(১) সূরা যিলযাল এর পরিচিতি
সূরা যিলযাল এ কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত যিলযাল শব্দ থেকে এর নাম রাখা হয়েছে সূরা আল-যিলযাল।
- সূরা যিলযাল হলো মাদানী সূরা।
- সূরা যিলযাল হচ্ছে পবিত্র কুরআনের ৯৯তম সূরা।
- সূরা যিলযাল এর আয়াতর সংখ্যা ৮টি।
- সূরা যিলযাল এর রুকুর সংখ্যা ১টি।
- সূরা যিলযাল এর পূর্ববর্তী সূরার নাম হলো, সূরা বাইয়্যিনাহ।
- সূরা যিলযাল এর পরবর্তী সূরার নাম হলো, সূরা আদিয়াত।
এই সূরার বিষবস্তু হচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষের পরকালের জীবনের সূত্রপাত কীভাবে হবে এবং মানুষের জন্য তা হবে কেমন বিস্ময়কর ও সেখানে দুনিয়ায় করা সমস্ত কাজের হিসাব মানুষের সামনে এসে যাওয়া।
হযরত আবী হাতেম হযরত আবু সাঈদ খুদরী থেকে যে রেওয়ায়েতটি উদ্ধৃত করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে,
“যখন আয়াতটি নাযিল হয় তখন আমি রসূলুল্লাহ্-কে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি কি আমার আমল দেখবো? তিনি জবাব দিলেন, হাঁ। আমি বললাম, এই বড় বড় গুণাহগুলিও দেখবো? জবাব দিলেন, হাঁ। বললাম, আর এই ছোট ছোট গুণাহগুলিও? জবাব দিলেন, হাঁ। একথা শুনে আমি বললাম, তাহলে তো আমি মারা পড়েছি। তিনি বললেন, আনন্দিত হও, হে আবু সাঈদ কারণ প্রত্যেক নেকী তার নিজের মতো দশটি নেকীর সমান হবে।”
(তাফহীমুল কোরআন)
(২) সূরা যিলযাল এর বাংলা অর্থ
بِسْمِ اللهِ الرَّحمنِ الرَّحِيمِ
বিসমিল্লাহি রহমানির রহিম
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।
1. | আরবিঃ إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا উচ্চারণঃ ইযা-ঝুলঝিলাতিল আরদুঝিলঝা-লাহা-। বাংলা অর্থঃ যখন পৃথিবী আপন কম্পনে প্রবলভাবে প্রকম্পিত হবে। |
2. | আরবিঃ وَاخْرَجَتِ الْأَرْضُ الْقَالَهَا উচ্চারণঃ ওয়া আখরাজাতিল আরদুআছকা-লাহা-। বাংলা অর্থঃ আর পৃথিবী যখন তার (অভ্যন্তরস্থ) ভারসমূহ বের করে দেবে। |
3. | আরবিঃ وَقَالَ الْإِنْسَانُ مَا لَهَا উচ্চারণঃ ওয়া কা-লাল ইনছা-নুমা-লাহা-। বাংলা অর্থঃ এবং মানুষ বলতে থাকবে এর (পৃথিবীর) কী হলো? |
4. | আরবিঃ يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا উচ্চারণঃ ইয়াওমাইযিন তুহাদ্দিছু আখবা-রাহা-। বাংলা অর্থঃ সেদিন পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। |
5. | আরবিঃ بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا উচ্চারণঃ বিআন্না রাব্বাকা আওহা-লাহা-। বাংলা অর্থঃ কেননা আপনার প্রতিপালক তাকে (এজন্য) আদেশ করবেন। |
6. | আরবিঃ يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَانَاهُ لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ উচ্চারণঃ ইয়াওমাইযিইঁ ইয়াসদুরুন্না-ছুআশতা-তাল লিউউরাও আ‘মা-লাহুম। বাংলা অর্থঃ সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বের হবে, যাতে তাদেরকে তাদের আমলসমূহ দেখানো যায়। |
7. | আরবিঃ فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَةَ উচ্চারণঃ ফামাইঁ ইয়া‘মাল মিছকা-লা যাররাতিন খাইরাইঁ ইয়ারাহ। বাংলা অর্থঃ কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে তা সে দেখবে। |
8. | আরবিঃ وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُهُ উচ্চারণঃ ওয়া মাইঁ ইয়া‘মাল মিছকা-লা যাররাতিন শাররাইঁ ইয়ারাহ। বাংলা অর্থঃ আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে, তাও সে দেখতে পাবে। |
(৩) সূরা যিলযাল এর বাংলা উচ্চারণ
সূরা যিলযাল এর বাংলা উচ্চারণ: ইযা-ঝুলঝিলাতিল আরদুঝিলঝা-লাহা-। ওয়া আখরাজাতিল আরদুআছকা-লাহা-। ওয়া কা-লাল ইনছা-নুমা-লাহা-। ইয়াওমাইযিন তুহাদ্দিছু আখবা-রাহা-। বিআন্না রাব্বাকা আওহা-লাহা-। ইয়াওমাইযিইঁ ইয়াসদুরুন্না-ছুআশতা-তাল লিউউরাও আ‘মা-লাহুম। ফামাইঁ ইয়া‘মাল মিছকা-লা যাররাতিন খাইরাইঁ ইয়ারাহ। ওয়া মাইঁ ইয়া‘মাল মিছকা-লা যাররাতিন শাররাইঁ ইয়ারাহ।
(৪) সূরা যিলযাল এর ব্যাখ্যা
