Skip to content

রিসালাত শব্দের অর্থ কী, কাকে বলে? এর সংজ্ঞা, গুরুত্ব, উদ্দেশ্য, গুণাবলি, সমাপ্তি ও খতমে নবুয়ত

রিসালাত শব্দের অর্থ কী, কাকে বলে এর সংজ্ঞা, গুরুত্ব, উদ্দেশ্য, গুণাবলি, সমাপ্তি ও খতমে নবুয়ত

(১) রিসালাত শব্দের অর্থ কী?

রিসালাত শব্দের আভিধানিক অর্থ বার্তা, চিঠি পৌছানো, পয়গাম, সংবাদ বা কোনো ভালো কাজের দায়িত্ব বহন করা।

(২) রিসালাত কাকে বলে? রিসালাতের সংজ্ঞা

ইসলামি পরিভাষায়, মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র বাণী মানুষের নিকট পৌছে দেওয়ার দায়িত্বকে রিসালাত বলা হয়। আর যিনি এ দায়িত্ব পালন করেন তাঁকে বলা হয় রাসুল। রাসুল শব্দের বহুবচন রুসুল।

(৩) রিসালাতে বিশ্বাসের গুরুত্ব

ইসলামি জীবনদর্শনে রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য। তাওহিদে বিশ্বাসের সাথে সাথে প্রত্যেক মুমিন ও মুসলিমকেই রিসালাতে বিশ্বাস করতে হয়। ইসলামের মূলবাণী কালিমা তায়্যিবাতে এ বিষয়টি সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে।

কালিমা তায়্যিবার প্রথমাংশ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; অর্থ- আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই) দ্বারা তাওহিদের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর সাথে সাথে দ্বিতীয়াংশ (মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ অর্থ- মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল) দ্বারা রিসালাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাওহিদে বিশ্বাস স্থাপনের ন্যায় রিসালাতেও বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।

বস্তুত, রিসালাতে বিশ্বাস না করলে কেউ মুমিন হতে পারে না। কেননা মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। এ স্বল্প জ্ঞান দ্বারা অনন্ত, অসীম আল্লাহ তায়ালার পূর্ণ পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয়। তাই নবি-রাসুলগণ মানুষের নিকট আল্লাহ তায়ালার পরিচয় তুলে ধরেছেন। তাঁর পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ও গুণাবলির বর্ণনা প্রদান করেছেন।

নবি-রাসুলগণ ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের জন্য আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত জীবনবিধান ও দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) না আসলে নবি ও রাসুল সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারতাম না। এমনকি আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও সিফাতের পরিচয়ও লাভ করতে পারতাম না। মূলত নবি-রাসুলগণের আনীত বাণী ও বর্ণনার ফলেই মানুষের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে।

সুতরাং নবি-রাসুলগণের এ সমস্ত সংবাদ বা রিসালাতকে বিশ্বাস করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, রিসালাতকে অস্বীকার করলে মহান আল্লাহকেই প্রকারান্তরে অস্বীকার করা হয়।

অতএব, মানবজীবনে রিসালাতে বিশ্বাস করা ইমানের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে নির্ধারিত।

(৪) নবি-রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য

আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য-অগণিত নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্যহীনভাবে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়নি বরং তাঁরা নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন।

নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের বেশ কিছু কাজ করতে হতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতিপয় কাজ হলো-

  • তাঁরা মানুষের নিকট আল্লাহ তায়ালার পরিচয় তুলে ধরতেন। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার জাত-সিফাত, ক্ষমতা, নিয়ামত ইত্যাদি বিষয়ের কথা মানুষের নিকট প্রকাশ করতেন।
  • সত্য ও সুন্দর জীবনের দিকে আহবান জানাতেন।
  • আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও ধর্মীয় নানা বিধি-বিধান শিক্ষা দিতেন।
  • পরকাল সম্পর্কে ধারণা প্রদান করতেন।
  • পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান বাস্তবায়নের জন্য হাতে-কলমে শিক্ষা দিতেন।

(৫) নবি-রাসুলগণের গুণাবলি

নবি-রাসুলগণ ছিলেন আল্লাহ তায়ালার মনোনীত বান্দা। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাঁদের নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আল্লাহ তায়ালাই ফেরেশতাদের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকেও রাসুল মনোনীত করেন; আল্লাহ তো সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা।”

(সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ৭৫)

সুতরাং মনোনীত বান্দা হিসেবে নবি-রাসুলগণ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। প্রথমত, তাঁরা ছিলেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তায়ালার উপর বিশ্বাসী। সবধরনের কথায় ও কাজে তাঁরা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের অনুসরণ করতেন। আল্লাহ তায়ালার পূর্ণ আনুগত্যই ছিল তাঁদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

