Skip to content

 

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় মুসলমানদের অবদান: ১৬ জন মুসলিম বিজ্ঞানী নাম ও পরিচয়

জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় মুসলমানদের অবদান ১৬ জন মুসলিম বিজ্ঞানী নাম ও পরিচয়

শুধু সাধারণ শিক্ষায় নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায়ও মুসলমানগণ সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রচেষ্টা ও অবদানের উপর ভিত্তি করে মুসলমানগণ একসময়ে সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক শাখা মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরই ফসল।

নিম্নে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় মুসলমানদের অবদান ও ১৬ জন মুসলিম বিজ্ঞানী নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো-

(১) চিকিৎসা শাস্ত্র

চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরণীয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির মূলে রয়েছে মুসলমানদের অবদান।

যাঁদের অবদানের কারণে চিকিৎসা শাস্ত্র উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- আবু বকর আল রাযি, আল বিরুনি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখ।

ক) আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া আল রাযি

  • তাঁর নাম মুহাম্মদ, উপনাম আবু বকর, পিতার নাম যাকারিয়া।
  • তিনি আল-রাযি নামে পরিচিত। তিনি ৮৬৫ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন।
  • তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শল্যচিকিৎসাবিদ ছিলেন।
  • দীর্ঘদিন তিনি জুন্দেরশাহপুর ও বাগদাদে সরকারি চিকিৎসালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তৎকালে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে অনেক রোগী তাঁর নিকট আসতেন।
  • শল্যচিকিৎসায় আল রাযি ছিলেন তৎকালের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁর অস্ত্রোপচার পদ্ধতি ছিল গ্রীকদের থেকেও উন্নত।
  • তিনি মোট দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে শতাধিক হলো চিকিৎসা বিষয়ক। তিনি বসন্ত ও হাম রোগের উপর ‘আল্ জুদাইরি ওয়াল হাসবাহ’ নামক একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মৌলিকত্ব দেখে চিকিৎসা বিজ্ঞানের লোকেরা খুব আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন।
  • তাঁর আরেকটি গ্রন্থের নাম হলো আল মানসুরি। এটি ১০ খণ্ডে রচিত। এ গ্রন্থ দুটি আল রাযিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে অমর করে রেখেছে।
  • তিনি হাম, শিশু চিকিৎসা, নিউরোসাইকিয়াট্রিক ইত্যাদি চিকিৎসা সম্পর্কে নতুন মতবাদ প্রবর্তন করেন।
  • আল মানসুরি গ্রন্থে তিনি এনাটমি, ফিজিওলজি, ঔষধ, স্বাস্থ্যরক্ষা বিধি, চর্মরোগ ও প্রসাধন দ্রব্য, শল্যচিকিৎসা, বিষ, জ্বর ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করেন।
  • তিনি ৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

খ) বুরহানুল হক আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল বিরুনি

  • সংক্ষেপে আল বিরুনি নামে পরিচিত।
  • ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে খাওয়ারিযমের নিকটবর্তী আল বিরুন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।
  • আল বিরুনি ছিলেন মধ্যযুগীয় শ্রেষ্ঠ মুসলিম পণ্ডিত, মহাজ্ঞানী ও নিষ্ঠাবান গবেষক।
  • তিনি অত্যন্ত মৌলিক ও গভীর চিন্তাধারার অধিকারী বড় দার্শনিক ছিলেন।
  • গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, পদার্থ, রসায়ন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে তিনি পারদর্শী ছিলেন।
  • এ ছাড়া তিনি প্রসিদ্ধ ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক পঞ্জিকাবিদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, ভাষাতত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্বের নিরপেক্ষ বিশ্লেষক ছিলেন।
  • স্বাধীন চিন্তা, মুক্ত বুদ্ধি, সাহসিকতা, নির্ভীক সমালোচনা ও সঠিক মতামতের জন্য তিনি যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
  • তিনি আল উসতাদ (মহামান্য শিক্ষক) নামে খ্যাতি অর্জন করেন।
  • তিনি ভূগোলের অক্ষরেখার পরিমাপ নির্ণয় করেন।
  • তাঁর লিখিত অনেক গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে ‘আল-আছারুল বাকিয়্যাহ-আনিল কুরুনিল খালিয়্যাহ’ গ্রন্থটি প্রসিদ্ধ। এ গ্রন্থে তিনি বর্ষপঞ্জি, গণিত, ভূগোল, আবহাওয়া বিজ্ঞান ও চিকিৎসাসহ নানা বিষয় বর্ণনা করেন।
  • তিনি প্রথম প্রমাণ করলেন যে, পৃথিবী গোলাকার। পৃথিবীর গোলাকার মানচিত্র তাঁর রচিত।
  • তিনি ১০৪৮ খ্রি. ইন্তিকাল করেন।

