ার যোগ্য হতে পারে না।
v) ধীরস্থির ও শান্ত স্বভাবের হওয়া
ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ধীরস্থির ও শান্ত স্বভাবের হতে হবে। তাড়াহুড়ো করে কোনো কাজ করলে সে কাজ সুন্দরভাবে করা যায় না। তাছাড়া তাড়াহুড়ো করা শয়তানের স্বভাব। অস্থির প্রকৃতির মানুষের পক্ষে কোনো বিষয় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সুযোগ হয় না। ফলে তিনি কার্যকর দিকনির্দেশনা দিতেও ব্যর্থ হন।
vi) মানসিক দৃঢ়তাসম্পন্ন
রাষ্ট্রের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো মানসিক দৃঢ়তাসম্পন্ন ব্যক্তি হবেন ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। যেকোনো পরিস্থিতে ভেঙে না পড়ে এক অল্লাহর ওপর ভরসা রেখে দুনিয়াবি সব প্রচেষ্টা চালানোই তার দায়িত্ব। রাষ্ট্রপতি দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন না হলে রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানে তিনি ব্যর্থ হবেন।
গ) রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য
- ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান মহান অল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রাষ্ট্র ও জনগণের নেতা হিসেবে অল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে বাধ্য থাকেন।
- রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো অল্লাহর সার্বভৌমত্বের সংরক্ষণ করা। তথা অল্লাহর খিলাফতের মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে-দ্বীন ইসলামকে সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা। দ্বীনকে পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়িত করা, দ্বীনের মর্যাদা, ঐতিহ্য-আদর্শ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। আর এ কাজের জন্য প্রধান দায়িত্বশীল হচ্ছেন খলিফা।
- রাষ্ট্র প্রধানের কর্তব্য হচ্ছে বিবাদমান পক্ষসমূহের ওপর অল্লাহর বিধি-বিধান কার্যকর করা। ঝগড়া-বিবাদ ও যাবতীয় সমস্যার সমাধান ও ফয়সালায় ইসলামি আইন অনুসরণ করা।
- ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিকদের জীবনকে সকল প্রকারের ভয়ভীতি ও বিপদ-আশঙ্কা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করে স্বাধীন নির্বিঘেœ জীবনযাপনের নির্ভরযোগ্য সুযোগ দেয়া রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। বৈদেশিক ও বিজাতীয় আক্রমণ ও আগ্রাসন থেকে দেশকে, দেশের জনগণকে এবং তাদের জীবন-সম্পদ, মান-ইজ্জত রক্ষা করা। এজন্য প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন ও সামর্থ্য সংগ্রহ করা রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যতম কর্তব্য।
- সব নাগরিকের সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামি রাষ্ট্র সব মানুষের নিরাপত্তা বিধানকারী রাষ্ট্র। মুসলিমঅমুসলিম নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিক এখানে সমান নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী। রাষ্ট্রপ্রধান তাদের সবার জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করবেন।
- রাষ্ট্রের বায়তুল মাল সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যতম আরেকটি দায়িত্ব। বায়তুল মাল থেকে যাকে যা দেয়া হবে তার পরিমাণ নির্ধারণ করা। যথাযথভাবে তা দেয়ার ব্যবস্থা করা, অপচয় না করা ইত্যাদি রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যতম দায়িত্ব। প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের দায়িত্বশীল, নির্বাহী কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ, তাদের কাজে সুযোগ সৃষ্টি করা, তাদের নিকট থেকে কাজ বুঝে নেয়া, তাদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা করা খলিফার দায়িত্ব ও কর্তব্য।
- ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকদের জন্য মৌলিক ইবাদতসমূহ আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করবেন। ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রশাসন ও নাগরিক জীবনযাপনের সব পর্যায়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ইসলামি বিধান মেনে চলতে গিয়ে নাগরিকরা যেন কোনো বাধার সম্মুখীন না হন তিনি তার নিশ্চয়তা বিধান করবেন।
- সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজের নিষেধ করার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধান অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। মহান অল্লাহ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অংশ হিসেবেই তাদেরকে এ কাজে আঞ্জাম দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ঘ) সার সংক্ষেপ
- ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ইমানদার, পুরুষ, স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবান হতে হবে। ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর জনগণের কল্যাণ নিহিত; তাই জনগণ নেতা নির্বাচনে অবশ্যই এ গুণাবলির প্রতি যত্ন বান হবেন।
- ইসলামি রাষ্ট্রের সামগ্রিক সংরক্ষণ, নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রের কল্যাণ, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা, প্রশাসনিক কর্মকা- পরিচালনা সর্বোপরি অল্লাহর বিধান জারি ও সংরক্ষণ করাই রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
(৪) মজলিসে শূরার সদস্যদের যোগ্যতা ও গুণাবলি এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ক) মজলিসে শূরার পরিচয়
মজলিসে শূরা ( َم ْجلِ ُس ُّ الش ْو ٰري) এর অর্থ মন্ত্রণা সভা, পরামর্শ সভা, পরামর্শ ও পর্যালোচনা সংস্থা প্রভৃতি।
ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনায় যে সংস্থা রাষ্ট্র পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে পরামর্শ প্রদান করে তাই মজলিসে শূরা।
খ) মজলিসে শূরার সদস্যদের যোগ্যতা
ইসলামি রাষ্ট্রে মজলিসে শূরা একটি অপরিহার্য নীতিনির্ধারনী উচ্চপরিষদ যা জাতীয় সংসদ বিশেষ। মজলিসে শূরার সদস্য যে কেউ হতে পারে না। মজলিসে শূরার সদস্যদের কিছু অনিবার্য যোগ্যতা ও গুণাবলি থাকা দরকার।
শূরা সদস্যদের জন্য যে যোগ্যতা ও গুণাবলি নির্ধারণ করা হয়েছে তা দু’রকমের, একটি হচ্ছে আইনগত অপরটি নৈতিক। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো-
i) আইনগত যোগ্যতা ও গুণাবলি
ইসলামি রাষ্ট্রের মজলিসে শূরার সদস্যদের আইনগত গুণাবলি নিম্নরূপ-
ii) মুসলিম হওয়া
মজলিসে শূরার সদস্য মুসলিম হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাজের গুরুদায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত হয়। মুসলিম ছাড়া তাদের উপর এসব গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা যায় না। আল-কুরআনে ঘোষণা এসেছেÑ
“অল্লাহ অঙ্গীকার করেছেন যে, তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে ও সৎকাজ করেছেন অবশ্যই তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেন।”
(সূরা নূর ২২:৫৫)
iii) প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া
মজলিসে শূরার সদস্যকে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু বা কিশোর মজলিসে শূরার সদস্য হতে পারে না। শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার মত উপযুক্ত বয়স থাকতে হবে। প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ রাষ্ট্র পরিচালনায় পরামর্শ প্রদানে অক্ষম।
iv) সুস্থ হওয়া
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য মজলিসে শূরার সদস্যকে অবশ্যই শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। দায়িত্ব পালনে অক্ষম এমন কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মজলিসে শূরার সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তাই রাষ্ট্রকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করানোর জন্য তাঁদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকতে হবে।