নবি-রাসুলগণ ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, সুবিবেচক ও বিচক্ষণ। তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ। তাঁরা সবধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র ছিলেন। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁদের সকল প্রকার অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে বাঁচিয়ে রাখতেন।

হযরত ইউসুফ (আঃ) ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ নবি। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আমি তাঁকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্য এভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। সে তো ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।”

(সূরা ইউসুফ, আয়াত ২৪)

নবি-রাসুলগণ ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। সকল সৎগুণ তাঁরা অনুশীলন করতেন। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ, সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ। দয়া, ক্ষমা, ধৈর্য ইত্যাদি সব ধরনের মানবিক গুণ তাঁদের চরিত্রে বিদ্যমান ছিল।

মিথ্যা, প্রতারণা, পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি খারাপ স্বভাবের লেশমাত্র তাঁদের চরিত্রে কখনোই ছিল না। বরং তাঁরা ছিলেন সৎস্বভাবের জন্য মানবজাতির অনুপম আদর্শ।

কর্তব্যনিষ্ঠা ও দায়িত্বপালনে নবি-রাসুলগণ ছিলেন অতুলনীয়। নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাঁরা বিন্দুমাত্র অলসতা ও উদাসীনতা প্রদর্শন করেননি। বরং এজন্য কাফিরদের বহু অত্যাচার ও নিপীড়ন ধৈর্যসহকারে সহ্য করেছেন। কিন্তু তারপরও তাঁরা যথাযথভাবে মানুষের নিকট আল্লাহ তায়ালার বাণী পৌঁছিয়েছেন।

তাঁরা ছিলেন নির্লোভ ও নিঃস্বার্থ। পার্থিব কোনো লাভের আশায় তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব থেকে কখনো পিছপা হননি। কাফিররা ইসলামের দাওয়াত প্রচার বন্ধ করার জন্য তাঁদের নানা প্রলোভন দেখাত। কিন্তু তাঁরা পার্থিব স্বার্থের কাছে মাথা নত করেননি।

দীন প্রচারে নবি-রাসুলগণ ছিলেন ত্যাগের মূর্ত প্রতীক। বিনা দ্বিধায় পার্থিব আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস, ধন-সম্পদ তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে ত্যাগ করতেন।

দীন প্রচারের স্বার্থে প্রিয়নবি (সাঃ) বাড়ি-ঘর, আত্মীয়- স্বজন, এমনকি নিজ দেশ মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। নবি-রাসুলগণের জীবনীতে ত্যাগের এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়।

নবুয়তের ধারা আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। সর্বপ্রথম নবি ছিলেন হযরত আদম (আঃ), আর সর্বশেষ নবি ও রাসুল হলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। এঁদের মাঝখানে আল্লাহ তায়ালা আরও বহু নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। নবি-রাসুলদের আগমনের এই ধারাবাহিকতাকেই নবুয়তের ক্রমধারা বলা হয়।

দুনিয়াতে আগত সকল গোষ্ঠী বা জাতির জন্যই আল্লাহ তায়ালা নবি-রাসুল বা পথপ্রদর্শনকারী পাঠিয়েছেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যই পথপ্রদর্শক রয়েছে।”

(সূরা আর-রাদ, আয়াত ৭)

তাঁরা মানুষকে এক আল্লাহ তায়ালার দিকে ডাকতেন। সত্য ও সুন্দর জীবনবিধান তথা আল্লাহর দীন অনুসরণের নির্দেশ দিতেন।

সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শরিয়ত তথা দীনের বিধি-বিধান এক রকম ছিল না। বরং মানবজাতির পরিবেশ, পরিস্থিতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন শরিয়ত দেওয়া হতো। নবি-রাসুলগণ তা মানবসমাজে বাস্তবায়ন করতেন। তবে সব নবি-রাসুলের দীনের মৌলিক কাঠামো ছিল এক ও অভিন্ন।

আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ বা তাওহিদ ছিল সবারই প্রচারিত দীনের মূলকথা। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আগত সকল নবি-রাসুলই এ দীন প্রচার করেছেন। হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইবরাহিম (আঃ), হযরত মুসা (আঃ), হযরত দাউদ (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) সকলেই এই একই দীন ও শিক্ষা প্রচার করেছেন।

আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন নবুয়তের ধারার সর্বশেষ নবি। তাঁর পরে আর কোনো নবি আসেননি, আসবেনও না। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাধ্যমে দীনের পূর্ণতা প্রদান করেন।

আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন,

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”

(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩)

এভাবে দীনের বিধি-বিধান পূর্ণতা প্রাপ্তির ফলে নবি-রাসুলগণের আগমনের ধারাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নবুয়তের ধারাও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়।

