স্বাদ ও পুষ্টিমূল্যের বিচারে কুল বাংলাদেশের একটি উৎকৃষ্ট ফল।
উল্লেখ্য কুল যখন পাকে তখন অন্যান্য অনেক ফলই পাওয়া যায় না। কুল বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য এবং ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ এর একটি ভাল উৎস।
কুল সাধারণত পাকা ও টাটকা অবস্থায় খাওয়া হয়। কুল দিয়ে সুগন্ধি চাটনি, আচার ও অন্যান্য মুখরোচক খাবারও তৈরি করা যায়।
বাংলাদেশের সব জেলাতেই কুলের চাষ হয় তবে রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহে উৎকৃষ্ট জাতের কুল চাষ হয়।
(১) কুলের জাতগুলো কী কী?
ক) বারি কুল-১
‘বারি কুল-১’ নামে জাতটি বাছাই পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয় এবং ২০০৩ সালে অনুমোদিত হয়।
- এটি নারিকেলী কুল জাত নামে পরিচিত।
- দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষত রাজশাহী ও খুলনা এলাকায় চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত জাত।
- ফল আকারে মাঝারী, ওজন ২৩ গ্রাম ও লম্বা।
- কুল খেতে খুব মিষ্টি, কচকচে ও সুস্বাদু।
- ফলের খাদ্যোপযোগী অংশ ৯২% এবং টিএসএস ১২.৮%।
- বীজ ছোট এবং বীজের অগ্রভাগ সুচালো।
- হেক্টরপ্রতি গড় ফলন প্রায় ১০-১৫ টন।
খ) বারি কুল-২
‘বারি কুল-২’ নামে এ জাতটি বাছাই পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ভাবিত একটি উচ্চ ফলনশীল জাত হিসেবে ২০০৩ সালে অনুমোদন লাভ করে।
- উত্তরাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য উত্তম। তবে দেশের অন্যত্র চাষ করা যায়।
- ফল আকারে বেশ বড় ও ডিম্বাকৃতির ((Oval shaped), খেতে সুস্বাদু।
- ফলের খোসা পাতলা, পাকার পর হলুদাভ সবুজ রং ধারণ করে।
- ফলের খাদ্যোপযোগী অংশ ৯১% এবং টিএসএস ১১.৫%।
- বীজের আকার ছোট এবং ডিম্বাকৃতির।
- হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১৮-২০ টন।
গ) বারি কুল-৩
উচ্চ ফলনশীল জাতটি বিদেশ থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘বারি কুল-৩’ নামে নির্বাচন করে ২০০৯ সালে মুক্তায়ন করা হয়।
- এর গাছ খাটো ও ছড়ানো প্রকৃতির।
- ডাল অল্প কাঁটা বিশিষ্ট।
- ফল আহরণের সময় মধ্য-মাঘ।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ২২-২৫ টন।
- ফল বড়, প্রায় গোলাকার ও হলুদাভ সবুজ বর্ণের।
- প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৭৫ গ্রাম, বীজ ছোট। ভক্ষণযোগ্য অংশ ৯৬%।
- শাঁস সাদা, কচকচে, কষ্টিভাব বিহীন, রসালো ও মিষ্টি (টিএসএস ১৪%)।
- জাতটি সমগ্র বাংলাদেশে চাষোপযোগী।
- কুলের উৎপাদন, অমৌসুমে ফলের প্রাপ্যতা বৃদ্ধিতে এবং ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি হ্রাসে জাতটি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে।
ঘ) বারি কুল-৪
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই করে মূল্যায়েনের মাধ্যমে ‘বারি কুল-৪’ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং ২০১৫ সালে জাত হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়।
- উচ্চ ফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী নাবী জাত।
- গাছ মাঝারী, মধ্যম ছড়ানো।
- ভাদ্র মাসে গাছে ফুল আসে এবং ফাল্গুন মাসের শেষার্ধ পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়।
- পাকা ফল দেখতে আকর্ষণীয় হলুদাভ সবুজ বর্ণের ও দু’প্রান্ত ভোঁতা।
- ফল ডিম্বাকৃতি এবং খোসা পাতলা, গড় ওজন ৩৬ গ্রাম খেতে কচকচে, রসালো এবং মিষ্টি (টিএসএস ১৫%) ও সুস্বাদু।
- বীজ ছোট, খাদ্যোপযোগী অংশ ৯৬%।
- গাছ প্রতি ফলন ২০০ থেকে ২২০ কেজি।
ঙ) বারি কুল-৫
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম বাছাই ও মূল্যায়নের মাধ্যমে বারি কুল-৫ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশে চাষের জন্য জাত হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়।
