কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। আকারের দিক থেকে কাঁঠাল সবচেয়ে বড় ফল।
বাংলাদেশের সব জেলাতেই কাঁঠালের চাষ হয় তবে ঢাকার উঁচু অঞ্চল, সাভার, ভালুকা, ভাওয়াল ও মধুপুর গড়, বৃহত্তর সিলেট জেলার পাহাড়ি এলাকা, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি এলাকায় সর্বাধিক পরিমাণে কাঁঠাল উৎপন্ন হয়।
কাঁঠালে প্রচুর শর্করা, আমিষ ও ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে। দামের তুলনায় এত বেশি পুষ্টি উপাদান আর কোন ফলে পাওয়া যায় না। কাঁচা ফল তরকারি, পাকলে ফল হিসেবে এবং বীজ ময়দা ও তরকারি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বীজ ভেজেও খাওয়া যায়।
(১) কাঁঠালের জাত পরিচিতি
বাংলাদেশে যে কাঁঠাল উৎপন্ন হয় শাঁসের বুনট (Flesh texture) অনুযায়ী সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় যেমন- খাজা, আদরসা বা দুরসা ও গালা।
ক) বারি কাঁঠাল-১
‘বারি কাঁঠাল-১’ জাতটি স্থানীয় জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন করে বাংলাদেশে চাষের জন্য ২০০৮ সালে অনুমোদন করা হয়।
- এটি একটি আগাম জাত।
- ফল মধ্য-মে মাসে পরিপক্কতা লাভ করে।
- গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ১০০-১২৫টি।
- এটি নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চ ফলনশীল জাত।
- গাছপ্রতি ফলন ১১৮০ কেজি (১১৮ টন/হেক্টর)।
- মধ্যম আকারের প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৯.৫ কেজি।
- ফল ডিম্বাকার ও খাদ্যোপযোগী অংশ ৫৫%।
- ফলের কোষ হালকা হলুদ বর্ণের, সুগন্ধযুক্ত ও অত্যন্ত রসালো, নরম এবং
দুরসা প্রকৃতির ও মিষ্টি (টিএসএস ২২%)। - জাতটি বাংলাদেশের সর্বত্র চাষোপযোগী।
খ) বারি কাঁঠাল-২
‘বারি কাঁঠাল-২’ জাতটি স্থানীয় জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন করে বাংলাদেশে চাষের জন্য ২০১১ সালে অনুমোদন করা হয়।
- এটি নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চ ফলনশীল অমৌসুমী জাত।
- গাছ খাড়া প্রকৃতির ও মধ্যম ঝোপালো।
- জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়।
- গাছপ্রতি ৫৪-৭৯টি ফল ধরে যার ওজন ৩৮০-৫৭৯ কেজি।
- ফল মাঝারী (৬.৯৫ কেজি) ও দেখতে আকর্ষণীয়।
- ফলের কোষ হালকা হলুদ বর্ণের, সুগন্ধযুক্ত ও মধ্যম রসালো এবং খুব মিষ্টি (টিএসএস ২১%) এবং খাদ্যোপযোগী অংশ ৬০%।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৮-৫৮ টন।
- বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষযোগ্য।
গ) বারি কাঁঠাল-৩
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত জার্মপ্লাজমের মধ্য থেকে বাছাই করে মূল্যায়েনের মাধ্যমে বারোমাসি কাঁঠালের জাত ‘বারি কাঁঠাল-৩’ উদ্ভাবন করা হয় এবং বাংলাদেশে চাষের জন্য ২০১৪ সালে জাত হিসাবে অনুমোদন করা হয়।
- বারি কাঁঠাল-৩ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চ ফলনশীল বারোমাসি জাত।
- সেপ্টেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়।
- গাছ খাড়া প্রকৃতির ও মধ্যম ঝোপালো ও ছড়ানো স্বভাবের।
- গাছ প্রতি ২১৯-২৪৫ টি ফল ধরে যার যার ওজন ১১৮৯-১৩৩২ কেজি।
- ফল মাঝারী আকারের (৫.৪৩ কেজি) এবং আকর্ষণীয় লালচে সবুজ রঙের।
- ফলের শাঁস মাঝারী নরম, হালকা হলুদ, মধ্যম রসালো, খুব মিষ্টি (টিএসএস ২৩.৬ %) এবং সুগন্ধযুক্ত।
- বেটা কেরোটিন সমৃদ্ধ (৩৫.০৬ মিগ্রা/গ্রাম) এবং খাদ্যোপযোগী অংশ ৫২.৫%।
- সারা বাংলাদেশে সব এলাকায় চাষ করা যায়, তবে পাহাড়ী এলাকায় চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
(২) কাঁঠাল চাষ পদ্ধতি
ক) জমি ও মাটি
- কাঁঠাল গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। পানি দাঁড়ায় না এমন উঁচু ও মাঝারী উঁচু সুনিষ্কাশিত ঊর্বর জমি কাঁঠালের জন্য উপযোগী।