গ) ইবনে সিনা

  • তাঁর পুরো নাম আবু আলি আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা।
  • তিনি বুখারার নিকটবর্তী আফশানা নামক গ্রামে ৯৮০ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন।
  • দশ বছর বয়সে পবিত্র কুরআন হিফজ করেন। তিনি দার্শনিক, চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ এবং মুসলিম জগতের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।
  • চিকিৎসায় তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য তাঁকে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র ও চিকিৎসা প্রণালি এবং শল্যচিকিৎসার দিশারি মনে করা হয়।
  • তাঁর রচিত অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘আল-কানুন ফিত-তিবব’ একটি অমর গ্রন্থ। ড. ওসলার এ গ্রন্থটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলে উল্লেখ করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে এর সমপর্যায়ের কোনো গ্রন্থ আজও দেখা যায় না।
  • আধুনিক বিশ্বেও তাঁর গ্রন্থটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পাঠদান করা হচ্ছে। চিকিৎসা সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্যের আশ্চর্য রকম সমাবেশ থাকার কারণে গ্রন্থটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বৃহৎ সংগ্রহ বলা চলে।
  • তিনি ১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

ঘ) ইবনে রুশদ

  • তাঁর পুরো নাম আবু ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদ।
  • তিনি স্পেনের করডোভায় জন্মগ্রহণ করেন।
  • মধ্যযুগে মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি তাঁদের একজন।
  • এই ক্ষণজন্মা পুরুষ শুধু এক বিষয়েই জ্ঞানী ছিলেন না, তিনি জ্ঞানের সকল শাখায় বিচরণ করেছেন। দর্শন, পদার্থ, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্র- এ সকল শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল।
  • তিনি এরিস্টটলের গ্রন্থসমূহ আরবিতে অনুবাদ করার পাশাপাশি নিজেও অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘আল জামি’। এ গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ও চিকিৎসার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
  • তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করা হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর লেখা গ্রন্থের নাম হলো ‘কুল্লিয়াত’ । এটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে সমাদৃত হয়েছে।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান মধ্যযুগের মুসলমানদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে অনেক ঋণী। মুসলমানদের ঐ অবদান না থাকলে আজকে চিকিৎসা বিজ্ঞান এতদূর আসতে পারত না।

আমরাও চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে গভীর অধ্যয়ন করে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সহজতর করে তুলব।

(২) রসায়নশাস্ত্র

বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ন্যায় রসায়নশাস্ত্রেও মুসলমানদের অবদান অনেক।

আল-কেমি (রসায়ন) শাস্ত্রে মুসলিম বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, জুননুন মিসরি, ইবনে আব্দুল মালিক আল-কাসি বিশেষ অবদান রাখেন।

তাঁদের নিরলস পরিশ্রম ও অকৃত্রিম অবদানের ফলে রসায়নশাস্ত্র আজ উন্নতির উচ্চশিখরে পৌঁছেছে।

ক) জাবির ইবনে হাইয়ান

  • আবু আব্দুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান দক্ষিণ আরবের আযদ বংশে ৭২২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
  • তাঁর পিতা হাইয়ানও একজন চিকিৎসক ছিলেন।
  • গণিতশাস্ত্রে শিক্ষা লাভ শেষে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রেও শিক্ষা গ্রহণ করেন।
  • তিনি কুফায় চিকিৎসা জীবন শুরু করলেও এর মধ্যে তিনি রসায়নশাস্ত্রে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করেন।
  • তিনি কুফায় একটি বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করে মৃত্যু পর্যন্ত (৮০৪ খ্রি.) সেখানেই গবেষণারত ছিলেন।
  • রসায়নকে তিনি সর্বপ্রথম বিজ্ঞানের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
  • রসায়ন ও বিজ্ঞানের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যথা পরিস্রবণ, দ্রবণ, ভস্মীকরণ, বাষ্পীকরণ, গলানো প্রভৃতি তাঁরই আবিষ্কার।
  • তিনি তাঁর গ্রন্থে ধাতুর শোধন, তরলীকরণ, বাষ্পীকরণ, ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়া, লোহার মরিচা রোধক বার্নিশ ও চুলের কলপ, লেখার কালি ও কাঁচ ইত্যাদি দ্রব্য প্রস্তুতের প্রণালি ও বিধি সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা করেন।
  • জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়নশাস্ত্রের পরিপূর্ণতা দান করেছেন বিধায় তাকে এ শাস্ত্রের ‘জনক’ বলা হয়।
  • তিনি ৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

