ইসলামি জীবন বিধানের মৌলিক যে পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে যাকাত তন্মধ্যে অন্যতম বুনিয়াদ বা স্তম্ভ। তাই যাকাত দেওয়ার নিয়ম, যাকাত কে দিবে, কাকে দিবে, এবং কাকে দেওয়া যাবে না এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যিক।
ইমান, সালাত, সাওম, যাকাত ও হজ্জ এ পাঁচটি বিধান মেনে চলা মুসলমানের জন্য ফরয বা অবশ্যকর্তব্য। এ পাঁচটি বুনিয়াদি বিধানের মধ্যে তিনটি বিধান ইমান, সালাত ও সাওম সকল মুসলমানের উপর ফরয করা হয়েছে। আর বাকি দুটি বিধান যাকাত ও হজ্জ শুধুমাত্র সামর্থ্যবান মুসলমানদের উপর ফরয করা হয়েছে। তাই যাকাত একটি আর্থিক ইবাদাত।
তাই আমাদের যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত, নিসাব কাকে বলে, কত টাকা থাকলে যাকাত দিতে হয়, যাকাতের খাত কয়টি, কয় শ্রেণীর লোককে যাকাত দেওয়া যায়, যাকাতের টাকা কাদের দেওয়া যাবে না ও যাকাতের গুরুত্ব ভালভাবে জানা থাকাতে হবে এবং যাকাত দেওয়ার নিয়ম অনুযায়ী এই ইবাদতটি পালন করতে হবে।
ধনসম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ অসহায় গরিব-দুঃখীদের জাকাত প্রদান করে মুমিনের আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে থাকেন। জাকাত গরিবের প্রতি ধনীর অনুগ্রহ নয়; বরং তাদের ন্যায্য অধিকার।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন,
“তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।”
(সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ১৯)
প্রিয় পাঠক, আজ আমরা ইসলামের এ গুরত্বপূর্ণ স্তম্ভ যাকাত দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানব। মোট ৬টি পয়েন্টে আজকের আলোচনাটি শেষ করব ইংশাআল্লাহ।
তো চলুন যাকাত দেওয়ার নিয়মসমূহ বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক-
(১) যাকাত কাকে বলে? যাকাত কি ও কেন?
যাকাত একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো পবিত্রতা, বৃদ্ধি, আধিক্য, বরকত ইত্যাদি।
যাকাত প্রদান করলে যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তির মনে কৃপণতার যে কলুষতা রয়েছে তা দূরীভূত হয়ে মন পবিত্র হয়। তা ছাড়া বিত্তশালীদের সম্পদে দরিদ্রদের যে অধিকার রয়েছে যাকাত প্রদানের মাধ্যমে তা করা হয়। ফলে এর মাধ্যমে তাঁর সম্পদও পবিত্র হয়।
যাকাত প্রদান করলে আল্লাহ ঐ ব্যক্তির সম্পদে বরকতদান করেন। এ ছাড়া যাকাত দরিদ্রদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। যাকাত প্রদানের ফলে দরিদ্রদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়, তাই যাকাত প্রদানের মাধ্যম সম্পদও বৃদ্ধি পায়। এজন্য যাকাতের অন্য অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া।
ইসলামি পরিভাষায় অর্থে যাকাত হচ্ছে শরিয়ত কর্তৃক নির্দিষ্ট সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে প্রদান করে মালিক বানিয়ে দেওয়া।
কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম সম্পদশালী ব্যক্তির নিকট যদি ৭.৫ তোলা স্বর্ণ (৮৫ গ্রাম সোনা) কিংবা ৫২.৫ তোলা রৌপ্য (৫৯৫ গ্রাম রুপা) অথবা এর সমপরিমাণ অর্থ/সম্পদ কমপক্ষে এক বছর সঞ্চিত থাকে, তাহলে তাকে তার সম্পদের শতকরা ২.৫ হারে (৪০ ভাগের এক ভাগ) গরিবের ও নিঃস্বদের হক আদায় করতে হয়। এ হক আদায় করার নামই যাকাত।
এছাড়া শস্য, পশু, ব্যবসায়িক মাল ইত্যাদির ওপর সুনির্দিষ্ট হারে যাকাতের বিধান রয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজিদের বিভিন্ন আয়াতে আমাদেরকে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে যাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।
যাকাত সম্পর্কে কোরআনের আয়াত,
“আর তোমরা নামায কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪৩)
যাকাত ধনীদের সম্পদে আল্লাহর নির্ধারিত গরিবের অংশ যা প্রদান করা অবশ্য কর্তব্য বা ফরয। এটি কোনো ধরনের দান বা অনুকম্পা নয়।
মহান আল্লাহর এ নির্দেশনার কারণেই যাকাত প্রদান করা ধনীদের কোনো প্রকারের অনুগ্রহ, দয়া বা সহযোগিতা নয়। এটি তাদের সম্পদে অসহায়, গরিব, অভাবী ও নিঃস্বদের হক বা অধিকার। তাই এ হক আদায় করে দেওয়া ধনীদের জন্য অবশ্য কর্তব্য বা ফরয।
ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ থেকে গরীব ও অসহায়দের এ হক আদায়ের নির্দেশ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
“তোমরা তাদের জানিয়ে দাও যে, মহান আল্লাহ তাদের সম্পদের উপর যাকাত ফরয করেছেন। তোমরা সমাজের সম্পদশালীদের সম্পদ থেকে তা (যাকাত) আদায় করে নিঃস্বদের মাঝে ফিরয়ে দাও।”
(বুখারি)
(২) যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি? যাকাত কাদের উপর ফরজ?