- ‘বারি কুল-৫’ একটি উচ্চ ফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী টক কুলের জাত।
- গাছ মাঝারী, মধ্যম ছড়ানো।
- ভাদ্র মাসে গাছে ফুল আসে এবং ফাল্গুন মাসের শেষার্ধ পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়।
- পাকা ফল দেখতে আকর্ষণীয় হলুদাভ সবুজ বর্ণের ও দু’প্রান্ত ভোঁতা।
- ফল ডিম্বাকৃতি এবং খোসা পাতলা, গড় ওজন ১৬ গ্রাম খেতে কচকচে, রসালো এবং টক-মিষ্টি (টিএসএস ১৮%) স্বাদযুক্ত।
- বীজ ছোট, খাদ্যোপযোগী অংশ ৮৬%।
- টাটকা ফল হিসাবে খাওয়া ছাড়াও শুকিয়ে সংরক্ষণ আার চার তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।
(২) কুল চাষ পদ্ধতি বর্ণনা
ক) জলবায়ু ও মাটি
উষ্ণ ও শুষ্ক জলবায়ু কুল চাষের জন্য সর্বোত্তম। এতে কুলের ফলন ও গুণগতমান দুই-ই ভাল হয়। তবে কুলের পরিবেশ উপযোগিতা ব্যাপক বিধায় আর্দ্র ও ঠান্ডা আবহাওয়ায় সফলভাবে এর চাষ করা সম্ভব।
উঁচু সুনিষ্কাশিত বেলে দোআঁশ অথবা দোআঁশ মাটি কুল চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। তবে সব ধরনের মাটিতেই কুলের চাষ করা যায়।
অন্যান্য প্রধান ফল ও ফসলের জন্য উপযোগী নয় এ ধরনের অনুর্বর জমিতে এমনকি উপকূলীয় লবণাক্ত জমিতেও সন্তোষজনকভাবে কুলের চাষ করা সম্ভব।
খ) বংশ বিস্তার
দু’ভাবে বংশ বিস্তার করা যায়, বীজ থেকে এবং কলম তৈরি করে।
কলমের চারা উত্তম কারণ এতে বংশগত গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।
বীজ থেকে চারা পেতে হলে বীজকে ভিজা গরম বালির ভেতর দেড় থেকে দুই মাস রেখে দিলে চারা তাড়াতাড়ি গজাবে, না হলে ৬-৮ সপ্তাহ সময় লেগে যাবে।
অন্যদিকে, কলমের চারা পেতে হলে নির্বাচিত স্থানে বীজ বপন ও চারা তৈরি করে তার উপর ‘বাডিং’ এর মাধ্যমে কলম করে নেয়াই শ্রেয়।
বলয় (Ring), তালি (Patch) অথবা T-বাডিং যে কোন পদ্ধতিতেই বাডিং করা যায়।
তালি, চোখ কলম অপেক্ষা সহজ।
বাডিং করার জন্য চারার রুটস্টক বয়স ৩ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত হতে পারে।
মধ্য-চৈত্র থেকে বৈশাখ (এপ্রিল-মে) বাডিং করার উপযুক্ত সময়।
এক্ষেত্রে সায়ন (Scion) সংগ্রহের উদ্দেশে নির্বাচিত জাত এবং রুটস্টক উভয়েরই পুরানো ডাল-পালা ফাল্গুন থেকে মধ্য চৈত্র (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) মাসে ছাঁটাই করে দিতে হয়। অতঃপর নতুন শাখাকে বাডিং-এর কাজে লাগাতে হয়।
গ) জমি তৈরি ও চারা রোপণ
- বাগান আকারে গাছ লাগাতে হলে গভীরভাবে চাষ দিয়ে জমি তৈরি করা উচিত। এতে দীর্ঘজীবী আগাছা দমন হবে।
- বাড়ির আশে-পাশে, পুকুর পাড়ে কিংবা রাস্তার ধারে গাছ লাগালে চাষ না দিয়ে সরাসরি গর্ত করে কুলের চারা লাগানো যায়।
- চারা লাগানোর জন্য ৫-৬ মিটার দূরত্বে ১ ⨉ ১ ⨉ ১ মিটির আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে।
- চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে প্রতি গর্তে ২৫ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি এবং ২৫০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত বন্ধ করে রাখতে হবে।
- জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ও ভাদ্র-আশ্বিন মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
- চারা রোপণের পূর্বে গর্তের মাটি কোদাল দিয়ে উলট-পালট করে নিতে হবে।
- রোপণের পর চারাটিকে একটি শক্ত খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে এবং গোড়ায় পানি দিতে হবে।
ঘ) সার প্রয়োগ
সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও অধিক ফলনশীলতার জন্য গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ অপরিহার্য।
সারের মাত্রা নির্ভর করে গাছের বয়স ও মাটির ঊর্বরতার উপর। বিভিন্ন বয়সের গাছে সারের মাত্রা।
এছাড়া, অঞ্চলভিত্তিক যেসব সারের অধিক ঘাটতি রয়েছে সে সব সারও প্রয়োগ করতে হবে।
গাছের বয়স | গাছপ্রতি গোবর (কেজি) | গাছপ্রতি ইউরিয়া (গ্রাম) | গাছপ্রতি টিএসপি (গ্রাম) | গাছপ্রতি এমওপি (গ্রাম) |
১-২ বছর | ১০ | ৩০০ | ২৫০ | ৩-৪ বছর |
৩-৪ বছর | ১৫ | ৫০০ | ৪০০ | ৪০০ |
৫-৬ বছর | ২০ | ৭৫০ | ৭০০ | ৭০০ |
৭-৮ বছর | ২৫ | ১০০০ | ৮৫০ | ৮৫০ |
৯ বা তদুর্ধ্ব | ৩০ | ১২৫০ | ১০০০ | ১০০০ |
- উল্লিখিত সার সমান দুই কিস্তিতে জ্যৈষ্ঠ এবং আশ্বিন মাসে প্রয়োগ করতে হবে। সার মাটির সাথে ভালভাবে মেশাতে হবে এবং প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।
- বাড়ির আঙ্গিনা, পুকুর বা রাস্তার ধারে লাগানো গাছে শাবল দ্বারা গর্ত করে তাতে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- গাছের গোড়া থেকে কতটুকু দূরে এবং কতদূর পর্যন্ত সার প্রয়োগ করা যাবে তা নির্ভর করে গাছের বয়সের উপর।
- সাধারণত পূর্ণ বয়স্ক গাছের গোড়া থেকে ১-১.৫ মিটার দূর থেকে শুরু করে ৩.৫ মিটার পর্যন্ত সার প্রয়োগ করা হয়।
ঙ) পানি সেচ ও পরিচর্যা
শুষ্ক মৌসুমে বিশেষত চারা গাছে এবং বয়স্ক গাছে ফলের বাড়ন্ত অবস্থায় অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে সেচ দিলে ফলন ও ফলের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।
চাষ দিয়ে বা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুল বাগানের আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
চ) ডালপালা ছাঁটাই
- নতুন রোপণকৃত বা কলমকৃত গাছে আদিজোড় হতে উৎপাদিত কুঁশি ভেঙ্গে দিতে হবে।
- গাছটির অবকাঠামো মজবুত করার লক্ষ্যে গোড়া থেকে ১ মিটার উঁচু পর্যন্ত কোন ডালপালা রাখা চলবে না।
- এক থেকে দেড় মিটার উপরে বিভিন্ন দিকে ছড়ানো ৪-৫টি শাখা রাখতে হবে যাতে গাছটির সুন্দর একটি কাঠামো তৈরি হয়।
- কুল গাছে সাধারণত চলতি বছরের নতুন গজানো প্রশাখায় ভাল ফল ধরে। এজন্য প্রতিবছর ফল আহরণের পরপরই ডাল ছাঁটাই আবশ্যক।
- চারা রোপণের বা কুঁড়ি সংযোজনের পর ৩/৪ বছর মধ্যম ছাঁটাই অর্থাৎ শুধুমাত্র প্রশাখা এবং শাখার মাথার দিক থেকে ৫০-৬০ সেমি পরিমাণ ছাঁটাই করতে হবে।
- গাছ কাঙ্খিত আকারে আসার পর এক বছর বয়সী ডাল গোড়ার দিকে ২০-৩০ সেমি পরিমাণ রেখে সম্পূর্ণ ডাল ছেঁটে দিতে হবে।
- এছাড়া মরা, দুর্বল, রোগাক্রান্ত এবং এলোমেলোভাবে বিন্যস্ত ডালও ছেঁটে দিতে হবে।
ছ) ফল সংগ্রহ
- জাত অনুসারে মধ্য-পৌষ থেকে মধ্য-চৈত্র (জানুয়ারি থেকে মার্চ) মাসের মধ্যে ফল পাওয়া যায়।
- সঠিক পরিপক্ক অবস্থায় ফল সংগ্রহ করা খুবই গুরত্বপূর্ণ। অপরিপক্ক ফল আহরণ করা হলে তা কখনই কাঙ্খিত মানসম্পন্ন হবে না।
- অতিরিক্ত পাকা ফল নরম এবং মলিন বর্ণের হয়ে যায়। এতে ফলের সংরক্ষণ গুণ কমে যায় এবং ফল দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
- ফল যখন হালকা হলুদ বা সোনালী বর্ণ ধারণ করবে এবং এর গন্ধ ও স্বাদ কাঙ্খিত অবস্থায় পৌঁছবে তখন কুল সংগ্রহ করতে হবে।
- সংগ্রহকালে যাতে ফলের গায়ে ক্ষত না হয় এবং ফল ফেটে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
- সকাল বা বিকেলের ঠান্ডা আবহাওয়া ফল আহরণের জন্য অধিক উপযোগী।
(৩) কুল গাছের পাউডারী মিলডিউ রোগ দমন
কুলের পাউডারী মিলডিউ একটি মারাত্মক রোগ। এই রোগের আক্রমণে ফলন হ্রাস পায়। আয়ডিয়াম প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
গাছের পাতা, ফুল ও কচি ফল পাউডারী মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত ফুল ও ফল গাছ হতে ঝরে পড়ে।
গাছের পরিত্যক্ত অংশ এবং অন্যান্য পোষক উদ্ভিদে এ রোগের জীবণু বেঁচে থাকে এবং বাতাসের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। উষ্ণ ও ভেজা আবহাওয়ায় বিশেষ করে মেঘাচ্ছন্ন অবস্থায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকার: গাছে ফুল দেখা দেয়ার পর থিওভিট, কুমুলাস ডিএফ নামক ছত্রাক নামক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি মিশিয়ে ১০- ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]