Skip to content

 

ইসলাম ও পারিবারিক জীবন

ইসলাম ও পারিবারিক জীবন

ইসলাম পৃথিবীতে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যেখানে মানুষের জীবনের প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে। পারিবারিক জীবন কেমন হবে সে ব্যাপারে ইসলামের রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি।

একজন নারী-পুরুষ কীভাবে দাম্পত্য জীবন শুরু করবে, একে অন্যের প্রতি কর্তব্য কী হবে, নিজেদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে কিভাবে তার সমাধান করবে ইত্যাদি সকল বিষয়ে ইসলামের রয়েছে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা।

(১) ইসলামি পরিবারের পরিচয়

ক) পরিবার

পরিরিবার মানব সমাজের প্রাথমিক ভিত্তি এবং মানব সভ্যতার সূচনাগার।

পরিবার এর ধারণা দিতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইবার বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মিলনের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালনের অতি সংক্ষিপ্ত অথচ স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পরিবার।

মনীষী অ্যারিস্টটলের মতে, পরিবার একটি অতি স্বাভাবিক মানবীয় সংস্থা। কেননা এর মূল নিহিত রয়েছে মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনের গভীরে।

খ) ইসলামি পরিবার

ইসলামি পরিবারের সংজ্ঞা হচ্ছে, যে পরিবার ইসলামি ভাবধারা, ইসলামি নীতিমালা ও ইসলামি বিধি-বিধানের ভিত্তিতে গড়ে উঠে এবং পরিচালিত হয় তাকে ইসলামি পরিবার বলে।

ইসলামি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকেই মুসলিম হতে হবে। অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামি পরিবারের সদস্য হতে পারবে না। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে তা ইসলামি পরিবার হবে না। এমনিভাবে পরিবারের সন্তানাদি বা অন্য কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ না করে বা ত্যাগ করে, তখন সে আর ইসলামি পরিবারের সদস্য থাকবে না।

প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম (আ) এবং তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া (আ) এর মাধ্যমে প্রথম পরিবার গঠিত হয়।

পবিত্র কুরআনের বাণী অনুযায়ী এ প্রথম পরিবারের সদস্যদ্বয়কে লক্ষ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছে স্বাচ্ছন্দে আহার কর।”

(সূরা বাকারা ২:৩৫)

এভাবেই গড়ে উঠেছিল মানব ইতিহাসের প্রথম ও আদি পরিবার। আর এ পরিবার থেকেই বিশ্বময় কালক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে অগণিত মানব-মানবী।

মানব পরিবার গঠন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

“বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে।”

(সুরা নিসা ৪:৩)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,

“বিবাহ হচ্ছে আমার সুন্নাত, যে আমার সুন্নাত মোতাবেক আমল করে না সে আমার উম্মত নয়।”

(মুসনাদে আহমদ)

নর-নারীর মধ্যে বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠন করা হয়। যা বিশ্বপ্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশ্বপ্রকৃতির সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলা জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেছেন জোড়া জোড়া করে।”

(সূরা ইয়াসিন ৩৬:৩৬)

সারসংক্ষেপ:

  • সামাজিক জীব হিসেবে সুখে শান্তিতে বসবাস করার প্রচেষ্টা মানুষের স্বভাব। হযরত আদম (আ) ও হযরত হাওয়া (আ) এর মাধ্যমে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছিল প্রথম পরিবার। সেখান থেকে ধীরে ধীরে উৎসারিত হয়েছে অগণিত মানব সংসার।
  • সমাজ জীবনের প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে পরিবার। পারিবারিক পবিত্রতা ও সুস্থতার উপরই নির্ভর করে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বময় মানব জাতির পবিত্রতা ও সুস্থতা।

(২) ইসলামি পরিবারের বৈশিষ্ট্য

বিয়ে ও দাম্পত্য জীবন বিশ্ব প্রকৃতির এক স্বভাব সম্মত বিধান। এটা এক চিরন্তন ও শাশ্বত ব্যবস্থা যা কার্যকর রয়েছে বিশ্ব প্রকৃতির প্রতিটি জীব ও জড়বস্তুর মধ্যেও।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“প্রত্যেক বস্তু আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি”।

(সূরা যারিয়াত৫১:৪৯)

ক) কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক

ইসলামি পরিবার কুরআন সুন্নাহর নীতির ভিত্তিতে তথা ইসলামি জীবন বিধান অনুসারে গড়া। আল্লাহর বিধানের আওতায়ই স্বামীস্ত্রী দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং সন্তান জন্মদান করে। আর এ বিধানের আলোকেই একে অন্যের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে থাকে।

ইসলাম পারিবারিক জীবনে পুরুষকে পরিবারের কর্তা বা অভিভাবক নিযুক্ত করে তার উপর ভরণ-পোষণ, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার দায়দায়িত্ব অর্পণ করেছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“পুরুষরা নারীদের কর্তা।”

(সূরা নিসা ৪:৩৪)

পারস্পরিক দায়িত্বসম্পন্ন মুসলিম পরিবারের প্রত্যেক সদস্যেরই যথারীতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। পরিবার প্রধান ইসলামি ভাবধারায় পরিবার পরিচালনা করবে। +

মহানবী (স) বলেন,

“ব্যক্তি তার পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল। সুতরাং সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”

(মুসলিম)

ভক্তি-সম্মান ও স্নেহ-মমতাসম্পন্ন মুসলিম পরিবার ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল সদস্যের প্রতি দাবী করে শ্রেণিমত ভক্তি- সম্মান, শ্রদ্ধা আদর-স্নেহ এবং মমতামাখা আচরণ। বড়রা ছোটদের স্নেহের পরশ দিয়ে মানুষরূপে গড়ে তুলবে। আর ছোটরা বড়দের সাথে সম্মান দিয়ে তাদের মেনে চলবে।

আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাযুক্ত পরিবারবিহীন মহা শূন্যতা ও নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে নোঙরবিহীন নৌকার মতো স্থিতিহীন করে দেয়। তাই ইসলামি পরিবারে প্রত্যেকে সামর্থ অনুযায়ী কাজ করে এবং একটি যৌথ তহবিল গঠন করে। ফলে, ইসলামি পরিবারে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বিদ্যমান থাকে।

খ) জবাবদিহিমূলক

ইসলামি পরিবার একটি জবাবদিহিমূলক দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। পরিবারের সকলের কাজ কর্মের এবং অধিকার ও কর্তব্যের যেমন পরিবারে জবাবদিহি করতে হয়, তেমনি আল্লাহর দরবারেও জবাবদিহি করতে হবে।