যাকাত ফরয ইবাদাত। তবে সকল মানুষের উপর যাকাত বাধ্যতামূলক নয়।
যাকাত ফরয হওয়ার শর্তসমূহ নিম্নরূপ-
- মুসলমান হওয়া;
- নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া;
- নেসাব প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া;
- ঋণগ্রস্ত না হওয়া;
- নিসাব পরিমাণ যাকাতের অর্থ সম্পদ মালিকের কাছে কমপক্ষে ১ বছর কাল থাকা।
- জ্ঞান-সম্পন্ন হওয়া; এবং
- বালেগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) হওয়া।
(৩) নিসাব কাকে বলে? নিসাব পরিমাণ সম্পদ কত টাকা? কত টাকা থাকলে যাকাত দিতে হয়? কত টাকা হলে যাকাত ফরজ?
যাকাত ধার্য হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা।
‘নিসাব’ বলা হয় নির্ধারিত নিম্নতম সীমা বা পরিমাণকে। এই পরিমাণ নির্ধারণে ব্যক্তির সর্বমোট আয় থেকে যাবতীয় ব্যয় বাদ দেওয়ার পর উদ্বৃত্ত অর্থ এবং তার পূর্বের সঞ্চয় ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ যুক্ত হবে।
প্রয়োজনীয় ব্যয় বাদে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য (৫৯৫ গ্রাম রুপা) বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (৮৫ গ্রাম সোনা) এর সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা সমমূল্যের সম্পদকে ‘নিসাব’ বলা হয়।
এছাড়াও ফসলের যাকাত (উশর), ফল, তরিতরকারি, পশু সম্পদ ইত্যাদির ওপর যাকাতের বিধান আছে।
(৪) যাকাতের খাত কয়টি? কাদের যাকাত দেওয়া যাবে? কয় শ্রেণীর লোককে যাকাত দেওয়া যায়? কে যাকাত পাওয়ার যোগ্য?
যাকাত বণ্টনের খাতসমূহ পবিত্র কুরআনে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন,
“সদকাতো (যাকাত) কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”
(সূরা তওবা, আয়াত: ৬০)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ যে আটটি খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
- ফকির বা দরিদ্র: ফকির বলতে সেই ধরনের ব্যক্তিদেরকে বোঝায় যারা একেবারে নিঃস্ব নয়। তাদের কিছু সহায় সম্পদ আছে। তবে এত কম যে তা দিয়ে অতি কষ্টে জীবন নির্বাহ করে থাকে। তাদের মৌলিক প্রয়োজন যথা অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের খরচ নির্বাহ করার মতো সামর্থ্য নেই।
- মিসকিন বা নিঃস্ব: যাদের জীবিকা নির্বাহের কোনো ব্যবস্থা বা নিশ্চয়তা নেই, জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা নেই। দৈহিকভাবে অক্ষম, বাঁচার জন্য অন্যের নিকট হাত পাততে হয়, তাদেরকে মিসকিন বা নিঃস্ব বলা হয়। এ ধরনের সকল প্রকার মিসকিন যাকাত পাবার যোগ্য।
- যাকাত আদায়কারী কর্মচারী: যে সকল কর্মচারী যাকাত বিভাগে কর্মরত। যারা যাকাত আদায় ও বণ্টনের সামগ্রিক কার্যক্রমের সাথে জড়িত, তাদের বেতন ও অন্যান্য প্রাপ্য যাকাতের অর্থ থেকে দেওয়া যাবে।
- চিত্ত আকর্ষণের জন্য: যারা নওমুসলিম, কিংবা সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে সমাজচ্যুত ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা দুর্বল ইমান দ্বিধাগ্রস্ত তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য। নওমুসলিম আর্থিকভাবে সক্ষম হলেও তাদের মনকে আকৃষ্ট করার জন্য যাকাত দেওয়া যেতে পারে।
- দাসমুক্তি: কোনো মুসলমান নর-নারী যদি দুর্ভাগ্যক্রমে দাসত্বের মধ্যে আটকা পড়ে বা বন্দি থাকে তবে তাকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের টাকা খরচ করা যেতে পারে।
- ঋণমুক্তি: ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, যার পক্ষে বৈধ আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয় তাদেরকে যাকাত দিয়ে ঋণমুক্ত করা যেতে পারে।
