(১) সূরা নাছর এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
সূরা নাছর পবিত্র কুরআনের একটি ছোট সূরা। এই সূরা মক্কায় বিদায় হজের সময় অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু যে সমস্ত সূরা হিজরতের পরে অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলো স্থান নির্বিশেষে মাদানি সূরা। এজন্য এ সূরাও মাদানি সূরা।
- সূরা নাছর পবিত্র কুরআনের ১১০তম সূরা।
- সূরা নাছর এর আয়াতের সংখ্যা ৩টি।
- সূরা নাছর পবিত্র কুরআনের ৩০তম পারায় অবস্থিত।
- সূরা নাছর এর রুকুর সংখ্যা ১টি।
- সূরা নাছর এর পূর্ববর্তী সূরা হলো- সূরা কাফিরুন।
- সূরা নাছর এর পরবর্তী সূরা হলো- সূরা লাহাব।
এ সূরার ‘নাসর’ শব্দ থেকে সূরাটির নাম রাখা হয়েছে আন-নাসর।
(২) সূরা নাছর বাংলা উচ্চারণসহ অর্থ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে৷
1. | إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ ইযা জা- আনাসুরুল্লাহি ওয়াল ফাতহু। যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়। |
2. | وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا ওয়ারা আইতান্না-সা ইয়াদখুলুউনা, ফি দ্বীনিল্লাহি আফওয়া-জা। এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবেন। |
3. | فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرُهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا ফাসাব্বিহ বিহামদি রাব্বিকা ওয়াস্তাগ ফিরহ্; ইন্নাহু কা-না তাও-ওয়া-বা। তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন, তিনি তো তওবাকবুলকারী। |
(৩) সূরা নাছর এর বাংলা উচ্চারণ
ইযা জা- আনাসুরুল্লাহি ওয়াল ফাতহু। ওয়ারা আইতান্না-সা ইয়াদখুলুউনা, ফি দ্বীনিল্লাহি আফওয়া-জা। ফাসাব্বিহ বিহামদি রাব্বিকা ওয়াস্তাগ ফিরহ্; ইন্নাহু কা-না তাও-ওয়া-বা।
(৪) সূরা নাছর এর ব্যাখ্যা
হাদিসে বর্ণিত আছে যে, সূরা আন-নাস্ত্র কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা। অর্থাৎ এরপর কোনো সম্পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ হয় নি। এ সূরাতে মক্কা বিজয়ের পর মানুষ যে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তা উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামের এ বিজয়ের ফলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুয়তী দায়িত্বের পরিপূর্ণতাও বোঝানো হয়েছে। তাই বিশিষ্ট সাহাবিগণ এ সূরা নাজিল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওফাত নিকটবর্তী বলে বুঝতে পেরেছিলেন।
মহানবি (সাঃ)-এর দুনিয়াতে আগমন ও অবস্থান করার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে বলে এ সূরায় ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ সূরা দ্বারা আরও বোঝানো হয়েছে যে, কোনো ব্যাপারে যখন আল্লাহ সাহায্য করেন তখন অনেক অসাধ্য কাজও সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। তখন আল্লাহর প্রশংসা করা আবশ্যক।
৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পরের বছর অর্থাৎ ৯ম ও ১০ম হিজরীকে ইতিহাসে ‘প্রতিনিধি দলসমূহের আগমনের বছর’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিনিধি দলসমূহের সংখ্যা ৭০ এর চেয়ে বেশি। ওই সময়ে মক্কার কাফিররা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। সূরা নাসরে মানুষের বিজয়ের বা সাফল্যের জন্য সৃষ্টিকর্তার সাহায্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
বিজয় মানুষের শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে না, বিপুল শক্তিশালী দলও যুদ্ধে পরাজিত হয়; অন্যদিকে, দুর্বল দলও আল্লাহ’র সাহায্যক্রমে জয়ী হতে পারে বদরের যুদ্ধ যার প্রমাণ। শক্তিমত্তা নয়, আল্লাহ’র সাহায্যই বিজয়ের একমাত্র নিয়ামক, এ কথাই সূরা নাসরের প্রথমিক তাৎপর্য।
বিজয়ের মুহূর্তে আল্লাহ তার রাসুল -কে দুটি নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিজের একটি গুণের কথা পুনরুক্ত করেছেন।
প্রথমটি হলো আল্লাহ’র গুণকীর্তন করা যে তিনি সবরকম দুর্বলতা বা দোষ থেকে মুক্ত (অর্থাৎ তিনি কারো সাহায্যের মুখাপেক্ষী নন)।
দ্বিতীয়ত আল্লাহ’র কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে তথা তাওবা করতে বলা হয়েছে। পুনরুক্ত করে বলা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী। লক্ষণীয় যে, বিজয়ের জন্য উৎসব করতে বলা হয় নি।
(৫) সূরা নাছর এর শিক্ষা
এ সূরার শিক্ষা নিম্নরূপ-
- আমাদের যাবতীয় কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন।
- আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সফলতা লাভ করা যায় না।
- কোনো কাজে সফলতা আসলে আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করা উচিত।
- যাবতীয় ত্রুটি, অপরাধ বা পাপকাজের জন্য তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