গ) মানবতার প্রশিক্ষণালয়

ইসলামি পরিবারে শিশুদের স্নেহ, মমতা, ভক্তি-শ্রদ্ধা,সুন্দর আচরণ, সহানুভূতি, সমবেদনা, উদারতা, ত্যাগ ইত্যাদি সামাজিক মানবীয় গুণাবলির প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে।

পারিবারিক জীবনে ছোট-বড় সকল সদস্যের নৈতিক চরিত্র গঠন ও উৎকর্ষ সাধনের এক বিশেষ সুযোগ রয়েছে। সন্তানকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলার এটাই হলো শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান।

সারসংক্ষেপ:

পরিবার হচ্ছে সমাজ জীবনের প্রথম ভিত্তি ও প্রাথমিক একটি প্রতিষ্ঠান। আদর্শ সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য পারিবারিক জীবন অত্যন্ত জরুরি। একটি আদর্শ পরিবার গঠনে যে সব উপায় উপকরণ দরকার তার সব কিছুই ইসলামে বিদ্যমান। তাই ইসলামি পরিবার প্রথা এক অনিবার্য শাশ্বত ব্যবস্থা যা মানব সভ্যতার রক্ষাকবচ।

(৩) ইসলামি পরিবারের প্রয়োজনীয়তা

সুষ্ঠু,সুন্দর, সুখী ও সমৃদ্ধশালী আদর্শ জাতি ও সমাজ বিনির্মাণ ইসলামি পারিবারিক জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

আদর্শ জাতি গঠনের জন্য আদর্শ পারিবারিক জীবন অপরিহার্য। প্রাথমিককালে মুসলিম জাতির যে অভ্যুদয় ঘটে তার মূলে ছিল পারিবারিক দৃঢ়ভিত্তি এবং পারিবারিক জীবনের সুস্থতা ও পবিত্রতা। সুতরাং পারিবারিক জীবনই হল ইসলামি সমাজের রক্ষাদুর্গ।

ক) সমাজ জীবনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান

বৃহত্তর সমাজজীবনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান পরিবার। ব্যক্তি জীবনে যে সব সৎ গুণ অর্জন করা হয়, পারিবারিক জীবনেই তার পরিচর্যা হয়ে থাকে।

ব্যক্তি জীবন ভালো না হলে যেমন ভালো পরিবার গঠিত হয় না, তেমনি ভালো পরিবার না হলে,আদর্শ ও সুন্দর সমাজ গঠিত হয় না।

ইসলামি পরিবারে বল্গাহীনতা,দায়িত্বহীনতা এবং উচ্ছৃঙ্খলার কোন স্থান নেই। ধৈর্য,সহিষ্ণুতা,সমঝোতা, সহযোগিতা,স্নেহ-মমতা,প্রেম-প্রীতি,শ্রদ্ধা,ভালোবাসা ইত্যাদি গুণাবলি আদর্শ সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত। আর এ সব গুণের অনুশীলন ও পরিচর্যা পরিবারেই হয়ে থাকে।

সুতরাং ইসলামি সমাজ গঠনে ইসলামি পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম।

খ) মানব জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য

মানব জীবনকে পরিপূর্ণতা দান, মানব সৃষ্টির ধারা অব্যাহত রাখার জন্যে এবং তাদের ওপর খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা আদম ও হাওয়া (আ)-কে সৃষ্টি করেছিলেন। আর তাদের মধ্যে এক মধুর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।

সৃষ্টির শুরু থেকেই নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক, একে অপরের ভূষণ। এ পবিত্র উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ আদম (আ)-এর দেহের অংশ থেকে হাওয়া (আ)-কে সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহ তা’আলা বলেন,

“হে মানবম-লী ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তিহতে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তার হতে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দুইজনহতে বহু নর-নারী ছড়িয় দেন।”

(সূরা নিসা ৪:১)

গ) পূত-পবিত্র জীবন যাপনের জন্য

ইসলামি পারিবারিক জীবন নারী-পুরুষকে কুপ্রবৃত্তি, অশ্লীলতা, ব্যভিচার, উচ্ছৃঙ্খলতা ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে।

মহান আল্লাহর বাণী,

“তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ।”

(সূরা বাকারা ২:১৮৭)

গ) সুশৃঙ্খল জীবনের জন্য

সমাজে সুখে শান্তিতে সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য পরিবার এবং পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম পরিবারের ভূমিকা আরও বেশি।

পারিবারিক জীবন মানুষের কুপ্রবৃত্তি, পশুবৃত্তি,উচ্ছৃঙ্খলতা,সীমালংঘন,অধিকার হরণ, প্রভৃতি পশু-চরিত্র থেকে মুক্ত ও পবিত্র করে। মানুষকে সুনিয়ন্ত্রিত,সুশৃঙ্খল,কল্যাণকর ও পবিত্র গুণবৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে।

ঘ) নিরাপদ জীবনের জন্য

ইসলামি পরিবারে সকল সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিৎ থাকে। খাওয়া-পরা, শিক্ষা-দীক্ষা, মান-সম্মান, সাহায্য-সহানুভূতি ইত্যাদি দায়িত্ব পারিবারিকভাবে পালন করা হয়ে থাকে। একজন অক্ষম হলে অপরজন তা আন্তরিকভাবেই পালন করে থাকে।

ঙ) জাতি গঠন ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য

ইসলামি পরিবারে সদস্যদের মধ্যে প্রেম-প্রীতি,স্নেহ-মমতা,সমঝোতা, সহানুভূতি,শ্রদ্ধা, ভালোবাসা,মান-মর্যাদা,আদবকায়দা,সাহায্য-সহযোগিতা এবং পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সৃষ্টি হয়। যা বৃহত্তর সমাজ ও জাতি গঠনে এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টিকরেছেন তোমাদের সংগিনীদেরকে যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবংতোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।”

(সূরা রূম ৩০:২১)

চ) মানব সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য

সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য গুণাবলির বিকাশ ও লালন ক্ষেত্র হচ্ছে সুশৃঙ্খল,বৈধ ও সুনিয়ন্ত্রিত বৈবাহিক সূত্রে গাথা পূত-পবিত্র পরিবারিক জীবন। এ পবিত্র পরিবারিক জীবন মানব জীবনকে সুনিয়ন্ত্রিত, কল্যাণমুখী এবং পূত-পবিত্র করতে সহায়তা করে।

ছ) পশুত্ব ও মানবেতর জীবন থেকে পরিত্রাণের জন্য

বল্গাহীন,অবাধ,অনিয়ন্ত্রিত মেলামেশা মানুষকে পশুত্ব ও মানবেতর জীবনের অতল অন্ধকারের আবর্তে নিক্ষেপ করে। ইসলামি পরিবার প্রথা মানুষকে পশুত্ব ও মানবেতর জীবন থেকে পরিত্রাণ দেয় এবং সুখী-সুন্দর, পূত-পবিত্র জীবন যাপনের দিকে ধাবিত করে।

