দৈনিক পাঁচ বার সালাত আদায় করার জন্য উত্তম রূপে পাক পবিত্র হতে হয়। উযূ-গোসল করতে হয়। উযূর পূর্বে মিসওয়াক করা সুন্নাত। এতে মুখ পরিষ্কার হয়। উযূ গোসলের মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করতে হয়- এর ফলে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা আসে। শারীরিক পরিচ্ছন্নতার সাথে সাথে মনকেও যাবতীয় কুচিন্তা হতে মুক্ত করতে হয়। এতে মানসিক প্রশান্তি আসে। তাছাড়া সালাত আদায় করতে হলে ওঠা-বসা করতে হয়। এর মাধ্যমে দৈহিক কসরৎ হয়। এতে দেহ সতেজ সবল হয় এবং দেহ মনে প্রফুল্লতা আসে। সালাতের এতসব কর্মকান্ডের কারণে মুসল্লি দৈহিক দিক থেকে ও মানসিক দিক থেকে অনেক রোগ-শোক ও টেনশন থেকে মুক্ত থাকেন। পবিত্র দেহ মন নিয়ে সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার প্রেরণায় উজ্জীবিত হন।
নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে সালাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা হলো-
(১) সালাতের পরিচয়
সালাত শব্দের অর্থ কি: সালাত আরবি শব্দ-এর অর্থ- দু’আ, প্রার্থনা, সান্নিধ্য। যেহেতু নামাযে দুআ ও প্রার্থনা রয়েছে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় ও তাঁর সান্নিধ্য পাওয়া যায়, তাই নামাযকে আরবিতে সালাত বলা হয়।
ইসলামি জীবনব্যবস্থা পাঁচটি মূল স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সালাত পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে দ্বিতীয় স্তম্ভ। ঈমানের পরই এর স্থান। সালাত শ্রেষ্ঠ ইবাদাত। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় সালাতের গুরুত্ব অপরিসীম।
(২) সালাতের ধর্মীয় গুরুত্ব
১। ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ: ইসলাম যে পঞ্চম ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তন্মধ্যে সালাতের স্থান দ্বিতীয়। ইসলামে সালাতের গুরুত্ব এতই বেশি যে, সালাত ব্যতীত ইসলামের কল্পনাই করা যায় না। যে সালাত পরিত্যাগ করে সে যেন ইসলামকেই ধ্বংস করে ফেলে। সালাত ত্যাগ করা কুফরেরই নামান্তর।
সালাত সর্বোত্তম ইবাদাত। সালাত বেহেশতের চাবি। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি সালাতের মাধ্যমেই হয়। সালাতের সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। সালাত মানবসমাজে সাম্য, শৃঙ্খলা সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, নেতৃত্ব নির্বাচন, আনুগত্য ইত্যাদি শিক্ষা দেয়। অতএব ইসলামে সালাতের ধর্মীয় এবং সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম।
২। দাসত্বের প্রকাশ: সালাতে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে আনুগত্য, দাসত্বের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শিত হয়। সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
হাদিসে কুদ্সিতে আছে, আল্লাহ বলেন,
“বান্দা যখন সিজদা করে তখন আমি তার সবচেয়ে নিকটবর্তী হই।”
(আল-হাদিস)
নামাযের মাধ্যমে নামাযী ব্যক্তি জান্নাত লাভ করবে। কেননা নামায হল বেহেশতের চাবি।
মহানবি (স) বলেন,
“নামায বেহেশতের চাবি।”
(আল-হাদিস)
নামাযের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে অত্যধিক স্মরণ করার সুযোগ হয়। যে ব্যক্তি যত অধিক নামায আদায় কওে, সে তত বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে।
৩। মুমিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কারী: ইসলাম ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য করার প্রধান উপায় হচ্ছে সালাত।
মহানবি (স) বলেছেন,
“মুসলিম ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী বস্তু হলো নামায বর্জন করা।”
(আল-হাদিস)
নামায হচ্ছে ঈমানের বাহ্যিক প্রকাশ। যে মুমিন। নামায আদায় না করে কেউ মুমিন হতে পারে না।
মহানবি (স) বলেন,
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামায ছেড়ে দেয় সে কাফির হয়ে যায়।”
(আল-হাদিস)
মহানবি (স) বলেছেন,
“নামায দ্বীনের স্তম্ভ, যে ব্যক্তি নামায প্রতিষ্ঠা করে সে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করল। আর যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করল সে যেন ইসলামকেই ধ্বংস করে ফেলল।”
(আল-হাদিস)
৪। সর্বোত্তম নেক আমল: একটি হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবি (স) -কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, কোন কাজ সর্বোত্তম? উত্তরে তিনি বলেনঃ সময়মত সালাত আদায় করা। সালাত মানুষের দেহ-মনকে সকল প্রকার পাপ-পংকিলতা হতে মুক্ত করে।
