(১) কিয়াস শব্দের অর্থ কি? কিয়াস কি? কিয়াস কাকে বলে?
কিয়াস শব্দের অর্থ কি: কিয়াস আরবি শব্দ। অর্থ হলো- পরিমাপ করা, অনুমান করা, তুলনা করা, সমান করা ইত্যাদি। অর্থাৎ- শাব্দিকভাবে কিয়াস হলো কোন বস্তুকে অন্য বস্তুর সাথে তুলনা করা।
কিয়াস কি: কিয়াস হলো ইসলামি আইনশাস্ত্রেরে চতুর্থ উৎস। কুরআন,সুন্নাহ ও ইজমার পর এর অবস্থান। এই তিন উৎসতে নেই এমন কোন বিষয়ের মাসয়ালা বা বিধান অনুমান করে নির্ণয় করাকে কিয়াস বলে।
ইমাম আবু হানিফা (র) বলেন, ‘কিয়াস হলো আইনের বিস্তৃতি। মূল আইন যখন সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট না হয়, তখন মূল আইন থেকে ইল্লাতের (হুকুমের কারণের) মাধ্যমে নতুন বিধি আহরণ করতে হয়। আর তখন যে আইনের সম্প্রসারণ হয় তাই কিয়াস।’ মূলত মূল আইনকে শাখায় তুলনা করেই নতুন আইনের জন্ম হয়। আর এটিই হল কিয়াস।
এক বাক্যে বলা যায়, ক্বিয়াস হলো কোন হুকুমের ক্ষেত্রে মূল দলীলের সাথে শাখাগত দলীলকে উভয়ের মাঝে সমন্বয়কারী ইল্লত (হুকুমের কারণ) থাকার কারণে সমান করা।
কিয়াস কাকে বলে: কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে শরীআতের যেসব হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়, শাখা-প্রশাখার মধ্যে ঐ হুকুমের কারণ পাওয়া গেলে শাখায় মূলের অনুরূপ হুকুম প্রদান করাকে শরী‘আতের ভাষায় কিয়াস বলা হয়।
কিয়াসের উদাহরণ: কুরআন মাজীদের মাধ্যমে ইসলামি শরীআতে মদ্যপানকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ হলো ‘নেশা’। অনুরূপভাবে কিয়াসের মাধ্যমে গাঁজা, আফিম, হিরোইন ইত্যাদি নেশা জাতীয় জিনিসকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে।
(২) কিয়াস শরীয়তের উৎস হবার ব্যাপারে দলিল
যে সব দলীলের মাধ্যমে শারঈ হুকুম সাব্যস্ত হয় তার অন্যতম হলো ক্বিয়াস। এটি শারঈ দলীল হিসাবে গণ্য হওয়ার ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ ও ছাহাবীদের বাচনিক দলীল রয়েছে।
কুরআনের দলীলের মধ্যে অন্যতম দলীল হলো-
আল্লাহর বাণী,
‘‘আল্লাহ যিনি সত্য সহ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনি আরও অবতীর্ণ করেছেন দাঁড়িপাল্লা/ন্যায়দন্ড।’’
(সূরা শুরা, আয়াত নং ১৭)
দাঁড়িপাল্লা (الْمِيزَان) হলো যার দ্বারা বিভিন্ন জিনিস ওযন করা হয় এবং সেগুলির মাঝে তুলনা করা হয়।
আল্লাহর বাণী,
‘‘যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবেই আমি দ্বিতীয় বার সৃষ্টি করবো।’’
(সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত নং ২১৪)
‘‘আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করেন, অত:পর সে বায়ু মেঘমালা সঞ্চারিত করে। অত:পর আমি তা মৃত ভূখন্ডের দিকে পরিচালিত করি। অত:পর তদ্বারা সে ভূখন্ডকে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করে দেই। এমনিভাবে হবে পুনরুত্থান।’’
আল্লাহর বাণী,
(সূরা ফাতির, আয়াত নং ৯)
আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জীবকে পুনরায় সৃষ্টি করাকে প্রথমবার সৃষ্টি করার সাথে সাদৃশ্য দিয়েছেন এবং মৃত ব্যক্তিদেরকে জীবিত করাকে জমিন জীবিত করার সাথে সাদৃশ্য দিয়েছেন। এটিই হলো ক্বিয়াস।
সুন্নাহ হতে দলীল হলো-
হাদিসে এসেছে,
যে মহিলা তার মা মারা যাওয়ার পর মায়ের পক্ষ থেকে ছিয়াম পালন করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার জবাবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্তব্য,
‘‘তোমার কি অভিমত, যদি তোমার মায়ের ঋণ থাকে, অতঃপর তা পরিশোধ করো, তবে কি তা আদায় হয়ে যাবে? মহিলা জবাবে বললেন, হ্যাঁ। এবার তিনি বললেন, তাহলে তোমার মায়ের পক্ষ থেকে ছিয়াম পালন করো।’’
(সহীহ বুখারী হা/১৯৫৩, সহীহ মুসলিম হা/১১৪৮)
হাদিসে এসেছে,
