নিম্নে হযরত মুসা (আঃ) এর জীবনী সহজ ভাষায় সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
(১) আগমন বার্তা
প্রাচীনকালে মিসরীয় বাদশাহদের ‘ফিরআউন’ বলা হতো। হযরত মুসা (আঃ)-এর সমসাময়িক ফিরআউনের নাম ছিল ওয়ালিদ ইবনে মুসআব। তাঁকে ‘দ্বিতীয় রামসিস’ (Ramses II)ও বলা হয়।
ফিরআউন স্বপ্নে দেখে যে, ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ থেকে এক ঝলক আগুন এসে মিসরকে গ্রাস করে ফেলেছে এবং তার অনুসারী ‘কিবতি’ সম্প্রদায়কে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বনি ইসরাইলদের কোনো ক্ষতি করছে না।
ফিরআউন তার রাজ্যের সকল স্বপ্নবিশারদ থেকে একসাথে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চায়। তারা বলল, ইসরাইল বংশে এমন এক পুত্রসন্তানের আগমন হবে যে আপনাকে ও আপনার রাজত্বকে ধবংস করে দেবে।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে ফিরআউন ভীষণ উত্তেজিত হলো এবং দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ফিরআউন সেনাবাহিনীকে আদেশ দিল যে, বনি ইসরাইল গোত্রে কোনো পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে যেন হত্যা করা হয়। এভাবে অসংখ্য ইসরাইলি পুত্রসন্তান ফিরআউনের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
(২) জন্ম
এমন দুঃসময়ে মৃত্যু পরওয়ানা কাঁধে নিয়ে হযরত মুসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করলেন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মহিমায় ফিরআউনের সৈন্যবাহিনী এ সংবাদ জানতে পারল না।
অপরদিকে হযরত মুসা (আঃ)- এর জননী খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর ইশারায় হযরত মুসা (আঃ)-কে তাঁর মাতা সিন্দুকে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। আল্লাহর কী মহিমা! সিন্দুকটি ভাসতে ভাসতে ফিরআউনের রাজ প্রাসাদের ঘাটে গিয়ে ভিড়ল।
ফিরআউনের স্ত্রী হযরত আসিয়া (আঃ) সিন্দুকটি খুললেন। ফুটফুটে একটি সুন্দর শিশু দেখে তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। নিঃসন্তান হযরত আসিয়া (আঃ) শিশুটি লালন-পালন করতে লাগলেন। শিশু মুসা অন্য কারো দুধ পান না করায় তাঁর মাকেই ধাত্রী নিয়োগ করা হলো। মহান আল্লাহর কুদরতে মুসা (আঃ) তাঁর মায়ের তত্ত্বাবধানেই ফিরআউনের ঘরে লালিত-পালিত হতে লাগলেন।
আল্লাহ বলেন,
“তখন আমি তোমাকে (মুসা-কে) তোমার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিলাম যাতে তার চক্ষু শীতল হয় এবং সে দুঃখ না পায়।”
(সূরা তা-হা, আয়াত ৪০)
শিশুকালে ফিরআউন একবার মুসা (আঃ)-কে কোলে তুলে নেয়। তখন শিশু মুসা (আঃ) ফিরআউনের দাড়ি ধরে তার মুখে চড় মারেন। এতে ফিরআউন রাগান্বিত হয়ে তাকে হত্যা করতে চাইল এবং বলল এই সেই শিশু যে আমার রাজত্ব ধ্বংস করবে। তখন হযরত আসিয়া (আঃ) এক ভয়ংকর অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে শিশু মুসাকে ফিরআউনের রোষানল থেকে রক্ষা করেন। তখন অগ্নি মুখে নেওয়ায় তার মুখে জড়তা তৈরি হয়।
(৩) মাদইয়ানে হিজরত
একদা হযরত মুসা (আঃ) দেখতে পেলেন একজন কিবতি জনৈক ইসরাইলিকে অত্যাচার করছে। তিনি অত্যাচারিত লোকটিকে বাঁচানোর জন্য অত্যাচারী কিবতি লোকটিকে একটি ঘুষি মারলেন। এতে লোকটি মারা যায়।
হযরত মুসা (আঃ) হতবাক হয়ে যান এবং ফিরআউনের ভয়ে মিসর ত্যাগ করে মাদইয়ানে হিজরত করেন। সেখানে হযরত শুয়াইব (আঃ)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হযরত মুসা (আঃ) তাঁর সান্নিধ্যে দশ বছর অতিবাহিত করেন। হযরত শুয়াইব (আঃ) তাঁর কর্মদক্ষতা, চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা সফুরাকে তাঁর সাথে বিবাহ দেন।
(৪) নবুয়ত লাভ
মাদইয়ানে কিছুকাল অবস্থানের পর মুসা (আঃ) তাঁর পরিবারসহ মিসরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। তুর পাহাড়ের পাদদেশে আসার পর সন্ধ্যা হয়ে যায়। রাত্রি যাপনের জন্য তিনি পাহাড়ের নিকটে ‘তুয়া’ নামক পবিত্র উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করেন এবং সেখানে নবুয়ত প্রাপ্ত হন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আমি তোমাকে মনোনীত করেছি, অতএব, যা প্রত্যাদেশ হয় তা শুনতে থাকো।”
