ইসলামি জীবনাদর্শের মূল ভিত্তি আল-কুরআন। দ্বিতীয় ভিত্তি আল-হাদিস। কুরআন জীবন বিধানের মৌলিক নীতিমালা উপস্থাপন করে। আর হাদিস সেই মৌলনীতির আলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। তাই হাদিস হচ্ছে কুরআনের নির্ভুল ব্যাখ্যা, কুরআনের বাহক বিশ্বনবীর (স) পবিত্র জীবনচরিত, কর্মনীতি ও আদর্শ তথা তাঁর বাণী, কাজ, হেদায়াত ও উপদেশাবলির বিস্তৃত উপস্থাপনা। ইসলামি জীবন-দর্শনে কুরআনের সাথে হাদিসের রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বাণী, কর্ম এবং সমর্থনকে হাদিস বলে। মূলত রাসূলুল্লাহ (স)-এর জীবনাদর্শের লিখিত রূপই হাদিস।
রাসূলুল্লাহ (স)-এর হাদিসের সংখ্যা লক্ষাধিক।
এই আর্টিকেল মনোযোগ সহকারে শেষ অবিধি পড়লে আপনি- হাদিস কাকে বলে, এর আলোচ্য বিষয়, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন। হাদিস কত প্রকার ও কি কি, প্রত্যক প্রকারেভেদের সংজ্ঞাসহ হাদিসের প্রকারভদে জানতে ও সহজেই ভিন্ন প্রকার হাদিস চিহ্নিত করতে পারবেন। হাদিস শাস্ত্রে ব্যবহৃত ৩২টি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষার মানে বুঝতে সক্ষম হবেন।
(১) হাদিস কাকে বলে? এর আলোচ্য বিষয়, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
ক) হাদিস কাকে বলে?
হাদিস কাকে বলে: হাদিস শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- কথা ও বাণী। ইসলামি পরিভাষায় নবী হিসেবে রাসূলুল্লাহ (স) জীবনে যা বলেছেন, যা করেছেন, যা অনুমোদন দিয়েছেন এবং সাহাবিদের যে সমস্ত কাজ ও কথার প্রতি সমর্থন ও সম্মতি দান করেছেন তার সবগুলোই হাদিস। অনুরূপভাবে সাহাবী ও তাবেঈদের কথা, কাজ এবং সমর্থনও হাদিস হিসেবে পরিগণিত।
হাদিসের বিষয়ে আল্লামা কিরমানী (র) লিখেছেন, ‘কুরআনের পর সকল জ্ঞানের মধ্যে সর্বাধিক উন্নত ও তথ্য সমৃদ্ধ শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে হাদিস।’
হাদিসকে সুন্নাহও বলা হয়। তবে সুন্নাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে রীতিনীতি, প্রথা ও নিয়ম।
রাসূলে করীম (স)-এর হাদিসও এক প্রকার ওহী। কেননা মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণ বলেছেন, ওহী দু’প্রকার- ১. প্রকাশ্য ও পঠিত ওহী ও ২. অপ্রকাশ্য ও অপঠিত ওহী। কুরআন হল প্রকাশ্য ও পঠিত আল্লাহর বাণী এবং হাদিস হল গোপন ও অপঠিত ইলাহী নির্দেশ।
রাসূলুল্লাহ (স) কখনও শরীআত ও ইসলাম বিষয়ক কোন কথা নিজের পক্ষ থেকে বানিয়ে বা মনগড়া বলেননি। আল্লাহর হুকুম ছাড়া যে তিনি কোন কথা বলেননি আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং তার সাক্ষ্য দিচ্ছেন,
“এবং সে মনগড়া কথা বলে না। এতো ওহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।”
(সূরা আন-নাজম, আয়াত নং ৩-৪)
আর প্রকাশ্য ওহী ছাড়া অন্য যে সমস্ত কথা তিনি সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে পেয়েছেন সেগুলোকে হাদিসে কুদসি বলা হয়।