এ সূরায় কিয়ামত বা মহাপ্রলয়ের বর্ণনা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এক সময় গোটা দুনিয়া ধ্বংস করে দেবেন। তিনি হযরত ইসরাফিল (আঃ)-কে শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়ার আদেশ দেবেন। হযরত ইসরাফিল (আঃ)-তখন শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন।
হযরত ইসরাফিল (আঃ)-এর শিঙ্গার শব্দে সারা পৃথিবীর সমস্ত নিয়ম- শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যাবে। পৃথিবী চরমভাবে কাঁপতে থাকবে। পৃথিবীর দালানকোঠা, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা সমস্ত কিছুই সেদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আসমান ভেঙ্গে যাবে। ভূপৃষ্ঠ তার ভেতরের সবকিছু বের করে দেবে। কবরসমূহ থেকে মানুষ বের হয়ে আসবে। এসব কিছু দেখে মানুষ আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাবে।
এরপর সকল মানুষ হাশরের ময়দানে একত্র হবে। সেখানে তাদের দুনিয়ার কাজকর্মের হিসাব নেওয়া হবে। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কাজকর্মও সেদিন হিসাবের বাইরে থাকবে না। বরং ছোট পাপ করলেও তার শাস্তি পেতে হবে। অন্যদিকে অণু পরিমাণ পুণ্য করলেও সেদিন মানুষ তার আমলনামায় দেখতে পাবে। এ পরিমাণ পুণ্যেরও প্রতিদান দেওয়া হবে।
(৫) সূরা যিলযাল এর শিক্ষা
এ সূরার শিক্ষা নিম্নরূপ-
- কিয়ামতে পৃথিবীর অবস্থা হবে ভয়াবহ। সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।
- মানুষ মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হবে।
- হাশরের ময়দানে মানুষ নিজ নিজ আমলনামা দেখতে পাবে।
- ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপ বা পুণ্য কোনো কিছুই এ আমলনামায় বাদ পড়বে না।
(৬) সূরা যিলযাল এর শানে নুযুল
একদা জনৈক ব্যক্তি একজন ফকিরকে অতি অল্প পরিমাণ খাদ্য দান করে। অতঃপর সে বলল যে, এ সামান্য দানে কি সাওয়াব হবে? অপর এক ব্যক্তি ছোট ছোট গুনাহ করত। এগুলো থেকে বিরত থাকত না। বরং সে এগুলোকে অবহেলা করত। আর এগুলোর কোনো গুরুত্ব দিত না।
এ দুই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এ সূরা নাজিল করেন। আর সকলকে জানিয়ে দেন যে, পুণ্য বা পাপ তা যত ছোটই হোক না কেন কিয়ামতে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। অতঃপর এগুলোর জন্য ও পুরস্কার বা শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আমরা সর্বদা কিয়ামত, হাশর ও আখিরাতের কথা স্মরণ রাখব। সেখানে আল্লাহর সামনে আমাদের দাঁড়াতে হবে।
(৭) সূরা যিলযাল এর তাফসির
সূরা যিলযাল এর আয়াত এক:
إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا
পৃথিবী যখন আপন কম্পনে প্রবলভাবে প্রকম্পিত হবে। [1]
[1] অর্থাৎ, এর অর্থ হল ভূমিকম্পের কারণে সারা পৃথিবী কেঁপে উঠবে। আর সমস্ত বস্তু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। এই অবস্থা তখন হবে, যখন শিঙ্গায় প্রথমবার ফুৎকার করা হবে।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
সূরা যিলযাল এর আয়াত দুই:
وَاخْرَجَتِ الْأَرْضُ الْقَالَهَا
এবং পৃথিবী যখন তার ভারসমূহ বের করে দেবে, [1]
[1] মাটির নিচে যত লোক দাফন আছে, তাদেরকে পৃথিবীর ভার বা বোঝা বলা হয়েছে। মাটি তাদেরকে কিয়ামতের দিন বের করে উপরে ফেলবে। অর্থাৎ, আল্লাহর হুকুমে সকলে জীবিত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে। আর এরূপ হবে শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুৎকারের পর। অনুরূপভাবে যাবতীয় খনিজ পদার্থ ও গুপ্ত ধনসমূহও বাহির হয়ে পড়বে।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
সূরা যিলযাল এর আয়াত তিন:
وَقَالَ الْإِنْسَانُ مَا لَهَا
এবং মানুষ বলবে, ‘এর কি হল?’ [1]
[1] অর্থাৎ, তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলবে, ‘এর কি হয়ে গেল? এ (পৃথিবী) কেন এমনভাবে কাঁপছে এবং খনিজ-সম্পদসমূহ বাইরে বের করে ফেলছে?!’