v) সুস্থ বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া
সুস্থ বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন ইসলামি রাষ্ট্রের মজলিসে শূরার সদস্যদের অন্যতম গুণাবলি। নির্বোধ, মানসিক প্রতিবন্ধী বা হাবাগোবা ব্যক্তি মজলিসে শূরার সদস্য হতে পারে না। তিনি বুদ্ধি, ভাষা, শ্রুতি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হবেন না।
vi) ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী হওয়া
মজলিসে শূরার সদস্যকে ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য অবশ্যই ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। তা না হলে ইসলামি নীতিমালা অনুসরণ করা সম্ভব হবে না। তাদের সমকালীন অন্যান্য শাসনব্যবস্থা এবং ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
vii) স্থায়ী অধিবাসী হওয়া
মজলিসে শূরার সদস্য হওয়ার জন্য তাকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দেশের স্থায়ী অধিবাসী হতে হবে। তাই কেউ স্থায়ী অধিবাসী না হলে তার পক্ষে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। আর সাধারণ মানুষও বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না
খ) মজলিসে শূরার সদস্যদের গুণাবলি
ইসলামি রাষ্ট্রের মজলিসে শূরার সদস্যদের নৈতিক গুণাবলি নিম্নরূপ-
i) মুত্তাকি হওয়া
মজলিসে শূরার সদস্যদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাকে মুত্তাকি হতে হবে। আল্লাহর অসন্তুষ্টির ভয়ে সব খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকাও মুত্তাকির উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য।
মহান অল্লাহ বলেন,
“তোমদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি অল্লাহ ভীরু, অল্লাহর নিকট সেই সবচেয়ে বেশি সম্মানিত।”
(সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩)
ii) আমানতদার হওয়া
আমানত হলো কোনো বস্তুর যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা। এ গুণ ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষেই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। অতএব মজলিসে শূরার সদস্যকে পূর্ণ আমানতদারির সাথে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
iii) পদলোভহীন হওয়া
ইসলামি জীবনব্যবস্থায় দায়িত্ব পালন করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে দায়িত্বহীনতার জন্য জনগণের কাছে যেমন জবাবদিহি করতে হয়, তেমনি আখিরাতেও জাহান্নামের আগুনের শাস্তির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। সে জন্য মজলিসে শূরার সদস্যকে অবশ্যই পদলোভহীন হতে হবে।
iv) ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া
মজলিসে শূরার সদস্য অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হবে। ন্যায়নীতি অবলম্বন ছাড়া সুষ্ঠু শাসন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ন্যায়নিষ্ঠবান ছাড়া বিচার ফয়সালা, দায়িত্ব বণ্টন, রাষ্ট্রপ্রধানকে সুপরামর্শ দেয়ার যোগ্য হতে পারে না।
v) ধীরস্থির ও শান্ত স্বভাবের হওয়া
মজলিসে শূরার সদস্য ধীরস্থির ও শান্ত স্বভাবের হতে হবে। তাড়াহুড়ো করে কোনো কাজ করলে সে কাজ সুন্দরভাবে করা যায় না। তাছাড়া তাড়াহুড়ো করা শয়তানের স্বভাব। অস্থির প্রকৃতির মানুষের পক্ষে কোনো বিষয় সুস্থভাবে সম্পন্ন করার সুযোগ হয়না। ফলে তিনি কার্যকর দিকনির্দেশনা দিতেও ব্যর্থ হন।
vi) মানসিক দৃঢ়তাসম্পন্ন
রাষ্ট্রের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো মানসিক দৃঢ়তাসম্পন্ন ব্যক্তি হবেন মজলিসে শূরার সদস্য। যেকোনো পরিস্থিতে ভেঙে না পড়ে এক আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে দুনিয়াবি সব প্রচেষ্টা চালানোই তার দায়িত্ব। .