জ) মানব শিশুর দৈহিক-মানসিক বিকাশ ও প্রশিক্ষণের জন্য

মানব শিশু অত্যন্ত দুর্বল ও অসহায় অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করে। পরিবারের মায়া মমতা ও স্নেহ-যত্নে সে শারীরিক ও মানসিকভাবে বৃদ্ধি লাভ করে। পারিবারিক দৃঢ় বন্ধন ও লালন পালন ছাড়া তার দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও উন্নতি সম্ভব নয়।

মাতা-পিতা সন্তানদের শুধু লালন পালনই করে না, তাদের লেখা-পড়া,আদব-কায়দা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে তাদের সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

সারসংক্ষেপ:

  • মানুষের জন্য পারিবারিক জীবন এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য প্রয়োজনীয় বিষয়। এ ছাড়া মানব জীবনের অস্তিত্ব বিকাশ অসম্ভব। মানব সভ্যতার উৎকর্ষ ও বিকাশের জন্য জন্য ইসলামের পরিবার প্রথা এক অনিবার্য প্রয়োজন।
  • ইসলামি পারিবারিক জীবনের উদ্দেশ্য হলো, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পবিত্র ও শান্তিময় জীবন যাপন করা এবং সন্তানসন্ততিকে ইসলামি আদর্শে আদর্শবানরূপে গড়ে তোলা। যাতে সকলের জন্য ইহ-কালীন সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রেমময় পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। কাজেই ইসলামি পরিবারের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।

(৪) পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য

সন্তানদের কাজ হ’ল, মহান স্রষ্টা ও পালনকর্তা আল্লাহ তা‘আলার যাবতীয় হুকুম পালনের সাথে সাথে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা ও তাদের মান্য করা। আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের পরেই পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। বৈধ কাজে নির্দেশ পালনে পিতা-মাতার আনুগত্য করা সন্তানের জন্য ওয়াজিব।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন যে,তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করতে।”

(সূরা বনী ইসরাঈল ১৭:২৩)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে শরীক করবে না, এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর।”

(সূরা নিসা ৪: ৩৬)

মহানবী (স) বলেন,

“পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।”

(তিরমিযি)

পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের যেসব কর্তব্য আবশ্যক-

ক) সদ্ব্যবহার

পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা নফল নামায, সাদকা, সাওম, হজ্জ, ওমরা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার চেয়েও উত্তম।

আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ,

“আমি মানুষকে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি।”

(সূরা লুকমান ৩১:১৪)

খ) ভরন-পোষণ

পিতা-মাতা দরিদ্র বা অসহায় হলে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সন্তানদেরকে নিতে হবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“বলুন” তোমরা যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়দের জন্য ব্যয় করবে।”

(সূরা আল-বাকারা ২:২১৫)

গ) বার্ধক্যে সেবা

পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের বিশেষভাবে সেবা যত্ন করা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো। মমতা বশে তাদের প্রতি নম্রতার বাহু অবনমিত করবে।”

(সূরা বনী ইসরাঈল ১৭: ২৩-২৪)

ঘ) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

ইসলামে আল্লাহর শোকরগুজারির সাথে সাথে মাতা-পিতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

কুরআনুল কারীমে আয়াত,

“আমার এবং পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”

(সূরা লুকমান ৩১:১৪)

ঙ) আহবানে সাড়া

পিতা-মাতা ডাকা মাত্র সাড়া দিতে হবে। সবার আগে তাদের নির্দেশ পালন করতে হবে।

চ) আনুগত্য

যদি পিতা-মাতা ইসলাম বিরোধী কোন নির্দেশ না দেয় তাহলে সর্বাবস্থায় তাঁদের আনুগত্য করতে হবে।

ছ) সেবা যত্ন ও খিদমত

সন্তানকে সর্বাবস্থায় পিতা-মাতার সেবা যত্ন ও খিদমতে নিয়োজিত থাকতে হবে।

জ) সন্তুষ্টি অর্জন করা

পিতা-মাতা যাতে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে এবং সন্তানের উপর সন্তুষ্ট থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

রাসূল (সা.) বলেন,

“আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং “আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত।”

(তিরমিযী, হাকিম)

ঝ) ওয়াদা, ওসিয়ত ও ঋণ আদায় করা

পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের দাফন-কাফনের পর তাদের ওয়াদা-অসিয়ত এবং ঋণ থাকলে তা আদায় করা সন্তানের কর্তব্য। পিতা-মাতার আত্মীয়, বন্ধুদের সাথে ভালো ব্যবহার, পিতা-মাতার অবর্তমানে পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুন্দর ব্যবহার করাও সন্তানের কর্তব্য।

ঞ) ক্ষমা প্রার্থনা ও দু’আ করা

পিতা-মাতার অসহায় অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরে নিজের শৈশবের তাঁদর অবদানের কথা স্মরণ করে ভালোবাসার সাথে বারবার আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও দু’আ করতে হবে এ বলে,

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে,

“হে আমার প্রতিপালক! তাদের উপর রহম কর। যেমন শিশুকালে তারা আমাকে লালন-পালন করেছিলেন।”

(সূরা বনী ইসরাঈল ১৭:২৪)

সারসংক্ষেপ:

  • পরম করুণাময় আল্লাহর পক্ষ হতে সন্তানের জন্য সেরা উপহার হলো পিতা-মাতা। পিতামাতা সন্তানের বেহেশত-দোযখ। তাই আল্লাহর পরেই তাঁদের স্থান।
  • সুতরাং ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় পিতামাতার খিদমত, সম্মান, মহব্বত করা এবং তাঁদের সাথে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসার সাথে সাথে ইহকালীন সৌভাগ্য হাসিল করা প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য।

(৫) সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য

সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে পিতা-মাতার নিকট এক বিশেষ উপহার। মুসলিম পরিবারে পিতাই যেহেতু প্রধান অভিভাবক; সেহেতু তার রয়েছে অনেক গুরু দায়িত্ব যেমন-

ক) প্রাক জন্মাবস্থায়

ভবিষ্যৎ সন্তানের কল্যাণের জন্য এবং সুখ-শান্তিময় জীবন-যাপনের জন্য নর-নারীকে অনুমোদিত বৈধ দাম্পত্য জীবনযাপন করতে হবে। কারণ, নর-নারীর অবৈধ সম্পর্কের কারণে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করে তা সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। শিশু-সন্তানের স্বাভাবিক সুস্থ-বিকাশের জন্য সন্তানের পিতামাতার মধ্যে ভালোবাসাপূর্ণ দাম্পত্য-জীবন গড়ে তুলতে হবে।

