ফুলের রাজ্যে অর্কিড এক অনিন্দ সুন্দর ফুল। এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ফুল উৎপাদনোক্ষম উদ্ভিদ জগতে অর্কিড একটি বিশাল পরিবার যার প্রায় ৯০০ গণ এবং ৩০,০০০ এরও অধিক প্রজাতি রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তর প্রজাতির অর্কিড জন্মাতে দেখা যায়। যে কারণে এর আদি বাসস্থানও এক জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। হিমালয়ের পূর্বাংশে ঘাসিয়া পাহাড়, বাংলাদেশের সিলেট জেলার উত্তরে পাহাড়ি অঞ্চল, থাইল্যান্ড, বার্মা, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ফিলিপিনস, মেস্কিকো, দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার উষ্ণ অঞ্চলে অর্কিড পাওয়া যায়।
এই ফুল অর্কিডেসি পরিবারের সদস্য। ফুলদানিতে দীর্ঘকাল সজীব থাকে বলে কাটফ্লাওয়ার হিসেবে এর ব্যবহার সর্বাধিক। এ ছাড়া ছোট অবস্থায় এর গাছও শোভা বৃদ্ধি করে।
(১) অর্কিড ফুলের বৈশিষ্ট্য ও জাত পরিচিতি
ফুলটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আকর্ষণীয় রঙ, বিভিন্ন ধরনের গড়ন, সুগন্ধ, ঔষধি গুণাগুণ, দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল। এই অর্কিড ফুলের গঠন বৈচিত্র্যে বিস্মিত হয়ে প্রাচীন চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস ‘সেরাফুল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টোটল, থিওফ্রাসটাস আদর করে এ ফুলের নাম দিয়েছিলেন অর্কিস। কালক্রমে এ নামটিই বিবর্তিত হয়ে অর্কিড হয়েছে।
চাষ পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে অর্কিড প্রধানত ২ প্রকার। যথা-
- পার্থিব: যেসব অর্কিড অন্যান্য ফুলের মতো মাটিতে জন্মায় এবং সেখান থেকে খাদ্য ও রস সংগ্রহ করে, তাদের পার্থিব অর্কিড বলে। এদের সুতার মতো সরু গুচ্ছ মূল থাকে। যেমন- ফায়াস, সিমবিডিয়াম, লেডি স্লিপার ইতাাদি।
- পরাশ্রয়ী: যেসব অর্কিড অন্য কোন গাছের শাখা বা কাণ্ডের উপর আশ্রিত হয়ে জন্মে তাদের পরাশ্রয়ী অর্কিড বলে। এদের লম্বা, মোটা ও পুরু মূল থাকে, বাতাস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। যেমন ডেনড্রোবিয়াম, ভ্যান্ডা, এরিডিস ইতাাদি।
Growth habit এর ওপর ভিত্তি করে অর্কিড আবার ২ প্রকার। যথা-
- সিমপোডিয়াল: প্রতি বছর Pseudobulb হতে অথবা কাণ্ডের গোড়া হতে শাখা বের হয় এবং শাখার অগ্রভাগ থেকে ফুল উৎপাদিত হয়। যেমন- ফেলেনপসিস, ক্যাটেলিয়া, ডেনড্রোবিয়াম, অনসিডিয়াম, সিমপোডিয়াম উল্লিখিত প্রজাতি।
- মনোপডিয়াল: একটি লম্বা কাণ্ড থাকে যা প্রতি বছর প্রতি ঋতুতে বর্ধনশীল অংশ থেকে পাতা এবং পত্রাক্ষ থেকে ফুল উৎপাদনের মাধ্যমে লম্বায় বাড়তে থাকে। যেমন- ভ্যান্ডা, এরিডিস, রিনকোস্টাইলিস ইত্যাদি।
বারি অর্কিড-১:
বারি অর্কিড-১ স্থানীয় প্রজাতির বৃহদাকার বিরুৎ শ্রেণির অর্কিড। এ প্রজাতি সিলেট ও মধুপুর অঞ্চলে সীমিত আকারে পাওয়া যায়। এ জাতটিকে ২০০৩ সালে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়।
- ফুলের স্টিক এক মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
- এতে ১০ থেকে ১৮টি ফ্লোরেট এবং ফুলের ব্যাস সাধারণত ১০-১৫ সেমি এর বেশি হয়। ফুলটি খুবই সুগন্ধী।
- পাঁপড়িগুলির বাইরের দিক Creamy white এবং ভিতরের দিক Reddish brown golden yellow.
