কমলা হল লেবুজাতীয় ফলের মধ্যে সারাবিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত জনপ্রিয় ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ একটি উৎকৃষ্ট ফল।
বর্তমানে বাংলাদেশে কমলার বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে। বৃহত্তর সিলেট, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড় কমলা চাষের জন্য উপযোগী।
এ পাঠ শেষে আপনি- কমলার জাত, বংশবিস্তার সম্পর্কে ধারণা পাবেন; কমলার জলবায়ু ও মাটিতে কমলা ভালো হয় তা জানতে পারবেন; কমলার চাষ পদ্ধতি ও কমলা গাছের পরিচর্যা শিখতে পারবেন।
নিম্নে কমলা চাষ পদ্ধতি সহজ ও সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপনা করা হলো-
(১) কলমার জাত
কমলার অনেক জাত রয়েছে। আমাদের দেশে জনপ্রিয় জাতগুলোর মধ্যে খাসিয়া, বারি কমলা-১, বারি কমলা-২, নাগপুরী উল্লেখযোগ্য।
(২) কমলার চাষের উপযোগী জলবায়ু ও কোন মাটিতে কমলা ভালো হয়?
- কমলা যেসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ভালো হয় সেখানেই ভালো জন্মে।
- কমলা গাছ ৫৫ ফারেনহাইট থেকে ১০০ ফারেনহাইট তাপমাত্রায় জন্মে।
- কোন মাটিতে কমলা ভালো হয়: সুনিষ্কাশিত দোআঁশ, বেলে দোআঁশ, পাহাড়ী মাটি কমলা চাষ করা হয়। বিশেষ করে উর্বর পার্বত্য এলাকায় এর চাষ ভালো হয়।
- কমলা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। বৃষ্টিপাত হলে পোকার আক্রমণ বেড়ে যায় এবং ফলের ক্ষতি হয়।
- অম্লীয় মাটিতে কমলা ভালো হয়।
(৩) কমলার বংশবিস্তার
- কমলা বীজ এবং কলম দুই পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করতে পারে।
- বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করলে মাতৃগাছের গুণাগুন ঠিক থাকে না, ফল আসতে বিলম্ব হয়।
- গুটি কলম, জোড় কলম ও চোখ কলমের মাধ্যমে চারা তৈরি করলে মাতৃগাছের গুণাগুন ঠিক থাকে এবং ফল তাড়াতাড়ি আসে।
(৪) কমলা চাষে জমি তৈরি
- জমি তৈরির আগে আগাছা জঙ্গল পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
- মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত কলমের চারা রোপনের উপযুক্ত সময়। তবে অন্যান্য সময় চারা রোপন করতে চাইলে সেচের ব্যবস্থা করে নিতে হবে।
- কমলার জন্য ৬ মি. x ৬ মি. দুরত্বে রোপন করা ভালো।
- চারা রোপনের ১৫-২০ দিন পূর্বে গর্ত করে নিতে হবে।
(৫) কমলা চাষে সার ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট কর্তৃক বয়সভেদে কমলা গাছে সারের গাছ প্রতি মাত্রা হলো-
গাছের বয়স | জৈব সার (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমপি (গ্রাম) |
১-২ বছর | ১২-১৫ | ২০০ | ১০০ | ১৫০ |
৩-৪ বছর | ১৫-১৮ | ৩০০ | ১৫০ | ২০০ |
৫-১০ বছর | ২০-৩০ | ৫০০ | ৪০০ | ৩০০ |
১০ বছরের বেশি | ৩৫-৫০ | ৬৫০ | ৫০০ | ৫০০ |
(রেফারেন্স: বিএআরআই, ২০১০)
মাটির উর্বরতা ও অবস্থার উপর ভিত্তি করে সারের পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে।
(৬) কমলা গাছের চারা রোপন
- গর্তের ঠিক মাঝখানে এক বছর বয়সের চারা রোপন করতে হবে।
- চারা গাছ ভালোভাবে বসিয়ে দিতে হবে। তবে চারা লাগানো আগে গর্ত প্রতি ১৫-২০ কেজি গোবর সার মাটির সাথে মিশিয়ে ভরাট করে ফেলতে হবে।
- উপরের মাটির সাথে ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমপি সার ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- চারার গোড়ার মাটি উঁচু করে দিয়ে খুটি বেধে দিতে হবে।
