ইসলামি আইন-কানুন ও মূলনীতির গবেষণাকারী মুজতাহিদগণের মূল ও প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে কুরআন ও হাদিস। এক্ষেত্রে কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা এবং হাদিসের বর্ণনা ও নির্ভরযোগ্যতায় ইমামদের মতপার্থক্যের কারণ থেকেই বিভিন্ন মাযহাবের উদ্ভব হয়েছে। তবে উক্ত পার্থক্যসমূহ শরীআতের মৌলিক বিষয়ে হয়নি, হয়েছে শাখা-প্রশাখায়। অতএব সকল মাযহাবই সত্যাশ্রয়ী এবং অনুকরণীয়-অনুসরণীয়। যে কোন একটি মাযহাব অনুসরণ করলেই ইসলামের অনুসরণ করা হবে এবং মুক্তি পাওয়া যাবে।
এই আর্কিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- মাযহাব অর্থ কি, মাযহাব কি, মাযহাব কাকে বলে, তা বলতে পারবেন। মাযহাব কয়টি, মাযহাব কত প্রকার ও কি কি, তা জানতে পারবেন। মাযহাবের পার্থক্যের কারণ বুঝতে পারবেন।
(১) মাযহাব অর্থ কি? মাযহাব কি? মাযহাব কাকে বলে?
মাযহাব অর্থ কি: ‘মাযহাব’ আরবি শব্দ। আভিধনিক অর্থ হচ্ছে- পথ, মত, দল।
মাযহাব কি: ইসলামি আইন-কানুন, মু’আমালাত ও ইবাদাত সম্পর্কিত মৌলিক বিষয়সমূহ ব্যতীত সেগুলোর শাখা-প্রশাখায় ইসলামি আইন বিশারদগণের বিভিন্ন মতবাদকে মাযহাব বলে।
মাযহাব কাকে বলে: কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা এবং হাদিসমূহের মধ্যে কোনটি অধিক প্রামাণ্য আর কোনটি কম নির্ভরযোগ্য এসব বিষয়ে ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে মুসলিম সমাজে যে সকল ধর্মীয় আইন সংক্রান্ত মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে তাকে মাযহাব বলে।
(২) মাযহাব কয়টি? মাযহাব কত প্রকার ও কি কি?
মাযহাব কয়টি: মুসলিম সমাজে অনেকগুলো মাযহাব বা মতবাদের উদ্ভব হয়। এসবের মধ্যে ৪টি মাযহাব অন্যতম। এ ৪টি মাযহাব সহীহ হওয়ার ব্যাপারে আলিমগণ একমত পোষণ করেছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমগণ এ চারটি মাযহাবের যে কোন একটির অনুসরণ বা তাকলিদ করাকে অবশ্য করণীয় বলে ফাতওয়া প্রদান করেন।
মাযহাব কত প্রকার ও কি কি: বিশ্বমুসলিম কর্তৃক সমাদৃত মাযহাব হচ্ছে ৪টি। যথা-
- হানাফি মাযহাব: ইমাম আবু হানিফা (র)-এর মতানুসারীকে হানাফি বলা হয়।
- মালিকি মাযহাব: ইমাম মালিক (র)-এর মতানুসারীকে মালিকি বলা হয়।
- শাফি’ঈ মাযহাব: ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতানুসারীকে শাফিঈ বলা হয়।
- হাম্বলী মাযহাব: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)-এর মতানুসারীকে হাম্বলি বলা হয়।
(৩) মাযহাবের পার্থক্যের কারণ
ইসলামি শরীআতের ফিক্হি মাযহাবের পার্থক্যের অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে যার কয়েকটি নিম্নরূপ-
প্রথমত: মহানবী (স)-এর হাদিস বিভিন্ন সাহাবী বর্ণনা করেন। অনেক বর্ণনাকারী তা অপরের নিকট বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনার ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। সুতরাং একই হাদিস বহু ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ফলে বর্ণনার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে কিছুটা পার্থক্য দেখা দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত: হাদিসের ব্যাখ্যার ব্যাপারেও মতপার্থক্য হয়েছে।
তৃতীয়ত: কখনও বর্ণনার সূত্রেও কোন দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। যেমন- বর্ণনাকারীদের মধ্যে কোন এক বা একাধিক ব্যক্তির বর্ণনা নির্ভরযোগ্য না হওয়া। সুতরাং এক ইমামের বিবেচনায় যে হাদিসটি গ্রহণযোগ্য, তা হয়ত অন্য ইমাম গ্রহণ করতে রাযি হননি। তিনি হয়ত অন্য হাদিসটি গ্রহণ করেছেন।
