(১) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ বলতে কী বুঝায়?
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ এর আরবি পরিভাষা হলো ‘আমর বিল মারূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ । ইসলামি জীবনদর্শনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য।
সৎকাজের আদেশ বা ‘আমর বিল মারূফ’ বলতে সাধারণত কাউকে কোনোরূপ ন্যায় ও ভালো কাজের নির্দেশ দান করা বোঝায়। তবে ব্যাপকার্থে কোনো ব্যক্তিকে ইসলামসম্মত কাজের নির্দেশ দেওয়া, উৎসাহিত করা, অনুপ্রাণিত করা, অনুরোধ করা, পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি সবই সৎকাজের আদেশের মধ্যে গণ্য।
অসৎকাজে নিষেধ বা ‘নাহি আনিল মুনকার’ হলো যাবতীয় মন্দ, খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে কাউকে বিরত রাখা। যেসব কাজ ইসলাম সমর্থন করে না এবং যেসব কাজ নীতি-নৈতিকতা ও বুদ্ধি-বিবেকবিরোধী সেসব কাজ থেকে কাউকে নিষেধ করা, বিরত রাখা, নিরুৎসাহিত করা, বাধা দেওয়া ইত্যাদি ‘নাহি আনিল মুনকার’ এর অন্তর্ভুক্ত।
শুধু মৌখিক নিষেধের দ্বারা নয় বরং নানাভাবেই অসৎকাজ থেকে বিরত রাখা যায়।
একটি হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন,
“তোমাদের কেউ যখন কোনো খারাপ কাজ হতে দেখে তবে সে যেন তা হাত দ্বারা প্রতিরোধ করে। যদি তা সম্ভব না হয় তবে মুখের দ্বারা প্রতিরোধ করে। যদি সে এ ক্ষমতাও না রাখে তবে সে যেন অন্তর দ্বারা এর প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। আর এটা হলো ইমানের দুর্বলতম স্তর।”
(মুসলিম)
এ হাদিসে মহানবি (সাঃ) হাত, মুখ ও অন্তর দ্বারা ‘নাহি আনিল মুনকার’ বা খারাপ কাজ প্রতিরোধ করার কথা বলেছেন।
হাদিস বিশারদগণের মতে, হাত দ্বারা বলতে এখানে নিজ শক্তি ক্ষমতা ও প্রভাব দ্বারা প্রতিরোধ করার কথা বোঝায়। মুখ দ্বারা প্রতিরোধ হলো নিষেধ করা, নিরুৎসাহিত করা, জনমত গঠন করে প্রতিরোধ করা। আর অন্তর দ্বারা প্রতিরোধ হলো মনে মনে ঐ কাজকে ঘৃণা করা, ঐ কাজ বন্ধ হওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা, প্রতিরোধের জন্য চিন্তা করা, পরিকল্পনা করা এবং পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত অন্তরে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা থাকা ইত্যাদি।
নানাভাবে মানুষকে অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করাই নাহি আনিল মুনকার।
(২) গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
ইসলামে আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা এর উপরই প্রতিষ্ঠিত।
সমাজে সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধ করার জন্য সবসময়ই কিছুসংখ্যক লোক থাকতে হয়। অন্যথায় সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে না। সমাজে অন্যায়, অত্যাচার, সন্ত্রাস, নির্যাতন ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়ে যায়। সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার জন্য এরূপ লোকদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধ করা অত্যন্ত মহৎ কাজ। এ মহৎ কাজ যারা সম্পাদন করবেন আল্লাহ তায়ালা তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা দান করবেন। পবিত্র কুরআনে সৎকাজের আদেশদানকারী এবং অসৎকাজের নিষেধকারীকে মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম বলা হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন,
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।”
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০)
আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার মুমিনগণের বৈশিষ্ট্য। এ কাজ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিই পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না।
আল্লাহ তায়ালা মুমিনগণের পরিচয় দিয়ে বলেছেন,
“আর তারা এমন লোক, আমি তাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। আর কর্মের প্রতিফলতো আল্লাহরই নিকট।”
(সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ৪১)
সৎকাজের আদেশ সমাজে সৎ ও ন্যায় কার্যাবলির প্রসার ঘটায়। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সদাচরণ ও নৈতিক গুণাবলি বিকশিত হয়। আর অসৎ কাজের নিষেধ সমাজ থেকে অন্যায়, অশ্লীলতা ও নির্যাতনের মূলোৎপাটন করে। মানুষ এর মাধ্যমে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ বুঝতে শিখে ও ধীরে ধীরে সত্য ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করে।
অন্যদিকে সমাজে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ না থাকলে সমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। একটি হাদিসে মহানবি (সাঃ) একটি উপমার মাধ্যমে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন,
“আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থানকারী ও সীমালংঘনকারীদের উদাহরণ হলো একদল লোকের ন্যায়, যারা জাহাজের যাত্রী। লটারির মাধ্যমে এদের একদল উপর তলায় ও অপর দল নিচতলায় স্থান পেল। নিচতলার লোকজন পানির প্রয়োজন হলে উপর তলার লোকদের নিকট পানি আনতে যায়। এমতাবস্থায় তারা (নিচতলার লোকজন) বলল, আমরা যদি নিচেই একটা ছিদ্র করে নেই তবে উপর তলার লোকদের কষ্ট দেওয়া থেকে বাঁচা যেত। এখন যদি তারা (উপর তলার লোকজন) তাদের বাধা দেয় তবে নিজেরাও বাঁচতে পারে এবং সবাইকে বাঁচাতে পারবে।”
(বুখারি)
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ মানুষকে ধ্বংস থেকে বিরত রাখে। এতে সমাজে দীন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর যে ব্যক্তি এ কাজ করে সে আরও গভীরভাবে সৎকাজে উৎসাহী হয়। নিজ জীবনে সে ব্যক্তি সকল অন্যায় ও অসুন্দর কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারে।
(৩) আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার ত্যাগের পরিণতি
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা আবশ্যকীয় কর্তব্য। এ কর্তব্যে অবহেলা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ শাস্তি। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেই এ জন্য শাস্তি প্রদান করেন। আর পরকালে এরূপ ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“বনি ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফরি করেছে তাদেরকে দাউদ (আঃ) ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের মুখ দিয়ে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। কেননা তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল ও অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছিল। তারা পরস্পরকে মন্দকাজ থেকে বিরত রাখত না। বস্তুত অত্যন্ত জঘন্য কর্মনীতিই তারা অবলম্বন করেছিল।”
(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৭৮-৭৯)
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“লোকেরা যখন কোনো অত্যাচারীকে (অত্যাচার করতে) দেখে, কিন্তু তারা তার হাত ধরে না (প্রতিরোধ করে না) এরূপ লোকদের উপর অচিরেই আল্লাহ শাস্তি পাঠাবেন।”
(তিরমিযি)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
“সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ। তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। অন্যথায় অচিরেই আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দেবেন। তখন তোমরা দোয়া করবে কিন্তু তা কবুল করা হবে না।”
(তিরমিযি)
প্রকৃতপক্ষে, আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার মানব জীবনের অপরিহার্য কাজ। দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা এর উপরই নির্ভরশীল। তবে অন্যকে সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধ করে বসে থাকলে চলবে না। বরং নিজেও তদনুযায়ী আমল করতে হবে। কেননা নিজে আমল না করে অন্যকে আদেশ দিলে পরকালে ভীষণ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসবে। সে এটা নিয়ে চারপাশে চক্কর দিতে থাকবে যেমনভাবে গাধা চক্রের মধ্যে ঘুরে থাকে। তখন জাহান্নামিরা তার চারপাশে সমবেত হবে এবং জিজ্ঞাসা করবে, হে অমুক! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি কি সৎকাজের আদেশ দিতে না এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে না? উত্তরে সে বলবে, হ্যাঁ আমি সৎকাজের আদেশ দিতাম, কিন্তু নিজে তা করতাম না। আর অন্যদের খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করতাম, কিন্তু নিজে তা থেকে বিরত থাকতাম না।”
(বুখারি ও মুসলিম)
অতএব, আমরা নিজেরা সৎকাজ করব ও অসৎকাজ থেকে বিরত থাকব। অতঃপর নিজ পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, প্রতিবেশী, সকলকে সৎকাজে উৎসাহিত করব। সৎকাজে সাহায্য-সহযোগিতা করব। আর অসৎকাজ থেকে তাদের বিরত রাখতে চেষ্টা করব।
আমাদের সমাজে প্রচলিত অন্যায়, অসত্য ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলব। সকলে মিলে সকল অন্যায় ও অত্যাচার দূর করে সুন্দর ও শান্তিময় সমাজ গঠনে সচেষ্ট হব।
[সূত্র: এনসিটিবি]