- আবার গরু-ছাগল, বন্য পশুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য খাচা দিয়ে বেড়া দিতে হবে।
(৭) কমলা গাছের পরিচর্যা
- গাছের মরা রোগাক্রান্ত ডাল ছেঁটে ফেলতে হবে। গাছে অতিরিক্ত ফল আসলে কিছু ফল ফেলে দেওয়া ভালো।
- বর্ষা আসার পরে ফল আহরণের পর পরই মরা ও রোগাক্রান্ত ডাল পালা ছেঁটে দিতে হবে। এতে ফল বড় এবং বেশি হয়।
- খরা বা শীত মৌসুমে সেচ দিতে হয়। তবে ৩-৫ বার সেচ দেয়া উচিত। বর্ষাকালে পানি না জমে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শীতকালে ১৫-২০ দিন পর পর হালকা সেচ দিতে হবে।
(৮) কমলা গাছের রোগ ও পোকামাকড় দমন
ক) রোগ দমন
- রোগ দমনে লবু জাতীয় ফলের ডাইব্যাক রোগ একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগে গাছের অগ্রভাগের ডাল মারা যেতে থাকে এবং আস্তে আস্তে গাছ মারা যায়। রোগ দেখামাত্র ১০-১৫ দিন পর পর বোর্দোমিশ্রণ স্প্রে করলে এ রোগ দমন হয়।
- ক্যাঙ্কার রোগে পাতা, ফল ঝরে যায়। বোর্দোমিক্সার প্রয়োগে বা আক্রান্ত অংশ কেটে রোগ দমন করা যায়।
- সাইলিড নামক পোকা গ্রীনিং রোগ বহন করে। এ রোগে আক্রান্ত হলে গাছের পাতা হলদে হয়। পাতা পাতলা কোকড়ানো ও ছোট হয়। গাছ মারা যেতে থাকে এবং ফল ধারণ ক্ষমতা থাকে না।
খ) পোকা দমন
- পাতা ছিদ্রকারী পোকা কচি পাতার নিচে আক্রমণ করে ফলে পাতা কুকড়ে যায়। এ পোকা দমনে মেটাসিসটক্স ১০ মি.লি./১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করা হয়।
- কান্ড ছিদ্রকারী পোকা ডাল বা কান্ড খেয়ে শুকিয়ে মারা যায়। রিপকর্ড ১০মি.লি/১০লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- ফলের মাছি পোকার কীড়া ফলের ভিতরে খেয়ে ফল ছিদ্র করে বের হয়ে আসে এবং ফল নষ্ট হয়ে ঝড়ে পড়ে। এ পোকার জন্য অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
(৯) কমলা সংগ্রহ
- কমলা গাছে প্রথমের দিকে ফল কম হয় তবে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ফলন বেড়ে যায় এবং ফল বড় হয়। কমলা নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে পাকা শুরু হয়।
- ফলগুলো পরিপক্ক হলেই সংগ্রহ করা উচিত। কমলা সংগ্রহের কয়েকদিনের মধ্যে হলুদ রং ধারণ করে।
(১০) কমলার ফলন
কমলা হেক্টর প্রতি গড় ফলন ২৫-৩০ মেট্রিক টন। সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা সেচের সুবিধা থাকলে ফলন বাড়ানো সম্ভব।
উপরোক্ত আলোচনাটি ম্ধ্যমে আমরা কমলা চাষ পদ্ধতি, কোন মাটিতে কমলা ভালো হয়, কমলা গাছের পরিচর্যাসহ প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানলাম।
কমলা একটি জনপ্রিয় ফল। কমলা বীজ ও কলম দুটি পদ্ধতিতেই বংশবিস্তার করে। গুটি কলম, জোড় কলম ও চোখ কলমের মাধ্যমে চারার তৈরি করা হয়।
যে জায়গাতে আবহাওয়ার তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে এবং ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে থাকে সেখানে কমলা চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ করার জন্য উপযুক্ত স্থান। তবে বেলে এবং দোঁআশ মাটিতে কমলালেবু চাষ করা ভালো। কমলা পাহাড়ী অঞ্চলে ভালো চাষ হয় কমলা ৬মি. x ৬মি. দূরত্বে রোপণে করা উচিত। আমাদের বাংলাদেশে কমলা চাষ উপযোগী অঞ্চল হলো বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড় জেলা এ ফল চাষ উপযোগী।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]