(১) আমানত অর্থ কী?
আমানত আরবি শব্দ। এর অর্থ গচ্ছিত রাখা, নিরাপদ রাখা।
(২) আমানত কী, কাকে বলে?
সাধারণত কারও নিকট কোনো অর্থ-সম্পদ, কথা গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলা হয়।
তবে ব্যাপকার্থে শুধু ধন-সম্পদ নয় বরং যেকোনো জিনিস গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলে। একজনের জান, মাল, সম্মান, কথা-প্রতিজ্ঞা সবকিছুই অন্যের নিকট আমানত স্বরূপ। যিনি গচ্ছিত সম্পদ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেন এবং তা প্রকৃত মালিকের নিকট ফিরিয়ে দেন তাকে বলা হয় আমিন বা আমানতদার।
আমানতের বিপরীত হলো খিয়ানত। খিয়ানত অর্থ আত্মসাৎ করা, ক্ষতিসাধন করা, ভঙ্গ করা। আমানতকৃত দ্রব্য বা বিষয় যথাযথভাবে প্রকৃত মালিকের নিকট ফিরিয়ে না দিয়ে আত্মসাৎ করাকে খিয়ানত বলে। যে ব্যক্তি গচ্ছিত জিনিসের খিয়ানত করে তাকে খায়িন (ও) বলা হয়।
(৩) আমানত রক্ষার গুরুত্ব
আমানত রক্ষা করা আখলাকে হামিদাহ-র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। সচ্চরিত্র ব্যক্তির মধ্যে আমানতদারি বিশেষভাবে বিদ্যমান থাকে। আমানত রক্ষা করা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ।
আল- কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার মালিকের নিকট প্রত্যর্পণ করতে।”
(সূরা আন-নিসা, আয়াত ৫৮)
আমানত রক্ষা করা মুমিনের জন্য আবশ্যক। প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি কোনো অবস্থাতেই আমানতের খিয়ানত করে না।
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার ইমান নেই।”
(মুসনাদে আহমাদ)
আমানত রক্ষা করা ইমানের অঙ্গ স্বরূপ। আমানতের খিয়ানত করা ইমানদারের বৈশিষ্ট্য নয়। বরং এটি মুনাফিকের চিহ্ন। আমাদের প্রিয়নবি (সাঃ) ছিলেন আমানতদারির মূর্ত প্রতীক। ঘোর শত্রুরাও তাঁকে আমানতদার হিসেবে জানত, তাঁর নিকট তাদের মূল্যবান ধন-সম্পদ আমানত রাখত। তাঁকে তারা আল আমিন বা বিশ্বাসী তথা আমানতদার নামে ডাকত।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ)ও সারাজীবন আমানত রক্ষা করে চলেছেন। এমনকি হিজরতের সময় মক্কার কাফিররা যখন তাঁকে হত্যা করতে বের হয় তখনও তিনি আমানতের কথা ভোলেননি। তিনি তাদের গচ্ছিত সম্পদ প্রকৃত মালিকের নিকট ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ইসলামি জীবন দর্শনে আমানত রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমানতের খিয়ানত করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ, হারাম। মহানবি (সাঃ)-এর হাদিসে এসেছে খিয়ানত করা মুনাফিকদের অন্যতম নিদর্শন স্বরূপ। আল্লাহ তায়ালা খিয়ানতকারীর প্রতি অসন্তুষ্ট।
মহান আল্লাহ বলেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা খিয়ানতকারীদের পছন্দ করেন না।”
(সূরা আল-আনফাল, আয়াত ৫৮)
খিয়ানত মানুষের পার্থিব জীবনেও বিপর্যয় ডেকে আনে।
মহানবি (সাঃ) বলেছেন, “আমানতদারি সচ্ছলতা ও খিয়ানত দারিদ্র্য ডেকে আনে।”
(মুসনাদে শিহাব আল-কাযায়ি)
খিয়ানতকারী মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে। লোকেরা তাকে ঘৃণা করে। এড়িয়ে চলে। তার সাথে ব্যবসায়- বাণিজ্য, লেনদেন করতে আগ্রহী হয় না। ফলে খিয়ানতকারী আর্থিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
(৪) আমানতের ক্ষেত্র
কারও নিকট কোনো দ্রব্য বা জিনিস গচ্ছিত রাখা হলে তা অবশ্যই যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। গচ্ছিত দ্রব্যে কোনোরূপ পরিবর্তন করা যাবে না। তা নিজ কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বরং প্রকৃত মালিক যখন চাইবে তখনই তা ফিরিয়ে দিতে হবে। এটাই আমানতের ইসলামি নীতি ও পদ্ধতি।
আমানতের ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক। শুধু ধনসম্পদই আমানত নয়, বরং কথা, কাজ, মান-সম্মানও আমানত হতে পারে।
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“যখন কোনো লোক কথা বলে প্রস্থান করে, তখন সে কথাও এক প্রকার আমানত স্বরূপ।”
(আবু দাউদ)
অর্থাৎ কেউ বিশ্বাস করে কোনো কথা বললে এবং তা গোপন রাখতে বললে সে কথাও আমানত স্বরূপ। সে কথা অন্যের নিকট বলে ফেললে আমানতের খিয়ানত করা হয়।
ইসলামে মানুষের প্রতিটি দায়িত্ব ও কর্তব্যই আমানত স্বরূপ। ব্যক্তিগত কাজের পাশাপাশি মানুষকে আরও বহু দায়িত্ব পালন করতে হয়। মানুষের এসব পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক দায়িত্ব আমানত হিসেবে গণ্য।
নিম্নে আমানতের কতিপয় ক্ষেত্র উল্লেখ করা হলো-
- মাতাপিতার নিকট সন্তান আমানত স্বরূপ। সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালন করা, তাদের সুশিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলা তাদের দায়িত্ব।
- সন্তানের নিকট মাতাপিতা আমানত। মাতাপিতার আনুগত্য করা, তাঁদের সেবা করা সন্তানের কর্তব্য ও আমানত।
- শিক্ষকের নিকট ছাত্র-ছাত্রী আমানত। তাদের সুশিক্ষা দেওয়া আমানত স্বরূপ।
- ছাত্রছাত্রীদের নিকট বিদ্যালয়ের সব আসবাবপত্র আমানত। এগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা তাদের কর্তব্য। শিক্ষকদের সম্মান করা, সুন্দরভাবে পড়াশুনা করা ইত্যাদিও শিক্ষার্থীদের নিকট আমানত স্বরূপ।
- কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিকট ঐ প্রতিষ্ঠান আমানত স্বরূপ। ঐ প্রতিষ্ঠানের সবকিছু রক্ষণাবেক্ষণ করা তাদের কর্তব্য।
- সরকারের নিকট রাষ্ট্রের সকল সম্পদ ও জনগণের অধিকার আমানত স্বরূপ। এগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার না করা খিয়ানত হিসেবে গণ্য।
- জনগণের নিকট রাষ্ট্র আমানত স্বরূপ। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষা করা, জাতীয় উন্নয়নের চেষ্টা করা জনগণের কর্তব্য। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করা খিয়ানত হিসেবে গণ্য।
আমানত একটি মহৎগুণ। নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করার মাধ্যমে মানুষ আমানত রক্ষা করতে পারে। আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে আমানত রক্ষা করতে সচেষ্ট হব।
[সূত্র: এনসিটিবি]