খ) আল কিন্দি

  • আবু ইয়াকুব ইবনে ইছহাক আল কিন্দি ৮০১ খ্রি. কুফায় জন্মগ্রহণ করেন।
  • তাঁর পিতা ইছহাক খলিফা মামুনের শাসনামলে কুফার গভর্নর ছিলেন।
  • তিনি এরিস্টটলের ধর্মতত্ত্ব (Theology of Aristotle) আরবিতে অনুবাদ করেন।
  • খলিফা মামুনের সময়ে জ্যোতির্বিদ, রসায়নবিদ, চিকিৎসক ও দার্শনিক হিসেবে তাঁর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
  • আল কিন্দি নিউপ্লেটোনিজমের উদ্ভাবক ছিলেন।
  • তিনিই সর্বপ্রথম প্লেটো ও এরিস্টটলের মতবাদ সমন্বয় করার চেষ্টা করেন।
  • তিনি অনধিক ৩৬৫টি গ্রন্থ রচনা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন।
  • তাঁর মতে গণিত ছাড়া দর্শনশাস্ত্র অসম্ভব।
  • দর্শন ছাড়াও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, গণিত ও সংগীত বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন।
  • তিনি মাতৃভাষা আরবি ছাড়াও পাহলবি, সংস্কৃত, গ্রিক ও সিরীয় ভাষার সুপণ্ডিত ছিলেন।
  • তিনি ৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

গ) জুননুন মিসরি

  • তাঁর নাম ছাওবান, পিতার নাম ইবরাহিম।
  • তিনি জুননুন মিসরি নামে পরিচিত।
  • তিনি মিসরের আখমিম নামক স্থানে ৭৯৬ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন।
  • তিনি সুফি হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও আরব মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে রসায়নশাস্ত্রের উপর যাঁরা প্রথমদিকে গবেষণা করেন তাঁদের অন্যতম।
  • তিনি রসায়নশাস্ত্রের বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেন। তাঁর লেখায় সোনা, রুপাসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থের বর্ণনা পাওয়া যায়।
  • তিনি মিসরীয় সাংকেতিক বর্ণের মর্মার্থ বুঝতেন।
  • তিনি মিসরের আল জিজাহ নামক স্থানে ৮৫৯ খ্রি. ইন্তিকাল করেন।

ঘ) ইবনে আব্দুল মালিক আল কাসি

  • তাঁর নাম আবুল হাকিম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মালিক আল খারেজেমি আল কাসি।
  • তিনি একাদশ শতাব্দীতে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন।
  • তিনি বাগদাদেই অবস্থান করতেন।
  • তাঁর লেখা ‘আইনুস সানাহ ওয়া আইওয়ানুস সানাহ’ (Essence of the Art and Aid of worker) এ গ্রন্থটি রসায়নশাস্ত্রে মূল্যবান একটি সংযোজন। তিনি এ গ্রন্থে রসায়নের প্রত্যেক প্রয়োজনীয় শাখার সরল ও সহজ পন্থা সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন।
  • যে সকল বস্তু ‘সাদা’ এবং যে সকল বস্তু ‘লাল’ এদের ব্যবহার ও পার্থক্য বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।

(৩) ভূগোলশাস্ত্র

অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা এবং বিস্তৃত এলাকার লোকদের কেবলা নির্ধারণসহ নানা প্রয়োজনে মানচিত্রের খুব প্রয়োজন দেখা দেয়।

ইসলাম প্রচারক ও বণিকগণের জন্য দেশ-দেশান্তর ভ্রমণ করার তাগিদে ভূগোলের জ্ঞান অর্জনের খুব প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য আল মোকাদ্দাসি, আল মাসুদি, ইয়াকুত ইবনে আব্দুল্লাহ ও ইবনে খালদুনসহ অনেক মুসলিম মনীষী ভূগোলশাস্ত্রে অসামান্য অবদান রাখেন।