পরিভাষায় মহানবী (স)-এর কথা, কাজ সমর্থনকেই হাদিস বলা হয়। আর সাহাবীগণের কথা, কাজ ও সমর্থনকে বলা হয় আছার এবং তাবিঈন ও তাবি-তাবিঈনের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণকে বলা হয় ফাতাওয়া।
খ) হাদিসের আলোচ্য বিষয়
হাদিসের আলোচ্য বিষয়: হাদিসের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর (স) জীবন ও কর্ম, তাঁর কথা, কাজ এবং সম্মতিমূলক কথা-কাজ-আচরণ, তাঁর সামগ্রিক জীবন ও জীবনাদর্শ-ই হচ্ছে হাদিসের আলোচ্য বিষয়।
হাদিস-বিজ্ঞানীগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে বলেন, ‘ইলমে হাদিসের বিষয়বস্তু বা আলোচ্য বিষয় হলো- রাসূলে করীম (স)-এর মহান সত্তা এ হিসেবে যে, তিনি আল্লাহর রাসূল।’
অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরামের কথা-কাজ ও অনুমোদনমূলক কথা এবং কাজের বিবরণও হাদিসের আলোচ্য বিষয়। তেমনিভাবে তাবিঈনের কথা, কাজ ও তাঁদের অনুমোদনমূলক কথা ও কাজের বিবরণও আলোচ্য বিষয়।
শরীআতের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে কুরআন মাজীদের পরেই হাদিসের স্থান। আর এ হাদিস কুরআনেরই ব্যাখ্যা ও বাস্তব-রূপায়ণ।
গ) হাদিসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
হাদিসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক জীবন যাপনে করার জন্য হাদিসের জ্ঞান অপরিহার্য। কেননা রাসূলের আনুগত্যের উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, কর্ম, অবস্থা ও অনুমোদিত বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন আবশ্যক। ইসলামি শরীআতের বিধি-বিধান ও হুকুমআহকাম সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানার্জন রাসূলের হাদিসের মাধ্যমেই সম্ভব। আর হাদিসের জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তা বিশ্বাস ও সে অনুযায়ী আমল এবং জীবনে বাস্তবায়ন মানব জীবনের মুক্তির জন্য অপরিহার্য।
হাদিস ইসলামি জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় উৎস। হাদিস ও সুন্নাহ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (স) এর জীবনাদর্শ। কুরআনকে ইসলামি শরী‘আতের মূলনীতি বলা হয়েছে। আর হাদিস সেই মূলনীতির ব্যাখ্যা। কুরআনের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করতে হাদিস অধ্যয়ন খুবই গুরুত্বের দাবিদার।
(২) হাদিস কত প্রকার ও কি কি?
ক) সংজ্ঞা হিসেবে হাদিস ৪ প্রকার
রাসূলুল্লাহ (স) যে সব বক্তব্য দিয়েছেন তাঁর দ্বারা যে সব কর্ম সম্পদিত হয়েছে এবং তিনি সাহাবাগণের যেসব কথা, কাজ অনুমোদন করেছেন সবই হাদিস। আর রাসূলের (স) হাদিস সবই সহীহ, কিন্তু সনদ ও বর্ণনাকারীদের সংখ্যা, গুণাগুণ ও বর্ণনার ধারাবাহিকতা ইত্যাদির বিবেচনায় মুহাদ্দিসগণ হাদিসকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এ শ্রেণীবিভাগের ফলে হাদিসের বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়েছে; হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা স্পষ্ট হয়েছে।
সংজ্ঞার আলোকে মুহাদ্দিসগণ হাদিসকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১. কাওলি হাদিস
