(১) তাহারাত অর্থ কি, মানে কি, কাকে বলে, কত প্রকার?
ক) পরিচয়
“তাহারাত’ আরবি শব্দ। এর অর্থ পবিত্রতা।
ইসলামি পরিভাষায় তাহারাত বলতে দেহ, মন, পোশাক, স্থান বা পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা ও নির্মলতাকে বোঝায়।
আল্লাহর ইবাদাত করার পূর্বে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। ওযু গোসল, তায়াম্মুম ইত্যাদির মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা যায়।
ইবাদাতের জন্য পবিত্র থাকা একান্ত প্রয়োজন। পবিত্র না হয়ে সালাত আদায় করা যায় না।
এ প্রসঙ্গে মহানবি (সা.) বলেন,
“পবিত্রতা ব্যতীত সালাত কবুল হয় না।”
(মুসলিম)
পবিত্র থাকলে শরীর সুস্থ থাকে, মন প্রফুল্ল থাকে। লেখাপড়া ও কাজকর্মে মন বসে। ভালো কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত ছিলেন। তিনি তাঁর উম্মতকে পবিত্ৰতা অর্জনের জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন এবং পবিত্র থাকার জন্য বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে মহানবি (সা.) বলেন,
“পবিত্রতা ইমানের অংশ।”
(মুসলিম)
খ) প্রকারভেদ
তাহারাত বা পবিত্রতা দুই প্রকার-
- বাহ্যিক পবিত্রতা
- অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা
বাহ্যিক পবিত্রতা: ইবাদাতের প্রস্তুতির জন্য শরীর, পোশাক-পরিচ্ছদ ও ইবাদাতের স্থান পবিত্র করতে হয়। শারীরিক পবিত্রতা লাভের মাধ্যম হলো ওযু, গোসল ও তায়াম্মুম। শরিয়তের বিধি অনুযায়ী ওযু, গোসল ও তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনই বাহ্যিক পবিত্রতা।
অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা: দেহের পাশাপাশি মনকেও যাবতীয় পাপ চিন্তা থেকে মুক্ত করতে হয়। কৃতপাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে হয়। ভবিষ্যতে ভালো কাজ করার অঙ্গীকার এবং পাপ কাজ বর্জন করার দৃঢ় সংকল্প করতে হয়। এতে দেহ ও মন পবিত্র হয় এবং আল্লাহর ইবাদাতের জন্য প্রস্তুত হয়। এটাই অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা।
(২) নাজাসাত অর্থ কি, মানে কি, কাকে বলে, কত প্রকার?
ক) পরিচয়
‘নাজাসাত’ আরবি শব্দ। এর অর্থ অপবিত্রতা। এটি তাহারাত বা পবিত্রতার বিপরীত।
শরীর থেকে যেসব জিনিস বের হওয়ার কারণে শরীর অপবিত্র হয়ে যায় অথবা যে সব দ্রব্য কোনো পবিত্র বস্তুতে লাগলে তা অপবিত্র হয়ে যায়, তাকে নাজাসাত বা অপবিত্রতা বলা হয়। যেমন: মল-মূত্র, রক্ত ইত্যাদি।
নাজাসাতের কারণে শরীর, কাপড় ও ব্যবহারিক জিনিসপত্র অপবিত্র হয়ে যায়। এ অবস্থায় তা পবিত্র করা একান্ত জরুরি।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“যদি তোমরা অপবিত্র হয়ে যাও তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে।”
(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৬)
খ) প্রকারভেদ
নাজাসাত বা অপবিত্রতা দুই প্রকার-
- নাজাসাতে হাকিকি বা প্রকৃত অপবিত্রতা
- নাজাসাতে হুকমি বা অপ্রকৃত অপবিত্ৰতা
নাজাসাতে হাকিকি: নাজাসাতে হাকিকি বলতে ঐ সকল অপবিত্র বস্তুকে বোঝায় যেগুলো প্রকৃতিগতভাবেই অপবিত্র এবং ইসলামি শরীয়ত সেগুলোকে অপবিত্র ঘোষণা করে। ঐ সকল অপবিত্র বস্তুকে মানুষ অপছন্দ করে। যেমন প্রস্রাব, পায়খানা, রক্ত ইত্যাদি। ইসলাম এসব থেকে শরীরকে পবিত্র রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
নাজাসাতে হুকমি: নাজাসাতে হুকমি হচ্ছে ঐ সকল অপবিত্ৰতা যা দেখা যায় না কিন্তু ইসলামি বিধানে তা নাজাসাত বা অপবিত্র বলে গণ্য। যেমন: ওযু ভঙ্গ হওয়া, গোসলের প্রয়োজন হওয়া ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, উভয় প্রকার অপবিত্রতা থেকে শরীর পবিত্র রাখা একান্ত প্রয়োজন।
(৩) অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের উপায়সমূহ
আল্লাহ তা’আলা নিজে পবিত্র, তাই তিনি পবিত্রতা অর্জনকারী ব্যক্তি ও পবিত্র বস্তুকে পছন্দ করেন। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার পবিত্রতা অর্জন করা জরুরি।
ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী পবিত্ৰতা অর্জনের উপায়গুলো হলো-
ক) ওযু
শরীর পবিত্র করার নিয়তে পাক-পবিত্র পানি দিয়ে শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী মুখমণ্ডল, দুই হাত কনুই সহ) ও দুই পা টাখনু সহ) ধৌত করা এবং মাথা মাসাহ করার নাম ওষু। যে পানি দিয়ে ওযু করা হবে তা অবশ্যই পবিত্র হতে হবে। যেমন: নদী, খাল, পুকুর, কূপ, করণা, নলকূপ বা শহরে সরবরাহ করা পানি।