চতুর্থত: বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত একই মর্মের হাদিসে একটি মর্মকে একজন ইমাম অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে করেছেন। অপর ইমাম অন্য মর্মকে নির্ভরযোগ্য মনে করে গ্রহণ করেছেন।
পঞ্চমত: আল-কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যায় মতানৈক্য। এটিও মাযহাবের পার্থক্যের অন্যতম কারণ হতে পারে। একজন তাফসীরকার একটি আয়াতের এক ধরনের ব্যাখ্যা করেছেন। আর একজন অন্যরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। অবশ্য এসব শরীআতের কোন মৌলিক নির্দেশের (ফরযের) ব্যাপারে ফকিহদের মধ্যে পার্থক্য হয়নি; বরং মতপার্থক্য হয়েছে শাখাপ্রশাখায়।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- ফজরের সালাত পড়া ফরয। এ ব্যাপারে সকল ইমাম একমত। মতানৈক্য রয়েছে আদায়ের সময়ের ব্যাপারে। একজন ইমাম ফজরের সালাত আলো-আঁধারে পড়া ভালো মনে করেন। অন্যজন ফরসা বা আরো আলো হবার পর পড়া ভালো মনে করেন। এ ব্যাপারে দুই ইমাম দুই হাদিস দ্বারা নিজেদের মতামত প্রমাণ করেছেন। অনুরূপভাবে ইমামের পেছনে কিরাত পাঠ করতে হবে, না চুপ করে থাকতে হবে, এ ব্যাপারেও দুটি মত রয়েছে। প্রত্যেকেরই যুক্তির ভিত্তিতে হাদিস রয়েছে। এমন সব প্রাসংগিক বিষয়ে ইমামদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে।
ষষ্ঠত: যে সকল সমস্যার সমাধান কুরআন ও হাদিসে পাওয়া যায় না এক্ষেত্রে ইজমা ও কিয়াসের সাহায্যে হুকুম প্রদানের ক্ষেত্রে এ মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। ফয়সালা যেমন দুইজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ মৌলিক আইনের ব্যাখ্যায় একমত হওয়া সত্ত্বেও এর ধারা-উপধারায় ভিন্ন ভিন্ন রায় প্রকাশ করে থাকেন। আর মুজতাহিদদের ভিন্ন মত পোষণ করা কোন দূষণীয় নয়। মহানবী (স) বলেছেন, ‘যারা এ জাতীয় গবেষণায় আত্মনিয়োগ করবে, তারা নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছলে দুটি পুরস্কার পাবে, আর ভুল হলেও শ্রমের মর্যাদাস্বরূপ একটি পুরস্কার পাবে।’
সপ্তমত: বিতর্কমূলক প্রশ্নে আইনজ্ঞের পরামর্শ ও বিচারকের মীমাংসা। যেমন, ইসলামি আইনের ব্যাপারে ফকিহদের ফাতওয়াও সেইরূপ। বিভিন্ন বিচারক ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন। যেসব ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহতে ফয়সালা পাওয়া যায় না, সেসব ব্যাপারে ফকিহদের ইজতিহাদ ও রায়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর ঐ সব ইজতিহাদ ও রায়ের ব্যাপারে সব সময়ে মতৈক্যের আশা করা যায় না।
(৪) শরয়ী মাসআলা গ্রহণে মাযহাবের ইমামগণের উপদেশ
মাযহাবের সংখ্যা অনেক হলেও পৃথিবীতে চারটি মাযহাব প্রসিদ্ধি লাভ করে। সংখ্যাধিক্যের হার হিসেবে ভারতবর্ষে হানাফী, আফ্রিকার দেশগুলোতে মালেকী, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে শাফেয়ী এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে হাম্বলী মাযহাব অনুসরণকারীদের সংখ্যাধিক্য রয়েছে। এর ব্যতিক্রম হিসেবে সবকটি মহাদেশ জুড়েই রয়েছে আহলে হাদীস মতাবলম্বী লোকেরা । মাযহাব পালনের ক্ষেত্রে মাযহাবের ইমামগণের কিছু মূলনীতি ও উপদেশ রয়েছে, তা আমরা অনেকেই জানি না। বিশেষ করে মতবিরোধপূর্ণ মাসআলাগুলোতে তথ্যসূত্র দুর্বল হলেও নিজ নিজ মাযহাবের রায় অন্ধভাবে মেনে চলি অনেকেই। এমন অনুসরণের অনুমতি কি আল্লাহর রাসূল (স) আমাদেরকে দিয়েছেন?