- ফী সাবিলিল্লাহ: ‘ফী সাবিলিল্লাহ’ বলতে আল্লাহর পথে খরচ করাকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহর পথে যে সকল কাজ, সে সকল খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। দ্বীনি ইলম শিক্ষার্থী, আল্লাহর পথে জিহাদকারী কিংবা সৎ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ দেওয়া যায়।
- মুসাফির: মুসাফির বলতে ওই ব্যক্তিকে বোঝানো হয়ে থাকে যারা নিজ দেশে ধনী হলেও সফরে এসে নিঃস্ব ও দরিদ্র হয়ে গেছেন। অর্থাৎ পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাকে যাকাতের টাকা সাহায্য হিসেবে দেওয়া যায়।
(৫) যাকাত কাদের দেয়া যাবে না? যাকাত কাকে দেওয়া দেয়া যাবে না? যাকাত কারা পাবে না? যাকাতের টাকা কাদের দেওয়া যাবে না?
যাদের যাকাত দেওয়া যাবে না, তারা হলো-
- কাফির। (অমুসলিম/যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে/যারা ইসলামের মৌলিক বিষয়বস্তুকে অস্বীকার করে।)
- নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। (যে ব্যক্তি অন্যূতম ৮৫ গ্রাম সোনা বা ৫৯৫ গ্রাম রুপার সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা সমমূল্যের দ্রব্যসামগ্রী বা বাণিজ্য পণ্যের মালিক, তাকে জাকাত দেওয়া যায় না।)
- নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের নাবালক সন্তান।
- বনু হাশেমের লোক।
- মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি—জাকাত দাতার সকল পিতৃকুল ও মাতৃকুলের সকল ঊর্ধ্বতন নারী-পুরুষকে জাকাত দেয়া যাবে না। অর্থাৎ জাকাত দাতা যাদের মাধ্যমে দুনিয়ায় এসেছে, তাদেরসহ তাদের ওপরের স্তরের কাউকে জাকাত দেওয়া যাবে না।
- জাকাত দাতার নিজের মাধ্যমে যারা দুনিয়ায় এসেছে, অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে ও তাদের সন্তানাদি একইভাবে তাদের সন্তানদের জাকাত দেওয়া যাবে না।
- স্ত্রী ও স্বামী একে অন্যকে জাকাত দিতে পারবে না।
- মসজিদ-মাদরাসা, পুল, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে ও মৃতের দাফনের কাজে জাকাতের টাকা দেওয়া যাবে না। কারণ, জাকাতের অর্থ শুধু গরিবদের ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দিলেই জাকাত আদায় হয়, আর এসব ক্ষেত্রে জাকাতের অর্থ ব্যয় ব্যক্তিবিশেষকে মালিক বানিয়ে দেওয়া হয় না।
- সেবার প্রতিদান বা পারিশ্রমিক হিসেবে কাউকে জাকাত দেওয়া যায় না ।
- কর্মচারীর মজুরি বা গৃহভৃত্য বা অন্য কোনো কর্মচারীকে মজুরি হিসেবে জাকাত দেওয়া যায় না। অবশ্য মজুরি ছাড়া উপহার হিসেবে তাদের জাকাত দেওয়া যায়।
(দেখুন- ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/১৮৮, ১৮৯; তাতারখানিয়া: ৩/২০৬; আদদুররুল মুখতার: ৩/২৯৪, ২৯৫; তাতারখানিয়া: ৩/১৯৮, ২০৮; দুররুল মুখতার: ৩/১৭১-১৭৩)
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
সহোদর ভাই-বোন, ফুফু-ফুফা, খালা-খালু, মামা-মামি যেহেতু উসুল বা ফুরু অর্থাৎ জাকাতদাতার মূল বা শাখা নয়, অর্থ্যাৎ যাকাত দাতা সরাসরি তাদের মাধ্যমে দুনিয়াতে আসেননি বা যাকাত দাতা মাধ্যমে তারা সরাসারি দুনিয়াতে আসেনি। তাই যদি তারা জাকাত গ্রহণের উপযোগী হয়, তাদের জাকাত দেওয়া যাবে। প্রয়োজনে অন্তরে জাকাতের নিয়ত রেখে মুখে তা উল্লেখ না করে দিয়ে দিলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে।
(দেখুন- হিদায়া: ১/২০৬, বাদায়ে: ২/৪৯)
(৬) যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
যাকাত একটি আর্থিক ফরয ইবাদাত। এর উদ্দেশ্য কেবলমাত্র আর্থিক লেনদেন বা ব্যক্তি কিংবা সামষ্টিক পর্যায়ে সাহায্য-সহযোগিতা নয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষের মনকে পরিশুদ্ধ করে তাকে শুদ্ধতম মানুষরূপে গড়ে তোলা এবং মহান আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করা।