মহান আল্লাহ বলেন,
“নিশ্চয় নামায মানুষকে অশ্লীল ও গর্হিত কাজ হতে বিরত রাখে।”
(আল-কুরআন)
নামাযে মানসিক পরিশুদ্ধি ঘটে এবং প্রশান্তি লাভ হয়। কেননা নামাযের জন্য পবিত্রতা অর্জন পূর্বশর্ত। আর নামায আদায় করতে বাহ্যিক পবিত্রতা তথা উযু ও গোসল করে দৈহিক পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। তারপর জায়নামাযে দাঁড়িয়ে মন হতে সকল প্রকার পার্থিব লোভ লালসা, হিংসা-দ্বেষ, ইত্যাদি মানসিক পাপ হতে ও মনকে পবিত্র করে।
মহান আল্লাহ বলেন,
“যে মুমিন নামাযে বিনয়াবনত তাদের জীবন সাফল্যমন্ডিত।”
(সূরা মুমিনুন, আয়াত নং ১-২)
(৩) সালাতের শিক্ষা
সালাত ব্যক্তিগত ইবাদাত হলেও সমাজের ওপর এর বিরাট প্রভাব পড়ে। সালাতের সামাজিক শিক্ষার কিছু দিক তুলে ধরা হলো-
১। ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে: একত্র হয়ে জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামায়াতে পড়ার কারণে মুসল্লিগণ দৈনিক পাঁচবার একত্রে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। একে অপরের সুবিধা-অসুবিধা ও রোগ-শোকের কথা জানতে পারে এবং তা নিরসনের ব্যবস্থা করতে পারে।
২। সাম্য প্রতিষ্ঠা: সালাতে দাঁড়াবার সময় কারো জন্য পূর্ব নির্ধারিত স্থান বরাদ্দ থাকে না। ফলে ধনী-গরিব, বাদশাহ ফকির, চাকর-মনিব, বিদ্বান- মূর্খ, সাদা-কালো নির্বিশেষে সকলেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক কাতারে দাঁড়ায়। এতে শ্রেণী বৈষম্য দূর হয় এবং অনুপম সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা: সালাতের ওয়াক্ত হলে একই সময়ে আযান, একই সময়ে সালাত এবং একই সময়ে ইমামের পেছনে সালাত আদায়ের ফলে শৃঙ্খলা বোধ ও সময়ানুবর্তিতা জন্ম লাভ করে। সামাজিক কোন সমস্যা সবাই মিলে সমাধান করার শিক্ষা পাওয়া যায়। আদর্শ সমাজ গঠনের প্রেরণা জাগ্রত হয়।
৪। নিয়মানুবর্তিতা: সালাত আদায় করতে একই সাথে নিয়ত করা, তাকবীরে তাহরিমা বাঁধা, একই সাথে রুকু সিজদা করা, একই সাথে সালাতের কার্যাবলি ইমামের পেছনে আদায় করতে হয়। এতে নিয়মানুবর্তিতা অনুশীলন করার শিক্ষা পাওয়া যায়।
৫। নেতা নির্বাচন: সালাতে একজন ইমাম নির্বাচন করতে হয়। আল্লাহভীরু ও সর্বজন সমাদৃত ব্যক্তিকেই ইমাম নির্বাচন করতে হয়। এ সময়ে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। জোরপূর্বক কিংবা অযোগ্য লোককে ইমাম নির্বাচন করা যায় না। কাজেই সালাতের মাধ্যমে সমাজে নেতা নিবাচন ও কর্তব্যপরায়ণ হওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায়।
৬। জামাআতবদ্ধ জীবন: সালাত একাকী আদায় করা ঠিক নয়। জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করতে হয়। এতে সমাজের মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে ঐক্য, সংহতি, সংঘবদ্ধ জীবনবোধ এবং জামায়াতী জিন্দেগীর নিয়ম কানুন। ফলে সংঘবদ্ধ জীবন পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া যায় সাপ্তাহিক জুমুআর সালাত ও বছরে দুটি ঈদের সালাত আরোও বৃহত্তর অঙ্গনে ঐক্য গড়ে তোলার প্রেরণা জাগে।
৭। কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা: কুরআনে ইসলামি রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষের মধ্যে সালাত কায়েম করার কথা বলা হয়েছে। একজন মুসলিম ব্যক্তির যেমন প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সালাত কায়েম করা, ঠিক তেমনি গোটা ইসলামি রাষ্ট্রেরও সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সমগ্র রাষ্ট্রে সালাত আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা কার্যকর করা। যে লোক সালাত পড়ে না, সে যেমন দ্বীন ইসলাম পালন করে না, তেমনি যে রাষ্ট্রে বা সরকার সালাত কায়েমের ব্যবস্থা করে না, সেটাও ইসলামি রাষ্ট্র নয়।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা সালাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে একট স্পষ্ট ধারণা অর্জন করলাম।
আর্টিকেলটি যদি ভালো লেগে থাকে, অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন। এ ধরণের ইসলামিক লেখা পেতে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ভিজিট করবেন। জাজাকাল্লাহ খায়রান।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]