মানুষের হিদায়াতের জন্য আগমনকারী এসব নবি-রাসুল সকলেই ছিলেন আল্লাহ তায়ালার মনোনীত বান্দা। তাঁদের সকলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“রাসুল, তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ইমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। তাদের সবাই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসুলগণে ইমান এনেছে। তারা বলে, আমরা তাঁর রাসুলগণের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না।”

(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৮৫)

নবুয়তের ধারায় আগমনকারী সব নবি-রাসুলকে বিশ্বাস করা ইমানের অপরিহার্য শর্ত। এঁদের কাউকে বিশ্বাস এবং কাউকে অবিশ্বাস করা যাবে না। বরং সকলকেই আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত নবি-রাসুল হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে। নবি-রাসুল হিসেবে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। কারও প্রতিই কোনোরূপ ঠাট্টা-বিদ্রূপ বা কটাক্ষ করা যাবে না।

(৬) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি

নবুয়তের ধারার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ছিলেন আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। দুনিয়াতে আগমনকারী সব নবি-রাসুলই কোনো বিশেষ গোত্র, বিশেষ দেশ, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন সারা বিশ্বের সকল স্থানের সকল মানুষের নবি। তিনি বিশ্বনবি।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“(হে নবি!) আপনি বলুন, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সকলের জন্যই আল্লাহর রাসুল হিসেবে প্রেরিত।”

(সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৫৮)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন সর্বকালের নবি। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আগমন করবে সকলের নবি তিনিই। তাঁর শিক্ষা, আদর্শ ও আনীত কিতাব আল-কুরআন সকলকেই অনুসরণ করতে হবে। তিনি রহমতের নবি। মানবজাতির জন্য তিনি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নিয়ামত ও অনুগ্রহ স্বরূপ।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“(হে নবি!) আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।”

(সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)

অতএব, আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)- কে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হিসেবে বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি কর্তব্য।

(৭) খতমে নবুয়তের অর্থ ও এতে বিশ্বাসের গুরুত্ব

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন সর্বশেষ নবি। তাঁর মাধ্যমে দীনের পূর্ণতা ঘোষিত হয় এবং নবুয়তের ধারা সমাপ্ত হয়। তিনি নবি-রাসুলগণের ধারায় সর্বশেষে আগমন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ তথা সর্বশেষ নবি বলে অভিহিত করেছেন।

খাতামুন অর্থ শেষ, সমাপ্তি। আর নবুয়ত হলো নবিগণের দায়িত্ব। সুতরাং খতমে নবুয়তের অর্থ নবুয়তের সমাপ্তি। আর যার মাধ্যমে নবুয়তের ধারার সমাপ্তি ঘটে তিনি হলেন খাতামুন নাবিয়্যিন বা সর্বশেষ নবি।

আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন হযরত আদম (আঃ)। আর সর্বশেষ ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে নবি-রাসুলগণের আগমনের ধারা শেষ বা বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং তিনিই সর্বশেষ নবি বা খাতামুন নাবিয়্যিন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবি।”

(সূরা আল আহযাব, আয়াত ৪০)

খাতামুন শব্দের অন্যতম অর্থ সিলমোহর। কোনো কিছুতে সিলমোহর তখন অঙ্কিত করা হয় যখন তা পূর্ণ হয়ে যায়। সিলমোহর লাগানোর পর তাতে কোনো কিছু প্রবেশ করানো যায় না। নবুয়তের সিলমোহর হলো নবুয়তের পরিসমাপ্তির ঘোষণা। নবুয়তের দায়িত্বের পরিসমাপ্তি ঘোষণা। অর্থাৎ নতুনভাবে কোনো ব্যক্তি নবি হতে পারবে না এবং নবুয়তের ধারায় প্রবেশ করতে পারবে না। এটাই হলো খতমে নবুয়তের মূল কথা।

আমাদের প্রিয় নবি (সাঃ) হলেন খাতামুন নাবিয়্যিন। তিনি সর্বশেষ নবি। তাঁর পরে আর কোনো নবি নেই। তাঁর পরে আজ পর্যন্ত কোনো নবি আসেননি। কিয়ামত পর্যন্ত আসবেনও না। তাঁর পরবর্তীতে যারা নবুয়ত দাবি করেছে তারা সবাই ভণ্ড, মিথ্যাবাদী ও প্রতারক।

কেননা মহানবি (সাঃ) বলেছেন,

“আমিই শেষ নবি। আমার পরে কোনো নবি নেই।”

(সহিহ মুসলিম)

অন্য একটি হাদিসে মহানবি (সাঃ) বলেছেন,

“অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হবে। তারা প্রত্যেকেই নবি হওয়ার দাবি করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবি। আমার পর আর কোনো নবি আসবে না।”

(আবু দাউদ)

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে খাতামুন নাবিয়্যিন হিসেবে বিশ্বাস করা ইমানের অন্যতম অঙ্গ। তাঁর পরবর্তীতে যারা নবি বলে দাবি করেছে সবাই মিথ্যাবাদী। আমরা তাদের নবি হিসেবে বিশ্বাস করব না। তাদের শিক্ষা, আদর্শ বর্জন করব।