খ) জন্মের পর প্রাথমিক কর্তব্য

সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই পিতার ওপর কতগুলো গুরু দায়িত্ব ও কর্তব্য এসে পড়ে; যা পিতাকে অবশ্যই পালন করতে হবে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই শিশুর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত ধ্বনি শোনানো। সপ্তম দিবসে ইসলাম সম্মত নাম নির্বাচন করা ও সামর্থ্য অনুযায়ী আকীকা করা। ছেলে সন্তানের সময় মত খাৎনা করানো।

গ) পরিচর্যা ও লালন-পালন

মহান আল্লাহর বিশেষ উপহার সন্তানকে ভালোবাসা ও স্নেহ মমতার সাথে অতি যত্ন সহকারে প্রতিপালন করা।

মহান আল্লাহরবাণী,

“জনকের কর্তব্য যথাবিধি তাদের ভরণ-পোষণ করা।”

(সূরা আল-বাকারা ২: ২৩৩)

ঘ) সন্তানদের মধ্যে পার্থক্য না করা

সন্তানদের মধ্যে অথবা পুত্র ও কন্যার মধ্যে আদর-যত্ন, স্নেহ-মমতার ব্যাপারে কোন রকম পার্থক্য করবে না। বরং ন্যায় সঙ্গতভাবে সমান আদর-স্নেহ করবেন। এমনকি কন্যা সন্তানকে একটু বেশি আদর-যত্ন করা সুন্নাত।

ঞ) শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দান

শিশুরাই হচ্ছে ভবিষ্যৎ মানবতার ধারক-বাহক। সুতরাং সন্তানের সুশিক্ষাই মুসলিম পিতার সর্বপ্রধান কর্তব্য। মহানবী (স)-এর নির্দেশনা হচ্ছে, কারো সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার জন্য একটি উত্তম নাম রাখবে ও আদব কায়দা শিক্ষা দেবে।

ট) উপযুক্ত বয়সে বিয়ের ব্যবস্থা করা

সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে পিতা তার বিবাহের ব্যবস্থা করবেন।

মহানবী (স) বলেন,

“সন্তান বয়োপ্রাপ্ত হলে বিবাহ দিবে- অন্যথা কোন পাপে লিপÍ হলে পিতা দায়ী হবে।”

(শুআবুল ইমান)

ঠ) সন্তানের কল্যাণ কামনা করা

পিতা সর্বদা সন্তানের কল্যাণকামী হবেন এবং তাদের সৎপথে পরিচালিত করবেন। তাদের জন্য দুআ করবেন।

মহানবী (সাঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন,

“তোমরা সন্তানদের কখনো বদ দুআ করোনা।”

(সহিহ মুসলিম)

মহান আল্লাহ কুরআনে শিক্ষা দিয়েছেন,

“হে প্রভু! তুমি আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে নামায প্রতিষ্ঠাকারী বানাও। প্রভু আমার! তুমি দুআ কবুল কর।”

(সুরা ইবরাহিম১৪:৪০)

ড) দ্বীনের পথে পরিচালনা করা

সন্তানকে ধর্মের পথে, সৎ সুন্দর ও ন্যায়ের পথে পরিচালনা করা পিতার অন্যতম কর্তব্য।

মহানবী (স) বলেন,

“তোমরা সাত বছর বয়সের সন্তানকে নামাযের আদেশ দেবে এবং দশ বছর বয়সের সময় প্রয়োজনে মারবে।”

(আবু দাউদ)

ঢ) বিলাসিতামুক্ত জীবনে অভ্যস্ত করা

সন্তানকে বিলাসিতামুক্ত জীবনে অভ্যস্ত করে তোলা উচিত। কেননা, সন্তানকে প্রথম থেকে বিলাসিতা ও অলস প্রবণ গড়ে তোলা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হতে পারে। কাজেই পিতাকে সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

ঞ) সযত্নে প্রতিপালন

একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সময় অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় থাকে। সে সময় শিশুর প্রয়োজন সঠিক ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিচর্যা। সন্তানকে স্তন্য পান করানো, গোসল, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি মায়ের দায়িত্ব।

ট) প্রাথমিক শিক্ষা দান

সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব মাতার ওপরই ন্যস্ত। যেহেতু শিশুরা মায়ের সান্নিধ্যে বেশিক্ষণ থাকে এবং তার সাথে প্রথম কথা বলতে শুরু করে তাই মাতাই হলেন শিশুর প্রধান শিক্ষয়িত্রী। মা সন্তানকে ধর্মীয় বিষয় যেমন দুআ-কালাম, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, আদব-কায়দা, সৌজন্য ইত্যাদি প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করবে।

ঠ) ব্যবহারিক শিক্ষা

দৈনন্দিন অনেক কাজ আছে যেগুলো মা শিশুকে সহজে শেখাতে পারেন। নিজেদের ব্যবহৃত কাপড়- চোপড় গোছানো, ঘর-আসবাব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, অযু-গোসল করে পাক-সাফ হওয়া ইত্যাদি বিষয় হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে পারেন। ছেলে ও মেয়ের চলাফেরার নিয়ম কানুন ভবিষ্যৎ জীবন উত্তমরূপে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজণীয় রীতিনীতি ইত্যাদি শিক্ষা দিতে পারেন।

সারসংক্ষেপ:

সন্তানের প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব অনেক। সন্তানের ভরণ-পোষণ, চিকিৎসা, অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা, সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকা, চরিত্র গঠন ইত্যাদির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা পিতামাতারই দায়িত্ব। আর এ সামগ্রিক দায়িত্ব পালন করতে পারলেই পিতামাতার মতো মহান আসনে সমাসীন হওয়া যায়।

(৬) স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

স্বামী-স্ত্রীকে কেন্দ্র করেই একটি পরিবারের ভিত্তি রচিত হয়।আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের উপর নির্ভর করে পরিবারের সুখ-শান্তি। এ জন্য ইসলাম স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য কতিপয় অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্য বেঁধে দিয়েছেন, যাতে তাদের দাম্পত্য জীবন সুখী থেকে আরো সুখকর ও মধুময় হয়ে ওঠে।

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নিম্নরূপ-

ক) সঠিক মর্যাদা দান

স্ত্রীকে স্বামীর আজ্ঞাবহ মনে না করে বরং একে অপরকে পরিপুরক হিসেবে মূল্যায়ন ও মর্যাদা দান করা।

মহান আল্লাহর বাণী,

“তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরাও তাদের পরিচ্ছদ।”

(সূরা বাকারা২ : ১৮৭)

