এই আর্টিকেলটি অধ্যয়নে আপনি- হাদিস সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারবেন; হাদিস সংকলনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন; হাদিস সংরক্ষণের ইতিহাস জানতে পারবেন; হাদিস সংরক্ষণের উপায় ও বিভিন্ন যুগে হাদিস সংরক্ষণের পদ্ধতি বলতে পারবেন; বিভিন্ন যুগে হাদিস সংরক্ষণের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা পাবেন।
(১) হাদিস সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর জীবদ্দশায় হাদিস পুস্তকাকারে সংকলিত হয়নি। এর প্রয়োজনও ছিল না। কেননা, তখন উদ্ভূত যে কোন সমস্যার তিনিই সরাসরি সমাধান দিতেন। কিন্তু তাঁর তিরোধানের পর নব উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানের জন্য হাদিস সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
ঐতিহাসিক ও বাস্তবতার নিরিখে প্রতীয়মান হয় যে, মহানবীর (স) ইন্তিকালের পর পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখন্ডে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। মরু আরবের চৌহদ্দি পেরিয়ে তা সাম্য ও শান্তি জ্যোতির বিচ্ছূরণ ঘটায় দেশ হতে দেশান্তরে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে। দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামি শাসন। এ শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতে গিয়ে হাদিসের জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নানা সমস্যা ও সংকট উত্তরণের জন্যও হাদিসের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য হয়ে উঠে।
মহানবীর (স) ইন্তিকালের পর ইসলামের সম্প্রসারণের সাথে সাথে তাঁর সাহাবিগণ বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন ও বসতি স্থাপন করেন। ফলে এক এলাকায় বসবাসরতদের স্মৃতিতে রক্ষিত হাদিস সম্পর্কে অন্য অঞ্চলে বসবাকারীরদের অবহিত হওয়া কষ্টসাধ্য ছিল। কাজেই সকল হাদিস সম্পর্কে সমগ্র বিশ্বের সব জায়গার লোকদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভে হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
ইসলামি হুকুমাত সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক ও বিচার সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য কুরআনের পরই হাদিসের নির্দেশাবলীর প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে দেখা দেয়।
মহানবীর (স) অবর্তমানে কুরআনের কোন কোন আয়াতের ব্যাখ্যা অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া সাহাবিদের শাহাদাতবরণ ও তিরোধানে হাদিস অবলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দেয়। অধিকন্তু এভাবে স্মৃতিপটে হাদিস রক্ষিত হয়ে থাকলে সেগুলোর বিলুপ্তি এবং বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থেকে যায়। সুতরাং হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়।
উপরিউক্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় খ্যাতনামা রাবী ও মুহাদ্দিসগণ হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের নিরলস প্রয়াস চালান এবং চিরদিনের জন্য হাদিস সংকলনের ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
(২) হাদিস সংকলনের উদ্যোগ
সাহাবায়ে কিরামের যুগের শেষের দিকে- খারেজি, রাফেজি, মুতাযিলা ও বিদআতি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হলে তারা অনেকেই মহানবী (স) এর হাদিসে পরিবর্তন এনে হাদিস বর্ণনা শুরু করে। এহেন যুগ সন্ধিক্ষণে হাদিসের সত্যাসত্য নির্বাচন একান্ত জরুরি হয়ে পড়ে। এ সময়ও বেশ কিছু সাহাবি জীবিত ছিলেন। তাঁদের থেকেই সঠিক হাদিস সংগ্রহ শুরু হয়।