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
সূরা যিলযাল এর আয়াত চার:
يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا
সেদিন পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। [1]
[1] এটা হল শর্তের জওয়াব। তিরমিযী কিয়ামতের বিবরণ ও সূরা যিলযালের তাফসীর পরিচ্ছেদ, মুসনাদে আহমদ ২/৩৭৪ নং হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী (সাঃ) এই আয়াত পাঠ করলেন এবং বললেন, ‘‘তোমরা জান, পৃথিবীর বৃত্তান্ত কি?’’ সাহাবীগণ (রাঃ) বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রসূলই ভাল জানেন। নবী (সাঃ) বললেন, ‘‘তার বৃত্তান্ত এই যে, নর অথবা নারী এ মাটির উপর যা কিছু করছে এই মাটি তার সাক্ষী দেবে। আর বলবে, অমুক অমুক ব্যক্তি অমুক অমুক দিনে অমুক অমুক কর্ম করেছে।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
সূরা যিলযাল এর আয়াত পাঁচ:
بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا
কারণ তোমার প্রতিপালক তাকে আদেশ করবেন। [1]
[1] অর্থাৎ, মাটিকে কথা বলার শক্তি আল্লাহই সেদিন দান করবেন। অতএব এটা কোন আশ্চর্যজনক কথা নয়। যেমন সেদিন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহ বাকশক্তি দান করবেন, ঠিক মাটিও আল্লাহর হুকুমে কথা বলবে। (জড়পদার্থের কথা বা শব্দ ধরে রাখা এবং প্রয়োজনে তা শুনিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তো বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে। অতএব সৃষ্টিকর্তার আদেশে মাটির কথা বলার ব্যাপারটা কোন আশ্চর্যের নয়।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
সূরা যিলযাল এর আয়াত ছয়:
يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَانَاهُ لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ
সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বের হবে, [1] যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো হয়। [2]
[1] يَصْدُر শব্দের অর্থ হল, বের হবে, ফিরে যাবে। অর্থাৎ, কবর থেকে বের হয়ে হিসাবের ময়দানের দিকে অথবা হিসাব শেষে জান্নাত অথবা জাহান্নামের দিকে ফিরে যাবে। أشتَاتا শব্দের অর্থ হল, ভিন্ন ভিন্ন; অর্থাৎ, দলে দলে। কিছু লোক ভয়শূন্য হবে, কিছু ভয়ে ভীত হবে। কিছু লোকের রঙ গৌরবর্ণের হবে; যেমন জান্নাতীদের হবে। আবার কিছু লোকের রঙ কাল বর্ণের হবে; যা তাদের জাহান্নামী হওয়ার নিদর্শন হবে। কিছু লোক ডান দিকের অভিমুখী হবে। আবার অনেকে বাম দিকের অভিমুখী হবে। অথবা এই বিভিন্নতা ধর্ম, মযহাব ও আমল এবং কর্ম অনুপাতে হবে।
[2] এটি يَصدُر ক্রিয়ার সাথে সম্বদ্ধ। অথবা এর সম্বন্ধ أوحَى لَها -এর সাথে। অর্থাৎ, মাটি (সেদিন) নিজের বৃত্তান্ত এ জন্য বর্ণনা করবে; যাতে মানুষকে নিজ আমল দেখানো হয়।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
সূরা যিলযাল এর আয়াত সাত:
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَةَ
সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে, সে তা দেখতে পাবে। [1]
[1] অতএব সে তাতে আনন্দিত হবে।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
সূরা যিলযাল এর আয়াত আট:
وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
এবং কেউ অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে, তাও সে দেখতে পাবে। [1]
[1] ফলে সে তার উপর অত্যন্ত লজ্জিত ও উদ্বিগ্ন হবে। ‘যার্রাহ’ কোন কোন উলামার নিকট পিঁপড়ে হতেও ছোট বস্তুকে বোঝায়। কেউ কেউ বলেন, মানুষ মাটিতে হাত মেরে তারপর হাতে যে মাটি অবশিষ্ট থাকে, সেটাকেই ‘যার্রাহ’ বলা হয়। কিছু সংখ্যক আলেম বলেন, ঘরের দরজা বা জানালার ছিদ্র দিয়ে সূর্যের ছটার সাথে যে ধূলিকণা দেখা যায়, সেটাই হল যার্রাহ। কিন্তু ইমাম শাওকানী (রঃ) প্রথম অর্থটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।এখানে বস্তুর সবচেয়ে ছোট অংশ বুঝাতে বাংলায় ‘যার্রাহ’কে ‘অণু পরিমাণ’ বলা হয়েছে।
ফাতহুল ক্বাদীরে ইমাম মুক্বাতিল (রঃ) বলেন, এই সূরাটি সেই দুই ব্যক্তি সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, যাদের একজন ভিখারীকে অল্প কিছু সদকা করতে ইতস্ততঃবোধ করত। আর অপরজন ছোট ছোট পাপ করতে কোন প্রকার ভয় অনুভব করত না।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
[সূত্র: এনসিটিবি ও hadithbd.com]