খ) উত্তম ব্যবহার

স্ত্রীকে জীবন সঙ্গিনী, প্রিয়তমা সাথী হিসেবে গ্রহণ করে নিজের সুখ-শান্তি, আনন্দ বেদনায় সমানাধিকার দান করা।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

“স্ত্রীদের ওপর যেমন স্বামীদের অধিকার আছে, তেমনি স্বামীদের ওপরও স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে।”

(সূরা বাকারা ২:১২৭)

গ) স্ত্রীর ভরণপোষণ

স্ত্রীর ভরণপোষণ, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং এ সংক্রান্ত ব্যয় স্বামী নির্বাহ করবে।

মহানবী (স) বলেন,

“তুমি যা খাবে, স্ত্রীকেও তা খাওয়াবে এবং তুমি যা পরবে স্ত্রীকেও তা পরতে দেবে।”

(আবু দাউদ)

ঘ) মোহরানা আদায় করা

মোহরানা স্ত্রীর একটি অধিকার এবং মোহরানা প্রদান স্বামীর জন্য একটি অবশ্য কর্তব্য।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তোমরা সন্তুষ্ট চিত্তে স্ত্রীদের মোহরানা আদায় কর।”

(সূরা নিসা ৪:৪)

ঞ) স্ত্রীর গোপনীয়তা রক্ষা করা

স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের অনেক গোপন বিষয় থাকে যা স্বামীর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ আমানত। স্বামী কোন অবস্থাতেই স্ত্রীর গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করবেনা।

রাসূল (সাঃ) বলেন,

“কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তিই সর্ব নিকৃষ্ট যে তার স্ত্রীর নিকট গমন করে তারপর সে তার স্ত্রীর গোপন বিষয়াদি অন্যের কাছে প্রকাশ করে।”

(সহিহ মুসলিম)

ট) ন্যায় বিচার করা

কারও যদি একাধিক স্ত্রী থাকে তাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করতে হবে। আর ন্যায় বিচার করতে না পারলে একাধিক বিয়ে করার অনুমতি নেই।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তোমরা যদি ভয় কর যে, ইনসাফ করতে পারবে না, তা হলে একটি মাত্র বিয়ে করবে।”

(সূরা নিসা ৪:৩)

ঠ) স্ত্রীদের সম্পদ গ্রাস না করা

স্ত্রীদের মোহরানার অর্থ অথবা পিতা-মাতা থেকে প্রাপ্ত সম্পদ কিংবা অন্য যেকোন সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করা স্বামীর কর্তব্য। আর স্ত্রীর এসব সম্পদ স্বামী কখনো গ্রাস করবেনা। স্ত্রী যদি খুশি মনে প্রদান করে তাহলে তা গ্রহণ করা যেতে পারে অন্যথা নয়। স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রী যাতে তার সম্পদ থেকে উত্তরাধিকার পেতে পারে সে নিশ্চয়তা দেওয়া।

ড) নির্দোষ হাসি-তামাশা করা

স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রগাঢ় ভালোবাসা ও প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য স্ত্রীর সাথে গম্ভীর হয়ে না থেকে নির্দোষ-হাসি তামাশা করা যেতে পারে। মাঝে মাঝে স্ত্রীকে উপহার উপঢৌকন এনে দেওয়া ইত্যাদি প্রেম ও সম্প্রতি বৃদ্ধি করে।

স্বামী এক নাগাড়ে চার মাসের বেশি দিন প্রবাসে থাকা অনুচিত। এতে স্ত্রীর অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। হযরত ওমর (রা) চার মাসের অধিক স্ত্রীকে বিরহে রাখতে নিষেধ করেছেন।

সারসংক্ষেপ:

ইসলাম পারিবারিক জীবনকে মধুময় করার জন্য স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক যে সব বিধি-বিধান ও দায়িত্ব-কর্তব্য আরোপ করেছে, সেগুলোর মাধ্যমেই যথাযথ ভাবে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সুখ অর্জিত হতে পারে। আর কেবল তখনই পরিবারে জান্নাতি সুখ বিরাজ করবে।

(৭) স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

পরিবারকে সুখী ও সার্থক করে তুলতে স্বামীর যেমন কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীরও কতগুলো দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে; যা নিম্নরূপ-

ক) স্বামীর আনুগত্য

পরিবারে স্বামী-স্ত্রী কারো অবদানই কম নয় তারপরেও পরিবারের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার খাতিরে একজনের নেতৃত্ব মেনে চলা প্রয়োজন। যেহেতু, দৈহিক ও মানসিকভাবে পুরুষ অধিক শক্ত-সামর্থ এবং রোজগারের দায়িত্ব স্বামীর ওপর ন্যস্ত, সেহেতু স্বামীকে বা পুরুষকেই এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই স্ত্রীকে স্বামীর আনুগত্য স্বীকার করতে হবে। স্বামীর আহবানে সাড়া দেওয়া: যে কোন অবস্থায় স্বামীর আহবানে সাড়া দেওয়া স্ত্রীর পবিত্র কর্তব্য।

মহানবী (স) বলেন,

“যখন স্বামী নিজ স্ত্রীকে নিজ প্রয়োজনে আহবান জানায়- তখন এতে সাড়া দেওয়া স্ত্রীর দায়িত্ব। যদিও সে তন্দুর পাকানোর কাজে ব্যস্ত থাকে।”

(তিরমিযী)

খ) সতীত্বের হিফাযত

স্ত্রীর সতীত্ব স্বামীর পবিত্র আমানত। সুতরাং কোন অবস্থাতেই স্ত্রী তার সতীত্ব বিনষ্ট করতে পারবে না।

মহানবী (সা) বলেন,

“স্ত্রী নিজের স্বার্থে কখনও স্বামীর আমানতের খিয়ানত করবে না।”

(নাসাঈ)

গ) স্বামীর সম্পদ সংরক্ষণ

স্ত্রী-স্বামীর ধন-সম্পদকে নিজের নিকট গচ্ছিত আমানত স্বরূপ মনে করে আন্তরিকতার সাথে তার হিফাযত করবে এবং কখনও অপচয় করবে না।

মহানবী (স) বলেন,

“স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামীগৃহের কোন সম্পদ ব্যয় করো না।”

(তিরমিযী)

ঘ) স্বামীর প্রতি সহানুভূতি

স্বামী যদি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না হয় তাহলে অভিযোগ, অনুযোগ না করে ধৈর্য ধারন করবে এমনকি যদি স্ত্রীর মোহরানা আদায় করতে স্বামী কষ্টবোধ করে তবে স্ত্রী স্বেচ্ছায় তা কমিয়ে স্বামীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করবে। আর স্বামী অপারগ হলে তা স্বেচ্ছায় মাফ করে দিবে।