প্রথম হাদিস সংকলনকারী কে? সর্বপ্রথম হাদিসশাস্ত্র সংকলন করার মহৎ কাজে কে ব্রতী হয়েছেন, তা নির্দিষ্ট করে বলা দুঃসাধ্য। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ উপস্থাপন করে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) সর্বপ্রথম হাদিস লিখে রাখার ব্যাপারে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে কাজ শুরু করেন। এ সময় অনেক সাহাবিই হাদিস সংকলনে নিজ নিজ শক্তি ব্যয় করেন। তাঁদের প্রচেষ্টার এ গতি হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের সময়কাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অতঃপর তিনি মদীনার কাজী আমর ইবনে হাজমকে হাদিস সংকলনের নির্দেশ প্রদান করেন।
- এ ছাড়াও সাধারণ রাষ্ট্রসমূহে তিনি মুহাদ্দিস, উলামায়ে কিরামসহ সকল সুধী মহলে সঠিক হাদিস সংকলনের নির্দেশ দেন। এ সময় থেকেই প্রধানত রাষ্ট্রীয়ভাবে হাদিস লিখন শুরু হয়। এদিক থেকে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযকে প্রথম সংকলনকারী না বললেও প্রথম বাস্তব নির্দেশ প্রদানকারী ও হাদিস সংকলনে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণকারী বলা যায়। আর ইবনে শিহাব যুহরীই হলেন হাদিস সংকলনের প্রথম রূপকার।
- হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের ইন্তিকালের পরে হাদিস সংকলনের কাজ আরো বেগবান হয়।
- ইমাম মালিক (র) সংকলন করেন ‘মুয়াত্তা’। তাছাড়া, আবু আমর (সিরিয়ায়), আওযাঈ (সিরিয়ায়), সুফিয়ান সাওরী (কুফায়), আবু সালামা (বসরায়) হাদিস সংকলন করেন।
- হাদিস সংকলনের এ কাজ দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরি শতাব্দীতে এসে পরিপূর্ণতা লাভ করে। সংকলিত হয় মহানবীর (স) হাদিসের বিশাল বিশাল সংকলন।
মানব জীবনে ইসলামি বিধিবিধান অনুসরণে হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের প্রয়োজনীতা দেখা দেয়। মহানবী (স) এর জীবদ্দশায় ও সাহাবায়ে কিরামের যুগে তাঁর সকল হাদিস ছিল লেখকদের মুখে মুখে এবং আমলি যিন্দেগিতে। কালক্রমে বাস্তবতার নিরিখে হাদিস সংগ্রহ ও সংকলন করা হয়।
(৩) হাদিস সংরক্ষণ
ইসলাম বিশ্বমানবের জন্য এক চিরন্তন জীবনব্যবস্থা। এর প্রধান ভিত্তি কুরআন মাজীদ, যার হিফাযতকারী স্বয়ং আল্লাহ। ইসলামের দ্বিতীয় ভিত্তি মহানবীর (স) হাদিসকেও তাঁর সাহাবীগণ, তাবিঈন ও তাবি-তাবিঈন এবং পরবর্তী উম্মতগণ হিফাযত করে রেখেছেন।
ক) হাদিস সংরক্ষণ পদ্ধতি
মুসলিম উম্মাহ হাদিস হিফাযতের জন্য প্রধানত চারটি পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। যথা–
- মুখস্থকরণ;
- লিখন;
- শিক্ষাদান ও
- আমল বা জীবনে বাস্তবায়ন।
খ) বিভিন্ন যুগে হাদিস সংরক্ষণ
হাদিস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সংকলনের ক্রমবিকাশের চারটি যুগ রয়েছে-
প্রথম যুগ: রাসূলের (স) নবুওয়াত প্রাপ্তি থেকে হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত
এ যুগে হাদিসের সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রচারের কাজ চলছিল বিশেষভাবে চারটি উপায়ে- ১. মুখস্থকরণ (মৌখিকভাবে) ২. শিক্ষাদান ৩. বাস্তব আমল ৪. লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে। তবে এ সময়ও বিচ্ছিন্নভাবে হাদিসের বহু লিখিত সম্পদ পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় যুগ: হিজরি ১০০-২০০ পর্যন্ত ১০০ বছর
এ যুগ দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম হতে তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম পর্যন্ত।
এটা তাবিঈন ও তাবি-তাবিঈন-এর যুগ। এ যুগেও হাদিস মুখস্থকরণ, ব্যাপক চর্চা ও সংকলনের বিকাশ শুরু হয় এবং হাদিস শাস্ত্রের ক্রমবিকাশের ও সংরক্ষণের সর্বোত্তম ধারাটি ক্রমোন্নতির পথে অগ্রসর হতে থাকে। হাদিস লিখনের ব্যাপারে উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) এক সরকারি ফরমান জারি করেন। এ ফরমানের ফলে হাদিস সংগ্রহ-সংকলনের যে প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছিল তা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে।
