আমলকি একটি অবহেলিত কিন্তু মূল্যবান ফল। বাংলাদেশে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও সিলেট এলাকায় আমলকির চাষ বেশি হয়।
আমলকি ভিটামিন ‘সি’ ও ‘ক্যালসিয়াম’ সমৃদ্ধ ফল। এ ফলে যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ আছে অন্য কোন ফলে তা নেই। জনসাধারণের ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি বিবেচনা করে এ ফলের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত।
দেশের প্রতিটি বসতবাড়িতে একটি আমলকি গাছ থাকা আবশ্যক। আমলকি চাষাবাদের মাধ্যমে দৈনন্দিন ভিটামিন ‘সি’ এর চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাই এ ফলের বাণিজ্যিক চাষের গুরুত্ব রয়েছে।
(১) আমলকির পুষ্টিমান ও ঔষধি গুণ
আমলকির ফল টাটকা অবস্থাতেই খাওয়া হয়।
আমলকির রস যকৃত, পেটের পীড়া, হাঁপানি, কাশি, বহুমুত্র, অজীর্ণ ও জ্বর রোগে বিশেষ উপকারী।
পাতার রস আমাশয় প্রতিষেধক ও বল বর্ধক। আমলকি রসের শরবত জন্ডিস, বদহজম ও কাশির জন্য উপকারী। ইউনানী শাস্ত্রে ঔষধ তৈরিতে আমলকির ব্যবহার প্রচলিত আছে।
খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম আমলকিতে রয়েছে (জলীয় অংশ ৯১.৪%), খনিজ ০.৭ গ্রাম, আঁশ ৩.৪ গ্রাম, আমিষ ০.৯ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, শর্করা ৩.৫ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৪ মিলিগ্রাম, লৌহ ১.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘বি-১’ ০.০২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘বি-২’ ০.০৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ ৪৬৩ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি ১৯ কিলো-ক্যালরি।
(২) আমলকির জাত
বারি আমলকি-১:
- উচ্চ ফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী জাত।
- গাছ বড়, খাড়া ও অল্প ঝোপালো।
- পৌষ ও বৈশাখ মাসে গাছে ফুল আসে এবং জ্যৈষ্ঠ ও অগ্রহায়ণ মাসে ফল আহরণ উপযোগী হয়।
- ফল বড় (৩০ গ্রাম), চ্যাপ্টা, ও হালকা সবুজ।
- শাঁস সাদা, মধ্যম রসালো, কচকচে, অল্প কষ্টিভাব সম্বলিত এবং সুস্বাদু (টিএসএস ১২.০)।
- উচ্চ ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ।
- ভক্ষণযোগ্য অংশ ৯২%।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ২৬.৪ টন।
- সমগ্র দেশে চাষোপযোগী।
(৩) আমলকি চাষের পদ্ধতি
ক) মাটি ও জলবায়ু
আমলকি গ্রীষ্ম ও অব-গ্রীষ্ম মন্ডলীয় অঞ্চলের ফল। এর জন্য নাতি দীর্ঘ ঠান্ডা, শুষ্ক তুষারপাতমুক্ত শীতকাল, উচ্চ বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা বিশিষ্ট দীর্ঘ উষ্ণ শীতকাল প্রয়োজন।
আমলকি একটি কষ্ট সহিষ্ণু উদ্ভিদ। জলবায়ু কিছুটা শুষ্ক হলেও গাছের কোন ক্ষতি হয়না।
সুনিষ্কাশিত সব ধরনের মাটিতেই আমলকির চাষ করা যায়। তবে চুন সমৃদ্ধ দোআঁশ মাটিতে আমলকি ভাল হয়।
খ) বংশ বিস্তার
- যৌন ও অযৌন উভয় পদ্ধতিতেই আমলকির বংশ বিস্তার করা যায়।
- বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় মাতৃ গাছের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে না এবং গাছের বৃদ্ধি ধীর গতি সম্পন্ন হয়। এজন্য কলমের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা ভাল। কলমের গাছে দ্রুত ফল ধরে।
- কলম করার জন্য আমলকির বীজ থেকে উৎপাদিত চারা আদি-জোড় এবং উন্নতমানের গাছের শাখা উপ-জোড় হিসেবে ব্যাবহার করা হয়।
- ফেব্রুয়ারি, মে-জুন এবং অক্টোবর মাসে ১৩ থেকে ১৪ মাস বয়সের চারার সাথে এক থেকে দেড় মাস বয়স্ক আমলকির ডাল ফাটল কলম পদ্ধতিতে জোড়া লাগাতে হবে।
- কলম করার পর উপ-জোড়ের শুকিয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য পলিথিন কাগজের ঢাকনা দিতে হবে।
- কলম টিকে গেলে ঢাকনা খুলে দিতে হবে।
- কলমটি নার্সারিতে স্থাপনের পর পানি সেচ, আগাছা দমন, সার প্রয়োগ এবং জোড়স্থানের নিচ থেকে গজানো কুঁশি ভাঙ্গাসহ অন্যান্য পরিচর্যা সঠিকভাবে করতে হবে।
- এভাবে উৎপাদিত রোগমুক্ত ১.০-১.৫ বছর বয়সী কলমের চারাকে রোপণের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