ঞ) গোপনীয়তা রক্ষা

স্ত্রী স্বামীর কোন গোপনীয়বিষয় অন্যের নিকট প্রকাশ করবে না। কেননা স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয় বিষয় পরস্পরের নিকট আমানত স্বরূপ।

ট) সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা স্ত্রীর ওপর কর্তব্য। স্ত্রী স্বামীর দেওয়া উপহার সাদরে গ্রহণ করবে। কোন অবস্থাতেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত আবদার করা কিংবা স্বামীর দেয়া উপহার গ্রহণে অসন্তষ্টি দেখানো উচিত নয়।

রাসূল (সাঃ) বলেন,

“যে স্ত্রীলোক এ অবস্থায় মারা যায় যে, তার স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট, সে জান্নাত লাভ করবে।”

(তিরমিযী)

ঠ) স্বামীকে সুখী করা

স্বামীকে সুখী ও আনন্দিত করা স্ত্রীর কর্তব্য।

মহানবি (সাঃ) বলেন,

“উত্তম স্ত্রী সে, যার দিকে তাকালে স্বামীর মন-প্রাণ আনন্দে ভরে ওঠে।”

(ইবনে মাজাহ)

ড) অবর্তমানে দায়িত্ব পালন

স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দত পালন করা এবং এ সময়ে অন্য স্বামী গ্রহণ না করা। স্বামী মারা গেলে কোন ঋণ থাকলে কিংবা কোন অসিয়ত বা কর্তব্য বাকি থাকলে তা আদায় করা।

ঢ) তত্ত্বাবধান করা

স্ত্রীকে স্বামী, সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধান করতে হবে।

হাদিসে এসেছে,

“স্ত্রী স্বামীর পরিবার পরিজনের ও সন্তানদের রক্ষক ও ধারক। তাকে এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।”

(সহিহ বুখারি-মুসলিম)

ঞ) স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার

স্বামীর আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে স্বামীর পিতা-মাতার সাথে এবং স্বামীর ভাইবোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে হবে।

ট) স্বামীর কল্যাণ কামনা

সদা সর্বদা স্বামীর কল্যাণ কামনা করা স্ত্রীর কর্তব্য। স্বামীর মৃত্যু হলেও তার জন্য দুআ করা কর্তব্য। সর্বোপরি একজন মুসলিম আদর্শ স্ত্রীরূপে নিজেকে উপস্থাপন করা স্ত্রীর সর্বোত্তম কর্তব্য।

সারসংক্ষেপ:

পরিবারকে সুখী ও স্বার্থক করে তুলতে স্বামীর যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীরও দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, যা পালনের মাধ্যমে সংসারে জান্নাতের সুখ বিরাজ করে।

(৮) ভাই-বোনের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য

জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিবারই পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। পরিবারে থাকে পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি রক্ত সম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কিত আরও অনেক আপনজন।

রক্ত সম্পর্কীয় সবচেয়ে কাছের মানুষ হল ভাই-বোন। পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ভাই-বোনদের পরস্পরের কতগুলো দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে, যা নিম্নরূপ-

ক) সম্মান ও স্নেহ

পরিবারে বড় ভাই-বোনেরা ছোট ভাই-বোনদের অভিভাবক। পিতা-মাতার অবর্তমানে বড়রা ছোটদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করবে। কখনও তাদেরকে অসহায়ত্বের মধ্যে ঠেলে দেবে না।

আবার ছোট ভাই-বোনদের কর্তব্য বড়দের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা। কেননা, সন্তানের কাছে পিতার যেমন মর্যাদা; ছোট ভাই-বোনদের কাছে বড় ভাই- বোনদেরও তেমন মর্যাদা।

রাসূল (সা.) বলেন,

“যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।”

(তিরমিযি)

খ) পারস্পরিক সহযোগিতা

ভাই-বোনেরা পারস্পরিক সহযোগিতা হাত প্রসারিত রাখবে। ছোটদের শিক্ষা-দীক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে বড়রা যেমন সাহায্য করবে তেমনি ছোট ভাই-বোনদের উচিৎ বড়দের কাজে-কর্মে, বিপদে-আপদে সাহায্য- সহযোগিতা করা।বড়-ছোট সকলের পারস্পরিক কর্তব্য হচ্ছে কেউ কাউকে কোন অবস্থাতেই পরিত্যাগ করবে না। কখনও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে ছিন্ন করবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“বলুন, তোমরা যে সম্পদ ব্যয় কর, তা পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য কর।”

(সূরা বাকারা২: ২১৫)

গ) হক আদায় করা

ভাই-বোনদের পারস্পরিক অধিকার আদায় করা কর্তব্য।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তুমি আত্মীয়- স্বজনদেরকে তাদের প্রাপ্য প্রদান কর।”

(সূরা বনী ইসরাইল১৭: ২৬)

তবে পারস্পরিক অধিকার আদায়ে খুব কড়াকড়ি না করে এমনভাবে আচার ব্যবহার করা যাতে সদ্ভাব ও সুসম্পর্ক বজায় থাকে।

ঘ) সদ্ব্যবহার করা

ছোটদের প্রতি বড়দের ব্যবহার হতে হবে সুন্দর, মার্জিত, উদার ও আদর্শ স্থানীয়। আবার বড়দের সম্মান করার সাথে সাথে তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলাও ছোট ভাই-বোনদের একান্ত কর্তব্য। বড়দের আনুগত্যের মধ্যে ছোটদের কল্যাণ নিহিত। বড়দের কোনক্রমেই কষ্ট দেওয়া বা বিরক্ত করা উচিৎ নয়।

অশোভন আচরণ না করা:কখনও কোন অবস্থাতেই ভাই-বোনেরা পরস্পর অশোভন, অসৌজন্যমূলক আচরণ করবে না। বড় ভাইদের হতে হবে উদার, শালীন। ছোটরা বড়দের অনুসারী।

সুতরাং ছোটদের প্রতি বড়দের ব্যবহার হতে হবে সুন্দর, মার্জিত, আদর্শ স্থানীয়, চমৎকার ও উপদেশপূর্ণ।বড় ভাই-বোনদের সাথে কথা-বার্তা বা পরামর্শ প্রস্তাব রাখতে হলে তাও আদবের সাথে হওয়া বাঞ্ছনীয়।

ঙ) অন্যায়-অবিচার না করা

ছোট-ভাই বোনদের প্রতি অন্যায়-অবিচার ও খারাপ আচরণ করা কখনও উচিত নয়। তাদের সাথে সদা-সর্বদা সদ্ভাব বজায় রাখা কর্তব্য। ছোটদের অন্যায় ও ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা কর্তব্য। ভাই-বোনদের পরস্পর কখনও পরিত্যাগ করা উচিত নয়। কোন অবস্থায় কথা-বার্তা বন্ধ করা বা পরিত্যাগ করা বৈধ নয়।