এ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই হাদিসের অসংখ্য সংকলন তৈরি হয়ে সর্বত্র প্রচারিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে হাদিসের ব্যাপক চর্চা অনুশীলন ও শিক্ষা দান চলছিল। এ সময়ে অসংখ্য হাফিয-ই-হাদিস জীবিত ছিলেন। তবে এ যুগের তিনজন বিশিষ্ট হাদিসের ইমাম ও তাঁদের সংকলিত হাদিসগ্রন্থ বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিল- ১. ইমাম মালিক (র) ও তাঁর মুআত্তা গ্রন্থ; ২. ইমাম শাফিঈ (র) ও তাঁর কিতাবুল মুসনাদ এবং ৩. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) ও তাঁর মুসনাদ।
তাছাড়াও ইমাম আবূ হানিফা ও ইমাম মালিকের ছাত্রগণ হাদিসের বিপুল জ্ঞানসম্ভার বক্ষে ধারণ করে সমগ্র মুসলিম জাহানের কেন্দ্রে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আর এর প্রচার ও শিক্ষাদানে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
তৃতীয় যুগ: হিজরি তৃতীয় শতাব্দীতে হাদিস চর্চা
হাদিস চর্চার স্বর্ণযুগ: হাদিস সংগ্রহ সংকলন ও সংরক্ষণের পরিপূর্ণতার যুগ। এ যুগে এমন সকল হাফিয-ই-হাদিসের জন্ম হয়, যাঁদের নজীর নেই এ যুগে হাদিস একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর এক একটি শাখা এবং বিভাগ সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্রভাবে গঠিত হয়।
এ শতাব্দীর মুহাদ্দিস ও হাদিস বর্ণনাকারীগণ হাদিসের অনুসন্ধানে জলে-স্থলে পরিভ্রমণ করেন। মুসলিম জাহানের প্রতিটি কেন্দ্রে এবং প্রতিটি অঞ্চলে হাদিসের খোঁজে তন্ন তন্ন করে বেড়িয়েছেন।
পূর্ণ সনদসম্পন্ন হাদিসসমূহ স্বতন্ত্রভাবে বিন্যাস করেন। সনদ ও বর্ণনা সূত্রের ধারাবাহিকতা এবং এর বিশুদ্ধতার ওপর পূর্ণ মাত্রায় গুরুত্বারোপ করেন। এ প্রয়োজনে আসমাউর রিজাল বা (চরিত বিজ্ঞান) সংকলিত ও বিরচিত হয়। ফলে হাদিস যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সত্য-মিথ্যা নির্ধারণের সূক্ষ্ম তত্ত্ব তথা لم الجر ح والتعديل এবং تنقيد الحديث এক একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে গড়ে ওঠে। সিহাহ সিত্তাহও এ শতকেই সংকলিত হয়।
চতুর্থ যুগ: হিজরি চতুর্থ শতাব্দীতে হাদিস চর্চা
তারপর এলো চতুর্থ যুগ। এ যুগ ছিল হাদিসের বিন্যাস, অলংকরণ, সংক্ষেপণ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের যুগ। এ চতুর্থ শতকে ইলমে হাদিস পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। তৃতীয় শতকে ইলমে হাদিসের যে চর্চা ও উন্নয়ন সাধিত হয়, তা অতীত সকল কাজকে অতিক্রম করে। তৃতীয় শতকেই হাদিসের সনদকারীদের ইতিহাস, জীবন-চরিত পুঙ্খানু পুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই হয়, সর্বতোভাবে ইলমে হাদিস এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বিজ্ঞান হিসেবে গড়ে ওঠে।
আর এ চতুর্থ শতকে পূর্বের শতকের কাজ-কর্মেরই ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। তবে হাদিস গ্রন্থ প্রণয়নে এ শতকে স্বতন্ত্রভাবে কিছু কাজও সম্পাদিত হয়েছে।
এভাবে হাদিস শাস্ত্র নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গভাবে সংকলিত ও সম্পাদিত হয়।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা হাদিস সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা, সংকলনের উদ্যোগ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা অর্জন করলাম।
ইসলামি জীবনব্যস্থার দ্বিতীয় উৎস হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলনে অবলম্বিত হয়েছে অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি ও উপায়। মহানবী (স) -এর যুগ থেকে সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন ও তাবি তাবিঈনের যুগে নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণিকভাবে হাদিস সংকলিত ও গ্রন্থিত হয়ে এসেছে।