মহানবী (স)-এর পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণীকে কাওলি হাদিস বা বক্তব্যমূলক হাদিস বলা হয়। যেমন- ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ’।
২. ফিলি হাদিস
মহানবী (স) স্বয়ং যে সকল কর্মকা- করেছেন এবং কোন সাহাবি তা বর্ণনা করেছেন, তাকে ফিলি হাদিস বা কর্মমূলক হাদিস বলা হয়। যথা- ‘রাসূল (স) এরূপ করেছেন।’
৩. তাকরীরী হাদিস
সাহাবীগণ মহানবীর (স) সম্মুখে শরীআত সম্বন্ধে কোন কথা বলেছেন অথবা কোন কাজ করেছেন এবং রাসূল (স) তার প্রতিবাদ করেননি অথবা নীরব থেকে মৌন সম্মতি জানিয়েছেন তাকে তাকরীরী হাদিস বা অনুমোদন মূলক হাদিস বলা হয়। যেমন- কোন সাহাবি বলেছেন: “আমরা রাসূলুল্লাহর (স) উপস্থিতিতে এরূপ কাজ করেছি ইত্যাদি।”
৪. হাদিসে কুদসী
উল্লিখিত তিন প্রকার হাদিস ব্যতীত আরো এক প্রকার হাদিস আছে, যা মহানবী (স) গোপন ওহিরূপে আল্লাহর নিকট হতে সরাসরি বর্ণনা করতেন; যার ভাষা ছিল রাসূলের, কিন্তু ভাব আল্লাহর- একে ‘হাদিসে কুদসী’ বলা হয়। যেমন- রাসূল (স) বাণী প্রদান করেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘রোযা আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব।’
খ) সনদ হিসেবে হাদিস ৩ প্রকার
সনদ বা রাবী পরম্পরার দিক থেকে হাদিসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. মারফূ
যে সব হাদিসের বর্ণনা পরম্পরা রাসূলুল্লাহ (স) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মারফু হাদিস বলা হয়।
২. মাওকুফ
যে সব হাদিসের বর্ণনা সূত্র সাহাবি পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মাওকুফ হাদিস বলা হয়।
৩. মাকতূ
যে সনদ সূত্রে কোন তাবিঈর কথা, কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে তাকে মাকতূ হাদিস বলা হয়।
গ) বর্ণনাকারীর (রাবী) সংখ্যা হিসেবে হাদিস ২ প্রকার
বর্ণনাকারীর (রাবী) সংখ্যা হিসেবে হাদিসকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. মুতাওয়াতির হাদিস
মুতাওয়াতির অর্থ একের পর এক পর্যায়ক্রমে আসা, বিরামহীন বা অনবরত। হাদিসে মুতাওয়াতির হল এমন হাদিস- যার বর্ণনাকারী রাবীর সংখ্যা প্রত্যেক যুগে ও প্রত্যেক স্তরে এত বেশি যে, তাদের সকলের ওপর একযোগে মিথ্যার ওপর ঐকমত্য হওয়া অসম্ভব।
২. আহাদ হাদিস
যে হাদিসের বর্ণনাকারীর সংখ্যা প্রত্যেক যুগে এক, দুই অথবা তিনজন তাকে আহাদ হাদিস বলে। এ শ্রেণীর হাদিস দ্বারা ইলমে যন্নী ‘ধারণামূলক জ্ঞান’ হাসিল হয়। ইমাম আবু হানিফার (র) মতে, এ জাতীয় হাদিস দ্বারা আমল করা ওয়াজিব হয়। ইমাম আহমদ (র) বলেন, এর দ্বারা ইলম ও আমল উভয়ই ওয়াজিব হয়।
ঘ) আহাদ হাদিস ৩ প্রকার
আহাদ হাদিসকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
১. মাশহুর হাদিস
মাশহুর অর্থ প্রসিদ্ধ, পরিচিত। যে হাদিসের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা সাহাবিদের পরবর্তী স্তরসমূহের কোন স্তরে যদি তিনজন হতে কম না হয়, তবে এরূপ হাদিসকে হাদিসে মাশহুর বলা হয়। এ প্রকার হাদিসকে হাদিসে মুস্তাফিযও বলা হয়।
২. হাদিসে আযীয