‘‘এক ব্যক্তি এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমার একজন কালো সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার কি উট আছে? লোকটি বললো, হ্যাঁ। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সেগুলোর রং কি? লোকটি বললো, লাল বর্ণের। তিনি বললেন, সেখানে কি ছাই বর্ণের উটও আছে? লোকটি বললো, জ্বী, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এ রং কোথা থেকে আসলো? লোকটি বললো, হয়তো এটি বংশগত কারণে হয়েছে। এবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জবাবে বললেন, তাহলে তোমার সন্তানও হয়তো বংশগত কারণে এমন হয়েছে।’’
(সহীহ বুখারী হা/৫৩০৫, সহীহ মুসলিম হা/১৫০০)
কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত এ রকম প্রতিটি দৃষ্টান্তই ক্বিয়াসের উপর প্রমাণ বহন করে। কেননা, এতে কোন জিনিসকে তার সমজাতীয় জিনিসের পর্যায়ভূক্ত করার’ বিষয়টি নিহিত আছে।
হাদিসে এসেছে,
ছাহাবীদের বক্তব্য থেকে অন্যতম দলীল হলো শাসন কার্য ফয়সালার ক্ষেত্রে আবু মুসা আল আশআ‘রী (রা.) এর উদ্দেশ্যে চিঠিতে উমার (রা.) বলেন,
‘‘… তারপর তোমার বুঝ, যা তোমার কাছে প্রতিভাত হয়, তদানুযায়ী ফায়সালা করবে। যে মাসআ‘লার ব্যাপারে কুরআন-হাদীছে কোন দলীল নেই তা তোমার কাছে পেশ করা হলে তুমি ঐ সব মাসআ’লাকে অন্যান্য বিষয়ের সাথে ক্বিয়াস বা পারস্পরিক তুলনা করবে এবং উপমা সম্পর্কে জ্ঞান রাখবে। তারপর তোমার ধারণানুসারে যা আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় এবং হক্বের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ হয়, তার উপরই নির্ভর করবে।’’
(বাইহাকী ১০/১১৫, দারাকুৎনী ৪/২০৬-২০৭)
ইবনুল কাইয়ুম (রহঃ) বলেছেন,
‘‘এটি অত্যন্ত মর্যাদাবান চিঠি, যা উম্মাহ গ্রহণ করে নিয়েছেন। ইমাম মুযনী (রহঃ) বলেন, ছাহাবীদের যুগ থেকে তার যুগ পর্যন্ত সকল ফকীহ একমত যে, ‘নিশ্চয় হক্বের অনুরূপ জিনিসও হক্ব এবং বাতিলের অনুরূপ জিনিসও বাতিল হিসাবে বিবেচিত’ এবং তারা ফিক্বহের সকল বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে ক্বিয়াসের ব্যবহার করছেন।’’
(ইগাসাতুল লাহফান ১/৮৬)
কিয়াসের একটি উদাহরণস্বরূপ: হাদীছে গোবর দিয়ে শৌচাকার্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। নিষেধের কারণ বলা হয়েছে যে, এটি নাপাক। (ছহীহ বুখারী/১৫৬) এর উপর কিয়াস করে বলা হয় যে, শুকনা রক্ত দিয়ে শৌচাকার্য করা নিষেধ। যে হুকুম সরাসরি দলীল দিয়ে সাব্যস্ত হয়, সেটি আসল। যাকে এ আসলের উপর কিয়াস করা হয়, তাকে শাখা বলা হয়। এখানে গোবর দিয়ে শৌচাকার্য করা নিষেধের হুকুমটি আসল। শুকনা রক্ত দিয়ে শৌচকার্য করা নিষেধের হুকুমটি শাখা। কিয়াস করার জন্য জন্য আসল ও শাখার ইল্লত বা কারণ একই হতে হয়। এখানে গোবর দিয়ে শৌচাকার্য করতে নিষেধের কারণ হলো এগুলো নাপাক। এর ভিত্তিতে শুকনা রক্ত দিয়ে শৌচকার্য করা নিষেধ হবে; কারণ এখানেও ঐ কারণটি পাওয়া গেছে। কেননা শুকনো রক্তও নাপাক।
(৩) কিয়াসের উৎপত্তি
ইসলামি আইন শাস্ত্রের চতুর্থ ভিত্তি হলো কিয়াস। কোন সমস্যার সমাধানে যখন কুরআন, হাদিস ও ইজমাতে সরাসরি কোন নির্দেশনা না পাওয়া যায় তখন ইসলামি পন্ডিতগণ কিয়াসের আশ্রয় নিয়ে উদ্ভূত সমস্যাটি সমাধান করেন।
দলিল: একটি হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, দৃষ্টান্তস্বরূপ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) যখন তাঁর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত মুআয ইবন জাবাল (রা)-কে ইয়ামানের শাসনকর্তা মনোনীত করে পাঠান, তখন তিনি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, বিচার সংক্রান্ত ব্যাপারে কোন নতুন সমস্যার উদ্ভব হলে তিনি (মুআয) কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন? তিনি বলেন, তিনি কুরআনের অনুসরণ করবেন। তিনি তাঁকে প্রশ্ন করলেন, যদি কুরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশ না থাকে? তখন মুআয (রা) উত্তর দিলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাহর (হাদিসের) অনুসরণ করবেন। আর রাসূল (স)-এর সুন্নাহর দ্বারা ফায়সালা করতে না পারলে তিনি তাঁর নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করবেন। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর জবাবে অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করেন। এবং তাঁর জন্য দুআ করেন।