অতএব, সকল সাওয়াবের কাজ করতে ও পাপকাজ থেকে বাঁচতে আমরা আল্লাহর সাহায্য চাইব। যখন আমাদের সফলতা আসবে তখন আমরা আল্লাহর প্রশংসা করব। আর যদি কোনো ত্রুটি হয়ে যায়, এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব।
(৬) সূরা নাছর এর শানে নুযূল
এই সূরার আয়াতসমূহ নবী মুহাম্মদ কে উদ্দেশ্য করে বর্ণিত। মক্কা বিজয়ের লক্ষণসমূহ পরিস্ফুট হয়ে ওঠা এবং এ বিজয়ের মাধ্যমে দুনিয়াতে ইসলামের রাসুল মুহাম্মদ-এর আগমন ও অবস্থানের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাওয়ার সমাসন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে এই সূরাটি নাযিল হয়ে থাকবে। এ সূরার অন্যতম তাৎপর্য এই যে মৃত্যু নিকটবর্তী প্রতীয়মান হলে মুসলমান ব্যক্তিকে তাসবীহ ও ইস্তেগফার করতে হবে।
আয়িশা (রা:) থেকে বর্ণিত যে, সূরা আন নাসর নাযিল হওয়ার পর রাসুল প্রত্যেক নামাযের পর ‘সুবহানাকা রাব্বানা ওয়া বেহামদিকা আল্লাহুম্মাগ ফিরলি’ দুয়াটি পাঠ করতেন।
উম্মে সালমা থেকে বর্ণিত যে, সূরা আন নছর নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসুল (সা:) সর্বাবস্থায় ‘সুবহানাল্লাহে ওয়া বেহামদিহি আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়া আ তুউবু ইলাইহি’ দুয়াটি পাঠ করতেন এবং, অতঃপর, এই দুয়া পাঠের যুক্তিস্বরূপ সূরাটি তিলাওয়াত করতেন।
(তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন এর অষ্টম খণ্ড, মূল লেখক: মুফতী মুহাম্মদ শফী এবং বাংলায় অনুবাদ: মুহিউদ্দীন খান, পঞ্চম সংস্করণ এর পৃ:৮৮৬)
(৭) সূরা নাছর এর তাফসির
সূরা নাছর এর প্রথম আয়াত:
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ
যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় [১]
[১] এ ব্যাপারে প্রায় সকলেই একমত যে, এখানে বিজয় বলে মক্কা বিজয় বোঝানো হয়েছে। [মুয়াস্সার, ইবন কাসীর]। আর বিজয় মানে কোন একটি সাধারণ যুদ্ধে বিজয় নয় বরং এর মানে হচ্ছে এমন একটি চুড়ান্ত বিজয় যার পরে ইসলামের সাথে সংঘর্ষ করার মতো আর কোন শক্তির অস্তিত্ব দেশের বুকে থাকবে না এবং একথাও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বর্তমানে আরবে এ দ্বীনটিই প্রাধান্য বিস্তার করবে। [দেখুন: আদওয়াউল বায়ান]
(তাফসীরে জাকারিয়া)
সূরা নাছর এর দ্বিতীয় আয়াত:
وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا
এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে। [1]
[1] আল্লাহর সাহায্য অর্থ হল, ইসলাম এবং মুসলিমদের কুফর ও কাফেরদের উপর বিজয় দান। আর বিজয় অর্থ হল, মক্কা বিজয়। মক্কা মহানবী (সাঃ)-এর জন্মভূমি এবং বাসস্থান ছিল। কিন্তু সেখান হতে তাঁকে এবং তাঁর সাহাবাগণ (রাঃ)-কে কাফেররা হিজরত করতে বাধ্য করেছিল। সুতরাং যখন ৮ হিজরীতে এই মক্কা নগরী বিজয় হল তখন লোকরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে লাগল। অথচ এর পূর্বে এক-দুজন করে মুসলমান হত। মক্কা বিজয়ের পর মানুষের নিকট এ বিষয়টি পূর্ণভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠল যে, তিনি আল্লাহর সত্য পয়গম্বর এবং ইসলামই হল সত্য ধর্ম; যা অবলম্বন ব্যতীত পরকালে পরিত্রাণ সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা বললেন, যখন এমন হবে তখন তুমি—-।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
সূরা নাছর এর তৃতীয় আয়াত:
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرُهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا
তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি অধিক তাওবা গ্রহণকারী। [1]
[1] অর্থাৎ, বুঝে নাও যে, রিসালতের তবলীগ ও হক প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যা তোমার উপর ছিল তা পূর্ণ হয়ে গেছে। এবার দুনিয়া থেকে তোমার বিদায় নেওয়ার পালা এসে গেছে। এ জন্য তুমি আল্লাহর তসবীহ, প্রশংসা এবং ক্ষমা প্রার্থনায় অধিকাধিক মনোযোগী হও। এ থেকে আমরা জানতে পারি যে, জীবনের শেষ দিনগুলিতে উক্ত কর্মাবলী করতে অধিক যত্নবান হওয়া উচিত।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
(৮) উপসংহার
এ সূরায় রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর রিসালতের দায়িত্ব পূর্ণতা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। তিনি অচিরেই ইহকালীন জীবন শেষ করে অপার জগতে পাড়ি দেবেন তার ইঙ্গিত রয়েছে।
তাওবার মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয়, বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং সর্বদা তাওবা ইস্তিগফারের মধ্যে রত থাকা উচিত। বিশেষ করে যারা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে, মৃত্যু নিকটে এসে পড়েছে তাদের জন্য আরো উত্তমভাবে আল্লাহমুখী হওয়া উচিত।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে নেক হায়াত দান করুন।
[সূত্র: এনসিটিবি ও hadithbd.com]