গ) মজলিসে শূরার দায়িত্ব ও কর্তব্য
- ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও মজলিসে শূরার সদস্যগণ জনগণের খাদেম তথা সেবক। জনগণের স্বার্থ, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে ভাবাই তাদের কাজ। কুরআন ও হাদিসের ঘোষণানুযায়ী সমগ্র জাতির ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পরামর্শ দানই হলো মজলিসে শূরার প্রধান কাজ।
- মজলিসে শূরা শাসক, প্রশাসক ও দায়িত্বশীল যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তার কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। কেননা, ইসলামি রাষ্ট্রের যেকোনো পর্যায়ের শাসক ও কর্মকর্তা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। কেউ কোনো কাজের সঠিক ব্যাখ্যাদানে অপারগ হলে এ পরিষদ তার কারণ খতিয়ে দেখবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খলিফাকে পরামর্শ দিবে।
- সব সৎ কাজে রাষ্ট্র প্রধানকে সাহায্য করা মজলিসে শূরার সদস্যদের অপরিহার্য কর্তব্য। মজলিসে শূরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মধ্যে রয়েছে অন্যায় ও গুনাহের কাজে খলিফাকে সংশোধনমূলক পরামর্শ দেয়।
- কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা যে সব বিধিবিধান প্রবর্তিত এ সব বিধি-বিধান মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ওহির মাধ্যমে অবতীর্ণ। এ সব বিধান কোন কালে কোন অবস্থার প্রেক্ষিতেই পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। তাই এগুলোকে স্থায়ী বিধান বলা হয়। আইন বিভাগের কাজ হলো এ সব মূলনীতি অনুসন্ধান করা। এ বিভাগ সবসময় এ কাজে নিষ্ঠার সাথে নিয়োজিত থাকবে।
- ইসলামি রাষ্ট্রের আইন বিভাগ মজলিসে শূরার সদস্যদের সাহায্য নিয়ে আইন পর্যালোচনা করে এর প্রেক্ষিত ও উপযোগিতা নির্ধারণ করবে। এ বিভাগ ধারাবদ্ধ ও অনুসন্ধানসূত্রে প্রাপ্ত আইনসমূহের যথার্থতা মূল্যায়ন করবে এবং এ উদ্দেশ্যে গভীর চিন্তা ও পরামর্শ গ্রহণ করবে।
- মজলিসে শূরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। ধনী-গরিব, ছোট, বড়, মুসলিম, অমুসলিম, সাদা, কালো শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষ যাতে সুবিচার পেতে পারে মজলিসে শূরা তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সে অধিকার রক্ষা করবে।
ঘ) সার সংক্ষেপ
- ইসলামি রাষ্ট্রে মজলিসে শূরা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারনী উচ্চপরিষদ। ইসলামি রাষ্ট্রের সাফল্য সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে। তাই ইসলামি রাষ্ট্রের মজলিসে শূরার সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে আইনগত ও নৈতিক গুণাবলিকে সর্বাধিক বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
- এর কোন সদস্যই বংশীয় আভিজাত্য বা প্রাচুর্যের কারণে নির্বাচিত হন না। তারা যথাযথ যোগ্যতার মাপকাঠিতে মজলিসে শূরার সদস্য হন। এ শূরার প্রত্যেক সদস্যই স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকারী। সরকার পরিচালনায় এ শূরার ভূমিকা ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ।
(৫) নাগরিক, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
ক) নাগরিকের পরিচয়
আভিধানিক দৃষ্টিকোণে নাগরিক (Citizen) শব্দের অর্থ নগর বা শহরের অধিবাসী।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল বলেছেন, যিনি নগর রাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তাকেই নাগরিক বলে।
ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক। মুসলিম-অমুসলিম সবাই এ রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে।
খ) নাগরিকদের অধিকার
ইসলামি রাষ্ট্রে গোষ্ঠী-বর্ণ নির্বিশেষে সব মুসলিম নাগরিক রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সমান অধিকারসম্পন্ন। নাগরিক অধিকার পর্যায়ে নিম্নলিখিত অধিকারসমূহ গণ্য হয়ে থাকে- এক. সামাজিক অধিকার, দুই. অর্থনৈতিক অধিকার ও তিন. রাজনৈতিক অধিকার।
i) সামাজিক অধিকার
- মানুষের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন জীবনের নিরাপত্তা লাভ। ইসলাম নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে।
মহান অল্লাহ বলেন,
“আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করবে না।”
(সূরা আনআম ৬:১৫১)
- জীবনের নিরাপত্তার সাথে ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তাও জড়িত। ইসলামি রাষ্ট্রে নাগরিকদের মান-সম্মান ও ইজ্জত-আবরুর পূর্ণ নিরাপত্তা থাকবে। ইসলামি রাষ্ট্র নাগরিকের ইজ্জত-সম্মান পূর্ণরূপে সংরক্ষণ করবে।