গ) জমি তৈরি
আমলকির জন্য সুনিষ্কাশিত এবং মাঝারী বা উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। বাগান আকারে চাষ করতে হলে নির্বাচিত জমি ভাল করে চাষ ও মই দিয়ে সমতল এবং আগাছামুক্ত করতে হবে।
ঘ) আমলকির চারা/গাছ রোপণের সময়
বর্ষার শুরুতে অর্থাৎ বৈশাখন্ডজ্যৈষ্ঠ মাস গাছ রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে বর্ষার শেষে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন মাসে গাছ লাগানো যায়। অতিরিক্ত বর্ষায় চারা রোপণ না করাই ভাল।
ঙ) গর্ত তৈরি
- রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে ৭ ⨉ ৭ মিটার দূরত্বে ১ ⨉ ১ ⨉ ১ মিটার আকারের গর্ত করতে হবে।
- গর্তের উপরের মাটির সাথে ১০-১৫ কেজি জৈব সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি ও ২০০ গ্রাম জিপসাম সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে তাতে পানি দিতে হবে।
চ) আমলকির গাছ লাগানোর পদ্ধতি
সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা আয়তকার কিংবা ত্রিভুজাকার প্রণালীতে আমলকির চারা লাগানো যেতে পারে। কিন্তু উঁচু নিচু পাহাড়ী এলাকায় কন্টুর রোপণ প্রণালী অবলম্বন করতে হবে। গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে নির্বাচিত চারাটা সোজাভাবে লাগিয়ে তারপর চারদিকে মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে এবং লাগানোর পর পরই বাঁশের খুঁটি, বেড়া ও পানি সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ছ) সার প্রয়োগ
আমলকি গাছে আশানুরূপ গুণগত মানসম্পন্ন ফল পেতে চাইলে নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে।
সারের পরিমাণ:
গাছের বয়স | জৈব সার (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) | জিপসাম (গ্রাম) |
১-২ বছর | ৫-১০ | ২০০ | ১০০ | ৫০ | ৫০ |
৩-৪ বছর | ১০-১৫ | ৩০০-৪৫০ | ২০০-৩০০ | ২০০-৩০০ | ১০০ |
৫-৬ বছর | ১৫-২০ | ৪০০-৭০০ | ৩০০-৫০০ | ৩০০-৫০০ | ২০০ |
৭-১০ বছর | ২০-২৫ | ৮০০-১০০০ | ৫০০-৮০০ | ৫০০-৮০০ | ৪০০ |
১১ বছর বা তদুর্ধ্ব | ৩০-৪০ | ১৫০০ | ১০০০ | ১০০০ | ৫০০ |
সার প্রয়োগের পদ্ধতি:
উল্লিখিত সার সমান দুই ভাগ করে বর্ষার প্রারম্ভে ও শেষে গাছের গোড়া থেকে কিছুটা দূরে যতটুকু জায়গায় দুপুর বেলা ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরে প্রয়োজনে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৪) আমলকি গাছের পরিচর্যা
ক) আগাছা দমন
আমলকি বাগান সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছের তলায় বা চারিদিকে যাতে আগাছা জন্মাতে না পারে সেজন্য বর্ষার শুরুতে এবং শেষে জমিতে চাষ দিতে হবে অথবা কোদাল দ্বারা কুপিয়ে দিতে হবে।
খ) সেচ প্রয়োগ
চারা রোপণের প্রথমদিকে প্রয়োজনমতো সেচ দেয়া দরকার। এছাড়া খরা বা শুকনো মৌসুমে পানি সেচ দেয়া ভালো।
গ) ডাল ছাঁটাইকরণ
চারা বা কলম রোপণের পর গাছকে সুন্দর একটি কাঠামো দেয়ার জন্য গোড়ার দিকের সমস্ত ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে। এছাড়া বর্ষার শেষে গাছের মরা, রোগাক্রান্ত, ভাঙ্গা ও দুর্বল ডাল পালা ছাঁটাই করতে হবে।
ঘ) ফল সংগ্রহ
ডালপালায় ঝাকুনি দিয়ে ফল মাটিতে ফেললে ফল আঘাত প্রাপ্ত হয়ে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তবে গাছের নিচে জাল ধরে শাখায় ঝাকুনি দিয়েও ফল সংগ্রহ করা যায়। সমস্ত ফল একসাথে পরিপক্ক হয় না। তাই ২/১ দিন পরপর ফল সংগ্রহ করতে হয়। সংগ্রহের সাথে সাথেই ফল বাজারজাত করতে হবে, কেননা সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে সংগৃহীত ফলে ভিটামিন ‘সি’ এর পরিমাণ কমতে থাকে।
(৫) আমলকি গাছের রোগ ব্যবস্থাপনা
মরিচা রোগ:
এ রোগের আক্রমণে পাতা ও ফলে মরিচা দাগ পড়ে। এতে গাছের ফলন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং ফলের গুণগতমান বিনষ্ট হয় ও বাজার মূল্য কমে যায়।
প্রতিকার: প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ইন্ডোফিল এম-৪৫ মিশিয়ে স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]