- দোআঁশ, বেলে দোআঁশ, এঁটেল ও কাকুরে মাটিতেও এর চাষ করা যায়।
- অম্লীয় মাটিতে কাঁঠাল গাছের বৃদ্ধি ভাল হয়।
খ) বংশ বিস্তার
- সাধারণত কাঁঠালের বীজ থেকেই চারা তৈরি করা হয়। যদিও এতে গাছের মাতৃ বৈশিষ্ট্য হুবহু বজায় থাকে না তথাপি ফলনে বিশেষ তারতম্য দেখা যায় না।
- ভাল পাকা কাঁঠাল থেকে পুষ্ট বড় বীজ বের করে ছাই মাখিয়ে ২/৩ দিন ছায়ায় শুকিয়ে বীজতলায় বপন করলে ২০-২৫ দিনে চারা গজাবে।
- দশ থেকে বার মাসের চারা সতর্কতার সাথে তুলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।
- এছাড়া অঙ্গজ অংশ বিস্তার পদ্ধতি, যেমন- ফাটল কলম (Cleft grafting), চারা কলম (Epicotyle grafting) এবং টিস্যু কালচার পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য।
গ) চারা রোপণের সময়
চারা বা কলম রোপণের সময় মধ্য-জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য শ্রাবণ (জুন-আগস্ট) মাস।
ঘ) চারা রোপণের দূরত্ব
গাছ ও সারির দূরত্ব হবে ৮ × ৮ মিটার। হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা ১০০টি।
চারা কলম রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে ১ ⨉ ১ ⨉ ১ মিটার গর্ত তৈরি করে নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করে গর্তের মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে।
ঙ) গর্তে সারের পরিমাণ
সারের নাম | গর্তপ্রতি সারের পরিমাণ |
গোবর/কম্পোস্ট | ২০-৩০ কেজি |
টিএসপি | ৪০০-৫০০ গ্রাম |
এমওপি | ২৪০-২৬০ গ্রাম |
চ) চারা রোপণ ও পরিচর্যা
গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর নির্বাচিত চারা সোজাভাবে গর্তের মাঝখানে লাগিয়ে চারার চারদিকের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালভাবে বসিয়ে দিতে হবে এবং খুঁটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। প্রয়োজনমতো পানি সেচ ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ছ) ডাল ছাঁটাইকরণ
- ছোট অবস্থায় চারা/কলম লাগানোর পর অপ্রয়োজনীয় ছোট ছোট শাখা প্রশাখা কেটে দিলে কান্ড তৈরিতে সহায়ক হয়।
- বড় গাছের মরা ডাল, ছোট ছোট শাখা প্রশাখা এবং পূর্ববর্তী বছরের ফলের বোঁটার অবশিষ্ট অংশ প্রুনিং করে দিলে ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
- বড় ডাল কাটা গাছের জন্য ক্ষতিকর।
জ) কাঁঠাল গাছে সার প্রয়োগ
চারা রোপণের পর গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। বয়স ভিত্তিতে গাছ প্রতি সারের পরিমাণ নিম্নে দেখানো হলো।
কাঁঠাল গাছের বয়স ভিত্তিক সারের পরিমাণ:
গাছের বয়স | জৈব সার (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) | জিপসাম(গ্রাম) |
১-৩ বছর | ২০ | ৪০০ | ৪০০ | ৩৫০ | ৮০ |
৪-৬ বছর | ২৫ | ৬০০ | ৫৫০ | ৪৫০ | ১০০ |
৭-১০ বছর | ৩০ | ৮০০ | ৭০০ | ৫৫০ | ১৩০ |
১১-১৫ বছর | ৪০ | ১০০০ | ৯০০ | ৬৫০ | ১৬০ |
১৫ বছরের উর্দ্ধে | ৪০-৫০ | ১২০০ | ১৬০০ | ১২৫০ | ৩০০ |
ঝ) প্রয়োগ পদ্ধতি
- চারা রোপণের পর থেকে তিন বছর পর্যন্ত গোবর, টিএসপি, জিপসাম, দস্তা সারকে বছরে একবার ব্যবহার করে এবং মোট ইউরিয়া এবং এমওপি সারকে ছয় ভাগে ভাগ করে দুই মাস পর পর প্রয়োগ করলে গাছের দ্রুত বৃদ্ধি হয়ে থাকে।
- ফলন্ত গাছে তিনবার সার প্রয়োগ করা উচিৎ।
- প্রথম কিস্তিতে গোবর, টিএসপি, জিপসাম, দস্তা ইত্যাদি সার পূর্ণ মাত্রায় এবং ৫০% ইউরিয়া ও এমওপি সার সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাসে।
- দ্বিতীয় কিস্তিতে ২৫% ইউরিয়া ও এমওপি সার ফলধারণের পর মার্চ মাসে।
- তৃতীয় কিস্তিতে ২৫% ইউরিয়া ও এমওপি ফল ধারণের ৬০ দিন পর মে মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