খ) গোসল
পবিত্র পানি দিয়ে নির্দিষ্ট নিয়মে পুরো শরীর ধৌত করাকে গোসল বলে। গোসলের মাধ্যমে পুরো শরীর পবিত্র হয়ে যায়।
গ) তায়াম্মুম
পানি পাওয়া না গেলে অথবা অসুস্থ অবস্থায় রোগী পানি ব্যবহারে অক্ষম হলে, মাটি বা মাটি জাতীয় বস্তু দ্বারা মুখমন্ডল ও হাত মাসাহ্ করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করাকে তায়াম্মুম বলে।
ইসলাম মনের পবিত্রতার ওপর খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। খ্যাতিমান ইসলামি পণ্ডিতগণ মনের ১০টি মৌলিক রোগ চিহ্নিত করেছেন। তা হলো লোভ, উচ্চাশা, রাগ, মিথ্যা বলা, গিবত (পরনিন্দা), কার্পণ্য, অহংকার, রিয়া (লোক দেখানো), হাসান (হিংসা)। উপযুক্ত পাপগুলো থেকে বেঁচে থাকলে মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব।
এ ছাড়া ইসলামের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাবগুলো যথাযথভাবে আদায়ের মাধ্যমে মনের পবিত্রতা অর্জন করা যায়।
কোনো মুমিন যদি ইবাদাতের পাশাপাশি হালাল খাদ্য গ্রহণ করেন, হারাম থেকে বেঁচে থাকেন, কুরআন তিলাওয়াত করেন এবং সদা আল্লাহর যিকির (সারণ) করেন তবে তাঁর অন্তর পবিত্র থাকবে।
এবার আমরা পবিত্র থাকার লক্ষ্যে ওযু, গোসল এবং তায়াম্মুমের নিয়মগুলো জেনে নেবো।
(৪) শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পবিত্রতার ভূমিকা
আমরা সবাই ভালো থাকতে চাই। ভালো থাকতে হলে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।
দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ থাকলে মনে সুখ-শান্তি থাকে না; ফলে নানারকম শারীরিক ও মানসিক রোগ সৃষ্টি হয়। এই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পবিত্রতার ভূমিকা অপরিসীম।
ইসলাম পবিত্রতার উপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে। ইসলাম শারীরিক পবিত্রতার সাথে সাথে মানুষের আত্মিক পবিত্রতা, বিশ্বাসের পবিত্রতা, কর্মের পবিত্রতা, আর্থিক পবিত্রতা, পরিবেশের পবিত্রতা ইত্যাদির প্রতি গুরুত্বারোপ করে।
পবিত্রতা শরীরকে রাখে সতেজ ও সবল, মনকে রাখে প্রফুল্ল। ফলে সেই শরীর ও মন থাকে রোগ-জীবাণু থেকে সুরক্ষিত।
অপবিত্রতা থেকে নানারকম রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হয়। পোশাক-পরিচ্ছদ নোংরা থাকলে রোগ-জীবাণু ছড়ায়।
পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র রাখার ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র রাখো। (যাবতীয়) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো।”
(সুরা আল-মুদ্দাছছির, আয়াত ৭৪)
বর্তমানে ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে ‘বিশ্ব হাতধোয়া দিবস’ পালিত হয়। সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হওয়ার পর দেশের প্রায় সব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামে পবিত্রতা অর্জনের জন্য ওযু, গোসল ও তায়াম্মুমের বিধান রয়েছে। দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায়ের জন্য ওযু করতে হয়। ওযু করলে শরীর থেকে যেমন রোগ-জীবাণু ধুয়ে যায়, তেমনি গুনাহসমূহও বের হয়ে যায়। এর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক পবিত্রতা অর্জিত হয়।
মানব শরীরে মুখগহ্বর স্পর্শকাতর একটি স্থান। আমরা সারা দিন নানা রকম খাবার গ্রহণ করি। আমরা যদি সব সময় মুখ পরিষ্কার না রাখি তাহলে নানারকম রোগের পাশাপাশি ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। তাই মহানবি (সা.) নিয়মিত মিসওয়াক করার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন।
শরীরিক পবিত্রতার সঙ্গে মানসিক শান্তি একই সূত্রে গাঁথা। আমরা শারীরিকভাবে পবিত্র থাকলে আত্মিক প্রশান্তি পাবো। মন থাকবে প্রফুল্ল ও সতেজ।
সুতরাং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পবিত্রতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই আমাদের সব সময় পবিত্র থাকার এবং আমাদের আশপাশের পরিবেশকে পবিত্র রাখার চেষ্টা করা উচিত।
তাহলে এতক্ষণ আমরা পবিত্র থাকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং এর বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে জানলাম।
[সূত্র: এনসিটিবি]