অন্য একটি হাদিসে আছে, হযরত মুহাম্মদ (স) আবু মূসা আল-আশআরী রা. কে বললেন, “আল্লাহর কিতাব (কুরআন) অনুযায়ী বিচার কর। তোমার যা প্রয়োজন, তা যদি এতে না থাকে তবে তেমাদের নবী (স)- এর সুন্নাহ হতে খোঁজ কর। সেখানেও যদি না পাও তখন নিজের মতামত ব্যক্ত কর।”
(৪) কিয়াসের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
ইসলাম একটি যুক্তিভিত্তিক গতিশীল জীবনব্যবস্থা। জীবন জিজ্ঞাসার সাথে সম্পর্কিত সকল সমস্যার সমাধান ইসলাম প্রদান করছে। হযরত মুহাম্মদ (স) জানতেন সময়ের বিবর্তনে মানব সমাজে নানারকম সমস্যার উদ্ভব ঘটবে। সে সব সমস্যা হতে তাঁর উম্মতকে বাঁচানোর জন্য তিনি সমাধানের পথ হিসেবে ইজমা ও কিয়াসের পথ খুলে রেখেছেন।
রাসূল (স)-এর ইন্তিকালের পর আসমানী বার্তা প্রেরণ বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া মুসলিম সাম্রাজ্যের পরিসীমা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। নব বিজিত মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে নতুন সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিচয় ঘটে। ফলশ্রুতিতে নতুন নতুন নানা সমস্যার উদ্ভব হয়। সাহাবাগণ কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে নতুন সমস্যার সমাধান দিতে থাকেন।
প্রথম হিজরি শতাব্দীর শেষ দিকে ফিক্হ শাস্ত্রের বিকাশ ঘটে। ফকিহগণ কুরআন ও হাদিসের নিরিখে চিন্তা ও গবেষণার সমন্বয় ঘটাতেন। সম্ভবত ইমাম শাফিঈ প্রথম ব্যক্তি যিনি উসূলে ফিকহের সংকলন চেষ্টা করেন এবং ইসলাম ধর্মীয় ও বিচার ব্যবস্থায় কিতাব, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন- “কিয়াসের ব্যবহার সে সময় করা যাবে যখন কিতাব, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা কোন সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।” সুতরাং কুরআন, হাদিস, ইজমা দ্বারা সমাধান বের করতে না পারলে কিয়াসের আশ্রয় নিতে হবে।
(৫) কিয়াসের-এর নীতমালা
মহানবীর (স) ইন্তিকালের পর সাহাবীগণ কুরআন-সুন্নাহর সাথে সাথে কিয়াসের অনুসরণে নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করতেন। পরবর্তীকালে ইসলামের মাযহাব চতুষ্টয়ের ইমামগণও কিয়াস প্রয়োগ করতেন। কিয়াস এমন সব সমস্যার সমাধান করে যা কুরআন-হাদিসে স্পষ্ট উল্লেখ নেই।
ইমামগণ নিম্নলিখিত নীতিমালার ওপর লক্ষ রেখে কিয়াস গ্রহণ করতেন-
- কিয়াস কুরআন-হাদিস ও ইজমার পরিপন্থী হবে না।
- কুরআন-হাদিস ও ইজমা দ্বারা প্রবর্তিত কোন আইনের মূলনীতি বিরোধী কোন আইন তৈরি করা কিয়াসের আওতা বহির্ভূত।
- কিয়াসের মূলনীতি মানুষের জ্ঞানের পরিসীমার মধ্যে থাকতে হবে।
- যে সকল সমস্যার সমাধান কুরআন, হাদিস ও ইজমা দ্বারা করা হয়েছে, সে সকল বিষয়ে কিয়াস প্রযোজ্য নয়।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলেচনার মাধ্যমে আমরা কিয়াস শব্দের অর্থ কি? কিয়াস কি? কিয়াস কাকে বলে? কিয়াসের-এর দলিল, উৎপত্তি, গুরুত্ব ও নীতমালা একটা স্পষ্ট ধারণা অর্জন করলাম।
মানবসমাজ গতিশীল। যতই দিন যেতে থাকে মুসলিম সমাজে নতুন নতুন প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে। বহু উদ্ভূত নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য ইজতিহাদ-গবেষণার প্রয়োজন হয়। কিয়াস ইসলামি আইন-বিজ্ঞানের এক গতিশীল ধারা। কিয়াস আইনকে কালোত্তীর্ণ এবং সার্বজনীনতা দান করেছে। ইসলামি আইন-বিজ্ঞান যে সর্বকালের মুক্তিসনদ তা এ থেকেই বুঝা যায়।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]