কোন বিষয়ে দুর্বল হাদীস আমল করা, অথচ একই বিষয়ে প্রাপ্ত বিশুদ্ধ হাদীসটি আমলে না আনা- এমন অদ্ভুত, অযৌক্তিক আমলের নির্দেশ কি মাযহাবের ইমামগণ আমাদেরকে দিয়েছেন? এ বিষয়ে তাঁরা আমাদেরকে কী উপদেশ দিয়েছেন, এতদসংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণী নিম্নে তুলে ধরা হলো।
১. ইমাম আবু হানীফা (র) বলেন, “হাদীস যেটি সহীহ সেটাই আমার মাযহাব ”(রাদ্দুল মুখতার ১/১৫৪; মুকাদ্দিমাতু উমদাতুর রিয়ায়াহ- ১/১৪; হাশিয়াতু ইবনু আবেদীখ- ১/৬৩)।
২. ইমাম মালেক (র) বলেন, “আমি নিছক একজন মানুষ। ভুল করি, শুদ্ধও করি । তাই আমার মতামতকে যাচাই করে নিও। কুরআন ও সুন্নাহর সাথে যতটুকু মিলে সেটুকু গ্রহণ করো, আর গড়মিল পেলে সেটুকু বাদ দিয়ে দিও।” (ইকাযুল হিমাম, পৃষ্ঠা ১০২)
৩. ইমাম শাফেয়ী (র) বলেন, “যদি তোমরা আমার কোন কথা হাদীসের সাথে গড়মিল দেখতে পাও, তাহলে তোমরা হাদিস অনুযায়ী আমল করো, আমার নিজের উক্তিকে দেয়ালে ছুড়ে ফেল।” (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ- ১/৩৫৭)।
৪. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) বলেন, “তুমি আমার অন্ধ অনুসরণ করো না। মালেক, শাফেয়ী, আওযায়ী, সাওরী- তাঁদেরও না; বরং তাঁরা যেখান থেকে (সমাধান) নিয়েছেন তুমিও সেখান থেকেই নাও।” (ইবনুল কাইয়্যিম রচিত ‘ঈলামুল মুওয়াকেয়ীন- ২/৩০২)।
তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি রাসূল (স)-এর সহীহ হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করবে সে লোক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।” (ইবনুল জাওযী রচিত, আল মানাকিব: ১৮২)
৫. আল্লামা ইবনে আবেদীন বলেন, “কোন মাসআলা সহীহ হাদীসের সাথে গড়মিল হলে ঐ হাদীসটিই আমল করবে । আর ঐ হাদীসই হবে তার মাযহাব। এরূপ আমল তাকে মাযহাব থেকে বের করে দেব না। হানাফী হলে সে হানাফীই থেকে যাবে।” (রাদ্দুল মুখতার- ১/১৫৪)
৬. সুনানে আবী দাউদ গ্রন্থের সংকলক মুহাদ্দিস আবু দাউদ (র) বলেন, এমন কোন লোক নেই, যার সব কথাই গ্রহণযোগ্য; কেবল রাসূলুল্লাহ (স) ছাড়া। (মাসাইলে ইমাম আহমদ: ২৭৬)
সর্বশেষে আল্লাহ তাআলার বাণীটি স্মরণ করি। তিনি বলেছেন,
“যারা (সব) কথা শুনে, অতঃপর উত্তমটি আমল করে তারাই হলো হেদায়াতপ্রাপ্ত, আর তারাই হলো বুদ্ধিমান।”
(সূরা আয যুমার, আয়াত নং ১৮)
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা মাযহাব অর্থ কি? মাযহাব কি? মাযহাব কাকে বলে? মাযহাব কয়টি? মাযহাব কত প্রকার ও কি কি? মাযহাবের পার্থক্যের কারণ সম্পর্কে জানলাম।
[সূত্র: ওপেন স্কুল ও hadithbd.com]