কামরাঙ্গা শিম বা চারকোনা শিমের জাতটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ও উন্নতমানের আমিষসমৃদ্ধ একটি সবজি। এর পাতা শাক হিসেবে, শিম সবজি, বীজ ডাল এবং কন্দমূল আলুর মত খাওয়া যায়।
এটা বরবটি বা দেশি শিমের মতো লতানো গাছ। ফলের আকৃতি চার পাখা বা শিরা বিশিষ্ট যা দেখতে অনেকটা কামরাঙা ফলের মতো। সম্ভবত এজন্যই কামরাঙা শিম নামে পরিচিত।
এ শিমের আদি স্থান পশ্চিম আফ্রিকা। কারও মতে এ সবজি ভারতে প্রথমে চাষ শুরু হয়। দক্ষিণ ও পূর্ব দক্ষিণ এশিয়ায় কামরাঙা শিম আবাদ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এছাড়া মিয়ানমার, মাদাগাসকার, পাপুয়া নিউগিনি, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বহু আগে থেকেই এ শিমের অস্তিত্ব দেখা গেছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশি উচ্চতা (১৫০০-২৫০০ ফুট) বিশিষ্ট স্থানে এ সবজি আবাদের জন্য বেশি উপযোগী। এ সুবিধার কারণে দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে কামরাঙা শিমের আবাদ প্রচলন বেশি। দেশের উত্তরাঞ্চলেও কোনো কোনো পরিবার সীমিত আকারে এ শিম আবাদ করে।
এ ফসল মূলত বসতবাড়ি ও তদসংলগ্ন এলাকায় পরিবারের চাহিদা মেটাতে সীমিত আকারে আবাদ করা হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অন্যান্য সবজির মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিসমৃদ্ধ এ কামরাঙা শিম আবাদ প্রবণতা বেশি দেখা যায় না।
বাংলাদেশে কামরাঙা শিমের জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ তেমন নেই। তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি কামরাঙা শিম-১ নামে একটা জাত অবমুক্ত করেছে।
দেশি জাতগুলো মূলত আলোকসংবেদনশীল। তাই এ সবজি হেমন্ত, শীত ও বসন্তকালে দিনের আকার ছোট থাকা অবস্থায় চাষ করা হয়।
বিদেশে নানা প্রজাতির এ শিম দেখা যায়। কোনো কোনো বিদেশি জাত বড় দিনেও অর্থাৎ গ্রীষ্ম-বর্ষায় ফুল-ফল ধরে যা বাংলাদেশে আবাদ প্রচলন ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাতে বছর ধরে এ গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিকর সবজি অসময়ে প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে।
(১) কামরাঙ্গা শিমের কিছু বৈশিষ্ট্য
- কচি শিম লম্বায় ১.৫-২ ইঞ্চি হলে তা সংগ্রহ করে সবজি হিসেবে অতি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। সবজি হিসেবে ব্যবহার উপযোগী একেকটা শিমের ওজন প্রায় ৫০-৬০ গ্রাম।
- পরিপক্ব শিম লম্বায় ৫-৭ ইঞ্চি হতে পারে। প্রতিটা শিমে ৫-৭টা বীজ থাকে। পুষ্ট বীজ সংগ্রহ করে তা মটরশুঁটি বা শিম বীজের মতো সবজি হিসেবে মুখরোচক ও উপাদেয়।
- একটা পূর্ণাঙ্গ শিম গাছ প্রায় ১০-১৫ ফুট লম্বা হয়। প্রতি গাছে মৌসুমে ৪০-৫০টা ফল ধরে। দিনের পরিধি অপেক্ষাকৃত ছোট হলে (১০-১১ ঘণ্টা) গাছে ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করে।
- অনুকূল মৌসুমে বীজ রোপণের ৬-৭ সপ্তাহ পর থেকেই গাছে ফুল ধরা আরম্ভ করে। ফুল ও গাছের আকৃতি দেখতে সুন্দর হওয়ার কারণে সৌন্দর্য আহরণেও অনেকেই বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ অংশে চাষ করে থাকে।
- ফুল ফোটার ১০-১২ দিন পর কচি শিম আহার উপযোগী হয়। বয়স্ক শিম শক্ত হলে সবজি হিসেবে খাওয়া যায় না। তবে পুষ্ট শিম থেকে বীজ বের করে মটরশুঁটির মতো বিভিন্নভাবে খাওয়া করা যায়।
- লতানো গাছে ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করলে তা থেকে এক টানা পর্যায়ক্রমে প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত সবজি সংগ্রহ করা যায়।
- এ শিম গাছ খরা সহ্য করতে পারে, কিন্তু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই উচু জমি বা জমিতে ঢিবি করে বীজ বপন করা করতে হয়। বেশি আর্দ্রতা বিশিষ্ট উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এ শিম চাষের জন্য বেশি ভালো। এ সবজি আবাদে পানির প্রয়োজনীয়তা কম হওয়ায় অপেক্ষাকৃত শুকনা এলাকায় কামরাঙা শিম চাষের প্রচলন বেশি।
- ডাল জাতীয় ফসলের মতো জমিতে নাইট্রোজেন যোগ করার ক্ষমতা এ সবজির আছে।
(২) কামরাঙ্গা শিমের জাত পরিচিতি
বারি কামরাঙ্গা শিম-১:
- এটি উচ্চ ফলনশীল (গড়ে ২০.০ টন/হেক্টর) এবং পোকামাকড় প্রতিরোধী।
- এর শিম আকর্ষমীয় গাড় সবুজ রঙের, গড়ে ১৭.৮ সেমি (৭ ইঞ্চি) লম্বা, ২.৬৫ সেমি (১ ইঞ্চি) চওড়া, লম্বা প্রতিটি শিমের গড় ওজন ১৫.২ গ্রাম।
- উদ্ভাবিত জাতটি উচ্চফলনশীল, পোকামাকড় ও রোগবালাই সহনশীল।
- বাংলাদেশের সর্বত্র চাষাবাদের জন্য এ জাতটি উপযোগী।
(৩) কামরাঙ্গা শিম চাষ পদ্ধতি বর্ণনা
ক) মাটি ও আবহাওয়া
- কামরাঙ্গা শিমের গাছের বৃদ্ধির জন্য উষ্ণ ও আদ্র পরিবেশ ভাল।
- ফুল ধারণের জন্য খাট দিবস (১২ ঘণ্টার কম) এবং মধ্যম তাপমাত্রা (১৮০-৩২০ সে.) প্রয়োজন।
- সুনিষ্কাশিত দোআঁশ মাটিতে (পি.এইচ মান ৫.৫-৮.০) এ শিম ভাল জন্মে।
- অন্য ফসলের মতো কামরাঙা শিম চাষের জন্য খুব বেশি উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না। অনুর্বর বেলে বা এঁটেল মাটিতেও এ ফসল ভালো ফলে।
- মার্চ মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বীজ বোনা যায়। তবে শ্রাবণ (মধ্য জুলাই-মধ্য আগস্ট) মাসে
- আবাদে খুব একটা বেশি সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। তবে পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু জমি এ সবজি আবাদের জন্য বেশি ভালো।
- ঠিকমতো আলো-বাতাস পায় এমন স্থানে এ সবজির ফলন ভালো হয়। উন্মুক্ত আধা ছায়াতেও এ সবজি ফলানো যায়। তবে বেশি ছায়ায় ফসল ভালো হয় না।
খ) উৎপাদন মৌসুম
এটি শীতকালীন ফসল।
গ) বপনের সময়
আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বীজ বপন করতে হয়।
ঘ) বীজের হার
৫-৬ কেজি/হেক্টর।
ঙ) বীজ বপন
- বরবটির বা দেশি শিমের মতো সারি করে বীজ বপন করে আবাদ করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি সারির মাটি গভীর করে কুপিয়ে মাদা তৈরি করে নেয়া প্রয়োজন।
- বীজের আবরণ খুব শক্ত হওয়ায় অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কম (৪০-৫০%)। এজন্য বীজ বপনের আগে তা ২০-৩০ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নেয়া উত্তম।
- সাধারণত ৮-১০ ইঞ্চি দূরত্বে ১ ইঞ্চি গভীরতায় বীজ বপন করা হয়। এক সারি হতে অন্য সারির দূরত্ব হবে ৩-৪ ফুট (প্রায় এক মিটার)।
- বীজ বপনের ৫-৭ দিনের মধ্যে তা গজিয়ে দ্রুত বাড়তে থাকে। এ ভাবে ৪-৫ সপ্তাহ বৃদ্ধির পর অনুকূল আবহাওয়ায় দিনের পরিধি কমে (১০-১১ ঘণ্টা) গেলে গাছে ফুল ফোটা আরম্ভ করে।
- কাঁকরোলের মতো কামরাঙা শিমের শিকড় থেকেও চারা তৈরি করা হয়। মৌসুম শেষে অনেকে বয়স্ক গাছের শিকড় সংগ্রহ করে রেখে দেয় পরে শরৎ-হেমন্ত কালে তা পুনরায় বীজের বিকল্প হিসেবে রোপণ করে থাকে।
চ) সারের পরিমাণ
বাড়িতে কামরাঙা শিম চাষ করার জন্য তেমন কোন সারের প্রয়োজন হয় না। তবে বানিজ্যিকভাবে কামরাঙা শিম চাষ করতে হলে অবশ্যই সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম | সারের পরিমাণ/হেক্টর |
গোবর | ৫ টন |
ইউরিয়া | ১০০ কেজি |
টিএসপি | ২০০ কেজি |
এমওপি | ১৫০ কেজি |
অথবা, জমিতে মাদা প্রতি ৪ থেকে ৫ কেজি গোবর সারের প্রয়োগ করতে হবে। এবং জমি চাষের সময় শতকপ্রতি ২০০ থেকে ৪০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমওপি সার জমির মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
সার দেয়ার সময় মাটিতে রস কম থাকলে সেচ দিতে হবে।
চারা গাজানোর প্রায় ৩ সপ্তাহ পর ২০ দিনের ব্যবধানে এতে আরও ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার ২-৩ কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করা ভালো।
ছ) পরবর্তী পরিচর্যা
- বীজ বপনের পর মাটি বেশি শুকনা হলে তা গজাতে বিলম্বিত হতে পারে। তাই মাটিতে রসের অভাব হলে ২-৩ দিনের ব্যবধানে হালকাভাবে সেচ দেয়া ভালো।
- চারা গজিয়ে এক ফুট লম্বা হলে আগা ভেঙে দেয়া প্রয়োজন। তাতে শাখা-প্রশাখার সংখ্যা বাড়বে, ফুল-ফল বেশি দিবে।
- শিম গাছের গোড়ার মাটিতে রসের অভাব হলে মাঝে মাঝে হালকা সেচ দেয়া প্রয়োজন। তবে খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় কোনো ক্রমেই যেন পানি না জমে। এজন্য জমিতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
- জমি সব সময় নিড়ানি দিয়ে আগাছামুক্ত ও মাটিতে চট ধরলে মাটি আগলা করে দেয়া দরকার। এ শিমে পোকা ও রোগের উপদ্রব খুবই কম।
জ) পোকামাকড় ও রোগদমন
- কামরাঙা শিমে তেমন পোকা বা রোগের আক্রমণ হয় না। তবে জাব পোকা ও ফলছিদ্রকারী পোকা মাঝেমধ্যে গাছে আক্রমণ করে।
- এই পোকা দমন করতে হলে শিম গাছের লতার প্যাচ খুলে গাছকে ঝোপালো হতে সাহায্যে করলে এই পোকার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ঝ) ফলন
- ২০-২১ টন/হেক্টর।
- গাছের ফুল ও কচি ফল সবজি হিসেবে নিয়মিত সংগ্রহ করা হলে শিকড়ের আকার বেশি বড় হয়। তাতে মূল বা আলুর ফলন বেশি হয়।
- প্রতি গাছ থেকে প্রায় ৪০-৬০টা (৪-৫ কেজি) কচি সবজি আহরণ করা যায়।
(৪) কামরাঙ্গা শিম চাষের প্রয়োজনীয়তা
কামরাঙা শিম অতি পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সবজি। মানুষসহ সব প্রাণিকুলের জন্য এ শিম অতি উপাদেয় ও পুষ্টিকর।
- কামরাঙা শিমে প্রোটিন অনেক বেশি। বীজে সয়াবিনের মতো প্রোটিন থাকে (৩০-৩৯%)। আরও আছে মিনারেলস, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট।
- কার্বোহাইড্রেট ও সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে ও কোলেস্টেরল থাকে না।
- ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি এতে খুব বেশি।
- শিকড়েও প্রচুর প্রোটিন থাকে। টিউবার বা শিকড়ে প্রোটিনের উপস্থিতি প্রায় ২০%।
- নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এ সবজি বিভিন্ন হারবাল মেডিসিন তৈরির কাজে ব্যবহার প্রচলন বেশি।
- এ সবজির লতা, ফুল, ফল সবই দেখতে সুন্দর হওয়ায় এবং সৌন্দর্য ও ফলন উভয় প্রাপ্তির লক্ষ্যে বাগানোর গুরুত্বপূর্ণ অংশে অনেকে এ সবজি আবাদ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
অন্য ফসলের মতো এ সবজি মাঠ ফসল হিসেবে আবাদ প্রচলন নেই। বাড়ির আঙিনায় শিম, বরবটি, শশা, করলার মতো ১-১.৫ ইঞ্চি লম্বা কাঠির বাউনি বা ছোট আকারের মাচা তৈরি করে তাতে উঠিয়ে আবাদ ব্যবস্থা নেয়া হয়। কাঠি বা কঞ্চি খাঁড়া করে দিয়ে বাউনির ব্যবস্থা করে খুব সহজেই এ সবজি চাষ করা যায়।
সাধারণত পরিবারের চাহিদা মেটাতে এ সবজির আবাদ করার প্রচলন বেশি। পার্বত্য জেলার অধিকাংশ পরিবার এ ধরনের শিম চাষে বেশি আগ্রহী। তারা নিজের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত শিম বিক্রি করে বাড়তি আয় করে থাকে।
কামরাঙ্গা শিম এর পাতা, ফুল, ফল, বীজ, শিকড়, সবই অতি পুষ্টিকর ও আহার উপযোগী এবং ভেষজ ঔষধিগুণসমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এ ফসলের সুফল আহরণ করা প্রত্যেকেরই কর্তব্য। পুষ্টিসমৃদ্ধ এ শিম প্রতিটা বসতবাড়িতে এবং বাড়ির ছাদে আবাদের জন্য অতি উপযোগী। বহুবিদ ব্যবহার উপযোগী মানুষ ও পশুপাখির জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ এ গুরুত্বপূর্ণ সবজি সম্প্রসারণ করার দ্রুত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
[সূত্র: বিএআরআই]