নিম্নে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর জীবনী সহজ ভাষায় সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
(১) পরিচয়
হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সর্বকনিষ্ঠা স্ত্রী। তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)-এর কন্যা। তাঁর মায়ের নাম উম্মে রুম্মান। তাঁর উপাধি ছিল ‘সিদ্দিকা’ ও ‘হুমায়রা’। আর তাঁর উপনাম হলো-উম্মুল মুমিনিন ও উম্মু আব্দুল্লাহ। তিনি হিজরতের পূর্বে ৬১৩/ ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।
কুরাইশ বংশের নিয়মানুযায়ী জন্মের পর তাঁর লালন-পালনের ভার দেওয়া হয় ওয়ায়েল নামে এক লোকের স্ত্রীর উপর।
শিশুকাল থেকেই তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারিণী। শিশুকাল থেকে তাঁর শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয়। শৈশবকালেই তাঁর আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথাবার্তা ও মেধাশক্তি সকলকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর মধ্যে সর্বদা শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। তিনি অন্য শিশুদের মতো খেলাধুলা, আমোদফূর্তি ও দৌড়াদৌড়ি করতে ভালোবাসতেন।
হযরত খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পর নবুয়তের দশম সনে মহানবি (সাঃ)-এর সাথে হযরত আয়েশা (রা.)- এর শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। হযরত খাওলা বিনতে হাকিম ছিলেন এ বিবাহের ঘটক। এ বিয়েতে দেনমোহর নির্ধারিত হয় ৪৮০ দিরহাম। বিবাহের তিন বছর পর রাসুল (সাঃ)-এর সাথে হযরত আয়েশা (রা.)- এর দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। হযরত আবু বকর (রা.) বিবাহের কাজির দায়িত্ব পালন করেন।
(২) শিক্ষাজীবন
তৎকালীন আরব সমাজে লেখা-পড়ার তেমন সুযোগ-সুবিধা ছিল না। হযরত আয়েশা (রা.) পিতার কাছ থেকেই মূলত লেখাপড়া শুরু করেন। তিনি কাব্য, সাহিত্য ও ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। যা একবার শুনতেন সাথে সাথে মুখস্থ করে ফেলতেন। পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন ছাড়াও তিনি গৃহস্থালী বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।
(৩) ইফকের ঘটনা
ষষ্ঠ হিজরি সনে বনু মুস্তালিক যুদ্ধে রাসুল (সাঃ)-এর সাথে হযরত আয়েশা (রা.)ও ছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে তাঁর গলার হার হারিয়ে যায়। হারানো হার খুঁজতে গিয়ে তিনি কাফেলা থেকে পিছনে পড়ে যান। ফিরতে দেরি হয়ে যায়। এ সুযোগে মুনাফিকরা তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করল। এতে তিনি চরম মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। তাঁর জীবন একেবারে বিষণ্ন হয়ে ওঠে।
কিন্তু তিনি ধৈর্য হারান নি। আল্লাহর উপর আস্থা রেখে অটল ছিলেন। এ সময়ে রাসুল (সাঃ) ও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি। তিনি চিন্তিত হলেন। হযরত আয়েশা (রা.)-এর পিতামাতাও চরম উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে কালাতিপাত করছিলেন।
অবশেষে হযরত আয়েশা (রা.)-এর পবিত্রতা বর্ণনা করে সূরা নুরে ১১-২১ নম্বর আয়াত নাজিল হলো। মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। রাসুল (সাঃ) চিন্তামুক্ত হলেন। হযরত আয়েশা (রা.)-এর পবিত্রতা ও চারিত্রিক মাধুর্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
(৪) শিক্ষায় অবদান
হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারিণী। তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। বিশেষ করে তাফসির, হাদিস, ফিকাহ ও আরবদের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। শরিয়তের বিভিন্ন মাসয়ালা মাসায়েল ও নীতিগত বিষয়ে তার পরামর্শ নেওয়া হতো।
তুলনামূলক কম বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে মর্যাদা হযরত আয়েশা (রা.) রাসুল (সাঃ)-এর অতি আদরের সহধর্মিণী ছিলেন। তিনি মহানবি (সাঃ)-এর অন্য স্ত্রীদের থেকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
রাসুল (সাঃ) বলেন,
“নারী জাতির উপর আয়েশা (রা.)-এর মর্যাদা তেমন, যেমন খাদ্যসামগ্রীর উপর সারিদের মর্যাদা।”
(বুখারি ও ইবনে মাজাহ)
সারিদ হলো আরবের শ্রেষ্ঠ খাদ্য, যা রুটি, গোশত ও ঝোলের সমন্বয়ে তৈরি হয়।
রাসুল (সাঃ) আরও বলেন,
“আয়েশা (রা.) হলেন মহিলাদের সাহায্যকারিনী।”
(কানযুল উম্মাল)
একবার নবি করিম (সাঃ) আয়েশা (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেন,
“হে আয়েশা! ইনি জিব্রাইল, তোমাকে সালাম দিচ্ছে।”
(বুখারি)
হযরত আয়েশা (রা.) নিজ বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। আজকের নারী সমাজও যদি হযরত আয়েশা (রা.)-এর মতো তপস্যা করেন তাহলে তাঁরাও মর্যাদাবান হবেন।
হযরত আয়েশা (রা.) হলেন সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। অনেক সাহাবি ও তাবেয়ি তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০টি। তন্মধ্যে ১৭৪টি হাদিস ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম যৌথভাবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারি ৫৪টি হাদিস এবং ইমাম মুসলিম ৬৯টি হাদিস এককভাবে তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।
ইবনে শিহাব জুহুরি বলেন,
“তিনি (আয়েশা) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী ছিলেন।”
(তাহজিবুত্ তাহজিব)
(৫) শিক্ষকতা
উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.) শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষভাবে নারীদের বিভিন্ন বিষয় তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করা হতো। তিনি হাদিস শিক্ষাদানে বেশি সময় ব্যয় করতেন। একসাথে তাঁর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০০-এর অধিক।
অনেক বড় বড় সাহাবি তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বিভিন্ন ঘটনা, প্রশ্নোত্তর এবং সামাজিক বাস্তবতার আলোকে শিক্ষা দিতেন। হযরত আবু মুসা আশআরি (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), আমর ইবনে আছ (রা.) প্রমুখ সাহাবি তাঁর হাদিসের পাঠদানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন।
(৬) গুণাবলি
হযরত আয়েশা (রা.)-এর চরিত্র ও আদর্শ অতুলনীয়। তিনি তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির দ্বারা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে বহুগুণের সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি ছিলেন, অনন্য সুন্দরী, তীক্ষ্ণ মেধাশক্তি সম্পন্ন, সত্যের সাধক, আদর্শ স্বামী সেবিকা, জ্ঞানতাপস ও সদালাপী। এক কথায় বলতে গেলে মানবীয় চরিত্রের সকল গুণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
মুনাফিক ও হিংসুকগণ তাঁর উপর যে অপবাদ দিয়েছিল তখন তিনি আল্লাহর উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ধৈর্যই তাঁকে স্থির-অবিচল রেখেছিল।
রাতের অধিকাংশ সময় তিনি ইবাদতে মশগুল থাকতেন। গরিব অসহায়দের দান সদকা করতে তিনি পছন্দ করতেন ও আনন্দ পেতেন। দানশীলতা, মিতব্যয়িতা, দয়া, পরপোকারিতা, ধর্মপরায়ণতাসহ সর্ব প্রকার গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন।
স্বামী প্রেমও তার জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। রাসুল (সাঃ)ও তাঁর সাথে খেলাধুলা ও দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন। পর্দার আয়াত নাজিল হওয়ার পর তিনি কঠোরভাবে পর্দা করতেন।
(৭) মর্যাদা
হযরত আয়েশা (রা.) রাসুল (সাঃ)-এর অতি আদরের সহধর্মিণী ছিলেন। তিনি মহানবি (সাঃ)-এর অন্য স্ত্রীদের থেকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
রাসুল (সাঃ) বলেন,
“নারী জাতির উপর আয়েশা (রা.)-এর মর্যাদা তেমন, যেমন খাদ্যসামগ্রীর উপর সারিদের মর্যাদা।” (বুখারি ও ইবনে মাজাহ)। সারিদ হলো আরবের শ্রেষ্ঠ খাদ্য, যা রুটি, গোশত ও ঝোলের সমন্বয়ে তৈরি হয়। রাসুল (সাঃ) আরও বলেন-“আয়েশা (রা.) হলেন- মহিলাদের সাহায্যকারিনী।”
(কানযুল উম্মাল)
একবার নবি করিম (সাঃ) আয়েশা (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেন,
“হে আয়েশা! ইনি জিব্রাইল, তোমাকে সালাম দিচ্ছে।”
(বুখারি)
হযরত আয়েশা (রা.) নিজ বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। আজকের নারী সমাজও যদি হযরত আয়েশা (রা.)-এর মতো তপস্যা করেন তাহলে তাঁরাও মর্যাদাবান হবেন।
(৮) ইন্তিকাল
উম্মুল মুমেনিন হযরত আয়েশা (রা.) ৫৮ হিজরির ১৭ রমযান ৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাকি নামক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। হযরত আয়েশা (রা.)-এর ধৈর্য, জ্ঞানসাধনা, পাণ্ডিত্য, স্বামীভক্তি ও চারিত্রিক মাধুর্য আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।
[সূত্র: এনসিটিবি]