(সূরা তা-হাঃ ১৩)
আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা (আঃ)-এর সাথে সরাসরি ও ফেরেশতাদের মাধ্যমে কথাবার্তা বলতেন। আর এ কারণে তাঁকে ‘কালিমুল্লাহ’ বলা হতো।
(৫) দীনের দাওয়াত
নবুয়ত লাভের পর হযরত মুসা (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে দীন প্রচারের জন্য আদিষ্ট হন। যেহেতু তাঁর মুখে জড়তা ছিল তাই তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে আল্লাহ হযরত হারুন (আঃ)-কে নবুয়ত দান করেন এবং তাকে মুসা (আঃ)-এর সহযোগী করে দেন। হযরত মুসা (আঃ) হযরত হারুন (আঃ)-কে নিয়ে ফিরআউনের কাছে যান এবং দীনের দাওয়াত দেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“ফিরআউনের নিকট যাও নিশ্চয়ই সে সীমা লঙ্ঘন করেছে। অতঃপর বলো, তোমার পবিত্র হওয়ার আগ্রহ আছে কি? আর আমি কি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের পথ দেখাব? যাতে তুমি তাকে ভয় করো।”
(সূরা আন্-নাযিয়াত, আয়াত ১৭-১৯)
হযরত মুসা (আঃ) ফিরআউনকে তাঁর মু’জিযাগুলো দেখালেন এবং তাকে আল্লাহর প্রতি ইমান আনার কথা বললেন। ফিরআউন এতে কর্ণপাত করল না। উপরন্তু সে হযরত মুসা (আঃ)-কে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল।
(৬) সত্যের জয় মিথ্যার ক্ষয়
হযরত মুসা (আঃ) ফিরআউনের ষড়যন্ত্র বুঝে ফেললেন। তাই তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। ফিরআউন হযরত মুসা (আঃ) ও তাঁর দলবলের মিসর ত্যাগের খবর শুনে সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাঁদের পিছে ছুটল। হযরত মুসা (আঃ) তাঁর দলবল নিয়ে নীল নদের তীরে এসে থমকে দাঁড়ালেন।
অন্যদিকে ফিরআউন তার সৈন্যবাহিনীসহ তাঁদের খুব কাছাকাছি চলে এলো। তখন মুসা (আঃ)-এর অনুসারীরা ভয় পেয়ে গেল। মুসা (আঃ) তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, নিশ্চয় আমার রব আমাদেরকে পথ দেখাবেন।
আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুসা (আঃ) তাঁর লাঠি দ্বারা নদীতে আঘাত করলেন। নদীর পানিতে রাস্তা তৈরি হলো। বনি ইসরাইলের ১২টি দলের জন্য ১২টি পথ হয়ে গেল। হযরত মুসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারীরা নিরাপদে নদী অতিক্রম করলেন।
ফিরআউন ও তার সৈন্যবাহিনী হযরত মুসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদের নদী পার হতে দেখে তাঁদের অনুসরণ করল। যখন তারা নদীর মাঝখানে পৌঁছল তখনি রাস্তা নদীর পানিতে মিশে গেল। ফলে ফিরআউন তার দলবলসহ ডুবে মরল। আল্লাহর নবিকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেরাই ধ্বংস হলো। আর এভাবে সত্যের জয় হলো।
(৭) তাওরাত লাভ
আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা (আঃ)-কে তাওরাত কিতাব দেওয়ার অঙ্গীকার করলেন। তিনি আল্লাহর আদেশে তাওরাত কিতাব আনতে তুর পাহাড়ে গেলেন। সেখানে ত্রিশ দিন থাকার ইচ্ছা করলেন কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আর দশ দিন বেশি অবস্থান করলেন।
তুর পাহাড়ে হযরত মুসা (আঃ) রোযা, ইতিকাফ ও কঠোর সাধনায় মগ্ন থাকতেন। তিনি তুর পাহাড়ে থাকাকালীন সময়ে তাঁর ভাই হযরত হারুন (আঃ)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। এমতাবস্থায় তাঁর অনুসারীদের অনেকেই ‘সামেরি’ নামক এক ব্যক্তির ধোঁকায় পড়ে গো-বৎস পূজা শুরু করে।
হযরত মুসা (আঃ) তাওরাত কিতাব নিয়ে এসে তাদের এ অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হলেন। তখন তাওবা হিসেবে গো-বৎস পূজারিদের একে অপরকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হলো। যার ফলে সত্তর হাজার বনি ইসরাইল নিহত হয়।
হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত হারুন (আঃ) আল্লাহর নিকট খুব কান্নাকাটি করেন। অবশেষে আল্লাহ তাদের মাফ করে দেন।
হযরত মুসা (আঃ) ১২০ বছর বয়সে সিনাই উপত্যকায় ইন্তিকাল করেন। তাঁকে তুর পাহাড়ের পাদদেশে সমাহিত করা হয়।
আমরা হযরত মুসা (আঃ) এর মতো নির্ভীক হয়ে সত্যের পথে মানুষকে ডাকব। সৎ ও ন্যায়ের পথ অনুসরণের মধ্যেই জীবনের সাফল্য নিহিত।
[সূত্র: এনসিটিবি]