প্রত্যেক স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম ব্যক্তি যার নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, এমন ব্যক্তিকে যাকাত প্রদান করতে হয়। যাকাত প্রদানকারীর সম্পদে আল্লাহ তা’আলা বরকত দান করেন এবং এর বিনিময়ে আখিরাতে তাকে অফুরন্ত কল্যাণ প্রদান করবেন।
হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন,
“হে বনি আদম! আমার পথে খরচ করতে থাকো। আমি আমার অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে তোমাদের দিতে থাকব।”
(বুখারি ও মুসলিম)
যাকাত প্রদানকারীর জন্য যেমন পুরস্কার রয়েছে তেমনি যাকাত প্রদানে যারা কৃপণতা করে তাদের জন্য শাস্তির দুঃসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
“দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী, আল্লাহর বান্দাদের নিকটবর্তী এবং জাহান্নাম থেকে দূরবর্তী। অপরদিকে কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, আল্লাহর বান্দাদের থেকে দূরে এবং জাহান্নামের সন্নিকটে। আর একজন জাহিল দানশীল একজন কৃপণ আবেদ অপেক্ষা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।”
(তিরমিযী)
যারা যাকাত প্রদান করে না কুরআন মাজিদ ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে তাদের জন্য কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“আর যারা সোনা-রুপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে ভয়ানক শাস্তির সংবাদ দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপালে, পাঁজরে ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে এবং তাদেরকে বলা হবে, এগুলোই সে সমস্ত সোনা-রুপা, যা তোমরা জমা করতে। কাজেই তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ ভোগ করো।”
(সূরা তওবা, আয়াত: ৩৪-৩৫)
সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণে ইসলাম যে সকল ব্যবস্থা মানুষকে উপহার দিয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে যাকাত।
সম্পদের সুষম বণ্টন করা না গেলে সম্পদ কতিপয় মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত হয়ে পড়ে। ফলে সমাজে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়। মানুষের অভাব-অনটন বেড়ে যায়, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ঘটে। এসব সমস্যা থেকে মানবজাতিকে রক্ষার লক্ষ্যে মহান আল্লাহ প্রত্যেক সম্পদশালী ব্যক্তির উপর যাকাত অবশ্যপালনীয় বা ফরয করেছেন।
তিনি (আল্লাহ) চান এ সম্পদ সুষম বণ্টনের মাধ্যমে যেন মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়। এ জন্য যারা যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়, তারা কৃপণ এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“মুশরিকদের জন্য শুধুই ধ্বংস, যারা যাকাত আদায় করে না।”
(সূরা হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত: ৬-৭)
আল্লাহর আদেশ মান্য করে যাকাত আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। যাকাত প্রদানের মাধ্যম সম্পদ ও মন পবিত্র হয়। তা ছাড়া এর মাধ্যমে সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটে।
যাকাত প্রদানকারীকে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে অফুরন্ত কল্যাণ দান করেন। পক্ষান্তরে যাকাত অস্বীকারকারীর জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন।
তাই আমাদের কর্তব্য হলো, নিজে যাকাত প্রদান করা এবং অন্যকে যাকাত দানে উৎসাহিত করা।
ক) যাকাতের ধর্মীয় গুরুত্ব
যাকাত মুসলমানদের জন্য অবশ্য পালনীয় ইবাদাত। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমান নর-নারীর ওপর যাকাত ফরয।
যাকাত হলো আর্থিক ইবাদাত। যাকাত দানের মাধ্যমে ব্যক্তির উপার্জিত সম্পদ পবিত্র হয়। ধন- সম্পদের মোহ ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।