হাদিসে এসেছে,

“তিন দিনের বেশি সময়ের জন্য তার ভাইকে পরিত্যাগ করা বৈধ নয়।”

(বুখারি-মুসলিম)

চ) গীবত না করা

ভাই-বোন পরস্পরের গীবত বা নিন্দা না করা সাধারণ কর্তব্য। এতে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ভাব নষ্ট হয়। কাজেই একে অপরের বদনাম অন্যায় অভিযোগ, নিন্দা, ঘৃণা ইত্যাদি থেকে ভাই-বোনদেরকে বিরত থাকতে হবে। পরস্পর শক্রতা বর্জন করা: পরস্পর শক্রতা না করা ভাই-বোনদের অবশ্য কর্তব্য। একে অন্যের বিরুদ্ধে লাগবে না। ঝগড়া-ফাসাদ করবে না।

রাসূলুল্লাহ (স) বলেন,

“প্রত্যেক সপ্তাহে দুদিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। যে বান্দা তার ভাইয়ের সাথে শক্রতা পোষণ করে সে ছাড়া প্রত্যেক মুমিন বান্দাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। বলা হয়, মিটমাট না করা পর্যন্ত এদের উভয়কে প্রত্যাখ্যান কর।”

(মুসলিম)

ছ) বিপদ বা অকল্যাণ কামনা না করা

ভাই-বোনদের মধ্যে কেউ কারও ক্ষতি, বিপদ, অকল্যাণ কামনা করা অনুচিত। কাউকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করা মারাত্মক অন্যায়। ভাই-বোনদের মধ্যে কেউ বিপদ-আপদে পড়লে খুশি হওয়া বিরাট অন্যায়।

হাদিসে এসেছে,

“তোমার ভাইদের বিপদে তুমি আনন্দ প্রকাশ করো না। এরূপ করলে আল্লাহ তাকে রক্ষা করবেন ও তোমাকে তাতে ফেলে দেবেন।”

(তিরমিযি)

সারসংক্ষেপ:

পৃথিবীতে ভাই-বোনের মতো আপনজন কেউ নেই। পরিবারে পিতামাতার পরই ভাই-বোনদের স্থান। কাজেই ভাই- বোনদের মধ্যে যে সব দায়-দায়িত্ব রয়েছে সে সব দায়িত্ব কর্তব্য পালনের মধ্যেই নিহিত আছে শান্তি ও সুখ।

(৯) শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার

আল-কুরআনের সর্বপ্রথম যে বাণীটি রাসূলুল্লাহ (স) এবং পৃথিবীবাসীদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা প্রেরণ করেছিলেন তা হচ্ছে- ‘ইকরা’ বা পাঠ কর।

পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (স) ঘোষণা করেন,

“আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।”

(তিরমিযি)

আল্লাহ ও রাসূলের পর মানুষকে আলোকিত করার কাজ শিক্ষকরাই করে থাকেন। তাই ইসলামি সমাজে শিক্ষক মাত্রই এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।

ক) আলোর দিশারী

মানব সভ্যতার শুরু থেকে যেসকল জ্ঞানী ব্যক্তিগণ তাদের জ্ঞানকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসছেন,সমাজে তারাই শিক্ষক হিসেবে পরিচিত।

জ্ঞান, দক্ষতা, পারদর্শিতা অনেকের মধ্যেই থাকতে পারে, কিন্তু যারা সেই জ্ঞান, দক্ষতা ও পারদর্শিতাকে অন্যের মাঝে বিতরণ করেন তারাই শিক্ষক। আর তাঁদের এই গুণের কারণেই শিক্ষকগণ বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।

খ) মুক্তির দূত

জ্ঞানই মানুষের যথার্থ শক্তি ও মুক্তির পথনির্দেশনা দিতে পারে। তাইতো পবিত্র কুরআনের প্রথম নাযিলকৃত আয়াতে জ্ঞানার্জন তথা বিদ্যাশিক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“পড়! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে। পড়! আর তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।”

(সূরা আল-আলাক ৯৬: ১-৫)

মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত আদম (আ) কে ফেরেশতাগণ সিজদা করেছিল তাঁর জ্ঞানের জন্য।

রাসূল (স) ঘোষণা করেন,

“প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর বিদ্যা অর্জন করা ফরয।”

(ইবনে মাজাহ)

গ) মানুষ গড়ার কারিগর

সভ্যতার বিকাশ ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর। কেননা, একজন মানুষ শিক্ষা ছাড়া প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে না। আর এই শিক্ষা কখোনোই শিক্ষক ছাড়া অর্জিত হয় না।

তাই একজন মানুষের প্রকৃত মানুষ ওঠার পেছনে পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকদের অবদান।মানবতার জন্য দরদ- ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকেই শিক্ষকগণ শিক্ষকতা করেন। তাই তাঁরা বিশেষ মর্যাদার যোগ্য।তাঁদের যথাযথ শ্রদ্ধা করা ইবাদাতের শামিল।

ঘ) জাতির প্রধান চালিকাশক্তি

যে জাতি যত শিক্ষিত সেই জাতি তত উন্নত। আর শিক্ষকরা হচ্ছেন জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে দেশ, জাতি এমনকি সারা বিশ্ব শিক্ষকের দ্বারা উপকৃত হয়। সত্য-সুন্দর, ন্যায়-নিষ্ঠার পথ হচ্ছে একজন আদর্শ শিক্ষকের আরাধ্য। এজন্য শিক্ষকদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো উচিত।

ঙ) সমাজ ও জাতির বিবেক

মানব সভ্যতা বিকাশের পিছনে রয়েছে শিক্ষক সমাজ। শিক্ষা সকল মৌলিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে সমাজে শিক্ষকের ভূমিকা সর্বোচ্চ।সমাজ পরিবর্তনে শিক্ষকগণের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

সমাজ সচেতনতা, নৈতিক চেতনার জাগরণ, আদর্শ জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করণের মত কাজগুলো শিক্ষকগণ করে থাকেন।

রাসূল (স) বলেন,

“আল্লাহর পরে, রাসূলের পরে ঐ ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব যে বিদ্যার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে।”

(মিশকাত)

চ) একটি মহান পেশা

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। তাইতো নবি করিম (সাঃ) বলেন, ‘দুই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো পদ- গৌরব লোভনীয় নয়। তা হলো: এক. ধনাঢ্য ব্যক্তি যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং তা সৎ পথে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন। দুই. ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ বিদ্যা দান করেছেন এবং সে অনুসারে সে কাজ করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।