- প্রথম পুরুষ ও স্ত্রী পুষ্প মঞ্জরী দেখা দেয়ার সময় ০.২% হারে বোরন স্প্রে করলে সুষম আকারের মান সম্পন্ন ফল পাওয়া যায়।
ঞ) পানি সেচ ও নিষ্কাশন
- ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে ১৫ দিন অন্তর রূপান্তরিত বেসিন পদ্ধতিতে পানি সেচ দিলে কচি ফল ঝরা কমে, ফলন ও ফলের গুণগতমান বৃদ্ধি পায়।
- কাঁঠাল গাছ জলাবদ্ধতার প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। স্বল্প সময়ের জলাবদ্ধতায় গাছ মারা যায়। এজন্য বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করা আবশ্যক।
ট) ফল ব্যাগিং
গাছে ফল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নিচের দিকে খোলা পলিথিনের ব্যাগ দ্বারা ঢেকে দিলে ফল ছিদ্রকারী পোকা ও নরম পচা রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং ফলের রং ও আকার আকর্ষণীয় হয়।
(৩) কাঁঠাল চাষে রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা
ক) নরম পচা রোগ
রাইজোপাস আর্টোকারপস নামক ছত্রাকের আক্রমণে কাঁঠালের মুচি বা ফল পচা রোগ হয়ে থাকে।
- এ রোগের আক্রমণে কচি ফলের গায়ে বাদামী রঙের দাগের সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত ফল গাছ হতে ঝরে পড়ে।
- গাছের পরিত্যক্ত অংশে এ রোগের জীবাণু বেঁচে থাকে এবং বাতাসের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকার:
- গাছের নিচে ঝরে পড়া পুরুষ ও স্ত্রী পুষ্প মঞ্জুরী সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার ব্যাভিস্টিন/ইন্ডোফিল এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
অথবা, ফলিকুর নামক ছত্রাকনাশক ০.০৫% হারে বা ইন্ডোফিল এম-৪৫/রিডোমিল এম জেড-৭৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে ফুল আসার পর হতে ১৫ দিন অন্তর অন্তর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
গ) গামোসিস
এ রোগের প্রভাবে গাছের বাকলে ফাটল ধরে ও ফাটলের স্থান থেকে অবিরত রস ঝরে। কাঠ বেরিয়ে আসে, ক্ষতস্থানে গর্ত হতে থাকে ও পচন ধরে। চারা গাছ সংবেদনশীল বিধায় ধীরে ধীরে মারা যায়।
প্রতিকার:
- ক্ষতস্থান বাটাল বা ধারালো ছুরি দিয়ে চেছে (স্কুপিং) উক্তস্থানে বর্দোপেস্ট/আলকাতরাঞ্চলেপন করতে হবে।
- প্রথমবার দেয়ার পর পরবর্তী দুমাসে আরো দুবার লেপন করা প্রয়োজন।
ঘ) কান্ড ছিদ্রকারী পোকা
কান্ড ছিদ্রকারী পোকা কাঁঠালের অন্যতম প্রধান শত্রু।
- এ পোকার কীড়া কান্ড ছিদ্র করে গাছের অভ্যন্তরে ঢুকে এবং কান্ডের কেন্দ্র বরাবর খেতে খেতে উপরের দিকে উঠতে থাকে।
- সময়মতো দমন করা না গেলে আক্রান্ত ডাল বা সম্পূর্ণ গাছ মারা যায়।
প্রতিকার:
- ছিদ্রের ভিতর চিকন রড ঢুকিয়ে পোকার কীড়া মেরে ফেলতে হবে।
- চিকন রড দিয়ে ছিদ্র পরিষ্কার করে এর অভ্যন্তরে কেরোসিন, পেট্রোল বা উদ্বায়ী কীটনাশক সিরিঞ্জের মাধ্যমে ঢুকিয়ে কাদা বা মোম দিয়ে ছিদ্রপথ বন্ধ করে দিলে
অভ্যন্তরে ধুয়া সৃষ্টি হয় এবং পোকা মারা যায়।
ঙ) ফল ছিদ্রকারী পোকা
এ পোকা কাঁঠালের আর একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর পোকা।
- এ পোকার কীড়া বাড়ন্ত ফলের গা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে এবং শাঁস খেতে থাকে।
- আক্রান্ত ফল বেঁকে বা ফেটে যায় এবং বৃষ্টির পানি ঢুকে ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়।
প্রতিকার:
- আক্রান্ত পুষ্প মঞ্জরী ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- বাগান সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- বাড়ন্ত ফল নিচের দিকে খোলা পলিথিনের ব্যাগ দ্বারা ঢেকে দিতে হবে।
- ফুল আসার সময় সুমিথিয়ন বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর ২/৩ বার স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]