ক) আল মোকাদ্দাসি

  • তাঁর নাম মুহাম্মদ, পিতার নাম আহমাদ।
  • তিনি ৯৪৬ খ্রি. বাইতুল মোকাদ্দাস এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন তাই আল মোকাদ্দাসি নামে পরিচিত।
  • তিনি একজন বিখ্যাত পরিব্রাজক ও ভূগোলবিদ ছিলেন।
  • তিনি স্পেন, ভারতবর্ষ ও সিজিস্তান ব্যতীত সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেন।
  • দীর্ঘ বিশ বছরের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ৯৮৫ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থের নাম হলো ‘আহসানুত তাকাসিম ফি মারিফাতুল আকালিম’ ।
  • এই মনীষী ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

খ) আল-মাসুদি

  • তাঁর নাম আবুল হাসান আলি বিন হুসাইন আল-মাসুদি।
  • তিনি বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন।
  • তিনি একাধারে পরিব্রাজক, ইতিহাসবিদ ও ভূগোলবিদ ছিলেন।
  • তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ‘ভূগোল বিশ্বকোষ’-এ তাঁর ভ্রমণসমূহের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
  • তিনি পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন করেন। পৃথিবীর আকার, আয়তন, গতি ও প্রধান প্রধান বিভাগগুলোর বিবরণ দেন।
  • ভারত মহাসাগর, পারস্য সাগর, আরব সাগরের ঝড়ের অবস্থার কথা তিনি উল্লেখ করেন।
  • ৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভূকম্পন বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন।
  • তিনি ৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মিসরে ইন্তিকাল করেন।

গ) ইয়াকুত ইবনে আব্দুল্লাহ

  • ইয়াকুত ইবনে আব্দুল্লাহ আল হামাবি পারস্যে জন্মগ্রহণ করেন।
  • তাঁর ‘মুজামুল বুলদান’ নামক গ্রন্থখানি ভূগোলশাস্ত্রের এক প্রামাণ্যগ্রন্থ। এতে তিনি প্রত্যেক স্থানের ঐতিহাসিক, জাতিতাত্ত্বিক ও প্রাকৃতিক বিষয়ের বিবরণ দিয়েছেন। ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের পরিচয় ও ঘটনাসমূহ উল্লেখ করেছেন।
  • তিনি ১২২৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদে ইন্তিকাল করেন।

ঘ) ইবনে খালদুন

  • তাঁর নাম আব্দুর রহমান, পিতার নাম মুহাম্মদ।
  • তিনি ইবনে খালদুন নামে পরিচিত।
  • তিনি ১৩৩২ খ্রি. তিউনিসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
  • তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতির মূলে ছিল তাঁর ভূগোল বিষয়ক গ্রন্থ ‘কিতাব আল- ইবার ওয়া দিওয়ান আল-মুবতাদা ওয়াল খাবার ফি- আইয়াম আল-আরাব ওয়াল আযম ওয়া বারবার’ এটি সংক্ষেপে আল মুকাদ্দিমা নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে ভূগোল বিষয়ে তিনি যেসব তত্ত্ব ও তথ্যের অবতারণা করেছেন তা তাঁকে ভূগোলশাস্ত্রে অমরত্ব দান করেছে।
  • তিনি ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

(৪) গণিতশাস্ত্র

গণিতকে বিজ্ঞানের মূল বলা হয়ে থাকে। এই গণিতশাস্ত্র আবিষ্কারের অগ্রগতি ও উন্নতির উৎকর্ষসাধনে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরণীয়।

আল-খাওয়ারেযমি, ইবনে হায়সাম, উমর খৈয়াম ও নাসির উদ্দিন তুসিসহ অনেক মুসলিম মনীষী এ শাস্ত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

ক) মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারেযমি

  • তাঁর নাম মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারেযমি।
  • ৭৮০ খ্রি. খাওয়ারেযম নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।
  • তিনি গণিতশাস্ত্রের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। তাঁকে গণিতশাস্ত্রের ‘জনক’ বলা হয়।
  • বীজগণিতের আবিষ্কারক হলেন তিনি। এ বিষয়ে তাঁর রচিত ‘হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালাহ’ গ্রন্থের নামানুসারে এ শাস্ত্রকে পরবর্তীকালে ইউরোপীয়রা আল-জেবরা নামকরণ করে। তিনি এ গ্রন্থে আট শতাধিক উদাহরণ সন্নিবেশিত করেন। সমীকরণের সমাধান করার ছয়টি নিয়ম তিনি আবিষ্কার করেন। এটি দ্বাদশ শতাব্দীতে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পঠিত হতো।
  • “কিতাবুল হিসাব আল আদাদ আল হিন্দী’ তাঁর পাটিগণিত বিষয়ক গ্রন্থ। তাঁর গণিতশাস্ত্র দ্বারা উমর খৈয়াম, লিওনার্ডো, ফিরোনাসসি এবং মাস্টার জ্যাকবসহ আরও অনেকেই প্রভাবান্বিত হয়েছেন।
  • তিনি ৮৫০ খ্রি. ইন্তিকাল করেন।

খ) হাসান ইবনে হায়সাম

  • হাসান ইবনে হায়সাম একজন চক্ষুবিজ্ঞানী (Optic Scientist) ছিলেন।
  • তিনি ৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
  • দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত প্রভৃতি বিষয়ে তিনি শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন।
  • চক্ষুবিজ্ঞান বিষয়ক মৌলিক গ্রন্থ “কিতাবুল মানাযির’ তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। মধ্যযুগে আলোক বিজ্ঞানের এটি একমাত্র গ্রন্থ ছিল।
  • গবেষক রোজার বেকন, নিউলার্ডো, কেপলার প্রমুখ এ গ্রন্থের উপর নির্ভর করেই তাঁদের গবেষণা করেন।
  • তিনি দৃষ্টি শক্তির প্রতিসরণ ও প্রতিফলন বিষয়ে গ্রিকদের ভুল ধারণা খণ্ডন করেন। তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, বাহ্যপদার্থ থেকেই আমাদের চোখে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়। চোখ থেকে বের হওয়া আলো বাহ্যপদার্থকে দৃষ্টিগোচর করায় না।
  • তিনিই ম্যাগনিফাইং গ্লাস আবিষ্কার করেন।
  • আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা গতি বিজ্ঞানকে তাদের আবিষ্কার বলে দাবি করলেও ইবনে হায়সাম এ বিষয়ে বহু পূর্বেই বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন।
  • বায়ুমণ্ডলের ওজন, চাপ এবং তাপের কারণে জড়পদার্থের ওজনেও তারতম্য ঘটে। মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ে তিনি তাঁর গ্রন্থসমূহে বর্ণনা করেছেন।
  • স্যার আইজ্যাক নিউটনকে (১৬৪২-১৭১৭ খ্রি) মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত শক্তির আবিষ্কারক মনে করা হলেও ইবনে হায়সাম এ বিষয়ে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
  • তিনি ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

গ) উমর খৈয়াম

  • তাঁর নাম উমর ইবনে ইবরাহিম আল খৈয়াম সংক্ষেপে উমর খৈয়াম।
  • ১০৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যে জন্মগ্রহণ করেন।
  • তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণির গণিতবিদ। তাঁর ‘কিতাবুল জিবার ওয়াল মুকাবালা’ গণিতশাস্ত্রের একখানি অমর গ্রন্থ।
  • ঘন সমীকরণ এবং অন্যান্য উন্নতশ্রেণির সমীকরণের পদ্ধতির বিশ্লেষণ এবং সংজ্ঞানুসারে এগুলোকে শ্রেণিভুক্ত করে উমর খৈয়াম বীজগণিতের অসাধারণ অগ্রগতি সাধন করেন। এ ব্যাপারে তিনি গ্রিকদের থেকেও বেশি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
  • পাটিগণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপরও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন।
  • তিনি ১১২২ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

ঘ) নাসির উদ্দিন তুসি

  • মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন তুসি ১২০১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
  • জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে মোট ষোলটি গ্রন্থ রচনা করেন।
  • তিনি ত্রিকোণমিতিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান হতে পৃথক করে সমতল এবং গোলাকৃৎ ত্রিকোণমিতি সম্পর্কে বর্ণনা করেন।
  • গণিতশাস্ত্র বিষয়ে প্রণীত তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে- মুতাওয়াসিতাত বাইনাল হান্দাসা ওয়াল হাইয়া (The Middle Books between Geometry and Astronomy), জামিউল হিসাব বিত তাখতে ওয়াত্বোরাব (Summary of the Whole of Computation with Table and Earth), কাওয়ায়েদুল হান্দাসা, তাহরিরুল উসুল অন্যতম।
  • তিনি ১২৭৪ খ্রি. ইন্তিকাল করেন।

আমরাও এসব মুসলিম বিজ্ঞানী ন্যায় জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখার চেষ্টা করব। সেই অনুযায়ী জীবন গড়ব এবং দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাব।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts

You cannot copy content of this page