- এ ফুলটি সাধারণত পানিতে ২৫-৩০ দিন পর্যন্ত তাজা থাকে।
(২) অর্কিড ফুল চাষ পদ্ধতি
ক) জলবায়ু ও মাটি
ছায়াযুক্ত সুনিষ্কাশিত কিন্তু স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে চাষ করা যায়। সাধারণত একই জমিতে দীর্ঘদিন এ ফুলের চাষ অব্যাহত রাখা যায়।
প্রখর সূর্যালোকে এ ফুল ভাল হয় না। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের জন্য জমিতে শেডনেট দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হয় যাতে ৪০-৬০% সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে।
টবে চাষের ক্ষেত্রে বড় গাছের নিচে এ ফুলের চাষ করা যেতে পারে এবং জাতটি বহুবর্ষজীবী।
খ) সাকার উৎপাদন ও বংশ বিস্তার
গাছের ফুল শেষে বা ফুল কাটার পর প্রতিটি গাছ থেকে পার্শ্বীয়ভাবে সাকার বের হয়। এই সাকারসমূহ গাছে লাগানো অবস্থায় যখন শিকড় বের হয় তখনই গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মূল জমিতে লাগানো যেতে পারে।
এছাড়া কেটে ফেলা ফ্লাওয়ার স্টিকের ফুল শেষ হয়ে গেলে তা থেকেও চারা উৎপাদন করা যেতে পারে। এজন্য বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়।
গ) জমি তৈরি ও রোপণ পদ্ধতি
বিভাজন প্রক্রিয়ায় গাছ থেকে সাকার সংগ্রহ করে অথবা টিস্যু কালচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চারা তৈরি করে জমিতে লাগাতে হবে।
পচা গোবর/কম্পোস্ট, নারিকেলের ছোবরা, ধানের তুষ ও বেলে দোআঁশ মাটির সমপরিমাণ মিশ্রণের মাধ্যমে বেড তৈরি করতে হবে। সাকার লাগানোর সময় সারি থেকে সারি ৩০-৪০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছে ২৫-৩০ সেমি দূরত্ব রাখতে হবে।
সাকার লাগানোর সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে শিকড়গুলো পুরোপুরি মাটির নিচে থাকে।
ঘ) সার প্রয়োগ
ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সমৃদ্ধ ২০:২০:২০ মিশ্র সার বেশ উপযোগী। সার পানিতে গুলিয়ে সপ্তাহে এক বা দু’দিন গাছে স্প্রে করতে হবে।
স্প্রে করার সময় গাছের পাতা যেন ভালভাবে ভিজে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ঙ) সেচ প্রয়োগ
মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রস থাকতে লাগানোর পর হালকা সেচ দিতে হয় যাতে সাকারগুলো মাটিতে লেগে যায়। পরবর্তী সময়ে আবহাওয়ার অবস্থা বুঝে সেচ দিতে হবে।
এছাড়াও ফুল চাষের জন্য বাতাসের অপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬০% বজায় রাখতে হলে স্প্রিংকলার দিয়ে মাঝে মাঝে Misting করতে হবে। জমিতে দাঁড়ানো পানি এ ফসলের জন্য ক্ষতিকর।
চ) ফুল আসার সময় ও ফলন
ফাল্গুন-চৈত্র মাস (মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য এপ্রিল)।
প্রথম বছর: ৬,০০০ স্টিক/হেক্টর,
দ্বিতীয় বছর: ৮,০০০ স্টিক/হেক্টর,
তৃতীয় বছর: ১০,০০০ স্টিক/হেক্টর।
এ ছাড়া প্রতি বছর গাছ থেকে চারা রেখে ২-৫টি সাকার সংগ্রহ করা সম্ভব।
ছ) ফুল সংগ্রহ
সাকার থেকে গাছ লাগানোর এক বছরের মধ্যেই ফুল আসে। অপরদিকে টিস্যু কালচার থেকে প্রাপ্ত চারা থেকে ফুল পেতে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগে।
বাণিজ্যিক চাষের ক্ষেত্রে ফ্লাওয়ার স্টিকের এক বা দুটি ফুল ফোটার সাথে সাথে কাটতে হবে। বাগানে বা টবে সৌখিন চাষের ক্ষেত্রে ফুল কাটার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে গাছে প্রায় ২৫-৩০ দিন পর্যন্ত ফুল টিকে থাকে।
(৩) অর্কিড চাষে রোগ ও পোকা দমন
এ ফুলটিতে সাধারণত রোগ বা পোকার আক্রমণ কম দেখা যায়। তবে ভাইরাস রোগের ক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ফুলের কুঁড়ির কীড়া দমনের জন্য কোন সিস্টেমিক বালাইনাশক অনুমোদিত প্রয়োগ মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
পাতায় দাগ দেখা দিলে অটোস্টিন ০.১% ১৫ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
(৪) টিস্যুকালচার পদ্ধতির মাধ্যমে ডেনড্রোবিয়াম অর্কিডের বংশবৃদ্ধি
অধিক পরিমাণে চারা উৎপাদনের জন্য টিস্যুকালচার পদ্ধতি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ পদ্ধতিতে মাতৃ গাছের সদৃশ, জীবাণুমুক্ত ও একই বয়সের সমআকৃতির চারা অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা যায়।
ইনভিট্রো কালচারের মাধ্যমে অধিক সংখ্যক Shoot জন্মানোর জন্য ডেনড্রোবিয়ামের কচি কান্ড এক্সপ্লান্ট হিসেবে নিয়ে গঝ মিডিয়ামের সাথে ১.০ মিগ্রা./লিটার TDZ এর মিশ্রণে ভাল ফল দেয়; অপরপক্ষে ১/২ গ্রাম মিডিয়ামের সাথে ১.০ মিগ্রা./লিটার IBA উল্লেখিত Shoot গুলিতে শিকড় গজানো এবং বৃদ্ধির জন্য উপযোগী।
মাটির পটে কোকোডাস্ট মিডিয়াতে অর্কিডের অণুজীব বা চারা ভালভাবে জন্মায়। এতে কৃষক কাঙ্খিত জাতের অধিকসংখ্যক রোগমুক্ত অর্কিড চারা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে।
[সূত্র: বিএআরআই]