আযীয শব্দটির অর্থ কম হওয়া, মজবুত ও শক্তিশালী বা বিজয়ী হওয়া। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদিসে আযীয বলা হয় এমন হাদিসকে, যার বর্ণনাকারী সংখ্যা প্রত্যেক যুগে কম পক্ষে দু’জন, এ ধরনের হাদিস দ্বারা আত্মতৃপ্তিমূলক জ্ঞান অর্জিত হয়।
৩. হাদিসে গরীব
গরীব শব্দের অর্থ স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন, দূরবর্তী ও দুষ্প্রাপ্য। পরিভাষায় এমন হাদিসকে হাদিসে গরীব বলা হয়, যার বর্ণনাকারীর সংখ্যা কোন স্তরে মাত্র একজন। এ ধরনের হাদিস গ্রহণযোগ্য এবং শরীআতে দলিলযোগ্য হবে।
ঙ) রাবীর বিশুদ্ধতার বিচারে মুত্তাসিল হাদিস তিন প্রকার
রাবীর (হাদিস বর্ণনাকারীর) বিশুদ্ধতার বিচারে মুত্তাসিল হাদিস ৩ প্রকার। যথা-
১. সহীহ হাদিস
‘সহীহ’ মানে বিশুদ্ধ। যে মুত্তাসিল হাদিসের সনদের প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ ‘আদালত’ ও ‘যাব্ত’ গুণ-সম্পন্ন এবং হাদিসটি যাবতীয় দোষ-মুক্ত, তাকে সহীহ হাদীস বলা হয়।
২. হাসান হাদিস
‘হাসান’ মানে উত্তম, সৌন্দর্য। যে হাদিসের রাবীর ‘যাব্ত’ ( স্মরণ শক্তি) গুণে পরিপূর্ণতা য় ঘাটতি রয়েছে তাকে হাসান হাদীস বলে। ফিক্হবিদগণ শরীআতের বিধান নির্ণয়ে ও আইন প্রণয়নে সহীহ ও হাসান হাদিস গ্রহণ করেন।
৩. যয়ীফ হাদিস
যয়ীফ মানে দুর্বল। পরিভাষায় যয়ীফ হাদিস বলা হয় এমন হাদিসকে, যে হাদিসের কোন রাবী সহীহ ও হাসান হাদিসের রাবীর গুণসম্পন্ন নয়। রাবীর দুর্বলতার কারণেই হাদীসটিকে যয়ীফ বলা হয়। নাউযুবিল্লাহ মহানবি (স) এর কোন কথাই যয়ীফ নয়।
রাবী বা হাদিস বর্ণনাকারীর দুর্বলতার কারণেই হাদিসটিকে যয়ীফ বা দুর্বল বলা হয়। অন্যথায় রাসূলের (স) কোন কথাই যয়ীফ নয়। যয়ীফ হাদিসের দুর্বলতা কম ও বেশি হতে পারে। খুব কম হলে তা হাসানের কাছাকাছি থাকে। আর বেশি হতে হতে তা একেবারে মাওজু বা জাল হাদিসে পরিণত হতে পারে। প্রথম প্রকারের যয়ীফ হাদিস আমলের ফযীলত বা আইনের উপকারিতা বর্ণনায় ব্যবহার করা যেতে পারে, আইন প্রণয়নে নয়। তবে জাল হাদিস কোন অবস্থায় আমলযোগ্য নয়।
(৩) হাদিস শাস্ত্রে ব্যবহৃত ৩২টি পরিভাষার সংজ্ঞা
নিম্নে হাদিস শাস্ত্রে ব্যবহৃত ৩২টি পরিভাষার সংজ্ঞা সহজভাবে তুলে ধরা হলো-
সনদ: হাদিস বর্ণনাকারীদের বর্ণনা সূত্রকে ‘সনদ’ বলে।
মতন: হাদিসে বর্ণিত মূল বক্তব্যকে ‘মতন’ বলে।
রাবী: হাদিস বর্ণনাকারীকে ‘রাবী’ বলা হয়।
রিওয়ায়াত: ‘হাদিস’ বা ‘আছার’ বর্ণনা করাকে রিওয়ায়াত বলে। কোন কোন সময় ‘হাদিস’ বা ‘আছার’কেও ‘রিওয়ায়াত’ বলে। যেমন- বলা হয়, এ সম্পর্কে একটি রিওয়ায়াত আছে।
সাহাবি: ‘সাহাবি’ আরবি শব্দ। বহুবচনে আসহাব, সাহাবা- যিনি ঈমান ও প্রত্যয়ের সাথে রাসূলে করীম (স)-এর সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন, রাসূলে করীম (স)-কে দেখেছেন এবং তাঁর একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন অথবা রাসূল (স)-কে একবার দেখেছেন এবং মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ঈমানের ওপর টিকে ছিলেন তাকে সাহাবি বলে।