ছ) সমাজ সেবক

শিক্ষাদানের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও জাতীয় উন্নয়নমূলক কার্যক্রমেও শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

সমাজ থেকে কুসংস্কার, অজ্ঞতা, গোঁড়ামি, অবক্ষয়, দুর্নীতি ইত্যাদি দূর করে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নৈতিকতা, মানবতা, মূল্যবোধ সংরক্ষণে শিক্ষকগণ সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন।

শিক্ষকরা দেশ ও জাতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচাইতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাই শিক্ষকদের সার্বিক মর্যাদা নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য।

সারসংক্ষেপ:

শিক্ষকতা একটি অত্যন্ত সম্মানিত পেশা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখার ঐতিহ্য ও প্রবণতা বেশ প্রাচীন। শিক্ষানুযায়ী মানবচরিত্র ও কর্মের সমন্বয় সাধনই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর তাগিদ। নিজে শিক্ষার্জন করার পরক্ষণেই অপরকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত ও চরিত্র গঠন করার মহান দায়িত্ব শিক্ষকের ওপর বর্তায়।

(১০) নৈতিক মানবিক জীবন গঠনে পরিবারের ভূমিকা

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের মিলেমিশে বসবাস করার প্রবণতা প্রাচীন। আধুনিক যুগে মানুষ বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করলেও রাষ্ট্রীয় ও সমাজিক জীবনের প্রাথমিক সোপান হল পরিবার। একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সুষ্ঠু, পূত-পবিত্র পারিবারিক জীবন অত্যন্ত জরুরি।

নৈতিকতা-মানবিকতা ইত্যাদি গুনাবলী অর্জনে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। কেননা, ব্যক্তি জীবনে যেসব দোষ-গুণ মানুষ অর্জন করে তার বেশির ভাগই পারিবারিক জীবনের পরিচর্যার ফসল। আবার ব্যক্তি জীবন ভালো না হলে ভালো পরিবার গঠিত হয় না,ভালো পরিবার গঠিত না হলে সুন্দর সমাজ গঠিত হয় না। তাই নৈতিক মানবিক জীবন গঠনে পারিবারের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ব প্রকৃতির শাশ্বত রূপ: দাম্পত্য জীবন তথা পারিবারিক জীবন বিশ্ব প্রকৃতির এক চিরন্তন রূপ। এটা এক শাশ্বত ব্যবস্থা যা কার্যকর রয়েছে বিশ্ব প্রকৃতির প্রতিটি জীব ও জড়বস্তুর মধ্যে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“প্রত্যেকটি বস্তুকেই আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি।”

(সূরা যারিয়াত ৫১:৪৯)

ক) একটি শিক্ষায়তন

পারিবারিক জীবনকে প্রাথমিক শিক্ষার কেন্দ্র বলা হয। কেননা, একটি শিশু আশৈশব মানবীয় গুণাবলী, সৌজন্যবোধ, আচার-আচরণ, বিনয, পরোপকার, ত্যাগ, নিষ্ঠা, নিয়ম-শৃঙ্খলা ইত্যাদি পারিবারিক পরিবেশেই শিক্ষা লাভ করে থাকে। যা পরবর্তীতে জীবন চলার দিশারী হয়। ইসলামি পারিবারিক ব্যবস্থায় এর সদস্যদের বিশেষ করে সন্তানসন্ততিদেরকে শৈশব হতে ইসলামের শিক্ষায় প্রশিক্ষণ এবং তা জীবনে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করাও পারিবারিক জীবনের উদ্দেশ্য।

খ) মানবিক গুণাবলীর লালন কেন্দ্র

ইসলামি পরিবার ব্যবস্থা মানবিক গুণাবলীর লালন ভূমি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রেম-প্রীতি, মায়া-মমতা, আদর-স্নেহ, তাহযীব ও তামাদ্দুন ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীর উন্মেষ ঘটে। এগুলো বৃহত্তর সমাজ-সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখে এবং সুষ্ঠু জীবন গড়তে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

গ) মানব সভ্যতার লালন ক্ষেত্র

ইসলামি পরিবার মানব সভ্যতার লালন ভূমি। স্বামী-স্ত্রীর প্রীতিময় পূত-পবিত্র পারিবারিক পরিমন্ডলে শিশুর জন্ম হয। পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজনের হৃদয় নিংড়ানো আদর স্নেহ ও মায়া-মমতায় লালিত হয়ে বড় হয়। আদব-কায়দা শেখে। উন্নত শিক্ষা দীক্ষায় গড়ে ওঠে। মাতা-পিতা তথা পরিবারের সহায়তা না পেলে সে শিশু সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠে না।

ঘ) প্রকৃত মানবিক সুখ ও শান্তির কেন্দ্রস্থল

আপন ও প্রিয়জনদের নিয়ে মিলেমিশে বাস করার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত আনন্দ, শান্তি, সুখ ও পরিতৃপ্তি। আর পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী সন্তান-সন্তুতি, ভাই-বোন সবাই মিলে সুখ-শান্তিতে বসবাস করার প্রতিষ্ঠানই হলো পরিবার।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সংগিনীদেরকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।”।

(সূরা রূম ৩০:২১)

ঙ) ভক্তি-সম্মান ও স্নেহ-মমতার উৎসস্থল

মুসলিম পরিবার ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল সদস্যের প্রতি শ্রেণিমত ভক্তি-সম্মান ও শ্রদ্ধা এবং আদর-স্নেহ, মমতামাখা আচরণ দাবী করে। বড◌ রা ছোটদের স্নেহের পরশ দিয়ে মানুষরূপে গড়ে তুলবে। আর ছোটরা বড়দের সাথে সম্মান দিয়েতাদের মেনে চলবে।

মহানবী (স) বলেন,

“যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”

(আল-হাদিস)

পরিবারের প্রকৃতি হলো পারস্পরিক প্রীতি-ভালোবাসা, দয়া-সহানুভূতি। ইসলামি পরিবারে দায়িত্বহীনতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার কোন স্থান নেই। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সমঝোতা, সহযোগিতা, স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ইত্যাদি গুণাবলী মুসলিম পরিবারে এনে দেয় স্বর্গসুখ।

সারসংক্ষেপ:

রাষ্ট্রীয় ওসমাজিক জীবনের প্রাথমিক সোপান হল পরিবার। একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সুষ্ঠু, পূত-পবিত্র পারিবারিক জীবন অত্যন্ত জরুরি। নৈতিকতা-মানবিকতা ইত্যাদি গুণাবলী অর্জনে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। কেননা, ব্যক্তি জীবনে যেসব দোষ-গুণ মানুষ অর্জন করে তার বেশিরভাগই পারিবারিক জীবনের পরিচর্যার ফসল।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts

You cannot copy content of this page