- ইসলাম নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে। বিনা বিচারে বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কাউকে আটক করা কিংবা শাস্তি দেয়া যাবে না। যেকোনো শাস্তির ক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও তাকে দিতে হবে।
- ইসলামি রাষ্ট্রে সব নাগরিকের নিরাপদ বসবাস করার অধিকার সংরক্ষিত। নাগরিকগণ নিজ নিজ ইচ্ছামত রাষ্ট্রের যে কোনো স্থানে অবাধে বসবাস করতে পারবে। তাতে রাষ্ট্র বা সরকার ঘোষিত কোনো রূপ বাধা দিতে পারবে না।
- ইসলামি রাষ্ট্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কেউ কারো ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে পারবে না।
- ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিকগণ আইনগত সাম্যের অধিকার পাবে। আইনগত সাম্য অর্থ সব নাগরিক, ধনী-গরিব, অভিজাতনীচ বংশজাত, উচ্চ ও নিম্নস্থ কর্মচারী, শাসক ও শাসিত সকলেই আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সমান ও অভিন্ন। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
- প্রত্যেক নাগরিক নিজের ইচ্ছামত ইসলামের সীমারেখা বজায় রেখে সংসার, ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা লাভ করবে। বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠনের অধিকার প্রত্যেকের রয়েছে।
- শিক্ষা সম্পর্কে ইসলামের নীতি ও আদর্শ যেকোনো রূপ সরকার অপেক্ষা অধিকতর দৃঢ় ও বলিষ্ঠ। ইসলামি রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিক শিক্ষা লাভের অধিকার পাবে।
রাসূলে করীম (সাঃ) -এর ঘোষণা,
“ইলম (জ্ঞান) অন্বেষণ প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরয।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ)
ii) অর্থনৈতিক অধিকার
- রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিকগণ বিভিন্ন অর্থনৈতিক অধিকার ভোগ করে থাকে। উপার্জনের অবাধ অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনের যেকোনো বৈধ উপায় এবং পেশা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এ ব্যাপারে নাগরিকদের মধ্যে কোনোরূপ বৈষম্য বা তারতম্য সৃষ্টির কারো অধিকার নেই।
- প্রত্যেক নাগরিকের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা অনুসারে রোজগারের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার দায়িত্ব সরকারের।
- ইসলামি রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিক খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা লাভের পূর্ণ অধিকার লাভ করবে। কেউ অসমর্থ হলে সরকার তার ব্যবস্থা করবে।
- ইসলামি রাষ্ট্র নিঃস্বদের অধিকার নিশ্চিত করবে। ইসলামি রাষ্ট্রে ফকির, মিসকিন, অভাবী ও অক্ষম নাগরিকদের বিশেষ অধিকার রয়েছে।
- ইসলাম সমাজের বিত্তশালীদের সম্পদে তাদের প্রাপ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।
- ইসলামি রাষ্ট্রে নাগরিকের হালাল উপার্জনের পূর্ণ অধিকার থাকবে। রাষ্ট্রের এমন কোনো রীতিনীতি বা বিধিবিধান থাকবে না যাতে তাকে হারাম উপার্জনে বাধ্য হতে হয়। এমন অব্যবস্থা দূর করে ইসলামি রাষ্ট্র তার নাগরিকের হালাল উপার্জনের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখবে।
iii) রাজনৈতিক অধিকার
- রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিকগণ বিভিন্ন রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে থাকে। ইসলামি রাষ্ট্র পরমার্শভিত্তিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেকটি বয়স্ক, সুস্থ, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম নাগরিকই সকল গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মতামত ও রায় প্রকাশের অধিকারী।
- ইসলামি রাষ্ট্রে যেকোনো নাগরিক একক বা যৌথভাবে তাদের যেকোনো অভাব-অভিযোগের কথা সরকারের নিকট পেশ করতে পারে।
- মুসলিম জনগণের মতামত বা ভোট না নিয়ে ইসলামি রাষ্ট্রের কোনো পদ দখল করার অধিকার কারো নেই। সুতরাং ভোটাধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
- নাগরিকগণ মহৎ ও কল্যাণে প্রত্যেক নাগরিকগণের সংঘটিত হবার অধিকার রয়েছে। নাগরিকগণ মহৎ ও কল্যাণকর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভা সমিতিতে যোগদানের অধিকার রাখে।
- সরকারের হিসাব-নিকাশ গ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শের দৃষ্টিতে সরকার ও সরকার পরিচালকদের সমালোচনা করা নাগরিকদের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
- ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিবৃত্ত করার জন্য সমালোচনার অধিকার নাগরিকগণের আছে।
গ) নাগরিকের কর্তব্যসমূহ
অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর জড়িত। নাগরিকের কল্যাণের জন্যই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য পালন করতে হয়। যেমন-
- প্রত্যেক নাগরিকেরই সর্বপ্রথম ও বুনয়াদি কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের আনুগত্য করা। আনুগত্য ব্যতীত কেউ কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক বলে দাবি করতে পারে না।
- রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন পুরোপুরি পালন করা নাগরিকদের কর্তব্য। আইন পালিত না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। নিজে আইন পালন এবং অপরকে আইন মানার জন্য উদ্বুদ্ধ করা নাগরিকের কর্তব্য।
- যাবতীয় রাষ্ট্রীয় পাওনা আদায় করা, রাজস্ব ও অন্যান্য পাওনা সঠিক সময়ে সরকারি তহবিলে জমা করাও নাগরিকদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। ইসলামি রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যখন যাকাত বা উশর দেয়ার যোগ্য হন, তখন কোনো বাহ্যিক চাপ বা রাষ্ট্রীয় কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাকাত ও উশর আদায় করে দেন।
- দেশের প্রতিরক্ষায় এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নাগরিকগণ তাদের জান মাল দ্বারা সর্বত্রভাবে রাষ্ট্রের সাহায্য করবে।
- রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য সরকার যাকে যে দায়িত্ব দেন কিংবা যে কর্মচারীকে যেখানে নিযুক্ত করেন তা মেনে নেওয়া ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনও নাগরিকদের কর্তব্য।
ঘ) সার সংক্ষেপ
- ইসলামি রাষ্ট্র মুসলিম জাতির স্বাধীন অস্তিত্ব ও ঐতিহ্যের সংরক্ষক। ইসলামি রাষ্ট্রে নাগরিক সব অধিকার ভোগ করেন। রাষ্ট্র প্রদত্ত সেবা ও সুযোগ গ্রহণ করেন।
- স্বাভাবিকভাবে তাই রাষ্ট্রের প্রতিও নাগরিকের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন অনিবার্য হয়ে পড়ে। নাগরিকের কর্তব্য পালন যথাযথ হলে রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা হবে এবং নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা রক্ষিত হবে। তাই নাগরিকের দায়িত্ব-কর্তব্যের গুরুত্ব অপসিরীম।
(৬) ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকের অধিকার
ক) অমুসলিম নাগরিক
ইসলামী রাষ্ট্রে মুলিম নাগরিকদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও সব ধরণের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে। ইসলামি রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকগণ তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন-
এক. অনুগত অমুসলিম নাগরিক: জন্মগত বা আনুগত্য স্বীকার করে ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম নাগরিক
দুই. চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক: যুদ্ধ ছাড়া অথবা যুদ্ধ চলাকালে আশ্রিত হিসেবে কোনো অমুসলিম ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাস করতে সম্মত হয়ে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে চলে এলে তাকে চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম বলে।
তিন. যুদ্ধে বিজিত অমুসলিম নাগরিক: তৃতীয় প্রকারের অমুসলিম নাগরিক হচ্ছে যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং তাদের ভূমি ইসলামি বাহিনীর করায়ত্তে এসেছে। অতএব যে প্রকারের অমুসলিম নাগরিক হোক না কেন, তারা স্ব স্ব ধর্ম পালন ও জীবন সম্পদের সমান নিরাপত্তা লাভ করবে এবং সকল নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।
খ) ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার
ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকগণও বিভিন্ন অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করে থাকে। যেমন-
ইসলাম মানুষকে যেমন মর্যাদাবান করেছে; তেমনি সব মানুষের জীবন, রক্ত, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তাও প্রদান করেছে। তাদের জীবন, সম্পদ, সম্মানের নিরাপত্তা হরণ করা বৈধ নয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করবে না।”
(সূরা আন’আম ৬:১৫)
তারা পারিবারিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার ব্যাপারে নিজ নিজ ধর্মের বিধান অনুসরণের অধিকার পাবে।
ইসলামের অনিন্দ্য সুন্দর আচরণে অভিভূত হয়ে যুগে যুগে অমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইসলাম সবার সাথে উত্তম আচরণ করতে নির্দেশ দেয়। মৌলিক ও সামাজিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য করে না।