সাহাবিদের সম্পর্কে সমালোচনা করা বা বিরূপ ধারণা করা জায়িয নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতে, সমস্ত সাহাবায়ে কিরামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা এবং তাঁদের ব্যাপারে কটুক্তি থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।
তাবিঈ: যিনি কোন সাহাবির নিকট হাদিস অধ্যয়ন করেছেন অথবা অন্ততপক্ষে একবার তাঁকে দেখেছেন তাকে ‘তাবিঈ’ এবং বহুবচনে তাবিয়ীন বলে। তাবিয়ীনদের সংখ্যা অগণিত। তাঁরা সাহাবিদের কাছ থেকে হাদিসের জ্ঞান লাভ করেছেন।
তাবি-তাবিয়ীন: যিনি কোন তাবি’ঈর নিকট হাদিস অধ্যয়ন করেছেন, তাকে তাবি-তাবি’য়ী এবং বহুবচনে তাবি-তাবয়ীন বলে। তাদের সংখ্যা অসংখ্য এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তাঁরা ছড়িয়েছিলেন। তাঁরা তাবি’য়ীগণের নিকট থেকে হাদিসের ইল্ম সংগ্রহ করে সমগ্র উম্মাতের মধ্যে ছড়িয়েছেন। হিজরি তৃতীয় শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত তাঁরা জীবিত ছিলেন।
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (স): রাসূল (স)-এর নাম উচ্চারণ করলে যা পড়তে হয়। এর অর্থ- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রতি দয়া ও শান্তি বর্ষণ করুন।
রাদিআল্লাহ্ আন্হু: আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন। সাহাবায়ে কিরামের নামের সাথে এটা পড়তে ও লিখতে হয়।
হাদিস ও সুন্নাহ: সুন্নাত শব্দের অর্থ হল কর্মপন্থা, কর্মপদ্ধতি, কর্মনীতি ও চলার পথ। পরিভাষায় রাসূল (স)-এর অনুসৃত কর্মপন্থা ও কর্মনীতিকে সুন্নাহ বলা হয়। হাদিস এবং সুন্নাহর মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নয়। তবে উভয়ের মধ্যে সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়- হাদিস হল মহানবীর (স) কথা, কাজ, মৌন সম্মতি ও আচার-আচরণের বিবরণ। পক্ষান্তরে সুন্নাহ হল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নীতি ও কর্মপন্থা।
আসহাবে সুফ্ফা: আসহাবে সুফ্ফা বলা হয় সাহাবাদের একটি নির্দিষ্ট অংশকে, যাঁরা সরাসরি রাসূলে করীম (স)-এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তাঁরা সার্বক্ষণিক রাসূল (স)-এর সাথে থাকতেন, তাঁর কথা শুনতেন এবং তা মুখস্ত করে নিতেন।
মুহাদ্দিস: মুহাদ্দিস মানে হাদিস বিশেষজ্ঞ, হাদিসবিশারদ। যিনি হাদিসের চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদিসের সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী তাঁকে মুহাদ্দিস বলে। মুহাদ্দিসগণ হাদিস বিশ্লেষণ ও হাদিসের সত্য-মিথ্যা নিরূপণে এবং হাদিসের ব্যাপক পঠন পাঠনে নিয়োজিত থাকেন।
শাইখ: হাদিস শিক্ষাদাতা রাবীকে শাইখ বলা হয়ে থাকে।
হাফিয: ‘হিফ্য’ থেকে হাফিয। ‘হিফ্য’ অর্থ মুখস্থ করা, যিনি সনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্তসহ এক লাখ হাদিস আয়ত্ত করেছেন তাকে হাফিযে হাদিস বলে।
হুজ্জাত: যিনি সনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্তসহ তিন লাখ হাদিস আয়ত্ত করেছেন, তাকে হুজ্জাত বলে।