মানুষ তার শরীরের চেয়ে সম্পদকে বেশি ভালোবাসে। এ জন্য মানুষ সম্পদ আহরণের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে। অথচ আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য সেই সম্পদকে দান করে থাকে। তাই যাকাতদানকারী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করবে। অপরপক্ষে যাকাত আদায় না করলে মহাপাপী হবে এবং জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করতে হবে।
একজন মুসলিম স্বেচ্ছায় যাকাত প্রদান করার মাধ্যমে তার ধন-সম্পদের জন্য আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এর ফলে সে আত্মিক শান্তি পায়।
আল-কুরআনের ঘোষণা,
“তাদের সম্পদ হতে ‘সদকা’ (যাকাত) গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র এবং পরিশুদ্ধ করবে। তুমি তাদেরকে দোয়া করবে। তোমার দোয়া তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”
(সূরা তওবা, আয়াত: ১০৩)
খ) যাকাতের সামাজিক গুরুত্ব
যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সমাজে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ, সহৃদয়তা ও সহনশীলতার প্রকাশ ঘটে। অর্থনৈতিকভাবে যারা অস্বচ্ছল তারা আর্থিকভাবে সক্ষম হয়ে থাকে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমে থাকে।
যাকাত দানের ফলে সমাজের গরিব, এতিম, বিধবা, বৃদ্ধ, রুগ্ণ, পঙ্গু, ও অক্ষম ব্যক্তিরা তাদের অভাব দূর করতে পারেন।
অর্থের অভাবে মানুষ চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই ও সন্ত্রাসের মতো অসংখ্য খারাপ কাজে , জড়িয়ে পড়ে। যাকাতের টাকা এ সকল মানুষকে অভাব থেকে দূরে রাখে এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে থাকে।
এ ছাড়া যাকাতের মাধ্যমে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজ করা হয়ে থাকে। যার ফলে সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত হয়।
গ) যাকাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
সম্পদশালীদের সম্পদ যাকাত আকারে সমাজের দরিদ্র শ্রেণির হাতে আসে। যাকাতের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরে সম্পদের প্রবাহ গতিশীল হয়।
দরিদ্র শ্রেণি যাকাত থেকে প্রাপ্ত অর্থ উৎপাদনের কাজে লাগিয়ে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করে থাকে। অভাবী মানুষ তার অভাব পূরণ করতে পারে।
ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ যাকাতের অর্থকে পুঁজি হিসেবে গ্রহণ করে নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটিয়ে থাকে।
প্রতিবছর যাকাত দেওয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার ক্রমান্বয়ে কমে আসবে।
আজকের যাকাত দেওয়ার নিয়ম বিষয়ক আলোচনাটি এখনেই সমাপ্ত হচ্ছে, আশা করি আমারা যে সমস্ত যাকাত দেওয়ার নিয়মগুলো জানলাম তা মেনে ফরয এই আর্থিক ইবাদতটি পালন করাতে পারব, আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।
Queries discussed: যাকাত দেওয়ার নিয়ম, যাকাত কাকে বলে, যাকাত কি ও কেন, যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি, যাকাত কাদের উপর ফরজ, নিসাব কাকে বলে, নিসাব পরিমাণ সম্পদ কত টাকা, কত টাকা থাকলে যাকাত দিতে হয়, কত টাকা হলে যাকাত ফরজ, যাকাতের খাত কয়টি, কাদের যাকাত দেওয়া যাবে, কয় শ্রেণীর লোককে যাকাত দেওয়া যায়, কে যাকাত পাওয়ার যোগ্য, যাকাত কাদের দেয়া যাবে না, যাকাত কাকে দেওয়া দেয়া যাবে না, যাকাত কারা পাবে না, যাকাতের টাকা কাদের দেওয়া যাবে না, যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, যাকাতের ধর্মীয় গুরুত্ব, যাকাতের সামাজিক গুরুত্ব, যাকাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব।
[সূত্র: এনসিটিবি]