মুসলিম নাগরিকের মত একজন অমুসলিমও রাষ্ট্রীয় আইনের আশ্রয় প্রার্থনা করার অধিকার রাখে। ইসলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমির, ফকির, শিক্ষিত, মূর্খ, মুসলিম, অমুসলিমদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ রাখেনি।
স্বজনপ্রীতি অথবা গোত্র, বর্ণ, ধর্ম বিশেষের পক্ষপাতিত্ব করা সম্পূর্ণ রূপে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের সমান অধিকার রয়েছে।
ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমদেরকে তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো চিন্তা, বিশ্বাস, ধর্ম অবলম্বনে বাধ্য করা যাবে না। দেশের প্রচলিত আইনের বিরোধী নয়, এমন যেকোনো কাজ তারা আপন ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে করতে পারবে। তাই তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা বা চাপ দেয়া যাবে না। .
মহান আল্লাহ বলেন,
“দ্বীন সম্পর্কে কোন জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই।”
(সূরা বাকারা ২:২৫৬)
ইসলামি রাষ্ট্র গোটা দেশের জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করবে, তাদেরকে সে শিক্ষা ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ইসলামের ধর্মীয় পুস্তকাদি পড়তে তাদেরকে বাধ্য করা যাবে না।
গ) সার সংক্ষেপ
- ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করে। অমুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে নিষেধ করে। তাই ইসলামি রাষ্ট্রে তাদের সমতার অধিকার নিশ্চিত হয়।
- ইসলাম অমুসলিমদের মানবিক মর্যাদা ঘোষণার মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা লাভের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। তাদের জান, মাল, ইজ্জত, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানসহ প্রতিটি ব্যাপারে স্বাধীনতা পাবে। এক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকগণ কোনো রকমের ব নার শিকার হবে না।
(৭) মদিনা সনদ: ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় মদিনা সনদের গুরুত্ব
ক) মদিনার সনদের পরিচয়
বিশ্বের সবকিছুই কোনো না কোনো আইন বা বিধিবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যুগে যুগে রাষ্ট্র পরিচালনা, বিভিন্ন সংস্থা পরিচালনার জন্য প্রণীত হয়েছে বিভিন্ন সনদ বা সংবিধান। আর পৃথিবীর প্রথম সংবিধান হলো মদিনা সনদ।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দে এ সনদ প্রণীত হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মদিনার তিনটি স্বতন্ত্র জাতি। আহলে কিতাব ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক এবং মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও মিত্রতা বজায় রাখার মানসে স্বাক্ষরিত চুক্তিই মদিনা সনদ নামে পরিচিত।
খ) মদিনা সনদের ধারা
মদিনা সনদে ৫৩টি ধারা রয়েছে। অন্য বর্ণনা মতে, এ সনদের ধারা ৪৭ অথবা ৫২টি। এ সনদের উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ নিম্নরূপ-
- মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সাধারণ জাতি তথা কমনওয়েলথ গঠন করবে।
- হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নবগঠিত প্রজাতন্ত্রের সভাপতি এবং পদাধিকার বলে তিনি মদিনার সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বময় কর্তা হবেন।
- পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে। মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায় নির্বিঘেœ নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
- কেউ কুরাইশদের সাথে কোনো প্রকার সন্ধি স্থাপন করতে পারবে না, কিংবা মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কুরাইশদের সাহায্য করতে পারবে না।
- স্বাক্ষরকারী কোনো সম্প্রদায়কে বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে, সব সম্প্রদায়ের লোকেরা সমবেত প্রচেষ্টায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করবে।
- বহিঃশত্রু আক্রমণে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ স্ব-স্ব যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করবে। যুদ্ধের খরচ কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী এককভাবে বহন করবে না। এতে যৌথ প্রচেষ্টার পথ সুদৃঢ় হয়।
- স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই গণ্য হবে। এর জন্য সম্প্রদায়কে দোষী করা চলবে না।
- মদিনার পবিত্রতা ঘোষণা করা হলো। রক্তপাত, হত্যা, বলাৎকার ও অপরাপর অপরাধমূলক কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হলো।
- অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সর্বপ্রকার পাপী বা অপরাধীকে ঘৃণার চোখে দেখতে হবে।
- ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। মদিনা সনদ ইহুদিদের প্রতি সুবিচারের পথ নির্দেশ করে। ইহুদি ও তাদের মিত্ররাও সনদের বিধানের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয়। তাদের নিরাপত্তার বিধান করা হয়।
- দুর্বল ও অসহায়কে সর্বতোভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে। মদিনা সনদ শুধু সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলার দিকে নজর রাখত না; বরং সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের উপকার সাধিত হয় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
- মহানবি (সা.)-এর অনুমতি ব্যতীত মদিনাবাসীরা কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
১৩. স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে রসূলুল্লাহ (সাঃ) অল্লাহর বিধান অনুযায়ী তার মীমাংসা করবেন।
১৪. সর্বশেষ এই বলে শেষ করা হয় যে, সনদের শর্ত ভঙ্গকারীর ওপর অল্লাহর লানত বর্ষিত হবে।
খ) ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় মদিনা সনদের গুরুত্ব
- ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় মদিনা সনদের গুরুত্ব খুব বেশি। মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। মহানবি (সাঃ) সর্বপ্রথম জনগণের কল্যানাকল্যাণ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রীয় শাসনে দেশের সব সম্প্রদায় ও জনগণের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তিনি এই সনদ প্রণয়ন করেন।
- মদিনা সনদ মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়কে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে হিংসা, দ্বেষ ও কলহের অবসান ঘটায়। বিপদে একে অপরকে সাহায্য করার জন্য তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। মদিনা রাষ্ট্র তথা ইসলামি প্রজাতন্ত্র সংরক্ষণে সবার সমভাবে যুদ্ধব্যয় বহন করার ব্যবস্থা, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক।
- মদিনা সনদ গোত্র প্রথার বিলোপসাধন করে ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মীয় অনুশাসন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে।
- অধ্যাপক পি. কে. হিট্টি বলেন, মদিনা প্রজাতন্ত্রই পরবর্তীকালে বৃহত্তম ইসলামি সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল স্থাপন করে। মদিনা সনদ মুসলমান ও অমুসলমানদের ধর্মে পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিশ্চয়তা বিধান করে। মদিনার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরা একে অপরের ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ শর্ত দ্বারা যে মহানুভবতা ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন, তা বিশ্বের ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
- মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবি (সাঃ) দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত আরব জাহানকে একতাবদ্ধ করার একটি মহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মদিনা নগরীর পুনর্গঠনের প্রয়াস পান।
- মদিনা সনদ প্রণীত হওয়ায় শতধাবিভক্ত মদিনাবাসী শান্তি-শৃঙ্খলায় ফিরে পায়। জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারিত হয়। মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি এ সনদের ফলেই গড়ে ওঠে।
গ) সার সংক্ষেপ
- মদিনা সনদ ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহানবি (সাঃ) মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে মদিনার ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক, আনসার ও মুহাজিরদের নিয়ে একটি বহুজাতিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করেন। আর এ কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের চুক্তিই হলো ঐতিহাসিক মদিনা সনদ।
- এ সনদের মাধ্যমে মদিনাবাসী সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য স্থাপিত হয়। উক্ত সংবিধানে সাম্যের মহান নীতি, আইনের শাসন, ধর্মের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ঘোষণা করা হয়। সর্বোপরি এ সনদের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]