হাকিম: যিনি সনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্তসহ সমস্ত হাদিস আয়ত্ত করেছেন তাকে হাকিম বলে।
আদালত: যে সুদৃঢ় শক্তি মানুষকে তাকওয়া ও মরুওত অবলম্বন করতে (এবং মিথ্যা আচরণ হতে বিরত থাকতে) উদ্বুদ্ধ করে তাকে আদালত বলে। ‘তাকওয়া’ অর্থে এখানে শিরক, বিদাআত ও ফিস্ক প্রভৃতি কবীরাহ গোনাহ এবং পুনঃ পুনঃছগীরা গোনাহ্ করা হতে বেঁচে থাকাকে বুঝায়। ‘মরুওত’ অর্থে অশোভন বা অভদ্রোচিত কার্য হতে দূরে থাকাকে বুঝায়। যেমন হাটবাজারে প্রকাশ্যে পানাহার করা বা রাস্তা-ঘাটে প্রস্রাব করা ইত্যাদি। যিনি এরূপ কার্য করেন এমন ব্যক্তির বর্ণিত হাদিস সহীহ নয়।
আদ্ল বা আদিল: যে ব্যক্তি আদালত গুণসম্পন্ন তাকে আদ্ল বা আদিল বলে। অর্থাৎ যিনি ১. রসূলুল্লাহ (স)-এর হাদিস সম্পর্কে কখনো মিথ্যা কথা বলেননি, ২. বা সাধারণ কাজ কারবারে কখনো মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হননি, ৩. অজ্ঞাতনামা অপরিচিত অর্থাৎ, দোষগুণ বিচারের জন্য যার জীবনী জানা যায় নি, এরূপ লোকও নন, ৪. বে-আমল ফাসিকও নন, ৫. অথবা বদ-ইতিকাদ বিদআতীও নন তাকে ‘আদ্ল’ বা আদিল বলে।
যাব্ত: যে শক্তি দ্বারা মানুষ শ্রুত বা লিখিত বিষয়কে বিস্মৃতি বা বিনাশ হতে রক্ষা করতে পারে এবং যখন ইচ্ছা তখন তাকে সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারে তাকে ‘যাব্ত’ বা (স্মরণশক্তি) বলে। আর এ গুণ সম্পন্ন ব্যক্তিকে যাবিত বলে।
ছিকাহ: যে ব্যক্তির মধ্যে ‘আদালত’ ও ‘যাব্ত’ উভয় গুণ পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান তাকে ছিকাহ বলে।
সহীহাইন: হাদিস গ্রন্থসমূহের মধ্যে সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমের স্থান সর্বোচ্চে। তাই বুখারী ও মুসলিমকে একসঙ্গে সহীহাইন বলে।
সুনানে আরবাআ: সিহাহ সিত্তার অপর চারখানা গ্রন্থ যথাক্রমে- আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসায়ি ও ইবনে মাজাহকে এক সঙ্গে সুনানে আরবাআ বলে।
জামি: যে হাদিস গ্রন্থে আকাইদ, সিয়ার, তাফসীর, ফিতান, আহকাম, আদাব, রিকাক ও মানাকিব এ আটটি প্রধান অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে তাকে জামি বলে। যেমন- জামি সহীহ বুখারী, জামি তিরমিযি।
সুনান: যে হাদিস গ্রন্থে হাদিসকে ফিকাহ শাস্ত্রের ন্যায় সাজানো হয়েছে; কিন্তু সেখানে কেবল তাহারাত, নামায, রোযা প্রভৃতি আহ্কামের হাদিসসমূহ সংগ্রহের দিকেই বেশি নজর দেওয়া হয়েছে তাকে সুনান বলে। যেমন- সুনানে আবূ দাউদ, সুনানে ইবনে মাজাহ, সুনানে দারিমী।
মুসনাদ: যে হাদিস গ্রন্থে সাহাবিদের থেকে বর্ণিত হাদিসমূহ তাঁদের নামের ……. অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে তাকে মুসনাদ বলে। যেমন, মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, মুসনাদে তাআলিছী ইত্যাদি।
মুজাম: যে হাদিস গ্রন্থে হাদিসমূহকে শাইখ বা উস্তাদদের নামানুসারে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, তাকে মুজাম বলে। যেমন- মুজামে তাবারানী।