আমরা জীবনের সর্বাবস্থায় মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ করে চলব।

(৮) নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে রিসালাত ও নবুয়ত এর ভূমিকা

ইসলাম নীতি-নৈতিকতার ধর্ম। ইসলামের সমস্ত আকিদা-বিশ্বাস, বিধি-বিধান, শিক্ষা-আদর্শ নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

ইসলামি জীবনদর্শনে রিসালাত ও নবুয়ত অপরিহার্য বিষয়। নবুয়ত ও রিসালাত হলো নবি-রাসুলগণের দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালার বাণী ও শিক্ষা মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়াকে নবুয়ত ও রিসালাত বলা হয়।

মানবজীবনে নৈতিক মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসারে নবুয়ত ও রিসালাত প্রধানত দুই ভাবে ভূমিকা রাখতে পারে-

প্রথমত,

নবুয়ত ও রিসালাতের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব, পরিচয় ও গুণাবলি সম্পর্কে জ্ঞান দান করা। মানুষকে সত্য ও সুন্দরের দিকে পরিচালনা করা। সর্বোপরি ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও সফলতার দিকনির্দেশনা প্রদান করা।

নবুয়ত ও রিসালাতের শিক্ষা মানুষকে শান্তি ও শৃঙ্খলার দিকে পরিচালনা করে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সকল কাজকর্ম আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত পথে পরিচালনা করতে সাহায্য করে।

এভাবে দেখা যায়, যে ব্যক্তি নবুয়ত ও রিসালাতের শিক্ষানুসারে জীবনযাপন করে সেই পরিপূর্ণ মানুষ। এরূপ ব্যক্তি সমস্ত মানবিক গুণের অধিকারী হয়। পশুত্বের অভ্যাস ত্যাগ করে মনুষ্যত্বের অভ্যাস অনুশীলন করে।

নবুয়ত ও রিসালাতের চেতনা মানুষের মধ্যকার সমস্ত খারাপ অভ্যাস, অশ্লীলতা ও মন্দকর্মের চর্চা দূর করে দেয়। মানুষ সৎ ও সুন্দর জীবনযাপনে উৎসাহিত হয়। উত্তম চরিত্র ও নৈতিক আচার-আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়। এভাবে নবুয়ত ও রিসালাতের শিক্ষায় মানুষ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়।

দ্বিতীয়ত,

নবুয়ত ও রিসালাত মানুষকে নবি-রাসুলগণের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে।

নবি-রাসুলগণ ছিলেন নিষ্পাপ। তাঁরা ছিলেন সকল সৎগুণের অধিকারী। উত্তম চরিত্রের নমুনা ছিল তাঁদের জীবনচরিত। কোনোরূপ অন্যায়, অনৈতিক ও অশ্লীল কাজকর্ম তাঁদের চরিত্রে কখনোই ছিল না। বরং সর্বাবস্থায় নীতি ও নৈতিকতার আদর্শ রক্ষা করাই ছিল তাঁদের অন্যতম দায়িত্ব।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।”

(সূরা আল-আহযাব, আয়াত ২১)

বস্তুত নবি-রাসুলগণ ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাঁদের জীবনী ও শিক্ষা আমাদের জন্য আদর্শ।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,

আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।

(ইবনে মাজাহ)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন মানবতার মহান শিক্ষক। তিনি মানুষকে মানবতা ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়েছেন।

তিনি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদির নির্দেশনা প্রদান করেছেন। অত্যাচার, অবিচার ও অনৈতিকতার বদলে সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার কথা বলেছেন।

তিনি মানুষকে উত্তম চরিত্রবান হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। নিজ জীবনে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ অনুশীলনের মাধ্যমে হাতে কলমে মানুষকে নৈতিকতা সমুন্নত রাখতে শিক্ষা দিয়েছেন।

তিনি স্বয়ং বলেছেন,

“উত্তম গুণাবলির পরিপূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।”

(বায়হাকি)

বস্তুত নবি-রাসুলগণ সকলেই ছিলেন উত্তম আদর্শের নমুনা। আর আমাদের প্রিয়নবি (সাঃ) ছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্বোত্তম। তাঁর চরিত্রে মানবিক সবগুণ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।

নবুয়ত ও রিসালাতে বিশ্বাসের মাধ্যমে আমরা ইসলামি জীবনদর্শনে প্রবেশ করি। অতঃপর নবি-রাসুলগণের জীবনী ও আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ কামনা করি। এভাবে আমাদের জীবন ও চরিত্র উত্তম হয়। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকশিত হয়। মানবসমাজে পশুত্বের পরিবর্তে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে।

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts