নিম্নে হযরত উমর (রাঃ) এর জীবনী সহজ ভাষায় সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
(১) পরিচয়
হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ ৬১ হিজরি সনে উমাইয়া বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল আজিজ। মাতা হলেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.)-এর পৌত্রী উম্মু আসিম লায়লা। তিনি একজন উমাইয়া খলিফা ছিলেন। তাঁকে ‘দ্বিতীয় উমর’ ও ইসলামের ‘পঞ্চম খলিফা’ বলা হয়।
(২) শৈশব ও শিক্ষাজীবন
শিশুকাল হতেই তিনি ছিলেন আল্লাহভীরু ও জ্ঞানতাপস। শিশু বয়সে তিনি পিতার সাথে মিসর গমন করেন এবং সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি কুরআন ও হাদিসের উচ্চতর জ্ঞান লাভের আশায় মদিনায় গমন করেন। তৎকালীন সময়ে মদিনার বিখ্যাত শিক্ষকদের নিকট হতে তিনি জ্ঞানার্জন করেন।
তিনি কুরআন, হাদিস, তাফসির ও আরবি সাহিত্যের উপর উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করেন। তিনি উমাইয়া শাসক খলিফা আব্দুল মালিকের কন্যা ফাতিমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
(৩) গভর্নর পদে নিয়োগলাভ
খলিফা ওয়ালিদ, উমর ইবনে আব্দুল আজিজ-কে ৮৭ হিজরি সনে মদিনার গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দান করেন।
তিনি অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ সহকারে দায়িত্ব পালন করেন। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তিনি মজলিশে শুরা গঠন করেন। এর সদস্য ছিলেন দশ জন মুত্তাকি (আল্লাহভীরু) লোক। তিনি শাসনকার্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মজলিশে শুরার মতামত গ্রহণ করতেন।
শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন বিচারক নিয়োগ করেন। গভর্নর থাকাকালে তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ কারণে তৎকালীন প্রখ্যাত মনীষী সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব তাঁকে ‘মাহদি’ (সুপথপ্রাপ্ত) উপাধি দিয়েছিলেন।
(৪) জনকল্যাণমূলক কাজ
গভর্নর নির্বাচিত হয়ে উমর ইবনে আব্দুল আজিজ জনসাধারণের কল্যাণার্থে কাজ শুরু করেন।
তিনি ‘মসজিদে নববি’র সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধন করেন। তিনি অসংখ্য ঘরবাড়ি, পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। পিপাসার্ত মানুষের জন্য তিনি অনেক কূপ খনন করেন। মসজিদে নববির বাগানে একটি ঝর্ণা ও চৌবাচ্চা নির্মাণ করেন। সমগ্র এলাকায় বিশেষ করে মক্কা, মদিনা ও তায়েফের মাঝে চলাচলের জন্য সংযোগ সড়ক তৈরি করেন।
শুধু জনকল্যাণমূলক কাজ নয় তিনি জ্ঞানেরও প্রসার ঘটিয়েছেন। তিনি জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। গভর্নর থাকাকালেও তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কুরআন, হাদিস ও অন্যান্য কিতাবাদি অধ্যয়ন করতেন।
(৫) খলিফা পদ লাভ
হিজরি ৯৯ সন মোতাবেক ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খলিফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালিক ইন্তিকাল করলে উমর ইবনে আব্দুল আজিজ মুসলিম জাহানের খলিফা নিযুক্ত হন।
খলিফা নিযুক্ত হয়ে তিনি পূর্ববর্তী খলিফাদের গৃহীত সকল অন্যায় নীতি বাতিল করে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন। তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে খলিফা নির্বাচনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি উপস্থিত লোকদের বলেন- ‘হে মানবমণ্ডলী! আমার অনিচ্ছা ও সাধারণ মানুষের মতামত ছাড়া আমাকে খলিফা মনোনীত করা হয়েছে। আমি আপনাদের বাধ্য করছি না, আপনারা যাকে ইচ্ছা খলিফা নির্বাচন করুন।’ তার এ ভাষণের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতা বলল ‘আমরা আপনাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলাম, আমরা আপনার খিলাফতের উপর সন্তুষ্ট।’ অতঃপর তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর প্রাদেশিক গভর্নরদের উদ্দেশ্যে প্রেরিত চিঠিতে তিনি উল্লেখ করলেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তার কিতাব মেনে চলো এবং রাসুলের সুন্নাত অনুসরণ কর।’
উমাইয়া বংশের লোকজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রভাবে রাষ্ট্র ও জনসাধারণের যে সকল সম্পদ দখল করে রেখেছিল তিনি তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এবং যথাযথ মালিকের কাছে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এমনকি তাঁর স্বীয় স্ত্রীর সম্পত্তি, উপঢৌকনসামগ্রী, গহনাদি রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা বাইতুল মালে জমা দেন।
রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদিনের আদর্শ বাস্তবায়ন করেন। বিশেষ করে হযরত উমর (রা.)-এর শাসননীতি অনুসরণ করেন।
রাষ্ট্রে সুখশান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাদের সাম্রাজ্যবাদী ও স্বার্থান্বেষী নীতি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন। রাষ্ট্রে ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মপরায়ণতা, সাম্যের ধারণা ও সকল জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে তাঁকে ‘উমাইয়া সাধু’ (Umayyad Saint ) বলা হয়।
(৬) হাদিস সংকলনে অবদান
ইসলামি জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে আল হাদিস।
রাসুল (সাঃ)-এর হাদিসগুলো হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। হাদিসগুলো সংরক্ষণ ও সংকলনের জন্য তিনি প্রাদেশিক গভর্নরদের নির্দেশ দেন। তিনি তাদের কাছে লেখেন- ‘তোমরা রাসুল (সাঃ)-এর হাদিসের প্রতি দৃষ্টি দাও এবং তা সংগ্রহ ও সংকলন করো।’ তারই প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্বে হাদিস সংকলিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহসহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়। ফলে হাদিস হারিয়ে যাওয়া ও বিকৃতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
(৭) প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রচারের ব্যবস্থা
উমর ইবনে আব্দুল আজিজ বিশ্বাস করতেন ‘যে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।’ তিনি গভর্নরদের নিকট প্রেরিত পত্রে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বারবার তাগিদ দিতেন। শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি অনেক প্রশিক্ষক নিয়োগ করেন। শিক্ষকদের জন্য মাথাপিছু মাসিক ১০০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ভাতার ব্যবস্থা করেন। তাঁর সময়ে সিন্ধু, আফ্রিকা, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে ইসলাম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটে।
(৮) কৃতিত্ব
দ্বিতীয় উমর নামে খ্যাত হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাষ্ট্র পরিচালনায় কুরআন-হাদিস ও খোলাফায়ে রাশেদিনের নীতি অনুসরণ করেছিলেন। তাই তাঁকে চার খলিফার পর ইসলামের পঞ্চম খলিফা বলা হয়।
তাঁর আমলে কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তিনি মানুষের মাঝে পারস্পরিক বিরোধ দূর করে সাম্য ও সম্প্রীতির সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময়ে জনসাধারণের আর্থিক অবস্থার এতবেশি উন্নতি হয়েছিল যে, যাকাত গ্রহণ করার মতো লোকও খুঁজে পাওয়া যেত না।
তিনি ছিলেন একাধারে ফকিহ (ইসলামি আইনশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ), মুজতাহিদ (ইসলাম ধর্মজ্ঞানে সুপণ্ডিত) এবং কুরআন ও হাদিসের হাফিজ।
(৯) চরিত্র
হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ ছিলেন আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী, বিনয়ী ও নম্র প্রকৃতির মানুষ। তাঁর অন্তরে এত আল্লাহভীতি ছিল যে, তিনি প্রায় আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন।
খলিফা হয়েও তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দৈনিক মাত্র দু-দিরহাম ভাতা গ্রহণ করতেন।
একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে তিনি অন্য ধর্মালম্বীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করতেন। তার আমলে খ্রিষ্টান, ইহুদি ও অগ্নি উপাসকগণকে তাদের গির্জা ও উপাসনালয় নিজ নিজ অধিকারে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তার আমলে সকল ধর্মের লোক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করত।
তিনি উদার চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। তিনি ‘আইলা’ ও সাইপ্রাসের খ্রিষ্টানদের কর কমিয়ে দেন। নাজরানের খ্রিষ্টানদের তিনি বিশেষ সুবিধা প্রদান করেন। জ্ঞানচর্চায় অমুসলিম মনীষীদেরও সাহায্য করেছিলেন। তিনি তাদের দ্বারা কয়েকটি গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।
(১০) ইন্তিকাল
এ মহামনীষী ১০১ হিজরি মোতাবেক ৭১৯ খ্রিষ্টাব্দের রজব মাসে মাত্র ৪০ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তাঁর খিলাফতকাল ছিল প্রায় আড়াই বছর।
আমরা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজের জীবনাদর্শ অনুসরণ করব। তাঁর ধর্মপরায়ণতা, জীবনসাধনা, ন্যায়পরায়ণতা এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করব।
[সূত্র: এনসিটিবি]