রিসালাহ: যে ক্ষুদ্র হাদিস গ্রন্থে মাত্র একটি বিষয়ের সমস্ত হাদিসকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, তাকে রিসালাহ বা জুয বলে। যেমন- কিতাবুত তাওহিদ (ইবনে খুযাইমা)। এ হাদিস গ্রন্থে তাওহিদ সম্পর্কিত হাদিসসমূহ একত্র করা হয়েছে।
রিজাল: হাদিসের বর্ণনাকারী সমষ্টিকে রিজাল বলে।
ইলমে আসমাউর রিজাল: যে শাস্ত্রে রাবীদের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে তাকে ইলমে আস্মাউর রিজাল চরিত বিজ্ঞান বলে। এ শাস্ত্রে হাদিসের বর্ণনাকারীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন, তাঁদের লেখাপড়া ও পান্ডিত্য, তাঁদের শিক্ষকদের ইল্মী অবস্থা, তাঁদের ছাত্রদের অবস্থা, জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁদের পরিশ্রম ও সফর, তাঁদের নৈতিক চরিত্র, তাঁদের সত্যবাদী বা মিথ্যাবাদী হবার ব্যাপারে ইলমে হাদিস বিশেষজ্ঞদের মতামত ইত্যাদি অবস্থার বিষয় আলোচিত ও পর্যালোচিত হয়।
মুত্তাফাকুন আলাইহি: মুত্তাফাকুন শব্দের অর্থ একমত, ঐকমত্য। আর আলাইহি শব্দের অর্থ ওপর। সুতরাং, মুত্তাফাকুন আলাইহি- এর অর্থ হচ্ছে- তার ওপর একমত বা ঐকমত্য। যে সকল হাদিস একই সাহাবি থেকে এক ও অভিন্ন সূত্রে ইমাম বুখারী (র) ও ইমাম মুসলিম (র) বর্ণনা করেছেন তাকে মুত্তাফাক আলাইহি বা ঐকমত্যে বর্ণিত হাদিস বলা হয়। এ জাতীয় হাদিসের গুরুত্ব বা গুণগত বৈশিষ্ট্য উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং প্রমাণ ও দলিলের দিক থেকে অগ্রগণ্য।
সিহাহ সিত্তাহ: সিহাহ (صحاح) শব্দটি (صحيح) সহীহ শব্দের বহুবচন। অর্থ বিশুদ্ধ, নির্ভুল, সহীহ। আর সিত্তাহ মানে ছয়। সুতরাং সিহাহ সিত্তাহ বলা হয় হাদিস শাস্ত্রের সেই ছয়খানা নির্ভুল ও প্রামাণ্য সংকলনকে, যার বিশুদ্ধতা সর্বজনস্বীকৃত। হিজরি তৃতীয় শতাব্দী ছিল হাদিস চর্চা, লিখন, পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ ও সংকলনের সোনালী যুগ। এ শতাব্দীতে যে ছয়খানি নির্ভরযোগ্য, প্রামাণ্য এবং সর্বজনস্বীকৃত হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে, সেগুলোকেই একত্রে সিহাহ সিত্তাহ বলা হয়। এগুলো হলো- সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিযী, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ি ও সুনানে ইবনে মাজাহ।
হাদিসের পবিভাষাসমূহ জানা থাকলে হাদিসের জ্ঞান সহজে বুঝা যায়। অতএব হাদিসের পরিভাষাগুলো জানা হাদিস পাঠকদের জন্য আবশ্যক।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা হাদিস কাকে বলে? হাদিস কত প্রকার ও কি কি? এবং হাদিস শাস্ত্রে ব্যবহৃত ৩২টি পরিভাষার সংজ্ঞা জানতে পারলাম।
ইসলামি জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় প্রধান উৎস হচ্ছে হাদিস। আল-কুরআন ইসলামি জীবন বিধানের মূলনীতি উপস্থাপন করেছে, আর হাদিস তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও বাস্তবায়নের রূপরেখা তুলে ধরেছে। ইসলামি শরীআতের বিধিবিধান ও হুকুম-আহকাম সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানার্জন রাসূলুল্লাহ (স)-এর হাদিসের মাধ্যমেই সম্ভব।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]